গীত --আপনারে চিনি
নীলফামারী জেলার হারিয়ে যাওয়া কিছু গীত । যা আমাদের ঐতিহ্য। আমাদের পরিচয় আমাদের স্বকীয়তা। এই লেখাটা লিখলাম মনের বেদনা থেকেই।
এই গীতগুলি সংগৃহিত। বেশীরভাগ গীতই মহেশ চন্দ্র রায়ের লেখা। সংগ্রহ করা হয়েছে মর্জিনা চৌধুরীর লেখা থেকে। এই সব গীত গাইবার সময় কোন বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয় না।
নতুন শিশুর জন্মের সময়কে তারা গীতের মাধ্যমে প্রকাশ করে। এই গীত অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয় বাচ্চার চুল কাটার আনুষ্ঠানে। যা নবজাতক জন্মের তিন থেকে ছয় দিনের দিন অনুষ্ঠীত হয়।
প্রসব বেদনাকে এই ভাবে প্রকাশ করা হয়---
দিদি শাক তুলিবার গেনু পাটিবাড়ী ও মোর দিদি- ( পাটিবাড়ী= পাট ক্ষেত)
দিদি ওঠে উঠে মোর প্যাটের বিষ ও মোর দিদি
দিদি ঘরের সোয়ামিক হামার ডাক দিয়া যাও----
ডাকি আনুক কবিরাজক রে দিদি
এর পর শুরু হয় পাসটি গীত । পাসটির একটি গীত হল---
পাসটির বাড়ীর গুয়াপান (পাসটি= আতুর ঘরের মা ও শিশু)
সবাই মিলি খাবার যান
কাজীর বাড়ীত পাসটি নাগিছে
বড় সাধের পাসটি রে-
হামরা না যাম মাও পাসটি দেখিবারে
হাটো হাটো ভাবী পাসটির বাড়ী যাও রে।
এরপর নাপিতকে নিয়ে পরে সবাই।
তোর নাউয়ার সোনার ক্ষুর (নাউয়া= নাপিত)
মোরবারে নতুন চুল
ওরে ভাল করি কামাবুরে নাউয়া
ভাল ধুতি পাবু।
ওরে মন্দ করি কামাবুরে নাউয়া
ন্যাদাই পায়া যাবু (ন্যাদাই= লাথি)
বাচ্চার মুখে প্রথম ভাত তুলে দেবার অনুষ্ঠানের নাম মুখে ভাত। এই অনুষ্ঠানে মেয়েরা গায় ---
ক্ষীর খারে ছাইলা ক্ষীর খা
তোর মার হাতের ক্ষীর খা
মার ডিম বেচার টাকা পামো
তবে না হ্যামরা খামো
মার হাতের ক্ষীরও।
এই ডিম বিক্রী হয় অর্থাৎ বিয়ে। এবারে বিয়ের আসরের গীত।
বর অথবা বউ পক্ষের তরফ থেকে বিয়ের সামগ্রী দেখে পরিজনদের উক্তি---
উত্তর হাতে আইল ডালা
ডালা দেখিতে সোন্দর হে
ঐ না ডালাত ন্যাখা আছে
শালা-শালীর জ্বালা রে\ শ্বাশুরী-ননদের জ্বালা রে।
বরের আগমনে কল্পিত হাতি ও পালকি নিয়ে রচিত গীতে যছে কৌতুক---
হাত্তি আইসে দোমে দোমে
পালকি কতই দূরে
আরে আসরে আসিয়া দামান
পালকি কতই দূরে-
আস্তে করিয়া থোন পালকি
বাবার খুলি য্যান না ভাংগি (খুলি=ঊঠান)
বাবার খুলি ভাঙ্গিয়া গেইলে
হইবে জরিমানারে----
এরপর হয় বরের ভাইকে নিয়ে হাস্য রস
মুইকি জানোরে গাবরুর ভাই (গাবরু=বর)
তোর বড়ই গৌরপ- (গৌরপ=অহংকার)
হাটুয়ার উপর লুঙ্গিরে পিন্দিচিস (হাটুয়া=হাটু, পিন্দিচিস=পরেছিস)
ঠিক বাদিয়ার ঢক (বাদিয়া= চর্মকার, ঢক= ঢংগে)
মেয়েকে গয়না পরানোর সময় গাওয়া হয়-
বরের বাপ আইনছের সোনা
ভরা সাবার মাযেরে বাপধণ
দেখিয়া যাও নাইটেরও শলকেরে।
গলায় শোবে তোর হাজার টাকিয়ার হারোয়া
নাকে শোবে তোর পাশে টাকার নাগোয়া
দূরে বিয়ে না দেবার আকুতি জানিয়ে কুমারী মেয়েরা গীত গাইতো
দয়াল দাদা ও
দূরান্ত্রোত মোক না খান বেচেয়া
হয় যদি মোর গোরত বিয়াও
পাঁচটা হৈত্তকী দিয়াও
সেও ভালো মোর সোয়ামি হোক হালুয়া।
কনে কৃষক বরের পানি গ্রহন করতে প্রস্তুত কিন্তু তবুও দূরে বিয়ে করতে চায় না। আরও দেখাযায়--
ও আবো তুই মরিয়া গেইলে
এ নাইওর মোক কায় নিগাইবে
নাড়, চিড়া, মুড়কি, বোকনা
কায় পাঠে দিবে ?
আবো অর্থ নানী। এই গীতে নানী নাতিনীর ভালবাসা ফুটে উঠেছে।
আমাদের দেশে অনেক লোয়াচার এবং সামাজিকতা ছিল। যা বাঙ্গালীর একান্ত নিজস্ব উৎসব হিসাবে পরিচিত ছিল। এই উৎসবগুলি ধর্ম, মত, জাত কোন কিছু না মেনেই পালন করা হত। এ বাঙ্গালীর সংস্কৃতির অংশ। যা বাঙ্গালীকে পরিচিত করতো সারা বিশ্বের কাছে আলাদা ভাবে। এখন ধর্ম ও বিদেশী সংস্কৃতির চাপে তাপে সেই সব উৎসব হারিয়ে গেছে, যা আছে তাও যাচ্ছে। বিদেশী সংস্কৃতি আসবে আমরা তা অবশ্যই গ্রহন করবো এবং আমাদের সংস্কৃতি তাদের মাঝে ছরিয়ে দেব। আমাদের ভালটুকু বা আনন্দের সাথে ওদের আনন্দ আসবে তবেই না সমাজ এগিয়ে চলবে। সময়ের দাবীকে মেনে নিতেই হবে।
এই ক্ষেত্রে আমার যুক্তি একটু ভিন্ন। যদি ধর্মের আগ্রাসন এভাবে না বিস্তার লাভ করতো তা হলে বিদেশী সংস্কৃতি এই রূপ প্রভাব ফেলতো না। আমাদের কাছে ইসলাম ধর্মকে কঠিন কঠোর করে তুলে ধরা হয়েছে। একটু কিছুতেই পাপ। পায়ের গোড়ালির একটু উপরে দেখা গেলে পাপ, গান গাইলে পাপ, নাচলে পাপ, মাথা না ঢাকলে পাপ, নামাজ না পড়লে পাপ, সেই নামাজ অবশ্যই কঠিন পর্দা মেনে পড়তে হবে না হলে পাপ, জোরে কথা বলা পাপ, জোরে হাঁটা পাপ, হাসা পাপ, চুল দেখা গেলে পাপ, বেগানা পুরুষ দেখলে পাপ, স্বামী যতই চাড়াল হোক তাকে তালাক দেয়া পাপ, টিভি দেখা পাপ, পাপ পাপ আর পাপ।
এর সাথে যুক্ত হয়েছে জন্মদিন পালন করা পাপ, কেক কাটা পাপ। কারন এটা খ্রিষ্টানরা করে। তাহলে তো ইংরেজী পড়া পাপ কারন তা খ্রিষ্টানদের ভাষা। কম্পিউটার ব্যবহার, ফেইসবুক ব্যবহার, বিভিন্ন প্রযুক্তির ব্যবহার সবই পাপ। বাংলায় কথা বলা পাপ কারন তা হিন্দুদের ভাষা অর্থাৎ মুসলমানরা এই উপমহা দেশে আসার আগে আমাদের পুর্বপুরুষেরা তো সব নিম্নবর্ণের হিন্দু ছিল। সমাজের উচ্চশ্রেনীর মানুষের নির্যাতন থেকে বাঁচবার জন্যই তারা অন্য ধর্ম গ্রহন করে। এই উপমহাদেশ সম্পুর্নই বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মাবলম্বিদের। পরবাসী মুসলমানেরাই।
কোন কথা থেকে কোথায় চলে গেলাম। লিখতে বসেছি কিছু গীত। যা উত্তর বঙ্গের হারিয়ে যাওয়া কিছু সংস্কৃতি। এখনও কোন কোন বাড়িতে এই সব অনুষ্ঠান হয়। সবচেয়ে মজার ব্যপার আর্থিক ভাবে ও সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিতদের মধ্যে এই লোকাচার অনুষ্ঠানে কোন অসুবিধা নাই, অসুবিধা যদি ভিন্নধর্মী কেউ করে বা দরিদ্র কেউ করে তবেই ফতোয়া জারি হয়।
সুন্দর, কৃতজ্ঞতাবোধ জাগানিয়া লেখা।
বাহ্।গীতগুলা তো দারুণ! এসব তো জান্তামই না! থ্যাংকুস রুনাপা।

অন্যরকম স্বাদ, ভাল লাগলো।
আপা অনেকদিন পর লিখলেন, ভাল আছেন তো?
আজকাল কয়জন ধর্ম মেনে চলে বলেন?
ধর্ম তার কথা বলবেই, তা সহজ করে শুনলেই হল।
আমার মনে হয় না ধর্ম আমাদের সংস্কৃতিকে বিদেশি সংস্কৃতির চাইতেও বেশি প্রভাবিত করছে।
বেশ লাগলো!
পাপিষঠা তোমার কি হবেগো!!!!
ইবাদত করো লাইনে আসো
আমাকে শূলে চড়িয়ে শিক কাবাব বানাবে তারপর লবন দিয়ে খাবে--- আমারেও একটু নিশ্চই খেতে দেবেন কারন খোদা দয়াময়
চর্যাপদ থেকে বাংলা বিবর্তন কিভাবে হল--এই লেখাটা আমার কাজে আসবে।প্রিয়তে নিলাম
নীলফামারী এলাকাটায় যাওয়া হয়নি। কুড়িগ্রাম গিয়েছিলাম একবার তাও আবার একদিনের জন্য। বাল্যবিবাহের দাওয়াতে
নতুন লেখা কি আসবে না?
মন্তব্য করুন