ইউজার লগইন

পড়া-পর : বিমল কর-এর 'দেওয়াল'

['বইপড়ুয়া' নামে একটা গ্রুপ আছে 'ফেসবুক'-এ। সে এক আজব জায়গা। হাজার পেরিয়ে তার সদস্য। একেকজন একেকরকম, তবে একটা জায়গায় ভারি মিল, তাঁরা হয় বই নিয়ে বলতে ভালবাসেন নয় শুনতে ভালবাসেন। আবার ওরাই লেখেন, বই নিয়ে। কেমন লাগল, কেন কেমন লাগল- এই সব! অনেক অনেক শুনতে শুনতে আর পড়তে পড়তে কেমন উশুখুশ লাগতে থাকে- তখন মাঝে মাঝে কিছু বলা হয়েই যায়! সে কথাগুলো এখানেও থাকে যদি, মন্দ হয় না বোধ হয়!

এ লেখাটা 'বিমল কর'-এর 'দেওয়াল' নিয়ে।]

স্কুলে বা কলেজে পড়ি তখন, পড়ছি পড়ছি (পাঠ্য বই ছাড়া আর কি!)- হঠাৎ কী হত, ঘড়ির দিকে কড়া নজরে তাকাতাম, ক'মিনিট হল আর কট্টুক পড়লাম তা দেখার সাধ! অংকে কাঁচা তাতে কী, ঐকিক নিয়মে বের করে ফেলা যেত ঘন্টায় গতিবেগ কত! ৫০ পৃষ্ঠা, ৬০না পৃষ্ঠা না পুরো সেঞ্চুরি?!

সে দিন ও গেছে, ঘড়ি দেখাও! ব্লগ পড়ে পড়ে কী অভ্যাস হয়েছে, আধপাতা পড়েই মনে হয় অনেক হল! বই পড়া! সময় কোথায় অত?!

হঠাৎ সময় মিলল। মোটা বই হাতে তুলতে ভয়, লেখকের নামেও অস্বস্তি, তবু দুঃসাহস করা গেল!

ফটিক দে লেন-এর বাসু, গৌরাঙ্গ, পঞ্চার চোখের সামনে দিয়েই সুধার সাথে হেঁটে এগারোর একের পুরানো বাড়িটায় ঢুকে পড়লাম যখন আর রত্নময়ীর দেখা পাওয়া গেল বাড়ির দোতলায়, নীচতলার পারুল বৌদি আর আনন্দবাবুর সাথে পরিচয় হয়ে গেল, এমনকি আক্রার বাজারে সুধার মা-কে না জানিয়ে অমলাদির হাত ধরে পাড়ার মেয়েদের স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে আরো বড় চাকরির বাজারে ঢুকে পড়ার গল্পটা জানা হয়ে গেল পাশে অনলাইন জগতের প্রবল হাতছানি নিয়ে ডাকতে থাকা চিৎপাত হয়ে পড়ে থাকা মুঠোফোনে আরো একবার সময়টা আর দুনিয়াটা এক ঝলক দেখে নেয়ার ইচ্ছা না হতেই, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল- পাঠক ধুঁকে ধুঁকে হলেও বেঁচে আছে।

পাঠকটির ততক্ষণে সুধার পাশটি ধরে কখনো নতুন আপিশে যাওয়া হয়েছে, বিস্ময়াভিভূত চোখে এ জগতটা দেখা শুরু হয়েছে, আপিশে সুচারুবাবুর সাথে অল্প আলাপ হচ্ছে আর সন্ধ্যে হতেই হেঁটে বাড়ি ফিরে সংসারের হিসেব মেলানো দেখা হয়ে যাচ্ছে। রত্নময়ীর চোখে শ্রাবণ মাসের বাদলাধরা দিনে মোহিতঠাকুরপোর পরামর্শে গ্রাম ছেড়ে আসা পন্ডিত চন্দ্রবাবুর পরিবারটির সাথে দেখা হয়ে যাচ্ছে। রত্নময়ীর চোখের জলে দেখা হয়ে যাচ্ছে একুশ দিনের টাইফয়েডে ছোট্ট আরতি, তার তিন চার বছরের বড় বাসু আর তাদের চাইতে একটু আঠারো উনিশের সুধাকে অনিশ্চিত জীবন যাপনের জন্য ঠেলে রত্নময়ীর হাতে ভার দিয়ে চন্দ্রবাবুর ফটোগ্রাফ হয়ে যাওয়া।

এরপর কেবল যুদ্ধ আর যুদ্ধ। সুধার তিরিশ টাকায় চেপে তিন বেলা পেটের ভাত পরনের কাপড় জীবনের গড়ন বদলানোর চেষ্টা আর মা-দিদির চোখের সামনে আড়াল হতে হতে বাসার বাসুটির পাড়ার বাসু হয়ে ওঠার ছবি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কড়া সবে বেজেছে, প্রকোপ এসে পড়ছে কলকাতায়, নিয়ত বদলে যাচ্ছে আশেপাশের জগতটা। কেউ কিছু করে নেয়ার তালে আছে আর কেউ কেবল বেঁচে থাকার আর কেউ পালানোর। সময় আর টানাপোড়েন। কেবল সাদাকালো ছবি।

চাওয়া আর পাওয়ার 'অনিশ্চিত হিসাব' সুধার আর সুধাদের চাহিদা বাড়িয়েই চলে, একটু খানি আয় বাড়ানোর চেষ্টা সুধার জীবনটাকে কেবল বেঁচে থাকা আর আরো একটা দিন কাটিয়ে দিতে পারাই মুখ্য করে দেয়।

নিত্যদিনের হতদরিদ্র জীবনে বাড়িভাড়ার তাকাদা আসে, ছেঁড়া শাড়ি জামা মলিনতর হয়, আরতিটা চোখের সামনে ফ্রক পরা থেকে শাড়ি পড়ার বয়সে আসে- নীচতলার আনন্দবাবুদের বদলে বাড়িওলার চিঠি হাতে আরেক শ্রাবণদিনে গিরিজাবাবু তার ভাইপো নিখিল আর ভাইঝি উমাকে নিয়ে আসেন পরিচয়ের গন্ডি বাড়াতে।

মিহিরবাবুরা আসেন, হাসিখুশী ডাক্তার দেবব্রত আসেন, বিনয়বাবু আসেন, চন্দ্রবাবু আসেন।

সুধাদের গল্পটা তেমনি থাকে কিন্তু।

কেবল বাসুর চোখে পড়ে না। বাসু রাতে ফেরে বাসু দুবেলা খেয়ে যায় পারা বেড়ায় রকে বসে মীনুদিকে ভেবে পাগলপারা হয়। দিদির চাকরি করাটা তার চোখে লাগে, মায়ের কাছে এক আনা দুই আনা চেয়ে না পেলে তার খিটিমিটি করার দরকার হয়, দিদি টাকা জোগাড় করে আনছে বলে বায়নাক্কা দেখাচ্ছে- সে কথা বারে বারে মনে না করিয়ে দিতে ছাড়ে না! পন্ডিত চন্দ্রকান্তের ছেলে হয়ে পাড়ার সোসাইটি গার্ড হলে সেটা অন্যায় কেন হয় তা না বুঝে মা-দিদির সাথে চোটপাট করে যায়।

এমনি করেই যুদ্ধ চলতেই থাকে, চড়তেই থাকে। কলকাতায় মানুষ আসে, কলকাতা থেকে মানুষ পালায়। গিরিজাবাবুর চোখে যুদ্ধ এক রূপ নিয়ে আসে, সুচারু আর নিখিলের চোখে আরেকরকম।

সুধারা কেবল বেঁচে থাকে। আশা ছাড়া। উদ্দীপনা ছাড়া। কেবল আরো একটা দিন পার করবে বলে, সব দায় শুধোবে বলে।

বিমল করে'র দেওয়াল পড়া হয়ে গেল। তিনটা পর্বে- ছোট পাখি, ছোট মন, খোলা জানালা। লেখকের সাত বছরের সাধনা পাঠকের চেখে দেখতে সাত দিন ও লাগেনি, তবে সত্যি করে দেখতে হয়ত ঠিকই লেগে যাবে।

তবে আর আর সবকিছুকে ভুলে এই পাঠকটির মনে থাকবে ছোট্ট আরতি আর খামে পুরে আসা এক সাগর কষ্টটুকুর জন্য-

এইটুকুনি, একটা ছোট মানুষ,
তার যদি হয় একলা হওয়ার দায়,

সবাই পাশে, তার পরেও যদি
একটা খবর একলা করে যায়,
চোখ পাল্টায়, পাল্টিয়ে যায় দেখা,
ভাগ্যে বদল হিঁচড়ে টানে লেখা,
দুঃখরা সব আকাশ ভেঙ্গে পড়ে,
নির্ভরতা হঠাত্‍ কোথায় সরে,
চিন্হ, চেনার, সবটা যদি পালায়,
সমুদ্দুরের নোনতা জলে ঢালায়,
খুনসুটি আর রাগারাগির ঘর
স্মৃতির ঘায়ে উছলে আনে ঝড়,
ঘর ভেঙ্গে যায়, আসনখানি কাঁপে,
গলায় বাঁধা কীসের আকুল চাপে,

সেই সে মানুষ, তার দুচোখের মেঘে,
বাষ্প দিয়ে হয়ত লেখক লেখে!!

তার সৌভাগ্য, আরতিদের সাথে তার পরিচয় নেই।

[নোটঃ উদ্ধৃত অংশটুক পঠনান্তে 'তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ামাত্র'। প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় ফেসবুক থেকে এখানেও তুলে দিলাম।]

পোস্টটি ১৩ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


এখন একদম পারফেক্ট হইছে! Smile

মর্ম's picture


Cool

আরাফাত শান্ত's picture


পড়ি নাই। আপনার পাঠ প্রতিক্রিয়ায় বিশেষ আগ্রহ পেলাম!

মর্ম's picture


পড়ার ইচ্ছাটা যদি হয় তো লেখা সার্থক!

গল্পটা না বলে দিয়ে বই নিয়ে লেখাটা আমার সাংঘাতিক কঠিন লাগে। আবার বলেই ফেলি যদি, তাহলে তো নতুন পাঠকের পড়ার আনন্দটাই নষ্ট হয়ে গেল!

রিভিউ তাই পড়িও যখন, সাবধানে পড়ি- গল্পটা যেন জানা না হয়ে যায়!

শওকত মাসুম's picture


অনেক আড়ে পড়েছিলাম। এখনও সংগ্রহে আছে। তবে বিমল কর গল্পকার হিসাবেই বেশি ভাল

মর্ম's picture


বিমল করের লেখা বেশি পড়িনি আগে। অসময় পড়া ছিল, আর এই দেওয়াল পড়া ছিল। আর কিছু ছোট গল্প।

দেওয়াল পড়া হল চারবারে আসে। এর আগে তিনবার হাতে নিয়েছি, পড়া শুরু করেছি- এরপর একটু পড়ে আবিষ্কার করেছি বইএর পাতা ছেড়া!

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই! একটাই বই বারবার নিয়েছি, বইয়ের পেছনে তালিকায় নিজের 'নামসই' পর্যন্ত আছে, সেটা আর দেখা হয়নি! ছেঁড়া হওয়ায় সন্দেহ হয়েছে- তখন টের পেয়েছি, সেই ধন আর এই ধন একই!

এইবারে একদম তৈরি হয়ে পড়লাম, আগেই জিজ্ঞেস করে নিয়েছি বই ছেঁড়া কি না!

টোকাই's picture


পড়ি নাই। আল্লার্ ওয়াস্তে কেউ কিনে উপহার দিলে মনের আনন্দে পড়তে পারতাম Smile

মর্ম's picture


জানেওয়ালা লোকজনের কাছে খোঁজখবর নেন, পিডিএফ পেয়ে যাবেন হয়ত Tongue

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

মর্ম's picture

নিজের সম্পর্কে

লেখালেখি করাটা একটা বড় ধরণের ব্যামো। কথা যখন অনেক জমে যায়, মাথার ভেতরে কুটকুট করতে থাকে ওগুলো। কী করি কী করি করে শেষ পর্যন্ত কী-বোর্ড টেনে বসতে হয়। ভাল হয় না কি মন্দ হয় সে তো পরের কথা, কিন্তু অশান্তি কমে, পেটও আর ভুটভাট করে না।

১২-১২-১২ তে উল্লেখ করার মত কিছু করা হয়নি, এমনকি এমন তারিখগুলোয় গত দশ বছরের অভ্যাস মেনে বই কেনার সময়টুকুও মেলেনি।

এখানে মাঝে মাঝে লেখা হবে হয়ত, ১২-১২-১২ তে এর সূচনা হোক!

তথ্যযোগঃ

সচলায়তন দিয়ে অনলাইন লেখালেখি শুরু হয় আমার, ২০১০-এ। নাই নাই করে সেখানেও কিছু লেখা জমা হয়ে আছে। অতি আগ্রহী পাঠক কেউ থাকলে ওখানেও ঘুরে আসার আমন্ত্রন জানিয়ে রাখি।

http://www.sachalayatan.com/mormo