ইদানিং জীবনযাপন
আমি কম্পিউটারের ১৭ ইঞ্চি স্ক্রীনে দেখছি ছেলের চেহারা থেকে শৈশবের ছাপ মুছে যাচ্ছে, কণ্ঠের মসৃনতা উবে গিয়ে কৈশোর আসছে। এই অদ্ভুত সময়টাতে যখন যেকোনো আবদারের শেষে ওকে শুনতে হচ্ছে তুমি কি এখনো বাচ্চা না কি, যাও পড়ার টেবিলটা গুছাও- এখন বড় হয়ে গেছো, আর যেকোনো মতামতের পর অবধারিত শুনতে হচ্ছে এই বয়েসে পাকনা পাকনা কথা বলতে হবে না, তুমি ছোটো আছো এখনও। এই অদ্ভুতুড়ে সময়টা ফিরে আসবে না ওর জীবনে- আমার জীবনেও।
আমার মেয়ে ওয়েবক্যামের সামনে দাঁড়িয়ে আমার সাথে লুকোচুরি খেলে। বাবা বলতো আমি কোথায়? আমি এপাশ থেকে বলি আরে আমার মেয়েটা কোথায় গেলো? আমি তো দেখতে পাচ্ছি না।
ও কম্পিউটার স্ক্রীনের পেছন থেকে বলে- এই তো আমি তোমার পিছনে। তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছো না? তুমি কি বোকা না কি?
বলতে পারি না- পৃথিবীতে বোকা মানুষ না হলে কেউ তোমাদের ছেড়ে দূরে থাকে না।
ও যখন বলে বাবা তোমার কি মন খারাপ? এই যে তোমাকে আদর করে দিচ্ছি। কম্পিউটার স্ক্রিনে ও হাত রাখলে বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যায়। মনে হয় এই জীবনের নিকুচি করি। এভাবে বেঁচে থাকা কোনো কাজের জিনিষ না।
বাক্সের উপর বাক্স বসিয়ে কংক্রীট নগরীতে শৈশবের কারাগার বানিয়েছি আমরা। এক চিলতে ছাদের চাবি বাধা বাড়ীওয়ালীর আঁচলে- গ্যারেজের এক টুকরো পরিসরে নিজের সম্রাজ্য সাজানোরও সুযোগ নেই। পেডোফাইল আর বিকৃতযৌন অভিরুচির মানুষেরা কোথায় থাবার ভেতর নখ লুকিয়ে বসে আছে জানি না। যে বয়েসে ওদের আম পাতা জোড়া জোড়া মারবো চাবুক ছুটবে ঘোড়া আর এলেন্টি বায়োস্কোপে মেতে থাকার কথা সে বয়েসে নামতা পড়ানোর মতো ওদের বলতে হচ্ছে হাতের কানুই থেকে শুরু করে পায়ের হাঁটু পর্যন্ত শরীরের যেটুকু অংশ সেটা প্রাইভেট এরিয়া। ওখানে অন্য কেউ হাত দিলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। আর যদি কেউ ব্যাথা দেয়, আমাদের জানাবে। আমাদের জানাটা জরুরী। প্রতিবার বলার সময় নিজের কাছে নিজে ছোটো হয়ে যাই।
এখন প্রতিদিনের সংবাদপত্রে শিশুনিপীড়নের অকল্পনীয় সব সংবাদ পড়ে ব্যক্তিগত ফোল্ডারে জমানো ছবি দেখি। ভাবিবাবা-মায়ের পক্ষে এইসব নিপীড়ন-নির্যাতনের কতটুকু গ্রহন করা সম্ভব? কতটা নিরুপায় হলে আমরা আমাদের সন্তানদের এই চাপ নিয়ে স্কুলে পাঠাই, ঘরের কাজের অবসরে বলি যাও একটু নিজের মতো খেলাধুলা করো। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাবা-মা হয়ে ওঠার সঙ্গী কিন্তু বর্তমান আমাকে আতংকিত করে। আমাদের শৈশবের ছেলেধরারা এত বেশী ভয়ংকর ছিলো না। এত হাঙ্গামার ভেতরেও ওদের দেখে উজ্জ্বল চোখে তাকানো, মুখের হাসি ধরে রাখা, প্রাণান্ত পরিশ্রমের কাজ।
স্কুলে গ্রেড আর বাবা মায়ের মর্যাদার লড়াইয়ে নিহত শৈশব বুকে পুষে কম্পিউটারে এডভেঞ্চার করছে ছেলে। আমেরিকার নির্বাচনের দিন বললোআমার এনিমেল জ্যামে নির্বাচন নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ বলছে ট্রাম্প জিতলে ওরা কানাডা চলে যাবে। ট্রাম্পের জেতার কি দরকার? বাবা ওবামা কি আরও কিছুদিন থাকতে পারবে না? বললাম বাবা ওবামা তো থাকতে পারবে না আর। ওখানকার নিয়মটাই এমন। এখন আর দুশ্চিন্তা করে লাভ নাই। নির্বাচন শেষ। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছে।
কেনো ট্রাম্প জিতে গেলো, এখন কি হবে? তাহলে তো ও এখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগিয়ে দিবে।
শুনো বাবা, আমেরিকার মানুষগুলো ভীষণ রেগে আছে। মানুষ রেগে গেলে বোকা হয়ে যায়। এবার ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়াটা এমনই ঘটনা। যারা রেগে আছে, তারা বোকামি করছে কিন্তু তাদের পরিস্থিতি বদলাবে না। যারা রেগে আছে, তারা ভাবছে তাদের চাকরি-বাকরি সব বিদেশীরা দখল করে ফেলতেছে। সমস্যা হলো ওখানে ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার খরচ বেশী। স্কলারশীপ না পেলে বেশীরভাগ মানুষ ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পারে না। স্কলারশীপ পেতে হলে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। ওরা স্কুল-কলেজে পরিশ্রমও করতে চায় না।
যারা বিদেশ থেকে যাচ্ছে, তারা ইউনিভার্সিটি শেষ করছে। ওদের যোগ্যতা বেশী। ওদের চাকরি হচ্ছে। এটা বছরের পর বছর চলতে থাকবে। এই রকম রাগ না করে, ওদের আরও পরিশ্রম করতে হবে এখন, না হলে কিচ্ছু বদলাবে না।
আমরা এসব নিয়ে পরে আবার কথা বলবো, যাও পড়াশোনা করো। মনে রাখবা পৃথিবীতে তোমাকে নিজে পরিশ্রম করে সব অর্জন করতে হবে। পরিশ্রম করে মর্যাদা যোগ্যতা অর্জন করতে হয়।
হঠাৎ হঠাৎ কথা হয় এখন ওদের সাথে। একই প্রশ্ন করে। তুমি কবে আসবা? তোমার শেষ হবে কখন? তুমি একই কথা বারবার বলো। আগামী বছর ,আগামী বছর, আগামী বছরটা শেষ হবে কখন? মেয়ে রাগ করে, অভিমান করে, বিছানার একপাশে আমার জন্যে ছোট্টো একটা জায়গা আলাদা করে রাখে। আমি আমার ১৭ ইঞ্চি স্ক্রীনের ভেতরে ওদের বেড়ে ওঠা দেখি। বিছানার এক চিলতে জমিনে শরীর রাখতে পারি না, এ পাশ আর ওপাশের মাঝখানে ৬০০০ মাইলের দুরত্ব।
ভেবেছিলাম এবার ওর জন্মদিনে লিখবো, লেখা হয় নি
In past two years, it:s been rough on me and I was not always been my best but since you born, you always inspired me to be a better person. As you grow up, things might not be better between us. But you will always be my hero.
মন্তব্য করুন