মান সম্পন্ন শিক্ষা- ২
পূর্বের লিখা মান সম্পন্ন শিক্ষা ১ এর মন্তব্যে দুইটি বিষয় উঠে এসেছে, ১। শিক্ষা ক্ষেত্রে রাজনীতি ২। সমাধান।
১। মানুষ মাত্র ই রাজনৈতিক। রাজনীতি মানে ই দেশের ক্ষমতা দখল না। শিক্ষায় রাজনীতির সংস্রব রোধ করা গেলে ও, শিক্ষা ক্ষেত্রে রাজনীতি দূর করা সম্ভব হবে না। কোথাও হয় নি। এই দেশে ও হবে না।
২। সমাধান কি?
-সমাধান অনেক সহজ। বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল কর এবং নতুন পরীক্ষা পদ্ধতি গ্রহন কর।
আজ আমি এই দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর ই দিব।-
------------------------------------------------------------------------------------------------
প্রথমে ই দেখা যাক আমাদের এখনকার শিক্ষা পদ্ধতি কি। আমরা যারা কম করে হলে ও স্কুল পাশ দিয়েছি, তারা ব্যক্তিগত ভাবে দেখেছি এবং আশে পাশে অনেক কে বর্তমানে দেখছি যারা স্কুলে পড়ছে। তা হয়তো নিজ পরিবারের বা আমাদের সমাজের কেউ। আমরা অনেকে আবার শিক্ষা সংশ্লিষ্ট পেশায় জড়িত। আমাদের স্কুল ১০ বছরের। এই দশ বছরে আমরা এখন তিনটা বড় বড় পরীক্ষা দেই; ১। পঞ্চম শ্রেনি, ২। অষ্টম শ্রেনি, এবং ৩। এস এস সি। পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষায় মুলত বাংলা, ইংরেজী গণিত, বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, ভুগোল, ইতিহাস থাকে। এর মাঝে বাংলা, ইংরেজি এবং গণিত প্রথম শ্রেনি হতে ই পঠিত হয়। বাংলা আমাদের মাতৃ ভাষা। ইংরেজি ব্যতিত সকল বিষয় বাংলায় ই পড়ানো হয়। বচ্চাদের তাই বই পড়তে খুব সমস্যা হয় না। বাচ্চাদের শিক্ষকরা কি বিদ্যালয়ে পড়ান?- অবশ্য ই পড়ান। তাহলে আমাদের শিক্ষায় সমস্যা কোথায়। আমাদের মূল সমস্যা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নতুন কে স্বাগত জানাতে পারে না। একই বিষয় অনেক ভাবে লিখা যায় বা বলা যায়, এক ই বিষয়ের ভিন্ন ভিন্ন উপস্থাপন কে গ্রহন করে না।আর ও সহজ ভাবে বললে কোন ছাত্রের নিজস্বতা কে গুরুত্ব দেয়া হয় না। এমন কি নিজের ভাষায় যে বাচ্চা ১০ মিনিট গড় গড় করে কোন একটা বিষয়ে কথা বলতে পারে, সেই বাচ্চাকে স্কুলে ঐ বিষয়ে লিখতে দিলে দুই লাইন লিখতে পারে না। স্কুল আর বস্তব জীবনের মাঝে বিশাল এক শুন্যতা তৈরি হয়ে আছে। স্কুল দেয়ালের বাইরের জীবনের অভিজ্ঞতা স্কুলের ভিতরে কাজে আসে না, স্কুলের ভিতরের শিক্ষা তার দেয়ালের বাইরে যায় না। এই বিচ্ছিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থায়, এক রাখাল ছেলে কে “রাখাল বালক” বা “গরু” রচনা লিখতে দিলে দুই লাইন লিখতে পারে না। এর উপর দশ লাইন লিখতে হলে ও তাকে এই দশ লাইন কোন বই দেখে আগে মুখস্থ করে নিতে হয়। নয়তো পরীক্ষার কেন্দ্রে বসে কান্না কাটি করে রচনা “কমন” পড়ে নাই বলে। অনেক অনেক ভাল ছাত্রের ও এই অবস্থা।
এই অংশের অবতারনার কারন একটা ই , আমাদের ছাত্রদের “কমন” পাওয়ার মাঝে ই জানার সীমাবদ্ধতা, এখানেই শিক্ষার প্রাথমিক কবর রচিত হয়। স্কুল এর সময়কাল প্রত্যেক বিষয়ের পাঠ্য সুচি অনুসারে অনেক বেশি। তাই স্কুলে শিক্ষকরা পুরা বই এক বছরে পড়িয়ে শেষ করতে পারেন। কিন্তু ছাত্র শিক্ষক অনুপাত এতো বেশি যে, একেকজন শিক্ষকের এক ক্লাসে ৭০-১০০ জন ছাত্র নিয়ে ও পড়াতে হয়। এক দিনে কম করে হলে ও ৪-৫ টা ক্লাস নিতে হয়। প্রতিদিন একজন শিক্ষক কে ৩০০-৫০০ ছাত্র পড়াতে হয়। এত জন ছাত্রের নিজস্বতা গুরুত্ব দিয়ে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করা কোন সুপার শিক্ষক এর পক্ষে ও সম্ভব না। পরীক্ষা নিয়ে প্রত্যেকটা ছাত্রের খাতায় উপস্থাপন লক্ষ্য করে তাদের কে সঠিক পথে আনা কোন ভাবে ই সম্ভব হয় না। তাই শিক্ষকরা একটা কমন পদ্ধতি তৈরি করে দেন। প্রশ্ন কেমন হবে, কোন প্রশ্নের উত্তর কি হবে। ছাত্ররা ও তাই লিখে। এতে শিক্ষকের ও সময় বাঁচে, ছাত্র ও একটা সঠিক উত্তর শিখে। ভিন্ন ভাবে উত্তর দিয়ে শুন্য নম্বর পাওয়ার অভিজ্ঞতা অনেকের ই আছে । আমরা শিক্ষকরা যেমন সময় এবং সুযোগের অভাবে গা্রমেন্ট এর কাপড়ের মতো একছাটে ছাত্র পড়াই, ছাত্ররা ও এই ছাটের বাইরে কিছু বুঝে না।
জীবন কে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পরীক্ষা পাশ করতে হবে, পারলে ভাল ফল ও করতে হবে। সবাই এর পিছনে ই ছুটছে। ভাল ফল করতে কোন ছাত্রের ই না ভাল লাগে। কোন বাবা ই না চান তার বাচ্চা ভাল ফল করুক? বাচ্চাদের ভাল ফলের জন্য বাচ্চাদের স্কুলের বাইরে ও শিক্ষক দেয়া হয়। আমাদের স্কুল ফাইনাল (এস এস সি) পরীক্ষার জন্য যে বই গুলো আমরা পড়ি, তার সবটা ই ১-১.৫ বছরের মধ্যে স্কুলে শেষ করে ফেলা যায় সহজে ই। কিন্তু পরীক্ষা দেয়া পর্যন্ত আমরা সময় পাই ২.৫ বছর। এইচ এস সি বা কলেজ লেভেলে এই শিক্ষক দেয়াটা বাধ্যতা মূলক হয়ে দাড়ায়, কারন আমাদের বই গুলোর তুলনায় সময় অনেক বেশি কম। বাবা মা কে বাধ্য হয়ে কলেজের বাইরে শিক্ষকের দারস্ত হতে হয়। প্রাইভেট টিউটর রা ও জানে বাবা মা ভাল ফল চায়, তাই এতো পয়সা খরচ। ওনারা ও বাচ্চাদের ন্যুনতম সময়ে যেভাবে ভাল ফল করা যায় তাই করেন। একটা ছাত্র কতটা জানে বা কতটা শিখল তার প্রকাশ হল পরীক্ষার ফল। তাই ভাল ফল করা ই চাই, যে কোন ভাবে।
“ভাল ফলের” আশায় পরীক্ষার আগে একটা পাচ কেজি ওজনের টেস্ট পেপার কিনা হয়। এই টেস্ট পেপার এ থাকে গত ১০-১৫ বছরের প্রশ্ন। এই সব প্রশ্ন ঘেঁটে ভাল ভাল শিক্ষকরা তৈরি করেন বিষয় ভিত্তিক সাজেশন। এই সাজেশন এর জন্য ও অনেকে অনেক শিক্ষকের কাছে পড়তে যায়। বা চড়া দামে এই সব সাজেশন কিনা হয়। এই সাজেশন তৈরির ক্ষেত্রে একটা বিষয় মেনে চলা হয়; গত বছরের প্রশ্ন এই বছর আসবে না। এবং সত্য হল, তাই ঘটে। ১৫০-২০০ পৃষ্ঠার বই থেকে ৩-৪ পৃষ্ঠা ব্যপি প্রশ্ন করা হয় এবং এই প্রশ্ন ব্যাংক থেকে ই সবাই সব কিছু কমন পায় পরীক্ষায়। ছেলে মেয়েরা আর বই খুলে ও দেখে না। সাজেশনেরর প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করে পরীক্ষা দিতে যায়।
১। প্রশ্ন করার সময় একটা বিষয় টা মাথা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে যে, গত বছরের প্রশ্ন আসবে না।
২। কয়েক সেট সাজেশন পড়ে যাতে কম করে হলেও ৮০% প্রশ্ন এর উত্তর করা যাবে; এই ধারনা যাতে তৈরি না হয়।
৩। বই এর এই অংশ পড়লাম ঐ অংশ পড়লাম না তবু ও ৯০% প্রশ্নের উত্তর করতে পারলাম, এমন প্রশ্ন যাতে না থাকে।
বইয়ের যে কোন অংশ থেকে যে কোন প্রশ্ন পরীক্ষায় যদি দেয়া হয় এবং পরীক্ষায় যদি কোন ধরনের বাছাইয়ের সুযোগ দেয়া না হয় ( যেমন ৫ টি থেকে ৩ টি প্রশ্নের উত্তর দাও), তাহলে ছেলে মেয়ে বাধ্য হয়ে বই পড়বে, সম্পূর্ণ বই পড়বে। এটা আমার পড়ানোর অভিজ্ঞাতা থেকে বলছি।
যেসব বিষয়ে থিউরি থাকে যা নাকি প্রায়োগিক দিক আছে, সেই সব বিষয়ে সরাসরি থিউরি লিখতে দেয়া যাবে না। থিউরি থেকে কনসেপ্টচুয়াল প্রশ্ন, যেমন একটা ঘটনা দেয়া থাকবে, এই ঘটনা থেকে কিছু বিষয় নির্ধারণ করতে হবে, এখন বল কোন থিউরি ব্যবহার করে এটা নির্ধারণ করা যাবে। বা ঘটনায় থিউরির কি কি বিষয় কাজ করছে, কিভাবে করছে?
এমন হতে পারে কোন একটা সমস্যা দেয়া থাকবে, থিউরি ব্যবহার করে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
থিউরি রিলেটেড ঘটনা এবং সমস্যা তৈরি করা টা শিক্ষকের সৃজনশীলতার প্রকাশ। ছাত্র সৃজনশীল হবার দরকার নেই। ছাত্রের দরকার চিন্তা করার ক্ষমতা তৈরি করা। এর জন্য শিক্ষকদের দায় ই বেশি। শিক্ষক ক্লাশে যে ধরনের শিক্ষা দিবেন বা যে উদ্দেশ্যে শিক্ষা দিবেন, ছাত্র ও সেভাবে ই শিখবে বা শিখার চেষ্টা করবে।
যে কোন প্রশ্নের উত্তরে ছাত্রের নিজস্বতা মুল্যায়ন করতে হবে। কোন ছাত্র নিজের মতো করে লিখল কম নম্বর পেল, কিন্তু কোন ছাত্র পঞ্চম শ্রেণীর বইয়ের কোন প্রশ্নের উত্তর কলেজ লেভেল বা তার উপরের কোন বই থেকে নোট করে লিখল তাকে বেশি নম্বর দেয়া হল এটা করা যাবে না। সঠিক উত্তরে নম্বর দিতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ই এই সব কঠিন কঠিন ভাষায় উচ্চমার্গীয় নোট তার শিক্ষক রা ই করে দেন এবং ছাত্র টা মুখস্ত করে খাতায় লিখে আসেন। বেশি নম্বরের আশায় সবাই সেই নোট এর পিছনে ছুটে।
৩৫ জন ছাত্রের জন্য এক জন শিক্ষক থাকবে। দরকার হলে স্কুল ডিজিটাইজ ২-৪ বছর পরে করা হবে। শিক্ষক ও স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
শিক্ষকের বেতন বাড়াতে হবে, যাতে তার ছেলে মেয়ের খাদ্য, বশ্র, বাসস্থান, শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের চিন্তা তাদের করতে না হয়। নিশ্চিন্তে স্কুলে পড়াতে পারেন। প্রাইভেট পড়াতে যাতে না হয়। কোন ছাত্র কে যদি ক্লাশের বাইরে পাড়ান ও, তা যেন শুধু ই অর্থনৈতিক না হয়। তা যেন হয় ছাত্রের প্রয়োজন।
ক্লাশে পড়ানো র ধরন বদলালে এবং প্রশ্ন পদ্ধতি বদলে দিলে, সৃজনশীল প্রশ্ন করার দরকার হবে না। কোচিং ব্যবসা এমনি বন্ধ হয়ে যাবে। ছেলে মেয়েরা বই পড়বে, যেমন তারা ভর্তি পরীক্ষার জন্য বইয়ের এই মাথা থেকে ঐ মাথা পড়ে।
এতো ভালো একটা লেখায় বানান ভুলগুলো চোখে লাগে
মন্তব্য করুন