রেইন মেশিন!
মনটা কিছুটা উদাস। উদাস হবার নানান কারন, তবে এই মুহূর্তে সব চেয়ে বড় কারন হলো মামার অসুস্থতা ও অপারেশন পরবর্তী অবস্থায়। হুট করেই মামা অসুস্থ হয়ে পড়লো, হাসপাতালে এডমিট ও এপেন্ডিসাইটিস অপারেশন। সব কিছু এত জলদি হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। যদিও আমি কিছুই করি নাই, সব কাজ মামীর বাড়ী আর খালার বাড়ী লোকেরাই করলো তবুও অবাক লাগে। কত কিছু হয়ে যায়, ঘটনার আকস্মিকতায়, যা বুঝে উঠতেই সময় লেগে যায়। আমি অবশ্য সব জায়গাতেই পর্যবেক্ষক, করার তেমন কিছু নাই আর আগ বাড়িয়ে করিও না। সবার ধারনা আমাকে কিছুই স্পর্শ করে না, তাই কিছুতেই আমি থাকি না। আসলে ব্যাপারটা এমন না, ব্যাপার হলো আমি খুবই অসামাজিক ভাবে নিরাসক্ত মানুষ, নিজের বস্তায় বস্তায় আসক্তি ও আবেগ নিজের কাছেই গোপন রাখি। তাই মামার এই সাময়িক অসুস্থতা আমাকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে। উত্তরায় স্কলাস্টিকার পাশে যে মেডিকেল কলেজ আছে সেখানের কেবিনে মামাকে রোজ দেখতে যাই, কিছুক্ষণ থেকেই আবার বাসে করে সোজা মোহাম্মদপুরে এসে পড়ি। ভালো লাগে না আমার হাসপাতাল। দেশের সব হাসপাতালই আমার কাছে একই লাগে। সাদা দেয়াল, লিফট, সিড়ি, বেড, ওয়ার্ড, মানুষজন, রোগী সবাইকেই দেখে মনে হয় এরা সব অসুস্থ। কেমন যেন বিষাদের এক প্রান্তর। অনেকেই হাসপাতালকে ভালোবাসেন, জন্ম মরন আনন্দ বিষাদের এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষন ভাবেন, আমি তেমন কিছুই ভাবি না। হাসপাতালে থাকতেও চাই না, রোগী দেখতেও চাই না, চাই আমার যেন হাসপাতালে যেতেই না হয় খুব একটা।
উত্তরায় যাই বাসে করে আর মেজাজ খারাপ হয়। উত্তরাকে- মানুষ ঢাকার ভেতরে ধরে কেন, তাই বুঝি না। রূপকথা নামের এক বাস আছে ভাড়া নেয় শ্যামলী থেকে পাক্কা ৩২ টাকা। সাথে শিশুমেলা যেতে রিকশা ভাড়া ২৫ টাকা, আরো ১০০ টাকা খরচ করলেই ট্রেনে সুলভ শ্রেনীর সিটে জামালপুর যাওয়া যায়। তবে উত্তরার একটা জিনিসই আমার ভালো লাগে তা হলো কিছুটা ছিমছাম অঞ্চল। ছোট্ট রাস্তায় রিকশা আর বড় রাস্তায় বাস এই ছাড়া উত্তরাবাসীর জীবনে কিছু নেই। আমাদের মত রিকশা করে নিউমার্কেট কিংবা পুরান ঢাকা যাবার আনন্দ তারা এ জীবনে পাবে না। অদ্ভুত সব লোকাল বাস আর আজাইরা ভাড়া নেয়া সিটিং বাস এই তাদের ভরসা। নয়তো সিএঞ্জি নিয়ে কার্য উদ্ধার করা ছাড়া উপায় কি? অথচ উত্তরাকেই কিন্তু আমার আপন করে নেয়ার কথা ছিল। কারন ২০০৬ ও ২০০৭ এই দুটো বছর আমি সমানে চিনতাম শুধু উত্তরাই। কোনোভাবে একশো টাকা ম্যানেজ হলেই উত্তরা, কারন বন্ধু কামরুল থাকতো। ও থাকতো ওর কাজিনের সাথে একটা বাড়ীতে। আমি কত বকা খেয়েছি এই উত্তরা সফরের জন্য তাও সময় পেলে উত্তরাতেই যাওয়া। দুই বন্ধু মিলে কত গল্প কত আড্ডা হাউজবিল্ডিংয়ের সেই বাড়ী আর লাগোয়া চায়ের দোকানে। চায়ের দাম ছিল তখন ৩ টাকা। দুই বন্ধু আঠারো টাকার চা খেয়ে সেই দোকানের টুলে ৬ ঘন্টা পার করতাম। চিটাগাংয়েও সেইম আড্ডা জীবন ছিল, উত্তরাকে তখন মনে হতো আরেক চিটাগাং। আর চিটাগাং থেকে কেউ আসলে তো কথাই নেই, মনে হয় আমরা স্বর্গে আছি। ২০০৮ সালে কামরুল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী অনার্স ছেড়ে দিয়ে চিটাগাং চলে গেল। আর আমিও সেদিক যাওয়া বাদ দিলাম। আগে বেভকো নামের এক এসি বাস ছিল, সেই বাস দেখলেই আমার উত্তরায় যাবার পিনিক উঠতো। এখন উত্তরার নাম শুনলেই গায়ে জ্বর আসে। খালার বাসা, কাজিনরা এত ভালোবাসে তাও ঠেকায় না পড়লে যাবার নাম নেই না। এখন মামার শ্বশুরবাড়িও সেই তল্লাটে, এতবার জোরাজুরি করে আমাকে নিতে পেরেছে একবার মাত্র।
সেই কামরুলও আগের কামরুল নেই। জীবন নিয়ে সেই অসামাজিক এক্সপেরিমেন্টাল ছেলে এখন পুরোদস্তুর ক্যারিয়ারিস্ট। ভালো একটা আইটি কোম্পানীতে মার্কেটিংয়ে ভালো জব করে, রাত নয়টা অবধি অফিস, তার সাথে দুটো টিউশনি। শনিবারে ঢাকায় ছিল, আমার সাথে আড্ডা মেরেছে তিন ঘন্টা, বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছে সন্ধ্যায়, মিরপুরে আত্মীয়ের খোজ নিয়েছে, অফিসে এমডির সাথে মিটিং করছে, রাতের বাসে চিটাগাং। আমি তাঁর টাইম ম্যানেজমেন্ট দেখে পুরো মুগ্ধ। কত পাল্টে যায় মানুষ। আর আমি যেখানেই যাই সেখানেই যাই সেখানেই বসে থাকি। বসে থাকার ফজিলতে ভুড়ি বাড়ছে শুধু। প্রতিদিন ভাবি সকালে হাটবো, ঘুমোতেই যাই সকালে। সাড়ে দশটায় ঘুম থেকে উঠে মেজাজ বিগড়ায়, বুয়ার বানানো একমন তেলে ভাজা আলুভাজি আর ঠান্ডা রুটি খেয়ে দিন শুরু করি। হিটারে চা খাই আর 'হৃদকলমের টানে' সৈয়দ হকের লেখা বইটা পড়ি আস্তে আস্তে। অসাধারণ লাগে প্রতিটা পাতাতেই। কি দারুন লেখার স্টাইল ও শব্দ চয়ন- খালি মুগ্ধ হই। আগে হক সাহেবকে আমার বিশেষ ভালো লাগতো না, এখন অবাক হই তাঁর লেখার ক্ষমতা দেখে। কোনো লোক ভালো বাংলা লিখতে চাইলে হক সাহেবের গদ্য মাস্ট পড়তে হবে। কবিতা কিংবা নাটক আমি বুঝি না অতো, কিন্তু তাঁর গদ্যের শক্তিময়তা যারা পড়ে নাই তারা বুঝবে না তিনি কেন এত দুর্দান্ত!
গনজাগরন মঞ্চ নিয়ে নাটক চলছে। এই প্রেক্ষিতে সবচাইতে বেশী খুঁজি শাহবাগের নাম শুনলেই যাদের চুলকানি হয় তাঁদের। তাঁর ভেতরে দেশে চলতেছে ৫৭ ধারার খড়গ। মঞ্চ কি করবে তা তাঁদের হেডেক, কিন্তু আমি এখনও বুকে- চিন্তায় -কথায় -স্বপ্নে শাহবাগকে বিশ্বাস করি। সব মিলিয়ে মাঝে মাঝে মনে হয় বিএনপি জামাতের শাসনেই দেশ চলছে। রাজীব নামের এক ছেলে ছাত্রলীগের বিশাল নেতা মোহাম্মদপুরে, সে দিনে দুপুরে বেড়ীবাধ থেকে চাদা তুলে আর ভরা মজলিশে মুক্তিযোদ্ধা পেটায়। এদের সাহস শুধু বাড়ছেই, বিএনপি আসলেও নতুন রাজীব আসবে নতুন ভাবে নানান নৈরাজ্য হবে। তেলেগু ব্লকব্লাস্টার হিট এক সিনেমা আছে নাম 'লিডার'। সিনেমাটা এক ব্যাতিক্রমী সাউথ ইন্ডিয়ান মুভি। সিনেমায় রানা দুগ্গাবাতি থাকে এক মুখ্যমন্ত্রীর সন্তান, যে মুখ্যমন্ত্রী ব্যাপক দুর্নীতিগ্রস্থ। বিদেশ থেকে সে আসে, এসে রাজনীতিতে নেমে দেখে ভালোভাবে চলার কোনো পথ নাই। নিজেও ঘুষ দেয় দলে নিজের প্রভাব বাড়াতে। ক্ষমতায় যেয়ে কালো টাকার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও, ঝানু রাজনীতিবিদ হয়ে যায়। সমাজ পাল্টাতে এসে নিজেই পাল্টে যাই। যখন যাকে দরকার এই বেসিসে সবার সাথে খাতির রাখে ও প্রেম করে। তার মা মৃত হবার আগে ডায়লগ দেয়, তোকে লিডার বানাতে চেয়েছিলাম, তুই রাজনীতিবিদ হয়ে গেলি। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদেরা লিডার হওয়া তো দূরে থাক, পলিটিশিয়ানও হতে পারে নাই। হয়েছে নিম্নশ্রেনীর বাটপার ও কমিশন এজেন্ট। আর আমরা নাগরিকেরা রাজনীতি সচেতনতার নামে হয়েছি চরম ভাবে রাজনীতি বিমুখ!
আজ হালকা গোছের বৃষ্টি হলো, ভিজলাম ইচ্ছে করেই। মনে হলো আরো অনেক বৃষ্টি দরকার, স্রষ্টা বা প্রকৃতি যদি না দেয় তাহলে এফডিসি থেকে একটা রেইন মেশিন ভাড়া করতে হবে। শুনেছিলাম রেইন মেশিনের নাকি অনেক ফোর্সে পানি ঝড়ে, যান্ত্রিক হলেও তো বৃষ্টি, তাতেই না হয় ভেসে যাক সব দুঃখ সুখ, ভুলিয়ে দিক জীবনের প্রাপ্তি আর হতাশার সব বোরিং গল্প!
বেভকোর এসি সিরাম কড়া ছিল।
হসপিটাল নিয়া আমারও এলার্জী আছে! মামা কয়দিন থাকতে হইব ওইখানে?
শাহবাগকে যে যার মত ইউজ কইরা নিছে, চোষা আম হৈয়া গেছে মনে হয় আমার কাছে। স্টিল জাগরন মঞ্চ কম হৈলেও কম কিছু দেয় নাই বইলাই আমার বিশ্বাস।
মাঝখানে একদিন মিরপুরে দেখছিলাম মেশিন দিয়া একটা মাঠরে গোসল করাইতাছে, সিরাম আফসোস লাগছিল ভিজতে পারিনাই বইলা।
বেভকো বাসটা চরম লাগতো আমার!
ভালো জিনিসের নাম বলছো তো, খোজ নিতে হবে!
মামা এখন শ্বশুরালয়ে, মোটামুটি সুস্থই!
মামা সুস্থ হোক জলদি।
ঢাকা শহরে আমাদের মত আমজনতার জন্য যাতায়াত একটা বিরাট সমস্যা। সি এন জি ভাড়া তো বিমান ভাড়ার কাছাকাছি হয়ে যাবে কিছুদিন পর। রিক্সায় বেশীক্ষণ বসে থাকলে ব্যাকপেইন আর বাসে উঠার যে কত ঝামেলা! মনে হলেই কোথাও যেতে মন চায় না। আসলে ঢাকা শহরের বহিরাগত এই আমি ঢাকাতে একদমই মন বসাতে পারি না আজকাল।
শাহবাগ, গণজাগরণ মঞ্চ, রাজনীতি এসব লেবু কচলাইয়া তিতা এখন।
বই পড়ার আনন্দ থাকুক আজীবন।
একটা ঝুম বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকি
থ্যাঙ্কস আপু
আপনিও ভালো থাকবেন
নিদারুন সত্যি
কি আর করা, এমন আক্ষেপ করেই কাটাতে হবে আমাদের!
মামার জন্য থাকলো অনেক অনেক শুভ কামনা।

কবে রেইন মেশিন ভাড়া করবেন? আমারে আওয়াজ দিয়েন। আমি চলে আসবো রেইন মেশিনের বৃষ্টিতে ভিজতে। হোক রেইন মেশিন। বৃষ্টিতো!
আসবেন কেমনে ফেসবুকে তো যোগাযোগ নাই!
রেইন মেশিন ! সুন্দর বটে !
ধন্যবাদ!
তবু ত দিনগুলো চলে যায় ঐ লোকাল বাসের সীটে বলেই ! আফসোস। মামার জন্য শুভ কামনা ।
শুভেচ্ছা
মন্তব্য করুন