কল্পিত একাত্তর
১৯৭১ সাল। ১৫ ই মে।
আনন্দপুর গ্রাম। বড় ছোট অনেক শহর থেকে দূরে, নিরবে নিভৃতে গড়ে ওঠা এক শান্ত পল্লী। সুন্দর, স্নিগ্ধ এই পল্লীর রূপ মোহিত করতে পারে যে কাউকেই। আমি ঢাকা ছেড়ে পালিয়েছি। দেশে এত মৃত্যু, আগুন আর লাশ দেখতে দেখতেই যেন বিগড়ে গেছি। ওরা সরকারি কোর্য়াটারের বাসায় আমার মা বাবাকেও হত্যা করল। তাদের অপরাধ ছিল বেতার যুদ্ধ নিয়ে গান করা। জীবন বাঁচাতে আজ এই অজো পাড়াতে। অনেক দিন পর আসলাম এখানে। বাবার বন্ধুর বাড়ি। প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক ভদ্র লোক। সন্ধ্যা যেন নামছে নামছে। চারপাশের মানুষ জন কেমন যেন বাঁকা চোখে তাকায় যেন ভৌতিক কোন চেহেরা দেখছে। অবশেষে এক জনকে বললাম অমল আহমেদের বাড়ি যাব। লোকটার মুখ থেকে যেন একটা গাঢ় আধাঁরের ছায়া নেমে গেছে। অনুসরণ করে চলেছি তাকে নিরব ধান ক্ষেতের মাঝ দিয়ে। মাঝে মাঝে ডানা ঝাপটে ওঠে অচেনা নামের কোন এক পাখি, দূরের ঘন জঙ্গল থেকে দু একটা শিয়ালের হাঁকও শোনা যায়। নিরবতা ভাঙ্গে পল্লীর...
অমল আহমেদ, বাবার কলেজের বন্ধু। বার কয়েক উনি গিয়েছিলেন আমাদের বাসায়। আমারো আসা হয়েছে দু এক বার। অসম্ভব ধরণের ভালো মানুষ। বাবার মৃত্যুতে যেন শক্ই খেলেন কিন্তু বিচলিত হন নি একদম। বরং আমাকে দেখে যেন একটু চিন্তিত হয়েই বললেন, "বাবা তুমি এসেছ। জানি না রক্ষা করতে পারব কী না। তবে ভয় পাবে না একদম তোমার অমল চাচা ত এখনো আছে। যাও, ভিতরে যাও।" তারপর অন্তঃ পুরিকায় ডাক পড়ল "হেমা, নিলয় এসেছে দেখে যা "
হেমাদ্রি। ষোড়সী বালিকা। নম্র, ভদ্র, সুশীলা বালিকা। বাবা, ঠিক করছিলেন পরের ফাল্গুনে ওর সাথে আমার বিয়ে দিবেন কিন্তু কিভাবে যে সব উল্টা পাল্টা হয়ে গেল। হেমা, সামনে দাড়িয়ে। জমাট বাঁধা অন্ধকারে তার শুভ্র মুখায়ব বড়ই স্পষ্ট। চোখে হয়ত কাজল ছিল আর দেখতেও মায়াবী। কিন্তু এই অন্ধকারে কারো চোখের কাজল খোঁজা যে বৃথা তা যেন বুঝলাম বহু পরে। ততক্ষণে আদেশ পড়িল "নিলয়, এসেছে ঘরে নিয়ে যাও। রুমটা একটু পরিষ্কার করে দিও। অনেক দিন কেউ থাকে না বড্ড ময়লা হয়ে গেছে।"
অনুসরণ করছি হেমাকে। আমার হেমাকে। নিরব এই পরিবেশে কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল। হেমাই নিরবতা ভাঙ্গল "কেমন আছ?"
" বাবা মাকে হারিয়ে বড্ড ছন্নছাড়া হয়ে গেলাম। তুমি কেমন আছ?"
"এই যেমন থাকা যায় এই যুদ্ধ বিগ্রহে। তোমায় অনুভব করছিলাম প্রচন্ড।"
"এসে গেছি। ভয় নেই আর "
সেদিনকার মত এইটুকুই কথা।
পরদিন সকাল। ঘুম ভাঙ্গল কিছু চাপা স্বরের আওয়াজে।
"না, যাব না এদেশ ছেড়ে।"
"তো আমরা কী মরব নাকি?"
"হু, মরবই তবু যাব না কোথাও"
বারান্দা দিয়ে বির্মষ মুখে কয়েক জনকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম। পাকিস্থানীদের নির্মম অত্যাচার পৌঁছে গেছে এই শান্ত পল্লীতেও। বারান্দার এক কোণে দাড়িয়ে অশ্রুপাত করছে হেমা। গ্রামে মিলিটারিদের ধ্বংসযষ্ণ চলছে। স্কুলের হেড স্যার যদু ভট্রর্চাযের বাড়িতে নাকি খুন হয়েছে সবাই। না, একে খুন বলা ঠিক হবে না একে শহীদ বলাই যুক্তি যুক্ত।
২
ভাঙ্গা প্রাচীর দেয়া বাড়ী। মনে হয় বৃটিশ আমলে তৈরী। চারদিকটা কেমন ভাঙ্গা চুড়া অবস্থা। বাড়ির সামনের খড়ের ঘরগুলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। গরুর ঘর ছিল হয়ত। এখন সব ছাই ভষ্ম ।
দো তলা বাড়ি। ভিতরে অনেক গুলা কামরা। বেশীর ভালই বন্ধ। হয়ত দেশ ছেড়েছিল অনেকে। প্রাণ ভয়ে। কয়েকটা দরজা খোলা। ভিতরে মৃদূ আলো আধারের ঢং।
একটা রুমে ঢুকলাম।
ফ্লোরে ছোপ ছোপ রক্তের বিচিত্র আলপনা। রক্তের দাগের উপর শক্ত বুটের দাগ। একটা, অনেকগুলো।
একটা লাশ।
গুলিতে ছারখার করা।
চেনার উপায় নেই।
ধুতি পড়া। হু, যদু স্যারই।
মানুষ মানুষকে এইভাবে মারতে পারে ! না দেখলে হয়ত ভাবা যেত না। মানুষ কত নির্মম ।
সামনে আরেকটা লাশ। একজন মহিলার। এটাও গুলি করা। উনি হয় যদু স্যারের স্ত্রী। বয়স দেখে ত তাই মনে হচ্ছে।
ভিতরে আরেকটা বসার ঘর। চেয়ার, টেবিল, সোফা উল্টানো। এখানে অন্ধকারটা আরো জমাট। জাপটে ধরার জোগাড় ।
আরেকটা ছোট কামরা।
আরেকটা লাশ। একটা মেয়ের। বয়স তের বা চৌদ্দ হবে। গলায় ওড়না পেছানো। পুরো নগ্ন। মেঝেতে চিত হয় শুয়ানো। যোনির দ্বার বেঁয়ে বয়ে গেছে রক্তের স্রোত মেঝের মাঝ দিয়ে। বাড়ন্ত বুক, উদরে পশুদের নখের ক্ষত চিহ্ন। যেন ছিঁড়ে ফেলেছে। দাঁতের দাগও আছে অনেক জায়গায়। সারা গায়েই পশুদের নিলজ্জ, র্নিমম, নিগৃহ আচরণের দৃশ্য।
হ্যাঁ, পশু । পাকিস্থানী পশু । ধ্বংস করে গেছে সব । মানুষ, স্বপ্ন, জীবন আর ভালবাসা। দেশ...
বেরিয়ে এলাম । চোখে বিন্দু বিন্দু জল । আগুনটাই যেন বেশী । ঘৃণার । ভাবছি, আর পালাব না। ঘৃণার আগুনে পুড়ে যাও বিবেকের শক্তিযুকু নিয়েই যুদ্ধে যাব। মুক্তি যুদ্ধে । দেশ মাতৃকাকে বাঁচাতে ।
[কল্পিত কথা র্বাতা। কয়েকটা মুক্তি যুদ্ধের বই পড়ে ইচ্ছা হল কিছু লেখার তাই লেখলাম। ইতিহাস বিকৃতির অপবাদ দিলে ক্ষমা র্প্রাথী। দেশে ত আবার এই জিনিসটা খুব ভাল করেই চলছে ]
ভালো একটা চেষ্টা। ক্যারি অন। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি তাদেরও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মাঝে মাঝে কিছু লিখা উচিৎ। তা না হলে তো সময়ের কালক্রমে হারিয়ে যাবে।
ধন্যবাদস্ ।
মন্তব্য করুন