বিজয়ের মাসে ভালো লাগার বিলাস
ডিসেম্বর মাসটা এলেই আমার খুব খুশি খুশি লাগে। এই খুশি লাগাটা খুব ছোট বেলা থেকেই।ডিসেম্বর মাস এলে শুধু আমার না আমার মনে হয় এদেশের প্রতিটা মানুষেরই খুব খুশি খুশি লাগে। কারণ বিজয়ের এই মাসে খুশি না লাগলে আর কখন খুশি লাগবে।
তবে বিজয়ের এই খুশির পাশাপাশি আমার আরো কিছু ছোট ছোট কারণেও বেশ খুশি খুশি লাগে।
ভালো লাগার প্রথম কারণঃ
গান ভালো লাগে না এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর।আর সে গান যদি হয় মুক্তিযুদ্ধের গান , দেশাত্মবোধক গান তাহলে তো আর কথাই নেই।যখন ছোট ছিলাম তখন ডিসেম্বর মাসের এক তারিখ থেকে দিন রাত সারাক্ষণই চারপাশে দেশের গানই শোনা যেত। মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি,সব কটা জানালা খুলে দাও না, সালাম সালাম হাজার সালাম সকল শহীদ স্মরণে ,তীর ভাঙ্গা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিব রে, সেই রেললাইনের ধারে মেঠো পথটার পাড়ে দাঁড়িয়ে, আমায় গেঁথে দাওনা মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা, এই পৃথিবীর পরে কত ফুল ফোটে আর ঝরে,এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা আমরা তোমাদের ভুলব না, এক নদী রক্ত পেরিয়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা তোমাদের ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না , এরকম আরো অসংখ্য গান চলত পুরো ডিসেম্বর মাস জুড়ে। দেশাত্মবোধক এই অসাধারণ গান গুলো শুনলে সারা শরীরে কেমন একটা আলোড়ন জেগে উঠত। কেমন যেন মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়তাম।
এখন আর ডিসেম্বর মাস এলে এই গানগুলো খুব একটা শুনতে পাই না ।
ভালো লাগার দিত্বীয় কারণঃ
ডিসেম্বর মাসের প্রথম দশ দিনের মধ্যেই স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে যেত। পড়ালেখার খুব একটা ঝামেলা থাকতো না ।নিজেকে খুব স্বাধীন স্বাধীন লাগত। পড়ালেখা নিয়ে কোনো চাপাচাপি করত না কেউ, খেলার সময় খেলা আর পড়ার সময় পড়া এরকম কোনো বিধি নিষেধ থাকত না। আমাদের বাড়িওয়ালাদের বাসায় ভিসিপি ছিল। প্রায় দিন তারা ভিসিপিতে ছবি দেখত। আমিও তাদের সাথে মুগ্ধ হয়ে দেখতাম বাংলাদেশের দারুণ দারুণ ছবি। ক্ষতিপূরণ, চাঁদনী,গরীবের বউ, অবুঝ মন, কেয়ামত থেকে কেয়ামত, অন্তরে অন্তরে, মরনের পরে............এরকম আরো অনেক ছবি।ওরা অবশ্য হিন্দি ছবিও দেখত।মিঠুন চক্রবর্তীর ছবি বেশি দেখত।আমিও দেখতাম মাঝে মাঝে।ভাষা বুঝতাম না বলে খুব একটা আরাম পেতাম না।
এছাড়া টিভিতে ডিসেম্বর মাসে মুক্তিযুদ্ধের ছবি দেখাত।মুক্তিযুদ্ধের অসাধারণ কয়েকটি ছবির মধ্যে ছিল,জীবন থেকে নেয়া, আলোর মিছিল, অরুনদোয়ের অগ্নিসাক্ষী, কলমিলতা,ওরা ১১জন সহ আরো কয়েকটা ছবি।এরপর ১৯৯৪ সালে যোগ হলো হুমায়ূন আহমেদের আগুনের পরশমণি। এতবার দেখেছি যে এই ছবিগুলো,এখনো মুখস্থ হয়ে আছে। যতবারই এই ছবিগুলো দেখতাম ভয়ে গা শিউরে উঠত। কী ভয়াবহ সময় ছিল ৭১!সর্বশেষ দেখেছি নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর “গেরিলা”। অসাধারণ এই ছবিটায় মানুষ জবাই করার ঐ ভয়ংকর দৃশ্যটা দেখে শিউরে উঠেছিলাম।বর্বরতার কী বিভৎস চিত্র!জয়যাত্রা,শ্যামল ছায়া, আমার বন্ধু রাশেদ ও দেখেছি অনেক দিন হয়েছে।
এখন আর ছবি দেখার সময় হয়ে উঠে না।
ভালো লাগার তৃতীয় কারণঃ
আমরা যে বাসায় থাকতাম সে বাসার সামনেই ছিল বাড়িওয়ালাদের ছোট একটা খালি জায়গা। আমাদের জন্য অবশ্য সেই খালি জায়গাই ছিল মাঠ।প্রতি বছর ডিসেম্বর মাস এলে বাড়িওয়ালার ছেলেরা, ভাতিজারা সেই খোলা জায়গাটাতে ব্যাডমিন্টন খেলার আয়োজন করত।কোর্ট বানাত,নেট লাগাত।আর শীতের রাতের একটা বড় সময় ধরে সপাৎ সপাৎ করে র্যারকেট চালাত।আমাদের জানালা দিয়ে মাঠের খেলার দৃশ্য স্পষ্ট দেখা যেত।আমি জানালার গ্রিল ধরে মুগ্ধ হয়ে তাদের খেলা দেখতাম। ব্যাডমিন্টন খেলাটা আমার খুব ভালো লাগত।
আমাদের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হবার পর আমরা ছোটরা বিকাল বেলায় সেই মাঠে ব্যাডমিন্টন খেলতাম। আব্বাকে নিয়ে স্টেডিয়ামের পাশের স্পোর্টস শপ থেকে একবার গিয়ে দুইটা র্যাতকেট কিনে এনেছিলাম।
এখনো হয়তো শীতের সময়ে ঠিকই ব্যাডমিন্টন খেলা হয়। আমারই হয়তো দেখা হয় না ।
ভালো লাগার চতুর্থ কারণঃ
ডিসেম্বর মাসে আউটডোর স্টেডিয়ামে বিজয় মেলা হতো।১৬ ডিসেম্বর এ আমরা ভাই-বোনরা আব্বার সাথে বিজয় মেলায় যেতাম।অনেক সময় ১৬ডিসেম্বরের আগেও দু’একবার বিজয় মেলায় গিয়েছি।কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর বিজয় মেলায় যাওয়া ছিল অবধারিত। রিকশা করে বিজয় মেলায় যাওয়ার সময় দেখতাম রাস্তায় রাস্তায় দড়ি টানিয়ে ছোট ছোট জাতীয় পতাকা দিয়ে পুরো এলাকা সাজানো হয়েছে।রিকশা গুলোর বেল এর পাশে একটা করে জাতীয় পতাকা লাগানো।আবার এলাকার অনেক উঠতি বয়সী ছেলেরা রিকশা থামিয়ে সবার শার্ট কিংবা পাঞ্জাবীতে ছোট ছোট সাইজের জাতীয় পতাকা লাগিয়ে দিচ্ছে।আর আশে পাশের সব জায়গা থেকে কানে ভেসে আসত মুক্তিযুদ্ধের সাড়া জাগানো সব গান।চারপাশ জুড়ে একটা উৎসব উৎসব ভাব।মনে হতো এই দিনটা যেন ঈদের মতো।কারো মনে কোনো দুঃখ নেই,কষ্ট নেই।সবাই যেন সুখী মানুষ।
বিজয় মেলায়ও ছিল সেই উৎসবের ভাব।আমরা মেলায় গিয়েই খূঁজে বের করতাম বইয়ের দোকান।কিনতাম বন্দে আলী মিয়ার ছড়ার বই, ছোটদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প , রাক্ষস ক্ষোক্কস আর ভূতের গল্প,গোপাল ভাঁড়, বীর বল আর নাসির উদ্দীন হোজ্জার হাসির গল্প। আর কিনতাম সাবু এবং চাচ চৌধুরীর কমিকসের বই।
বেশ ক’বছর হলো বিজয় মেলায় আর যাওয়া হয় না। এখন নাকি বিজয় মেলা দলীয় সম্পত্তির মতো হয়ে গেছে। আর তাই বিজয় মেলাও নাকি বিভিন্ন দলে বিভক্ত। কী বিচিত্র সব কথা!
এ বছর অবশ্য কন্যাকে নিয়ে প্রথম বারের মতো আউটডোর স্টেডিয়ামের বিজয় মেলায় এক পলক ঘুরে এসেছি।বিজয় মেলায় সবই আছে। শুধু বিজয় উৎসবের সেই আমেজটা খূঁজে পাই নি কোথাও।
ভালো লাগার পঞ্চম কারণঃ
বিজয় দিবস উপলক্ষে টেলিভিশনে জাতীয় প্যারেড ময়দান থেকে সরাসরি কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান দেখাত। আর এ উপলক্ষে ১৬ ডিসেম্বর সকাল থেকে টিভি খোলা থাকত।ঢাকার প্রায় সব নামকরা স্কুলের শিক্ষার্থীরা জাতীয় এই কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে যোগ দিত।কি ছন্দময় এক আয়োজন!এই প্যারেড অনুষ্ঠানটা আমার এত ভালো লাগত! সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু বদলে গেছে। অনেক ভালো লাগারও বেশ হেরফের হয়ে গেছে। কিন্তু এত বছরেও কেন জানি বিজয় দিবসের এই কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের আবেদন এত টুকু ম্লান হয় নি । এখনো বিজয়ের দিবসের দিন আমি সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বিটিভির দিকে তাকিয়ে থাকি এই কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান দেখার জন্য।
ভালো লাগাটা এখনো ঠিক আগের মতোই প্রানবন্ত।
অনেক কিছুই মিলে যাওয়ায় লেখাটা ভালো লাগলো অনেক।
মন্তব্য করুন