শতবর্ষে বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা
"মাস্টারদা সবাইকে ডেকে যার যার দায়িত্ব বুঝিয়ে ছড়িয়ে পড়তে বললেন। আমি সহ আরো জন-দশেকের দায়িত্ব ছিল দামপাড়া পুলিশ লাইনের আশপাশে রাত ১০ টার মধ্যে উপস্থিত থাকা। আমারা যথাসময়ে মিলিটারী পোশাক পরে উপস্থিত হলাম। সঙ্গে ছিল দুখানা শাবল, আলমারি ভাঙার জন্য। কথা ছিল রাত ১০টায় আরেক গ্রুপ পাহাড়ে উঠে প্রহরীদের আটক করবে এবং বন্দে মাতরম' চিত্কার করবে। এই চিত্কারের সঙ্গে সঙ্গে আমরা যারা জঙ্গলের চারদিকে ছিলাম তারাও একযোগে বন্দে মাতরম বলে চিত্কার করে পাহাড়ে পৌছাব। দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করছি। তখনো জানি না আমাদের মিশন কতটুকু সফল হবে। জীবনের প্রথম এ ধরনের একটি অপারেশন করছি। এমন সময় হঠাত্ করে ওপর থেকে বন্দে মাতরম চিত্কার শুনলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমরা যারা জঙ্গলে ছিলাম তারা একযোগে বন্দে মাতরম চিত্কার দিয়ে পাহাড়ের ওপরে উঠে পড়লাম। শত্রুরা আমাদের চিত্কার শুনে ভাবল, আমরা হয়তো সংখ্যায় অনেক। ফলে তারা ভয়ে পালালো। পুলিশ লাইনের ভেতরে ঢুকে শাবল দিয়ে আলমারি ভেঙে রাইফেল, বারুদ নিয়ে নিলাম। আর যা প্রয়োজন হবে না তাতে আগুন লাগিয়ে দিলাম। সে দিন আমারা সবাই যার যার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছিলাম বলেই পুলিশ লাইন আক্রমণ সফল হয়েছিল। আমাদের হাতে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র এসেছিল, যা পরে জালালাবাদ যুদ্ধে কাজে লাগানো হয়।" এক সাক্ষাতকারে ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামের বিখ্যাত অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অভিজ্ঞতা এভাবেই বর্ণনা করছিলেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী।
অকুতোভয় এই বিপ্লবীর আজ শততম জন্মবার্ষিকী। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, প্রণাম, স্যালুট সবকিছু। শুভ জন্মদিন বিপ্লবী। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হউক।
১৯১১ সালের ১০ জানুয়ারী চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালি থানায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। রাঙামাটি বোর্ড স্কুল, করোনেশন উচ্চ বিদ্যালয়, পি.সি সেন সারোয়ারতলি উচ্চ বিদ্যালয়, চিটাগাং কলেজে পড়াশোনার পর যান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বন্দী থাকা অবস্থায় প্রথম শ্রেণীতে আই.এ এবং বি.এ পাশ করেন। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই তাঁর অন্তরে বিপ্লব ছিলো।
বাবা কামিনী কুমার চৌধুরী ছিলেন পেশায় উকিল। অসহযোগ আন্দোলনের অন্যতম কর্মী কামিনী কুমার বিলেতি কাপড় ছেড়ে খদ্দরের কাপড় পরা শুরু করেন, বিনোদ বিহারীকেও তাই পরতে দিতেন। ১১ বছর বয়সের বালক তখন থেকেই দীক্ষা পায় বিপ্লবের।
১৬ বছর বয়সে এক দিন বিপ্লবী রামকৃষ্ণের সঙ্গে বিনোদ বিহারীর পরিচয় হয়। সেখান থেকেই বিপ্লবের শুরু। এর দু-তিন মাসের মধ্যেই তিনি মধুসূদন দত্ত, তারকেশ্বর দস্তিদরের মতো আরো কয়েকজন বিপ্লবী নেতার সান্নিধ্যে আসেন।
বিনোদবিহারী চৌধুরী যখন বিপ্লবী দলে ঢোকেন তখন মাস্টারদা সূর্যসেন জেলে। ১৯৪২ সালে ভারত আইনে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি। ৪৮' সালের শেষের দিকে মাস্টারদা জেল থেকে ছাড় পান। ১৯২৯ সালে প্রথম দেখা হয় মাস্টারদার সঙ্গে। অল্প দিনেই বিনোদবিহারী চৌধুরী মাস্টারদা সূর্যসেনের স্নেহভাজন হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৩০ সালের ঐতিহাসিক অস্ত্রাগার লুন্ঠনে বিনোদবিহারী চৌধুরী তাই হতে পেরেছিলেন সূর্যসেনের অন্যতম তরুণ সহযোগী। বিপ্লবী দলের সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা ১৮ এপ্রিলকে চারটি এ্যাকশন পর্বে ভাগ করেছিলেন। প্রথম দলের দায়িত্ব ছিল ফৌজি অস্ত্রাগার আক্রমণ, দ্বিতীয় দলের ছিল পুলিশ অস্ত্রাগার দখল, তৃতীয় দলের ছিল টেলিগ্রাফ ভবন দখল, চতুর্থ দলের ছিল রেললাইন উত্পা টন। বিনোদবিহারী চৌধুরী ছিলেন পুলিশ অস্ত্রাগার দখল করার গ্রুপে। এই অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অভিজ্ঞতার কথা শুরুতেই বলা হয়েছে।
মাস্টারদার নেতৃত্বে এই বিনোদ বিহারীরাই সবার আগে চট্টগ্রামের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রামে ব্রিটিশ শাসকের সব ঘাঁটির পতনের পর মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রামে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। এক সাক্ষাতকারে তিনি জানান- "১৮ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রামে ব্রিটিশদের মূল ঘাঁটিগুলোর পতন ঘটিয়ে মাস্টারদার নেতৃত্বে শহর আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। নেতা-কর্মীরা দামপাড়া পুলিশ লাইনে সমবেত হয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে এবং মাস্টারদাকে প্রেসিডেন্ট ইন কাউন্সিল, ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চিটাগাং ব্রাঞ্চ বলে ঘোষণা করা হয় এবং রীতিমতো মিলিটারি কায়দায় কুচকাওয়াজ করে মাস্টারদা সূর্যসেনকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তুমুল 'বন্দে মাতরম' ধ্বনি ও আনন্দ-উল্লাসের মধ্যে এ অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়।"
জালালাবাদ যুদ্ধ ছিল বিনোদবিহারী চৌধুরীর প্রথম সম্মুখযুদ্ধ। সেদিন তিনি ব্রিটিশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন অসীম সাহসিকতায়। গলায় গুলিবিদ্ধ হয়েও লড়াই থামাননি। চোখের সামনে দেখেছিলেন ১২ জন সহকর্মীর মৃত্যু। "আমরা দলে ছিলাম ৫৪ জন, পাহাড়ে লুকিয়ে আছি, তিন দিন কারো পেটে ভাত পড়েনি। পাহাড়ি গাছের দু-একটি আম খেয়ে দিন পার করেছি। এ কারণে বিপ্লবীদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। এর মধ্যেই একদিন বিকেলে অম্বিকাদা কীভাবে যেন বড় এক হাঁড়ি খিচুড়ি নিয়ে হাজির হলেন। আমরা তো অবাক। ওইদিন সেই খিচুরি আমাদের কাছে মনে হয়েছিল অমৃত।"
"এর আগে অস্ত্রাগারে আগুন লাগাতে গিয়ে হিমাংশু সেন বলে এক বিপ্লবী অগ্নিদগ্ধ হয়। তাঁকে নিরাপদ স্থানে রাখার জন্য অনন্ত সিংহ ও গনেশ ঘোষ, আনন্দ গুপ্ত ও মাখন ঘোষাল দামপাড়া ত্যাগ করে। এ ঘটনার পর তত্কা লীন চট্টগ্রাম জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সমুদ্র বন্দরের বিদেশী জাহাজ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে সৈন্য নিয়ে আমাদের আক্রমণ করে৷ কিন্তু লোকনাথ বলের নেতৃত্বে একদল বিপ্লবী তার যোগ্য জবাব দিয়েছিল। এদিকে অনন্তদা ও গণেশদা হিমাংশুকে রেখে ফিরে না আসাতে মাস্টারদা অন্যান্যের সঙ্গে পরামর্শ করে দামপাড়া ছেড়ে নিকটবর্তী পাহাড়ে আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ২১ এপ্রিল তারিখেও তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ না হওয়াতে শেষ রাতের দিকে পুনরায় শহর আক্রমণের উদ্দেশ্যে আমরা ফতেয়াবাদ পাহাড় হতে রওনা হই। মাস্টারদা আমাদের ডেকে বললেন, আমরা যেকোন প্রকারেই আমাদের কর্মসূচি পালন করব। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো ভোর রাতে চট্টগ্রাম শহর আক্রমণ করা হবে। বিনোদবিহারী চৌধুরীরা ফতেয়াবাদ পাহাড় থেকে সময়মতো শহরে পৌঁছাতে পারলেন না। ভোরের আলো ফোটার আগেই তাঁদের আশ্রয় নিতে হলো জালালাবাদ পাহাড়ে। ঠিক করা হলো রাতের বেলা এখান থেকেই শহরে ব্রিটিশ সৈন্যদের অন্যান্য ঘাটি আক্রমণ করা হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য বিপ্লবীদের, গরু-বাছুরের খোঁজে আসা রাখালরা মিলিটারি পোশাক পরিহিত বিপ্লবীদের দেখে পুলিশে খবর দেয়। ওই রাখালদের দেখেই সূর্যসেন প্রমাদ গুনেছিলেন৷ তখনই তিনি ধারণা করেন শত্রুর সংগে সংঘর্ষ অনিবার্য। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে তার আশংকা বাস্তব হলো। মাস্টারদা লোকনাথ বরকে আসন্ন যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন।"
"লোকনাথদা যুদ্ধের একটি ছক তৈরি করেছিলেন। আমাদের কয়েকজনের দায়িত্ব ছিল ত্রিশাল আক্রমণের। যাতে শত্রু কোনক্রমে পাহাড়ে উঠে আসতে না পারে সেজন্য আমাদের যুদ্ধকৌশল কী হবে তা বলে দিলেন। বেলা ৪ টা নাগাদ পাহাড় থেকে দেখলাম সৈন্যবোঝাই একটি ট্রেন জালালাবাদ পাহাড়ের পূর্ব দিকে থামল। ডাবল মার্চ করে ব্রিটিশ সৈন্যরা পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে দু'পক্ষের তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। শত্রুরা কিছুতেই পাহাড়ের ওপর উঠতে পারছিল না। তারা আমাদের দিকে বৃষ্টির মতো গুলি করছিল। আর আমাদের তেমন কোনো অস্ত্রও ছিল না। এ ছিল এক অসমান যুদ্ধ। এই যুদ্ধে প্রথম শহীদ হলেন হরিগোপাল বল নামে ১৫ বছরের এক বিপ্লবী। শহীদের রক্তে জালালাবাদ পাহাড় সিক্ত হলো। কিছুক্ষণ পরেই দেখতে পেলাম আরেক বিপ্লবী বিধু গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যাচ্ছে। মারা যাওয়ার আগে বিধু বলল, 'নরেশ আমার বুকেও হাদাইছে একখান গুলি। তোরা প্রতিশোধ নিতে ছাড়বি না।' বিধু ছিল মেডিকেল স্কুলের শেষে বর্ষের ছাত্র, খুব রসিক। মারা যাওয়ার আগেও তার রসিকতা কমেনি। একে একে নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনও শহীদ হলো। হঠাত্ করে একটা গুলি এসে আমার গলার বাঁ দিকে ঢুকে ডান দিকে বেরিয়ে গেল৷ দু হাতে গুলি ছুঁড়ছিলাম। এক সময় অসহ্য যন্ত্রণায় জ্ঞান হারালাম।" ঘন্টাখানেক অচৈতন্য থাকার পর বিনোদবিহারী চৌধুরী দেখলেন শত্রু-সৈন্যরা সব পালিয়ে গেছে। গলার মধ্যে তখন অসহ্য যন্ত্রনা। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে। পরনের লেঙ্গুট খুলে বিপ্লবীরা তার গলায় ব্যান্ডেজ করে দিল। মাস্টারদা সিদ্ধান্ত নিলেন জালালাবাদ পাহাড় ছেড়ে অন্য পাহাড়ের ঘন জঙ্গলে রাতের মতো আশ্রয় নেবেন। পরবর্তীতে কর্মসূচি হবে গেরিলা যুদ্ধ।
"আমার ধীরগতি চলার কারণেই একসময় মাস্টারদার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। তখন লোকনাথদার সাথে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো শহরের আশপাশ থেকে গ্রামের ভেতরে প্রবেশ করব সবাই। প্রায় গ্রামে আমাদের দলের ছেলেরা রয়েছে। সেখানে গোপন আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হবে। লোকদা আমাদের নির্দেশ দিলেন, অপরাহ্ণ পর্যন্ত ধানক্ষেতে লুকিয়ে থাকতে। বিকেল ৪টার দিকে ধানক্ষেত থেকে বের হয়ে আবার হাঁটা ধরলাম। গলায় প্রচন্ড ব্যথা। ক্ষণে ক্ষণে রক্তপাত হচ্ছিল। এক সময় লোকদাকে বললাম-আমি অত্যন্ত দুর্বল বোধ করছি। আমার জন্য আপনাদের পথ চলতে খুব অসুবিধা হচ্ছে। আমাকে রেখে আপনারা চলে যান। লোকদা বললেন, 'এই অবস্থায় তোমাকে কীভাবে ফেলে যাব।' আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম তার ৪ মাইলের মধ্যেই কুমিরা। তখন ছোট কুমিরা গ্রামে আমার খুড়তুত ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি। জেঠাশ্বশুর ছিলেন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। সেখানেই আমি আশ্রয় নিলাম।" খুড়তুত ভাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে বিনোদবিহারী চৌধুরীর চিকিত্সাব চলে দীর্ঘদিন। তাদের আদর-যত্নে তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন এক সময়।
"এরই মধ্যে গান্ধীজির নেতৃত্বে ভারতের সর্বত্রই লবণ আইন ভঙ্গ আন্দোলন শুরু হয়। কুমিরাতেও কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকদের শিবির স্থাপিত হলো। ফলে আশ্রয়স্থল হারাতে হলো। "আন্দোলন দমনের জন্য গ্রামে পুলিশ বাহিনী ক্যাম্প করে। আর এতে শঙ্কিত হয়ে পড়েন আশ্রয়দাতারা। ঠিক করা হলো, এখান থেকে আমাকে সরিয়ে ফেলা হবে। কারণ আমি এখানে ধরা পড়লে বাড়ির সবাইকে বিপ্লবীকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে জেলে পচতে হবে। সমস্যা হলো কীভাবে পালাই। সে সময় আমার বৌদি বাপের বাড়িতে এসেছেন। তাকে পাঠানো হবে চট্টগ্রামের চাকতাই। বৌদির সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করলাম আমিও বউ সাজব। লাল পাড়ের শাড়ি হাতে শাঁখা ও চুড়ি পরে বউ সাজলাম। বিকেল নাগাদ পৌছে গেলাম চাকতাই। পথে দুবার সৌভাগ্যক্রমে পুলিশ বেষ্টনী পার হয়ে চলে এসেছিলাম।"
কিন্তু এভাবে পালিয়ে বেশিদিন থাকতে পারলেন না। তাঁকে জীবিত বা মৃত ধরে দেওয়ার জন্য ৫০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৩৩ সালের জুন মাসে ব্রিটিশ সরকারের হাতে বিনোদবিহারী চৌধুরী গ্রেপ্তার হন। কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে না পারলেও বেঙ্গল ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট এ্যাক্টে চিটাগাং জেল, কলকাতা প্রেসিডেন্সি জেল, দিউলি ডিটেনশান জেল এবং বাহরামপুর জেলে বিনা বিচারে পাঁচ বছর কারারুদ্ধ রাখা হয় তাঁকে। এরপর তিনি ১৯৩৮ সালে মুক্তি পান কিন্তু এটি তার প্রকৃত মুক্তি ছিল না৷ তিনি পরের এক বছর বাড়িতেই বন্দী জীবন কাটান৷ ১৯৩৯ সালে তিনি প্রকৃত মুক্তি লাভ করেন৷ ১৯৪১ সালের মে মাসে গান্ধীজীর ভারত ছাড় আন্দোলনে যোগদানের প্রস্তুতিকালে আবার গ্রেপ্তার হন তিনি এবং চিটাগাং জেল, হিজলি বন্দী শিবির, ঢাকা জেল ও খকশি বন্দী শিবিরে তাঁকে আটক রাখা হয়৷ ছাড়া পান '৪৫ সালের শেষের দিকে।
এরই মধ্যে ১৯৩০ সালে কংগ্রেস চট্টগ্রাম জেলা কমিটি সহ-সম্পাদক, ৪০-৪৬ বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস নির্বাহী কমিটির সদস্য হন। আর এরই মধ্যে ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারী বীর বিপ্লবী সূর্যসেনকে চট্টগ্রাম কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে বৃটিশ শাসক গোষ্ঠী। ৪৬ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম জেলা কমিটি, ১৯৪৭ সালে ৩৭ বছর বয়সে পশ্চিম পাকিস্তান কংগ্রেসের সদস্য হন তিনি।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা। তিনি তখন আইনসভার সদস্য। ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি আইন পরিষদে যাবার আগে মেডিকেল কলেজে গিয়ে দেখে আসেন বরকতের লাশ। সেদিনই এই বর্বরতার বিরুদ্ধে অ্যাসেম্বলিতে কঠোর প্রতিবাদ করেন তিনি।
১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারির মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দলকে বেআইনি ঘোষণা করলে রাজনীতি থেকে অবসর নেন তিনি। কিন্তু বিপ্লব তাঁকে ছাড়েনি। '৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তান সরকার সিকিউরিটি এ্যাক্ট অনুযায়ী বিনোদবিহারী চৌধুরীকে বিনা বিচারে এক বছর কারাগারে আটকে রাখে।
১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম থেকে পালিয়ে ভারতে গিয়ে তরুণ যোদ্ধাদের রিক্রট করে ট্রেনিংয়ে পাঠিয়েছেন বিনোদ বিহারী। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাইফেল হাতে নিতে পারেননি বটে কিন্তু ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছেন৷সংগঠন করেছেন মুক্তিযুদ্ধ।
মাঝে তিনি ১৯৩৯ সালে দৈনিক পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসাবে তাঁর কর্ম জীবন শুরু করেন৷ এরপর ১৯৪০ সালে চট্টগ্রাম কোর্টের একজন আইনজীবী হিসাবে অনুশীলন শুরু করেন৷ কিন্ত অবশেষে তাঁর দীর্ঘ ক্যারিয়ার জীবনে শিক্ষকতাকেই তিনি পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন৷প্রবর্তক বিদ্যাপীঠ, সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ, মাস্টারদা সূর্যসেন স্মৃতির, জালালাবাদ স্মৃতি সমিতিসহ আরো বেশকিছু সংগঠনের সভাপতি হিসাবে দ্বায়িত্ব পালন করছেন এবং নিয়মিত এসব সংগঠনের সভা-সমিতি, মিটিং করছেন। এখনও করে যাচ্ছেন। কিছুদিন আগেও তিনি ওয়াদ্দেদারের স্মৃতিধন্য চট্টগ্রাম নগরীর ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ অপর্ণাচরণ ও কৃষ্ণ কুমারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় রক্ষার জন্য অনশন করলেন। এখনো মাথায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে ব্যান্ডেনা পরে রাস্তায় নামেন। এক সাক্ষাতকারে তিনি জানান- "আমি বিশ্বাস করি এই বয়সেও আমি জাতির উপকারে আসতে পারি৷ হতে পারি জাতির পথ প্রদর্শক৷ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত আমি আমার মূলনীতি সমূহ প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে যাব৷ জাতির জন্য অবিরাম কাজ করব৷ আমি দেখতে পাচ্ছি আমার দেশের জনগন অত্যাচারিত হচ্ছে৷ তাদের উপর অন্যায় চলছে৷ তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি নিগৃহীত লাঞ্চিত জনগনের জন্য আমাকে আবার যুদ্ধ করতে হবে এবং আরো কঠিন সংগ্রাম করতে হবে৷ কেউ আমার পথ রোধ করতে পারবে না৷ কোন অশুভ শক্তি আমাকে থামাতে পারবে না"
১৯৪০ সালে বিনোদ বিহারী চট্টগ্রাম কোর্টের আইনজীবী কিরন দাশের মেয়ে বিভা দাশকে বিয়ে করেন। বিভা দাশ চট্টগ্রামের মানুষের কাছে বেলা চৌধুরী নামেই সমধিক পরিচিত। সম্প্রতি বিভা দাশ পরলোক গমন করেছেন।
২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করেন।
বিপ্লবী বিনোদ বিহারী ক্ষুধা ও দারিদ্রমূক্ত একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন। তার শততম জন্ম দিনে এটাই তার আকাঙ্খা, দেখে যেতে চান স্বপ্নের বাস্তবায়ন। সেই অপেক্ষাতেই আছেন তিনি।
নাম : শ্রী বিনোদবিহারী চৌধুরী
পিতা :স্বর্গীয় কামিনীকুমার চৌধুরী
মাতা : স্বর্গীয়া রামা চৌধুরী
জন্ম : তারিখ ১০ জানুয়ারী (১৯১১)
স্ত্রী : বিভা চৌধুরী (বেলা)
ছেলে : বিবেকান্দ্র চৌধুরী
তথ্য কৃতজ্ঞতা: হিমেল চৌধুরী
বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী কে জন্ম শতবার্ষিকীর অভিনন্দন
ধন্যবাদ শাতিল
বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী কে জন্ম শতবার্ষিকীর অভিনন্দন
ধন্যবাদ টুটুল
শতবর্ষে বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীর প্রতি বিণম্র শ্রদ্ধা
ধন্যবাদ জয়িতা
সম্ভবতঃ আমাদের সময়ের সর্বশেষ নিখাদ আইডলের অন্যতম অথবা একমাত্র নিদর্শন। এই মানুষটি এখনও এই বয়সেও যে কোন অন্যায়-অসঙ্গতির প্রতিবাদে সক্রিয় থাকেন, মিছিলেও নামেন, না দেখলে বিশ্বাস হবার নয়। কীরকম পরিমিত আর নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করেন, আগে বলতেন "আমাকে বেলার চেয়ে বেশী বাঁচতে হবে, আমি চলে গেলে ওকে দেখবে কে?" সত্যিই, বেলাদিই আগে চলে গেলেন!
শুধু রাজধানীবাসী ছিলেন না বলে তাঁর পরিচিতিটা এখনকার প্রজন্মের কাছে সেভাবে সর্বব্যাপী হয়নি। লোকেনদা খুব ভালো কাজ করলেন ব্লগপোস্টটা লিখে।
আপনার মন্তব্যটা পড়ে খুব ভালো লাগলো
''নিখাদ আইডল'',চমৎকার বলেছেন।
শ্রী বিনোদবিহারী যত বড় মাপের মানুষ আমাদের প্রজন্ম তাঁর মর্ম কতটুকুই বা উপলব্ধি করতে পেরেছে?
শতবর্ষে বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীর প্রতি বিণম্র শ্রদ্ধা
লোকেনদা খুব ভালো কাজ করলেন ব্লগপোস্টটা লিখে।
ধন্যবাদ
জন্ম শতবর্ষে বিপ্লবীর প্রতি শ্রদ্ধা। শুভ জন্মদিন।
লোকেন বোস, খুব ভালো একটা কাজ করলেন। তথ্যবহুল পোস্ট। অনেক কিছু জানা ছিলো না। ধন্যবাদ
আপনাকেও ধন্যবাদ নজরুল
লোকেনদা, শিরোনামে বিণম্র বানানটা ঠিক করে বিনম্র করে দিন, প্লিজ।
ধন্যবাদ নুশেরা। বানানটা ঠিক করে দিলাম।
আপনার এই উদ্যোগটা ভালো লেগেছে। আমার অনেক ভুল হয়, যদি চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দেন, খুব উপকারে আসবে।
আবারো ধন্যবাদ
আমার শ্রদ্ধা রইলো ও জন্ম শতবার্ষিকীর অভিনন্দন।
শতবর্ষে বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীর প্রতি বিণম্র শ্রদ্ধা
মন্তব্য করুন