জীবনযাপন
জীবন ঝঞ্ঝাটময় এবং প্রতিনিয়ত উদ্ভট ঝঞ্ঝাটে আটকে যাওয়ার অনায়াস অভ্যাস আমার আছে। তবে আজকে যেমনটা হলো তেমন করুন পরিস্থিতির মুখোমুখি হই নি অনেক দিন।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে আসার পর এডমিট কার্ড কোথাও তুলে রেখেছিলাম, মনে ছিলো না। এর ভেতরেই ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট হলো, ভর্তিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি কি না জানার উপায় নেই, হঠাৎ করেই পুরোনো বইয়ের ভাঁজে যত্ন করে তুলে রাখা এডমিট কার্ড খুঁজে পেলাম, পুরোনো পেপারের জঞ্জাল খুলে ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বের করে দেখলাম দু দিন পরেই ইন্টারভিউ। ময়মনসিংহ যেতে হবে। যদিও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই নি, কিন্তু বন্ধুদের সাথে উৎসাহ নিয়ে দুইদিন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম, এগ্রিটেকনোলজি বিষয়টা তখন খুব বেশী গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় নি, এখন এগ্রোটেকনোলজির খুচরা গবেষণা পড়ি জীবনের চাপে।
এডমিট কার্ড হারানো, ঘরের চাবি হারানো, পাসপোর্ট হারানো, অনেক ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে অনেকটা সাবধানী এখন। ঘর থেকে বাইরে পা রাখার আগে ৩ বার চাবি বাজিয়ে দেখি, বাড়তি নিরাপত্তার জন্যে অফিসের ড্রয়ারে একটা ঘরের চাবি প্রতিলিপি রাখা আছে।
উন্নত প্রযুক্তির দেশে অনেকদিন ধরেই ম্যাগনেটিক লক প্রচলিত। কার্ড ঘষে ল্যাবে ঢুকো, কার্ড ঘষে অফিসে ঢুকো, মঙ্গলসূত্রের মতো সারাক্ষণ গলায় ঝুলিয়ে রাখো ম্যাগনেটিক কার্ড। মাঝেমাঝে ভুলে গেলেও অফিস আওয়ারে ল্যাবভর্তি সহকর্মী, দরজার ঘন্টা বাজালে কেউ না কেউ এসে উদ্ধার করে।
গত পরশু কনফারেন্স থেকে ফেরার পর শুনলাম কনফারেন্স রিপোর্ট লিখতে হবে, ষান্মাসিক গবেষণার বিস্তারিত লিখতে হবে, আজ সারা দিন আস্তে ধীরে কনফারেন্স রিপোর্ট আর ষান্মাসিক গবেষণার সারসংক্ষেপ লিখে দীর্ঘ দিন পর সিনেমা দেখলাম। ভাবলাম কখনও ইউনিভার্সিটির অফিস রুমে রাত কাটানো হয় নি, দেখা যাক কেমন লাগে রাতে থাকতে? অফিসের ডিভানে শুয়ে বুঝলাম আমার ঘরের মেঝেতে ছড়ানো বিছানায় হাত পা দশ দিকে ছড়িয়ে ঘুমানোর আনন্দ এই আড়াই ফুটের ডিভানে পাওয়া যাবে না।
ব্যাগ গুছিয়ে, রাত ৪টায় যখন বাসার পথে রওনা দিবো, টয়লেটে গেলাম। টয়লেট থেকে বের হওয়ার পর মনে হলো আমার ব্যাগ অফিস রুমে, ব্যাগের ভেতরে ম্যাগনেটিক কার্ড, ব্যাগের ভেতরে ঘরের চাবি। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, ছাতাটাও অফিস রুমে ঝুলছে। আধুনিক অফিস রুম, দোরাজের উপরে সুন্দর সিগারেটের প্যাকেট রাখা, ব্যাগটা টেবিলে সাজানো, কাঁচের দরজা দিয়ে সব দেখছি, ছুঁতে পারছি না।
প্রফেসরের রুমে বাতি জ্বলতে দেখেছিলাম রাত ২টায়, তারপর সে ঘুমিয়েছে, এখন এই গভীর রাতে তাকে ঘুম থেকে তুলে যদি বলি চাবি দাও অফিসে যাবো- নিতান্ত ভদ্রলোক প্রফেসর কারাতের এক কোপে ঘায়েল করে ফেলতে পারে। পাশের ল্যাবে বাতি জ্বলছে, অনেক আশা নিয়ে সেখানে ডোরবেল বাজালাম। আশায় আশায় থাকলাম কেউ দরজা খুলে বলবে আপনাকে কিভাবে সাহায্য করবো জনাব? তবে এমনটা ঘটলো না।
মনে পরলো এই ফ্লোরের কোথাও না কোথাও জরুরী টেলিফোন নাম্বারগুলো ঝুলানো দেখেছি, সেখান থেকে প্রয়োজনীয় নাম্বারে ফোন করলে মুশকিল আসান। দুশ্চিন্তার কিছু নেই। টানা বারান্দার এপাশ ওপাশে হাঁটি, জরুরী টেলিফোন নাম্বার লেখা সাইনবোর্ড খুঁজে পাই না। খাওয়ার রুমে বড় করে লেখা তুমি যদি ময়লা পরিস্কার না করো তাহলে তোমার মা লজ্জা পাবে। সেখানে কয়েকটা নাম্বার লেখা আছে, কিন্তু বাকি সম্পূর্ণ বর্ণনা বিশুদ্ধ জাপানীতে,
নতুন ভাষা শেখার তীব্র অনাগ্রহে এখনও জাপানী ভাষা শেখা হয় নি। ইংরেজী ভাষায় প্রতিদিনের কাজ চালানোর মতো দক্ষতা আছে আর আঙ্গুলের ইশারায়, শরীরের ভঙ্গিতে বাকি যোগাযোগের কাজটা মোটামুটি চলে যায় বলে ভাষা শেখাটা খুব বেশী গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় নি।
এই গভীর রাতে অলৌকিক ভাবে জাপানী ভাষা শিখে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। নোটিশ বোর্ডের কোণায় জরুরী টেলিফোন নাম্বার খুঁজে পেলাম, টেলিফোন সে তো অফিস রুমে, বিকল্প ফোন খুঁজতে হবে। বিল্ডিং এর দরজায় ফোন আছে, সে ফোনে কথা বলতে গিয়ে যদি অটোমেটিক ডোর বন্ধ হয়ে যায় তাহলে বৃষ্টি আমি এবং আমার একাকীত্ব শিরোণামে নতুন গল্প শুরু হবে। মিটিং রুমের টেলিফোন থেকে জরুরী প্রয়োজনে ফোন করুন নাম্বারে ফোন দিলাম।
পরবর্তী ১ ঘন্টায় ৩ জন ভিন্ন ব্যক্তি, ভয়েস রিকগনিশন সফটওয়্যারের তরুনী কণ্ঠকে অসংখ্য পুনরাবৃত্তির পর বুঝাতে পারলাম
আমার একটা অফিস ছিলো
অফিসে একটা ফোন আছে
অফিসের ফোন নাম্বার
আমার অফিস রুম নাম্বার
আমি টয়লেটে যাওয়ার সময় ঘরে চাবি রেখে এসেছি
আমার অফিস রুমে আমার ব্যাগে চাবি রাখা আছে, সে চাবি না পেলে আমি বাসায় যেতে পারবো না, অফিসেও ঢুকতে পারবো না, আমাকে সাহায্য করতে হবে- এই তিনটা বাক্য অন্তত ২৫ বার বিভিন্ন কায়দায় বলেও তাদের বুঝাতে পারলাম না।
জাপানের কোনো জায়গায় কোনো প্রয়োজনে ফোন দিলে যে পরিমাণ বাক্য ব্যয় করতে হয়, সে তুলনায় আমার বাক্য ব্যয়ের পরিমাণ খুব বেশী না, কিন্তু শেষ রাতে সামান্য ৫টা বাক্য বুঝাতে না পারার ব্যর্থতায় তাৎক্ষণিক বিকল্প খোঁজার চেষ্টা করলাম।
সবগুলো ফ্লোর মিলিয়ে গেস্ট রুম আছে ১৫টা, সেখানে অবশ্য হাতল ওয়ালা চেয়ার, মিটিং রুমের চেয়ার জুড়ে ঘুমানো যাবে, ঠান্ডা লাগবে, সেটার বিকল্প খুঁজতে হবে। এইসব বিকল্পের মাঝে দেখলাম মিটিং রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে প্রফেসর চোখ মুছে জিজ্ঞাসা করছে এই রাতে তুমি কি করো এখানে?
তাকে বললাম আই লকড মাইসেলফ আউট অফ দ্যা অফিস। নাউ এই কলড টু সাম লেট আওয়ার অফিস এন্ড রিকোয়েস্টিং দেম টু হেল্প মি টু গেট ইন বাট সো ফার আই হ্যাভ নট মেড এনি প্রোগ্রেস।
যদি ওরা তোমার ঘুম ভাঙায় আমি দুঃখিত। আমি এমনটা চাই নি।
প্রফেসর বললো কার্ডটা সাথে রাখতে ভুল হতেই পারে কিন্তু এমন ভুল করা ঠিক হবে না। সব সময় কার্ডের কথা স্মরণে রাখতে হবে। তোমার রিসার্চ রিপোর্ট জানাই হলো না। তুমি তোমার প্রেজেন্টেশন ঠিক সময়ে শেষ করতে পারছিলা।
তাকে বললাম সে রিপোর্ট লিখে দেরি হয়ে গেলো, আর তারপর তো আমি নিজেই বাইরে বন্দী হয়ে গেলাম। সমস্যা নেই আমি এখনই মেইল করে দিচ্ছি।
প্রফেসর এবং আমি দুজনেই টেলিফোনে বলার চেষ্টা করেছিলাম আমার যে সাময়িক সমস্যা হয়েছিলো সেটার সমাধান হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে তাদের সহযোগিতা আমার প্রয়োজন নেই। অবশ্য তারা টেলিফোন পাশে রেখে নিজেদের ভেতরে আলাপচারিতায় মগ্ন ছিলো। অফিসের ফোন নাম্বার আর অফিস নাম্বার দিয়ে কিভাবে আমার কাছে পৌঁছানো যাবে সেটার হদিশ খুঁজছিলো হয়তো।
ফোন রাখার ৩০ মিনিট পর সে অফিস থেকে একজন আসলো , এসে আমাকে দেখলো, তারপর বিশুদ্ধ জাপানীতে আমাকে কিছু বুঝানোর চেষ্টা করলো। আমি হাসি মুখে তাকে বললাম আমি তো ভাই জাপানীর বিন্দু বিঃসর্গ বুঝি না। তবে তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
কি বুঝলো জানি না, দরজা খুলে বাইরে গেলো, আবার দরজা খুলে ভেতরে আসলো? বাঘ আর চতুর ছাগলের গল্পের মতো আমি আমার কার্ড গলায় ঝুলালাম, তাকে নিয়ে বাইরে গেলাম। বাইরে গিয়ে বললাম এই যে দরজা, এটা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যায়
আমার কার্ড ঘষলে দরজাটা খুলে
কার্ডটা আমার গলায় ঝুলানো থাকে কিন্তু আমি যখন টয়লেটে গেলাম
তখন কার্ডটা ছিলো ঐ যে ব্যাগটা ঐ ব্যাগের ভেতরে
আমি সামনের বোর্ডে গিয়ে তাকে দেখালাম টেলিফোন নাম্বার। বললাম আমি এই নাম্বার নিয়ে তাদের ফোন দিয়েছি, ঐ পাশের অফিস থেকে। তারপর আমার প্রফেসর এসে আমাকে সাহায্য করেছে আমি ভেতরে ঢুকতে পেরেছি।
কি বুঝলো আমি জানি না? আরও ২০ মিনিট পর স্টুডেন্ট সেকশনের কোনো এক অফিসার ঘুম জড়ানো গলায় বললো জনাব রাসেল অফিসে কি সমস্যা হয়েছে?
তাকে বললাম সাময়িক অসুবিধা হয়েছিলো তবে সে সমস্যা এখন মিটে গেছে, এটা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।
তাহলে আমাদের অফিসে চলে আসেন?
তাকে আবারও বললাম- আমার যে সমস্যা ছিলো, সেটার সমাধান হয়ে গেছে। এখন আমার সহযোগিতার প্রয়োজন নাই। তবে এরপরও যদি তার মনে হয় আমার অফিসে যাওয়া দরকার, আমি অফিসে যাবো। অফিসের ঠিকানা জানালে আমি পরের দিন সকালে তাদের সাথে দেখা করবো।
আমি ঠিক আছি, আমার এখন কোনো সমস্যা নেই, আমার সহযোগিতা লাগবে না- এই বাক্যগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ৫ বার পুনরাবৃত্তি করার পর সে অবশেষে বললো তাহলে তোমার এখন সমস্যা নেই- এই তো? আমি বললাম ঠিক তাই। আমার এখন কোনো সমস্যা নেই। আমি একটু পরে বাসায় যেতে পারবো। তাহলে ঠিক আছে। তাহলে তো তোমার অফিসে আসার দরকার নাই?
আমি বললাম হ্যা আমার এখন তোমাদের অফিসে যাওয়ার কোনো দরকার নাই। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আমার বাসায় যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না
আমি হলে এর শিরোনাম দিতাম অদ্ভুত প্যারাময় একটি রাত!
ভাল লাগল ।
মন্তব্য করুন