অদৃশ্য দানব (শেষ পর্ব)
পার্কার হ্যানিফিন - যারা বোয়িং ৭৩৭ বিমানের রাডার কন্ট্রোল ইউনিটটি তৈরী করেছিলেন, তাদের সাথে কথা বলে অনুসন্ধানকারী দলটি বিমানের রাডার সংক্রান্ত বিষয়ে কোন সমাধানে পৌছাতে পারেন না। কাজেই তারা দৃষ্টি দেন সেদিনের আবহাওয়ার দিকে।
দুর্যোগপুর্ন আবহাওয়া বিমান দুর্ঘটনার প্রধান কারন গুলোর একটি। পার্বত্য অঞ্চলে বাতাস পর্বতের একপাশ থেকে অন্যপাশে যাবার সময় এক ধরনের ঘুর্ণীর সৃষ্টি করে, যা বিমানের জন্য অত্যন্ত বিপদজনক।
গ্রেগ সলোটলো - একজন আবহাওয়া বিশারদ সেদিনের আবহাওয়া পর্যবেক্ষন করেন এবং দুর্ঘটনাস্থলের আশেপাশে থাকা মানুষজনের সাথে কথা বলেন। কয়েকজন এলাকাবাসীর দেয়া তথ্য থেকে জানা যায় যে, ইউনাইটেড ৫৮৫ বিমানটির দুর্ঘটনার কিছুক্ষন আগে তীব্র দমকা বাতাস বয়ে যায়। কিন্তু সেদিনের আবহাওয়ার তথ্য, বাতাসের গতিপথ ও বিমানটির ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডারের দেয়া তথ্য কোন ভাবেই প্রমান করেনা যে দমকা বা ঝড়ো বাতাস এই বিমান দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডারে দেখাচ্ছে মাত্র ১০ সেকেন্ডে বিমানটি খাড়া ভাবে ওপর থেকে মাটিতে আছড়ে পরে। যা বাতাসের কারনে হতে পারেনা।
ইউনাইটেড ৫৮৫ বিমানটির দুর্ঘটনার ২১ মাস পরেও দুর্ঘটনার কোন কারন জানা যায়না। কিন্তু বিমান দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার কারণ খুজে পাওয়াটা অত্যন্ত জরুরী, কারন খুঁজে না পেলে একই ভাবে আরও বিমান এই ভাবেই দুর্ঘটনার মুখোমুখি হবে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে প্রায় দুবছর পেরিয়ে যাবার পরে এনটিএসবি কোন সঠিক কারন চিহ্নিত করা ছাড়াই তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করতে বাধ্য হন।
এনটিএসবির রিপোর্ট প্রকাশ হবার প্রায় দুবছর পর অদৃশ্য দানব আবার হানা দেয়।
১৯৯৪ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর। ইউএস এয়ার ৪২৭ বিমানটি ১৩২ জন যাত্রী ও ক্রু নিয়ে পিটসবার্গ এয়ারপোর্টে অবতরনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। বিমানটি থেকে ১০ কিলোমিটার সামনে ছিলো আরেকটি বিমান। বাতাসে বিমানের ইঞ্জিনের প্রচন্ড ধাক্কার ফলে যে পথে একটি বিমান যায়, সেখানে বাতাস এলোমেলো হয়ে থাকে। ব্যাপারটা শান্ত লেকের পানিতে চলা স্পীডবোটের ঢেউএর মতই। কিন্তু বাতাসের সেই ঢেউ বিমানের জন্য ঝুকিপুর্ণ নয়। ইউএস এয়ার ৪২৭ বিমানটি সেই ঢেউএর ভেতর পরে সামান্য ঝাঁকি খেয়ে ওঠে। এর পরপরই বিমানটি বা দিকে কাত হয়ে যায়। পাইলটদের শত চেষ্টার পরেও বিমানটি নিয়ন্ত্রনে রাখা সম্ভব হয়না এবং ২৩ সেকেন্ডের মাথায় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়।
বিধ্বস্ত বিমানের ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডারের তথ্য বিশ্লেষন করে অনুসন্ধানকারী দলটি এই দুর্ঘটনার সাথে পুর্বের ইউনাইটেড এয়ার ৫৮৫ এর দুর্ঘটনার মিল দেখতে পান। ইউনাইটেড এয়ার ৫৮৫ ডানদিকে উলটে গিয়েছিলো আর ইউএস এয়ার ৪২৭ উলটে গিয়েছিলো বাম দিকে। কিন্তু দুটি দুর্ঘটনার মাঝে একটি বিশাল পার্থক্য ছিল। তা হলো - ইউএস এয়ার ৪২৭ দুর্ঘটনার দিনে বাতাসের গতি অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল।
এবারেও অনুসন্ধানকারী দলটি বিমানের রাডারটি সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করেন। কিন্তু ফলাফল শুন্য। কোন অস্বাভাবিকতা দেখা যায় না ইউএস এয়ার ৪২৭ এর রাডারে। বিচিত্র কোন কারণে এবারেও দুর্ঘটনা কবলীত বিমানটির রাডার সম্পুর্ন রুপে বামদিকে ঘোরানো ছিলো। অথচ ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডারের দেয়া তথ্য মতে রাডারটি ডান দিকে ঘোরানোর জন্য পাইলট চার্স এমেট তার রাডার প্যাডেল সম্পুর্ন ভাবে চেপে রেখেছিলেন।
যথাযত ভাবে তদন্তের পর এনটিএসবির রিপোর্ট প্রকাশীত হয় যাতে দুর্ঘটনার কারন অজানা বলে উল্লেখা করা হয়। কিন্তু এটা খুবই অস্বাভাবিক। তিন বছরের মধ্যে দু দুটো একই ধরনের বিমান দুর্ঘটনা, শতশত মানুষের প্রানহানী, কিন্তু কারন অজানা - এটা মেনে নেয়া যায়না। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে এধরনের আরেকটি বিমান দুর্ঘটনাকবলীত হলে বোয়িং ৭৩৭ বিমানগুলোকে নিষিদ্ধ করে দেয়া হতে পারে।
জুন ৩, ১৯৯৬ - ইস্টউইন্ড ফ্লাইট ৫১৭ রিচমড ভার্জিনিয়া এয়ারপোর্টে অবতরনের প্রস্তুতি নেয়ার সময় হঠাৎ ডানদিকে বেঁকে যায়। পাইলট ব্রায়ান বিশপ বা দিকের রাডার প্যাডেল চেঁপে বিমানটি সোজা করার চেষ্টা করেন, কিন্তু রাডার প্যাডেলের ওপর যথেষ্ট চাপ দেবার পরেও তিনি প্যাডেলটি নাড়াতে পারেননি। কাজেই বিশপ বিমানের ডান দিকের ইঞ্জিনের শক্তি বৃদ্ধি করেন যা বিমানটিকে উলটে যাবার হাত থেকে রক্ষা করে। প্রায় ২৭ সেকেন্ড বিমানটি ডানদিকে কাত হয়ে থাকার পরে অজানা শক্তিটি বিমানটি ছেড়ে দেয়, ফলে বিমান পুনরায় সোজা হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে পাইলটরা যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করতে শুরু করেন। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরেই বিমানটি আবারও ডান দিকে কাত হয়ে পাইলটের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। এবারেও প্রায় ৩০ সেকেন্ড পর বিমানটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
পাইলট ব্রায়ান বিশপ এয়ারপোর্ট নিয়ন্ত্রন কক্ষকে জানান যে তার বিমান নিয়ন্ত্রন করতে সমস্যা হচ্ছে এবং তার কো-পাইলটকে বলেন আশেপাশের নির্জন কোন এলাকা খুজে বের করতে কারন এরপর আরেকবার বিমানটি কাত হয়ে গেলে বিমানটিকে রক্ষা করার আর কোন উপায় থাকবে না, কাজেই তারা ঘনবসতিপুর্ন কোন এলাকায় যাতে বিমানটি বিধ্বস্ত না হয়, সেই চেষ্টা করবেন।
কিন্তু বিমানটি নিরাপদেই রানওয়েতে অবতরন করে।
পরদিন সকালেই বিমান দুর্ঘটনা অনুসন্ধানকারী দলটি রিচমন্ডে পৌছে যান। তারা বিমানের ও পাইলটের দেয়া তথ্য থেকে পুর্বের ইউনাইটেড এয়ার ৫৮৫ ও ইউএস এয়ার ৪২৭ বিমান দুর্ঘটনার সাথে এর সামঞ্জস্য খুঁজে পান। কিন্তু এবারে তাদের হাতে রয়েছে একটি সম্পুর্ণ বিমান ও দুজন জীবিত পাইলট, ফলে তার বুঝে যান যে যদি তারা এই বিমানের রহস্য উন্মোচন করতে পারেন, তাহলে পুর্বের বিমান দুর্ঘটনা দুটির সমাধান বের করতে পারবেন।
ক্যাপ্টেন ব্রায়ান বিশপের দেয়া তথ্য মতে - যখন বিমানটি ডান দিকে বেঁকে যায়, তখন তিনি রাডার প্যাডেলের ওপর প্রায় দাঁড়িয়ে থেকেও রাডার নাড়াতে ব্যার্থ হন।
অনুসন্ধানকারী দলটি এবার নিশ্চিত হয়ে যান যে বোয়িং ৭৩৭ এর রাডারটি কোন ভাবে এই সব দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। তাই তারা রাডারের দুর্বলতা খুজে বের করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। সেনাবাহিনীর এক ইঞ্জিনিয়ারের কথামত তারা রাডারের ওপর থার্মাল শক টেষ্ট চালান। এই পরীক্ষায় রাডারটিকে প্রথমে প্রচন্ড ঠান্ডায় (শুন্যের নীচে ৪০ ডিগ্রী তাপমাত্রায় - যা ১০০০০ ফিট উচ্চতায় বাতাসের স্বাভাবিক তাপমাত্রা) কিছুক্ষন রাখা হয়, পরে রাডারটির ভেতর প্রচন্ড উচ্চ তাপমাত্রার হাইড্রোলিক ফ্লুইড প্রবাহীত করা হয় এবং রাডার নড়াচড়ার কমান্ড দেয়া হয়। অনুসন্ধানকারীরা দেখতে পান কিছুক্ষন ঠিক ভাবে কাজ করার পর রাডারটি হঠাৎ থেমে গেলো।
তাদের ব্যাক্ষায় অনুসন্ধানকারী দলটি বলেন যে - অনেক উঁচুতে ওড়ার সময় বোয়িং ৭৩৭ বিমানের রাডার প্রচন্ড ঠান্ডা হয়ে যায় এবং পরে অবতরনের জন্য নিচে নেমে আসায় কোন কোন ক্ষেত্রে রাডারটি জ্যাম হয়ে যায়, শুধু তাই না - অনেক ক্ষেত্রে রাডারটি ডান দিকে ঘুরানোর জন্য কমান্ড দিলে রাডার বা দিকে ঘুরে যায়।
এনটিএসবির তথ্য মতে বোয়িং কতৃপক্ষ তাদের বিমানের রাডারের নকশা বদলে ফেলেন ও যে সমস্ত বিমানে ওই মডেলের রাডার সংযুক্ত করা ছিলো, সেগুলো বদলে দেন। এরপর এ ধরনের বিমান দুর্ঘটনা এখন পর্যন্ত আর ঘটেনি।
দারুণ! আমি বাসার ছোটদের পড়ে শোনাব।
ইহা ছোটদের জন্য লিখিত কল্পকাহিনী নহে
পড়লাম পুরাটা। আমি এই পর্বটা দেখেছি, চিনতে পারলাম। চমৎকার লিখেছেন।
অনেক ধন্যবাদ
একটা রোমাঞ্চকর সিরিজ অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে পড়লাম। আরো আরো আরো এমন জিনিস পড়তে চাই
মন্তব্য করুন