মান সম্পন্ন শিক্ষা
কিছুদিন যাবত আমরা জাতিগত ভাবে খুব উদ্বিগ্ন সময় কাটাচ্ছি । বিশেষ করে যখন ই কোন জাতীয় পরীক্ষা সামনে আসছে তখন ই যার বাসায় পরীক্ষার্থী আছে তিনি যেমন চিন্তিত সময় কাটাচ্ছেন, তেমনি আমরা যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাঠ অনেক বছর হয় পার করে এসেছি তারা ও বেশ চিন্তিত। বিশাল উত্তেজনায় সময় কাটছে পরীক্ষার পূর্বের রাত গুলো। অনেকটা ক্রিকেট খেলার মতো, এক বলে ছয় রান। হয় ছক্কা নয় হেরে গেল। প্রশ্ন পত্র ফাঁস হল বলে হল বলে করতে করতে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন হাতে পৌছাল কি পৌছাম না, তা নিয়ে বিশাল উত্তেজনা। সময় মতো হাতে এসে পড়লো তো ছক্কা মানে "Five", নয়তো ফেইল অথবা কোন রকম পাশ নম্বর। যার বাসায় পরীক্ষার্থী আছে, তারা চিন্তিত আবার দুই ভাবেঃ
১। প্রশ্ন পত্র হাতে এসে পৌঁছাবে তো?
২। সবাই প্রশ্ন আগে পেয়ে যাবে, আমার বাচ্চা তো ভাল পরীক্ষা দিয়ে ও তুলনামূলক ভাবে খারাপ করবে
যারা এক নম্বর জনিত সমস্যায় আছেন তাদের এক ধরনের প্রশান্তি আছে, যে তারা তাদের বাচ্চাদের পরীক্ষার আগে পিছন দরজা দিয়ে বের হয়ে যাওয়া প্রশ্ন পত্র তাদের বাচ্চাদের দিবেন এবং সেই প্রশ্নের উত্তর রাত জেগে মুখস্থ করাবেন। বা বার বার রিভাইস করাবেন।
যারা দ্বিতীয় কারনে উদ্বিগ্ন, তাদের যন্ত্রনা টা বহু মাত্রিক। প্রথমে তাদের নিজের ভিতরের মানুষের সাথে যুদ্ধ। এই প্রশ্ন কি সে তার বাচ্চার নাগালের ভিতর আনবে? বা বাচ্চা কে দেয়া উচিৎ? বাচ্চা যদি জানে তার পরিবার ইচ্ছাকৃত ভাবে তাকে "নকল প্রশ্ন" (ফাঁস হওয়া প্রশ্ন) দিচ্ছে না, তাহলে ফল প্রকাশের পর সে কি তার আপাত খারাপ ফলের জন্য দোষারোপ করবে? সে যদি তার বাচ্চা কে বুঝাতে ব্যর্থ হয়?!! এর সাথে থাকবে এক বুক হতাশা, এবং এই অবস্থা থেকে মুক্তির পথ না জানার গ্লানি।
এখন আসা যাক প্রক্তন ছাত্রদের কথায়। তারা ভাবছে, হচ্ছেটা কি চারদিকে। এক সময় নকল এর প্রকোপ ছিল। এখন তো আর তার দরকার ই নাই। প্রশ্ন ই আগে পেয়ে যায়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কি হবে? পঞ্চম শ্রেণী থেকে চাকুরী পর্যন্ত সকল সরকারী পরীক্ষার প্রশ্ন ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা ভোগ করছে বাংলাদেশী। শিক্ষার মান কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে? আমার ছেলে মেয়ে কে কারা পড়াবে?
সর্ব শেষ আলোচনা "শিক্ষার মান"। শিক্ষার মান এখন প্রশ্নের মুখোমোখি। এই লাগাতার হরতালের মতো লাগাতার প্রশ্ন ফাঁস এখন নিত্য দিনের বিষয়। পরীক্ষার আগে প্রশ্ন ফাঁস ই শিক্ষার মান নিম্নগামী হবার কারন, নাকি শিক্ষার মানের অবনতির কারনে ই লাগাতার এই প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে এবং আমরা এই প্রশ্ন ব্যবহার করছি। আমার কাছে মনে হয় আমাদের শিক্ষার মান অনেক নীচে নেমেছে বলে ই আমরা এই অনৈতিক কাজ গুলো করতে পারছি, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কে ও এই শিক্ষা দিচ্ছি। একটা সময় ছিল, একজন চোর ও চাইতো তার ছেলে মেয়ে চুরি না করে ভাল কিছু করবে, শিক্ষিত হবে। তখন বিনামূল্যে বই পাওয়া সহজ ছিল না, স্কুলের সংখ্যা ও এতো ছিল না। এখন আমাদের সামনে শিক্ষা উপকরণ সহজলভ্য, আমাদের বাচ্চাদের অধিকাংশ বাবা মা শিক্ষিত কিন্তু আমরা আমাদের বাচ্চাদের অন্যায়ে উৎসাহ দিচ্ছি। চুরি করতে শিখাচ্ছি হাতে কলমে। একটা পঞ্চম, অষ্টম বা দশম শ্রেণীর বাচ্চা নিশ্চয় নিজে গিয়ে প্রশ্ন পত্র খুঁজে নিয়ে আসে না। আমরা শিক্ষিত বাবা মা ই এই কাজ করি। সমাজের অল্প শিক্ষিত মানুষের ও সরকার বা বোর্ড পর্যন্ত হাত পৌছায় না সহজে যে তারা প্রশ্ন পত্র বের করে নেট এ ছেড়ে দিবে। এর পিছনে শিক্ষিত মানুষ ই কাজ করছে। এই অপশিক্ষা প্রশ্নপত্র ফাঁসের দ্বারা হয়নি। এই অপশিক্ষিত মানুষ গুলো ৩০-৫০% যখন পাশের হার তখনকার সময়ের শিক্ষিত মানুষ। তাহলে তো শিক্ষার মান নেমে গিয়েছে অনেক আগে ই। এই কারনেই ই প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে এবং এর গন ব্যবহার হচ্ছে। বেশ কিছু বছর ধরে ই এই প্রশ্ন পত্র ফাঁস হচ্ছে, কিন্তু আমরা এই পর্যন্ত শুনিনি যে ফাঁসকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান শস্তি পেয়েছে। তার মানে কি দাঁড়াল? হয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ঠিক মতো কাজ করছে না, নয়তো তাকে আরও ও উপর থেকে নির্দেশ দেয়া আছে কাজ না করার জন্য। কারন সে তার দায়িত্ব পালন না করে ও কিভাবে চাকরি টিকিয়ে রাখছে? এই অপরাধীদের ধরার জন্য তেমন কোন পদক্ষেপ এর প্রয়োজন নেই; যারা প্রশ্ন করেন, যাহারা প্রশ্ন নির্বাচন করেন, প্রেস এবং যার জিম্মায় প্রশ্ন থাকে তদের একসাথে এক কামরায় নিয়ে বসেন। সকল সত্য বের হয়ে আসবে। পরবর্তী বছরে আর কোন প্রশ্ন ফাঁস হবে না। অন্তত গন এবং লাগাতার প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হবে। যে শিক্ষার্থী প্রশ্ন একরাতের পরিশ্রমে A+ এবং যে শিক্ষার্থী দুই বছর পরিশ্রম করে A+ পাচ্ছে তাদের জানার মান কনভাবে ই এক হতে পারে না। এই যে কোন বিষয় সম্পর্কে জানা, এটা ই শিক্ষার মান নির্ধারণ করে। আমাদের শিক্ষার মান কোন ভাবে এক রাখা তো যাচ্ছে ই না, উপরন্তু যাদের মান ভাল তারা ও প্রশ্ন ফাঁস হবার কারনে, মানহীন শিক্ষার অংশ হয়ে যাচ্ছে। যখন সমস্ত উন্নত বিষব গ্রেড সিস্টেম এ চলছে, তখন ও আমরা নম্বর পদ্ধতিতে মান নির্ণয় করেছি, সারা উন্নত বিশ্বে ৮০% এ A যখন আমাদের তখন ৬০% এ ফার্স্ট ডিভিশন। তাই বলে আমাদের ছেলে মেয়েদের সেই সকল উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেতে তেমন সমস্যা হয়নি। কিন্তু এখন আমাদের গ্রেড সিস্টেম, শিক্ষকদের নির্দেশনা দেয়া হয় বেশি করে নম্বর দিতে। প্রশ্ন পত্র ফাঁস করে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সবাই সোনালী ফল পাচ্ছে তাতে লাভ কি হচ্ছে। এখনকার এই সোনালী রূপালি ফলদারী রা সঠিক কোন পরিক্ষায় পাশ নম্বর পাচ্ছে না। ভাল কোথাও ভর্তি হতে পারছে না। সর্বস্তরে ই তাদের প্রশ্ন পত্র পরীক্ষার আগের রাতে হাতে পৌঁছে দিতে হচ্ছে। এই অবস্থার কথা এখন দেশে বিদেশে সবাই জানে। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সেই সকল ছাত্র, যারা পড়া লিখা করে ভাল ফল করেছে। কারন তাদের কেউ বিশ্বাস করছে না। এই গ্রেড মূল্যহীন হয়ে পড়ছে।
বাবা মায়ের কাছে শুনা কথা, '৭১ পরবর্তী সময়ে দেশের যখন খুব নাজুক অবস্থা তখন ও সকল পরীক্ষা বাংলাদেশ সরকার নিয়েছে। সেই পরীক্ষায় সবাই বই খুলে পরীক্ষা দিতে পেরেছে, সবাই পাশ করেছে। অনেককে পরবর্তীতে এটা নিয়ে বলতে ও শুনেছি, স্বাধীনতার পরের পাশ দেয়া। তখন দেশের অবস্থা ছিল ভঙ্গুর, চারদিক বিদ্ধস্থ, নতুন একটা দেশ, কোন কিছু ই ঠিক ঠাক শুরু হয়নি। আমাদের সনদদারী কিছু মানুষ প্রয়োজন, তাই না হয় মানুষ ভুল জেনে ও মেনে নিয়েছে। এখন কি আমাদের দেশের অবস্থা তখনকার চেয়ে ও খারাপ, যে আমরা এখন নকল নয়(নকল এ একটা অনিশ্চয়তা থাকে, খুঁজে বের করার সময় লাগে। বই ঠিক মতো পড়া না থাকলে ঐ সময়ের মধ্যে খুঁজে বের করে উত্তর লিখা সহজ নয়) , বাসায় বাসায় প্রশ্ন পৌঁছে দিচ্ছি। আমাদের ছেলে মেয়েদের শুধু মেধা বিকাশের পথ রুদ্ধ করছি না, তাদের কে অন্যায় করে লাভবান হতে উদ্বুদ্ধ করছি। যে বা যারা এটা করছে খুব বুঝে শুনে ই এগুচ্ছেন মনে হচ্ছে। একটা মেধাহীন, অনৈতিক ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করছে বাংলাদেশে। এটা '৭১ এর বুদ্ধিজীবী হত্যার সময়ের চেয়ে ভয়ঙ্কর। সেই দিন সেই সময়ের মেধাকে খুন করেছে, কিন্তু মেধার বিকাশ কে রুদ্ধ করতে পারে নি। এই ২০১৪ তে এসে খুব পরিতাপের সাথে দেখতে হচ্ছে সেই বিকাশ কে কিভাবে খুন করা হচ্ছে, তাও আমরা নিজেরা ই করছি। আমাদের সরকার ও এই নিয়ে চিন্তত বলে মনে হচ্ছে না। তারা অবশ্য এ ঘটনা ই স্বীকার করতে রাজি নন। দেশের কোটি কোটি জনগণ দেখছে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে, শুধু যাহারা দেখা জরুরী তারা ই দেখতে পারছেন না, তাই এই অবস্থা রোধের কোন ব্যবস্থা ও নেয়া যাচ্ছে না। যদিও আমার ঠিক বোধগম্য নয় এই সর্বময় ক্ষমতাধারি সরকার তার ক্ষমতার এক ঝলক কেন দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছেন।!!
এখন আমি খুব খুব সন্দিহান আমাদের শিক্ষার মান নিয়ে। এখন যদি প্রশ্ন পত্র ফাঁস রোধ ও করা যায়, আমরা কি বলতে পারব যে শিক্ষার মান বেড়ে গিয়েছে? আমাদের ভিতর যেই মানুষ গুলো অন্যায় করছে এবং নিজ শিশুকে ও তার অংশীদার করছে, এই মানুষ টা যখন ই সুযোগ পাবে তখন ই অন্যায় সুযোগ নিবে।
শিক্ষার মুল উদ্দেশ্য গ্রেড না। শিক্ষার প্রাথমিক উদ্দেশ্য শিশু কে সামাজিক মানব শিশু হিসাবে গড়ে তুলা। শিক্ষা নৈতিকতা শিখাবে, এর প্রয়োজনীয়তা বুঝাবে, তাও না বুঝলে তাকে নৈতিকতার এবং দায়িত্বশীলতার চর্চা করাবে। সেই প্রাথমিক শিক্ষায় ই আমরা ফেল করে বসে আছি। এখন মনে হয় সময় এসেছে প্রাথমিক শিক্ষার মুলে আমূল পরিবর্তন আনার। ব্যক্তি কেন্দ্রিক জীবন যাপন করতে হলে ও যে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয় তা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ই প্রশিক্ষন দেয়া দরকার। এর জন্য নতুন করে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা সাজনো উচিৎ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গ্রেড কেন, পাশ ফেল নিয়ে ই চিন্তা করা উচিৎ না। আমাদের যেখানে শিক্ষার ভিত ই নাই সেখানে শিক্ষা ক্ষেত্রে সততা আশা করা দুরাশা মাত্র। আমরা জতিগত ভাবে ই নীতি হীন হয়ে যাচ্ছি।
১] অত্যান্ত মূল্যবান পোষ্ট ! নিঃসন্দেহে সময়োচিৎ ও ! ৪৩ বছরে আমরা তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক ফায়দার লাভের জন্য রাষ্টের যাবতীয় ইনিষ্টিটিউশন ধ্বংস করে দিয়েছি ! স্বাধীনতার পরপরই শুরু হয় নকলের মহোৎসব ! তখন পরীক্ষার হলে রাজনৈতিক ক্যাডারদের উপস্থিতি ছিল লক্ষ্য করার মতো । কর্তৃপক্ষ সন্মান হারানোর ভয়ে নিস্ক্রিয় থাকতো । '৭৪ এ ডিগ্রী পরীক্ষায় নকল ধরতে গিয়ে উশৃংখল পরীক্ষার্থীদের হাতে নিঃগৃহিত হয়েছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কলেজের সন্মানিত এক অধ্যাপক । চট্টগ্রাম 'ভার্সিটির ভি সি ছিলেন তখন অদ্যাপক আবুল ফজল সাহেব ! জানা যায় রিক্স নিয়ে নকল ধরতে নিষেধ করেছিলেন তিনি । তিনি অন্যভাবে নকল প্রবণতা বন্ধ করার উপায় বের করেছিলেন । সে বছর ডিগ্রী পরীক্ষায় পাশের হার ছিল ২% মাত্র । নকল অনেকটা স্বকীয়ভাবে কমে গেছিল পরবর্তী পরীক্ষাগুলোতে ।
২] স্বাধীনতার পরে খুব অল্প সময়ে ভিয়েৎনাম দ্রুত উন্নতি সাধন করে । 'কিভাবে' ? জিজ্ঞাসিত হয়ে সে দেশের একজন অদ্যাপক বলেছিলেন, ' আমরা শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতিকে কখনো আসতে দিইনি । রাজনীতির কলুষতা আমাদের ছাত্রদের ছুঁতে দেইনা ' ।
৩] আমরা আমাদের সন্তানদের নষ্ট করছি । প্রতিদিন একটু একটু বিষ মেশাচ্ছি তাদের হৃদয়-মনে । বিষে বিষে নীল হয়ে বড় হবে ওরা একদিন, তারপর পেছনে ফিরে দেখবে পিশাচ পূর্ব পুরুষরা ধ্বংসের দোর গোড়ায় রেখে গেছে ওদেরকে ।
৪] জাতি হিসেবে টিকে থাকতে হলে আমদেরকে প্রকৃত শিক্ষা অর্জণ করতে হবে, এর কোন বিকল্প নাই !
অনেক অনেক ধন্যবাদ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পোষ্টির জন্য ! ভাল থাকুন ।
সবাই শুধু সমস্যা লিখে, সমাধান কোথায়?
মন্তব্য করুন