আমার ১১০ টাকার ঘুম ;)
মার্চ মাসে কোয়ান্টাস যখন ঘোষনা করে যে ওরা ২০% ষ্টাফ ছাটাই করবে, তখন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনাই যে আমার কপালে কি পরিমান দুর্ভোগ আছে । আমার কাজ ছিলো রাতে। কোয়ান্টাস এয়ারওয়েজের ইন্টারন্যাশনাল ক্যাটারিং সার্ভিসে ছোট একটা জব করতাম। কাজ তেমন কিছুই না, সপ্তাহে ৬ দিন, রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত সারা রাত ঘুরাঘুরি। কোন সমস্যা হলে সমাধান দেয়া, ২৮টা ক্যামেরায় চোখ রাখা আর চান্স পেলেই ব্লগিং, ফোরাম আর ফেইসবুকে নৃত্য করা ।
এপ্রিল মাসের আমাকে একটা ইমেইল করে জানায় যে মে মাস থেকে আমার শিফটটাই এই লো ট্রাফিক সিজনের জন্য ক্যানসেল করা হইছে, তার মানে আমার কোন জব নাই... অক্টোবর থেকে জানুয়ারী পর্যন্ত প্রচুর লোক থাকে প্লেনে। সে সময়ে নাইট শিফট শেষ করে রাত ৩টার দিকে, মর্নিং শিফট শুরু হয় ৪টা থেকে। প্রায়দিনেই ২১~২৩ ঘন্টা কাজ চলে। ডাল সিজনে রাত ১০টা ১১টার মধ্যেই নাইট শিফট শেষ হয়ে যায়, মর্নিং আরম্ভ হয় ৫টা থেকে। কাজেই এ সময়ে আমার তেমন কাজ আসলেও থাকেনা ।
মাথায় বাজ পড়লেও মনে একটাই আশা ছিলো যে এই লাইনের অনেক দিনের অভিজ্ঞতা আর চেনা জানা লোকের সাহায্য পেলে কাজ পেতে দেরী হবেনা। অনেকদিন রাতে ঘুমাইনা, কাজেই সপ্তাহ খানেক ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম, শুধু খেতাম আর ঘুমাতাম । কিন্তু বিশ্বমন্দার ধাক্কা যে কি জিনিস সেটা টের পেলাম নতুন কাজ খুঁজতে বের হয়ে... দিন যায়, কোথাও নতুন কাজ পাইনা, সবাই শুধু বলে - ডাকবে, কেউ ডাকেনা, অনেকে বিরক্ত হয়ে ফোন ধরাই ছেড়ে দিলো। চারিদিকে শুধু ছাটাই আর ছাটাই। একটা উদাহরন দেই। আগে একজন ওয়ার্কার ফ্লোরে এক ঘন্টায় ৮০০ স্কয়ার মিটার কাজ করতে পারে বলে ধরা হোত, এখন সেটা রাতারাতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২০০ স্কয়ার মিটারে। তার মানে সোজা কথায়, আগে যেখানে ৩ জন লোক কাজ করতো, এখন সেখানে কাজ করবে দুজন। সমান তালেই কমে গেছে উপরের দিকের পোষ্ট গুলো। কাজেই যাদের জব আছে, তারা মাটি কামড়ে পড়ে আছে আর দুঃস্বপ্ন দেখছে যে এই বুঝি একটা ইমেইল ছাটাইয়ের বার্তা নিয়ে এলো। পার্ট টাইম ওয়ার্কার থেকে কর্পোরেট বড় কর্তারা - কেউই বাদ ছিলেননা ছাটাইয়ের লিষ্টে।
আমার চোখের সামনে তখন অন্ধকার, দিনের বেলা টর্চ জ্বালাইয়া চলার মত অবস্থা । মাঝে মাঝে টুকটাক কাজ করি, যে যখন ডাকে, তার কাজ করে দেই, কখনও রেষ্টুরেন্টে, কখনও ক্লিনিং, কখনও কম্পিউটার মেরামত। খাওয়া আর বাসাভাড়ার টাকা উঠানোই কষ্টকর।
এমন সময় নতুন একটা কন্ট্রাক্টের কাজের অফার পাই, সপ্তাহে ৭ দিন, সারা রাত কাজ। রাতে কাজ করতে এমনিতেও আমার কোন সমস্যা নাই, সমস্যা শুধু ছিলো ৭ দিন কাজ নিয়ে, কিন্তু সে সময়ে না করে দেবার সাহস বা অবস্থা কোনটাই ছিলো না। কাজ শুরু হয় জুলাই মাসের ৪ তারিখ থেকে। যে বিল্ডিংয়ে কাজটা, সেখানে আমি সিডনীতে নতুন আসার সময় কাজ করেছিলাম, কাজেই ভালই হলো আমার জন্য। এখানেও কাজ তেমন কিছুনা, নাইট শিফটের ওয়ার্কারদের দিকে নজর রাখা, আর কিছু পেপার ওয়ার্ক। সারা রাত জেগে থাকতে হবে দেখে নিজেই আগ বাড়িয়ে কিছু বাড়িতি কাজ নিয়ে নাই, আমি তো জানি যে ওরা কোন ভাবেই এই সময়ের মধ্যে সব কাজ শেষ করতে পারবে না, ফলে কাজের মান খারাপ হবে, তখন বস্দের প্রথম ঝাড়ী আমাকেই শুনতে হবে ।
সেই থেকে সপ্তাহে ৭ দিন কাজ করি... সকালে বাসায় ফিরে ঘুমাই, যদিও প্রায় দিনেই ঘুম হয়না। আমি যখন ঘুমাই, তখন বাকিরা (এই বাসায় ৫টা রুমে মোট ৯ জন ছেলে থাকে) জেগে ওঠে। ওরা শব্দ করে, আর আমার ঘুমের ১২টা বাজায়। কাজ চলে যাবার পর বেশী ভাড়ার হাউজ ছেড়ে দিয়ে কম ভাড়ায় শেয়ারে একটা রুমে উঠেছি, কাজেই খুব বেশী আশা করাটাও উচিৎ না। আমার একার ঘুমের জন্য তো ওরা রান্নাবান্না, গান শোনা, গল্প করা, হাসাহাসি বাদ দিয়ে দেবে না ।
প্রতিদিন একটু একটু করে জমতে থাকে আমার ঘুম। প্রথম দিকে সপ্তাহে কোন একদিন সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত ঘুমিয়ে পুষিয়ে নিতাম, পরে সেটাও বন্ধ হয়ে গেলো। সারা রাত কাজ করে এসে আমি বিছানায় চোখ খুলে জেগে থাকি, ঘড়ির কাটা দ্রুত সময় মেপে চলে - আমার ঘুম আর আসেনা। এদিকে রাতে আবার কাজ, সেটা মনে করে জোর করে ঘুমানোর চেষ্টা করি, কিন্তু ঘুমানো কি এত সহজ? ঘুম ঘুম চোখে কম্পিউটারের সামনে বসে থাকি, কিছুই ভাল লাগেনা। ব্লগ লেখা, ফোরামিং, ফেইসবুক, চ্যাটিং সব মাথায় উঠেছে। বাসায় কথা বলাও কমে গেছে অনেক। শুধু আদিত্য কথা বলতে চাইলে মানা নেই।... হয়তো অনেক সাধ্য সাধনা করে ঘুমিয়েছি, এমন সময় উনার কথা বলতে ইচ্ছে হলো পাপার সাথে, সে কথা ২০ সেকেন্ডের হলেও আমি কল দেই ওকে। আমার সন্তানকে আমি কাছে থেকে আদর দিতে পারিনা, সে কারনে ওর জন্য বাকি সব কিছুতে কোন কমতি রাখতে চাইনা।
একটানা ৪ মাস কাজ করে নভেম্বরের ৫ তারিখ থেকে ২ দিন ছুটি নিয়েছিলাম। কিন্তু সে সময়েও একটা খ্যাপের কাজ করেছিলাম বলে ঘুমানো হয়নি সেভাবে। তারপর থেকে আবার ভীষন কাজের চাপ যাচ্ছে। ভেবেছিলাম ক্রিসমাসে অন্তত একদিন ছুটি পাবো। কিন্তু এ বছরই প্রথম আর সবার সাথে আমাদেরও ক্রিসমাসে কাজ করতে হয়েছে । যা হোক, এর মাঝে গত কয়েক সপ্তাহ আমার ঘুমের মহা সমস্যা গেছে। ঘুমের অভাবে মাথা খারাপ হবার যোগার।
অনেক ভেবে চিন্তে আমার সাথে কাজ করে ইন্ডিয়ান একটা ছেলেকে ট্রেনিং দিয়েছি কয়েক সপ্তাহ যাতে মাঝে মাঝে ছুটি নিলে ও কাজটা চালিয়ে নিতে পারে। গত শনিবার রাত ছিলো আমার সেই কাঙ্খিত ছুটির দিন। সকালে ৬.৩০এর ট্রেন ধরে আমি বাসায় ফিরবো, মনের আনন্দে ট্রেনেই ঘুমিয়ে গেছি, জেগে দেখি আমার ষ্টেশনের পরের ৩ নম্বর ষ্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়লো মাত্র । কি আর করা, পরের ষ্টেশনে নেমে আবার উল্টোদিকে ফিরে এলাম। বাসায় পৌছুতেই আরেক বসের কল, "কাজে যাবেন? খ্যাপের একটা কাজ আছে"। যেহেতু রাতে আজ কাজ নেই, তাই মানা করার প্রশ্নই ওঠে না। সেই কাজ শেষ করে ফিরতে ফিরতে দুপুর ৪টা (এখন সন্ধ্যা হয় ৮.৩০'র দিকে )। বাসায় ফিরে দেখি রান্না নেই কোন, গরুর মাংস আর পুঁই শাক রান্না করে, গোসল করে, নামাজ পড়ে খেতে খেতে ৮টা বেজে গেছে। এরপর বাসায় একটু কথা বলে শুতে গেছি ৯টার আগেই। ৯.৪৫'এ এশার নামাজের সময়। কিছুক্ষন পরে উঠে নামায পড়ে নেবো মনে করে ঘুমিয়ে গেছি, সে ঘুম ভেঙ্গেছে পরদিন, মানে আজ দুপুর ১২.৩৮'এ। শনিবার রাতে কাজ করলে পেতাম ১১০ ডলার, তার বদলে পেলাম ১৫ ঘন্টা ঘুম, খারাপ না ... কি বলেন ...
জীবনটা ম্যালা কঠিন... দ্যাশে থাইকা বুঝিনা :(
না বুঝাই ভাল রে ভাই ;)
কঠিন অবস্থা
এখন অবস্থা অনেকটা ভাল :)
দেশে থেকে আসলেই বুঝিনা এত কঠিন জীবন। মনে হয় দেশেই অনেক ভালো আছি।
আসলেও অনেক ভাল আছেন দেশে ...
চোখের সামনে আরো একটা কষ্টের জলরঙে আঁকা ছবি ভেসে উঠল।
সকালেই পড়েছিলাম।
বিশ্বাস করেন কমেন্ট করার কোন ভাষা পাইনাই
ভাই, এটাই তো জীবন ... এসবের মাঝেও ভাল থাকি ... থাকতে হয় ...
কঠিন জীবন। পড়ে ভাল লাগছে বলা ঠিক হবে না মনে হয়।
ভাল লাগার কথাও না। এসব লিখতেও চাই না, কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয় টমের চেহারার আড়ালের মানুষটার সুখ দুঃক্ষ সবার সাথে শেয়ার করা উচিৎ ...
কি বলবো ভাইয়া?
মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা এত ঝামেলা আর কষ্টের কেন? কিন্তু তোমাদের এইসব কথা শুনলে তো মনে হয় "অনেক সুখে আছি"।
যেখানেই থাকো, ভাল থাকো। তোমার আদিত্য'ও ভালো থাকুক!
এই ঝামেলা আর কষ্ট আছে বলেই জীবন বৈচিত্রময় ...
ভাল থাকিস বুড়ী ;)
কমেন্ট করার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না....তবু দোয়া করি ভালো থাকেন।
দোয়াটুকুই দরকার ... ভাল থাকবেন ...
মানুষের যন্ত্র হয়ে যাওয়ার চুড়ান্ত উদাহরণ।
সব কিছুই নিয়তি ।
আমি পালাইতে চাই। কিন্তুক ইহা হবার নয় ।
অনেকের জন্য অবস্থাটা আরও বেশী খারাপ ... সেদিকে তাকিয়ে সান্তনা পাই ভাই ...
ঘুমের শান্তি টাকা দিয়ে কেউ পরিমাপ করতে পারে না।
রোজ অপেক্ষায় থাকি, এই বুঝি রিসেশন শেষ হুইসেল বাজছে আর আমরা যারা সূতার আগায় বসে আছি তারা প্রান ভরে নিঃশ্বাস নেবো।
সবকিছু মিলিয়ে ভালো থাকুন। একদিন যখন এদিন কেঁটে যাবে তখন দেখবেন মনে করতে কতো গর্ববোধ করছেন।
গত বছরের শেষের দিকে শুনেছিলাম রিসেশন শেষ। কিন্তু যে ক্ষতিটা হবার, তা তো হয়েই গ্যাছে। আগের চাইতে কাজের স্কোপ কমেছে, ফলে গড়পরতা কাজের পরিমানটা গ্যাছে বেড়ে। আগে যেসব কন্ট্রাক্ট 50K+ তে নেয়া হতো, এখন সেগুলো 29K তেও নেয়া হয়েছে। কাজেই রিসিশন কাটলেও আমার মত কামলাদের শান্তি পাবার কোন সম্ভাবনা নেই ...
ইউরোপে রিসেশন শেষ না। আজকে খবর পেলাম চাকরী টার্মিনেট করার লিষ্টে আমিও আছি। ফার্ষ্ট ইন ফার্ষ্ট আউট। চিয়ার্স।
কঠিন জীবনাচারের এমন অনবদ্য প্রকাশ! মাঝে মাঝে ১১০ টাকার ঘুম মন্দ নয়। ভালো থাকুন।
সেটাই রে ভাই ... এসবের মাঝেই বেচে থাকতে হয় :)
ঘুম হোক, মাগনা মাগনা...
তিথি আর আদিত্য কেমন আছে টম?
দোয়া রাইখেন নানী ;)
ওরা আছে ভালই। ছেলে আমার আজকে স্পোর্টসে দৌড়ে সেকেন্ড হয়ে ম্যাডেল পেয়েছে, অনেক খুশী সে, সাথে আমিও :D
অপনা কেমন আছে এখন?
ওয়াও গ্রেট নিউজ! আদিত্যের অনারে হয়ে যাক পার্টি।
অপনার তো স্কুল বন্ধ এই মাস পুরোটাই। ভোরে ওঠা নিয়ে যন্ত্রণা নাই। সে আছে খানাপিনার উপর।
কালকে পার্টি হইছে বাসায়, ফেইসবুকে ছবি দিবো আজকে। আপনার তো দেখা পাইনা সেইখানে :(
আমি নেক্সট মান্থে আসতে পারি অপনাকে দেখতে, সম্ভাবনা আছে যাওয়ার ;) ;)
:)
আরে ... গোল্লা যে :D
:)
স্বাগটুম আমার ব্লগে ;)
কিরাম আছো?
হ
আপনার সঙ্গে এই লেখাটি নিয়ে একটু কথা ছিল। দয়া করে guruchandali এর জিমেলে একটা মেল দিন। যদি karubasona এর জিমেলেও একটা কপি দেন ভাই খুবি কাজ হয়।
অপেক্ষা করছি।
সুমেরু
মন্তব্য করুন