আটপৌরে দিনগুলো!
ঝুলছে একটা পোষ্ট, প্রথম পাতার দেয়ালে। নিজেকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজী না করতে পেরেই এই পোষ্টটা লিখছি। তবে আদৌ নিশ্চিত না যে পোষ্টটা প্রথম পাতায় দিচ্ছি কিনা। তাও লিখছি, লিখতে তো কোনো দোষ নাই। অদ্ভুত এক দিন কাটলো আজ। সাধারণের ভেতরই অসাধারণ। এমন না যে খুব সিগনিফিকেন্ট কিছু ঘটছে বা করছি, তবুও দিনটা খুব ইন্টারেষ্টিং ভাবে কাটলো। এরকম ইন্টারেষ্টিং দিন আগে সমানে কাটাতাম, এখন কালে ভদ্রে আসে। টিভিতে একটা এ্যাড দেখায়, রোশন সাহেব বলেন কোন সুগন্ধি ইউস করতে আর তা করলেই নাকি হবে বি ইন্টারেস্টিং। আমি অবশ্য কোনো সুগন্ধিতে নাই, গায়ে ঝপজপা ঘামের গন্ধই আমার নিত্য দিনের সঙ্গী। নতুন বইয়ের পাতার ঘ্রান আর সুবাস ছড়ায় এমন ফুল ছাড়া, আর কিছুই ভালো লাগে না নাকে। তবে আমার যে বন্ধু ছিল, যার উপরে কিশোর বেলার প্রেম প্রেম ব্যাপার ছিল তাঁর গায়ের গন্ধ খুব আকর্ষণ করতো। রিকশায় কিংবা এক সাথে যখন বসে থাকতাম, কোচিংয়ে পাশে বসে আড্ডা দিতে দিতে, বড়ই নিস্তব্ধ নিস্তরঙ্গ মোহে আবিষ্ট হতাম। অদ্ভুত এক ক্ষমতা নাকের নাকি মাথার, যে সেই ঘ্রান এখনো আমি চাইলে আবিষ্কার করতে পারি। বছর দুয়েক আগে যখন দেখা হয়েছিল তখন অনেক চেষ্টা করেও সেই গন্ধ আর নাকে লাগে না। আমাদের মন খুব অদ্ভুত এক জিনিস, কত কিছুর সংমিশ্রনে কত রকমে কত কি নিয়ে ভাবে ও সেই ভাবনার পালে হাওয়া লাগাতে একটা সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয়।
আজকাল ঘুম ভাঙে তিন দফায়। প্রথম দফায় সাড়ে ছটায়। তখন বুয়া আসে সকালে নাস্তা বানাতে। কিভাবে যে আমি দরজাটা খুলি তাতে নিজেই অবাক হই। আর বুয়া শেল্ডন কুপারের সম্ভবত আপন বোন, কুপার তো তাও পেনি পেনি পেনি করে সমানে নক দেয় আর বুয়া এত জোরে নক করে মনে হয় দালানে আগুন লাগছে, আর শান্ত মামা শান্ত মামা করে- না খুলে উপায় কি? এরপর ঘুম ভাঙ্গে মোবাইলের এলার্মে সাড়ে আটটায়। কবে যে এই এলার্ম সেট করে ছিলাম তা মনে নেই। প্রতিদিনই বাজে আর আমার ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম ভাঙলে আমার প্রধান কাজ হয় দুটো। এক- মোবাইলে, ফেসবুক ব্লগ দেখা আর প্রথম আলো কিংবা অনলাইন খবরে চোখ বুলানো। কাজ থাকলে তখনই উঠে পড়ি নয়তো আবার ঘুমাই। দশটা বিশ বা পচিশ আমার প্রিয় সময় উঠার। কেউ না কেউ তখন ফোন দেয়। মন চাইলে ধরি না হলে ধরি না। ফ্রেশ হই, নাস্তা খাই তারপর চা খেতে খেতে পিসিতে বসি। ইহা গত ১ মাসের রুটিন। নয়তো আগে আমি সকালে উঠার পার্টি ছিলাম, সেই কোন ভোরে ঘুম থেকে উঠতাম আর এখন ভোর হবার সময় ঘুমোতে যাই। আজ(সোমবার) অবশ্য ঘুম থেকে উঠেই পেলাম পুলকের ফোন। নিউমার্কেট যাবে, আমি যাবো কিনা? আমি বললাম আমার তো কোনো কাজ নাই আর কেনার মতো কিছু টাকাও নাই। তাও ভাবলাম ঘুরে আসি। ফেসবুকের লাইক বিনিময়ের চেয়ে, রিকশা ভ্রমন উত্তম। ঘুম হবার কারনে শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছিলো। অনেক দিন পর দিনের বেলা চায়ের দোকানে গেলাম। চা খেতেই খেতেই পুলক হাজির। আমাদের প্রিয় রিক্সাচালকরা কেউ নাই, জুবায়ের-রহিম-নিপু-হাফিজুল কাউকেই খুঁজে পেলাম না। এক অচেনা রিকশাচালককে নিলাম, যথারীতি তার রিকশা চালনা খুব একটা ভালো লাগলো না। পুলকের কথা শুনছিলাম, আগের মতো পুলক আর আমার আলাপ হয় না। সে কোর্টে যায়, আইএল্টিএস ক্লাসে যায়, ফ্যামিলীর নানা কাজ অকাজে ভীষণ ব্যস্ত। তাও ঘুরে ফিরে আমার সাথে পুলকের আলাপ সেই সিনেমা, গান- বাজনা -রাজনীতি আর পুলকের সেই হয়েও না হওয়া গার্লফ্রেন্ডের আপডেট নিয়ে। সেই বিখ্যাত মেয়ে আবার মডেল মানুষ, অনেক সার্কেল,কত পার্টিতে যায়, উদ্ভট সব আলাপ সালাপ শুনে অবাক হই। আর আমার বন্ধুর জন্য মায়া হয়। এইসব অসাধারণ ছেলেরা কিসের কারনে যে এমন সব মেয়েদের সাথে ইমোশনাল এটাচমেন্টে জড়ায় তা আমার জানা যাই। জেমস বলছিলো এক দারুন খবর, তার এক বন্ধু আছে সে এক বিখ্যাত মডেল নাম বললে অনেকে চিনবেন তার প্রেমে হাবুডুবু খেতো। সেই মেয়েও চামে পাইয়া যাবতীয় বাজার করা থেকে শুরু করে এসাইনমেন্ট করানো, বাসায় বাইকে আনা নেওয়া থেকে শুরু করে মেয়ের পারসোনাল যত কাজ- সব ওই ছেলে করতো। মেয়ে এখন বিদেশে, এক এয়ারলাইন্সে এয়ার হোস্টেজের চাকরী করছে। ছেলের সাথে আর কোনো যোগাযোগ নাই। এই গল্পটা যখন কিছুদিন আগে শুনছিলাম তখন মনে হচ্ছিলো সুন্দরী মেয়েদের কত সুবিধা, চাইলেই একটা বন্ধুকে বিনে পয়সায় চামচা হিসেবে রাখতে পারে।
রজনীকান্তের নতুন সিনেমার লিঙ্গার ট্রেইলার,গোন গার্ল কিংবা নতুন এভেঞ্জার নিয়ে আলাপ, নায়িকা দীপিকার কাজ কারবার, রনবীর সিংয়ের ডায়লগ বাজি, টেন্ডুলকারের আত্মজীবনীতে কি আছে, কি কি দেখলাম টিভিতে, কত কিছু নিয়ে কথা বলতে বলতে আসলাম নিউ মার্কেট। বেলা বারোটা -একটা নিউমার্কেট মানেই খালি মধ্যবিত্ত মেয়ে আর মেয়ে। অবশ্য পুলক বললো মেয়েদের জিনিস ছাড়া নিউমার্কেটে আছে টা কি? পুলকের লক্ষ্য মুলত একটাই নিউলাইফের দোকানে যাওয়া, হোমিও প্যাথির কিসব মেডিসিন কেনা, আন্টির জন্য। পুলকের কল্যানেই আমার এখানে অনেকবার আসা। কেমন জানি একটা প্রাচীন প্রাচীন ভাবে আছে। আলমারী গুলোর দিকে তাকালে মনে হয় পাকিস্তান আমলের সজীবতা এখনো ধরে রেখেছে। যাই হোক অর্ডার শেষে সামনে হাটলাম। এক দারুন চায়ের দোকান আছে, চিনি আর গরুর দুধে ঠাসাঠাসি অবস্থা, আমি আর পুলক প্রায়ই খাই। চা খেয়ে নিউমার্কেটে বইয়ের দোকান গুলোতে ঢুকলাম সব বারের মতোই। কম কেনা হয় এখান থেকে। আর পকেটে ছিলই ৬২ টাকা। কেমন জানি মলিন সব। বইয়ের শেলফে অনেক ধুলোবালি, ভাবতে থাকলাম এই দোকানগুলোতেই বাংলাদেশের যত স্বনামধন্য লেখক তারা বই কিনতে আসতেন, পড়তেন, আমিও দেখছি। নিউলাইফ থেকে মেডিসিন নিয়ে আবারো রিকশায় বাসার পথে। পুলকের সাথে আলাপ করছিলাম রাজনীতি নিয়ে। নতুন নতুন ভাবে জাসদ নিয়ে যে বই বেরুচ্ছে তার ব্যাপার স্যাপার নিয়ে, তারপর আলোচনা আসলো রিকশাওয়ালারা কেন টাকা জমাতে পারে না, ঢাকা শহরে কেন বৃদ্ধ রিকশাওয়ালার সংখ্যা বাড়ছে তা নিয়ে, রিকশাওয়ালারা এখন বিকাশের কারনে সমিতির লোন গুলো কিভাবে দিচ্ছে এসব নিয়ে। আমাদের কথার চোটে রিকশাচালক মতামত দিলো 'মামা আপনারা দেখি আসলেই অনেক কিছু জানেন, সত্যিকার জ্ঞানী মানুষ আপনারাই'। যাক একজন রিক্সাচালকের সার্টিফিকেট পেয়ে খুব শান্তি পেলাম।
বাসায় এসে বুয়ার জঘন্য হাতের রান্না খেলাম। তবুও শান্তি বুয়া আসে, আল মাহবুব কিংবা রিং রোডের নান্নায় এখন আর খাওয়ার টাকা পকেটে থাকে না। আর বন্ধুদেরও সাক্ষাৎ নাই যারা আমাকে খাওয়াতে ভালোবাসতো। যাই হোক বসলাম পিসিতে। মনিটরে চি চি শব্দ করে সমানে কানে হেডফোন দিয়ে বসে থাকতে হয়। রিপিট শাপল দিয়ে কোনো গান রেখে দেই, বাজতেই থাকে। শুনতে শুনতে যা শুনি, প্রতিটা গানই আমার মুখস্থ হয়ে যায়। সন্ধ্যা হয়, পড়তে বসি, নানান কিছু নিয়ে পড়ি। রাত আটটার দিকে বাসার থেকে বের হই। যখন করার মতো আর কিছুই খুঁজে পাই না। বারেকের দোকানে যাই, লোকজনের আপডেট শুনি, স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতারা বিয়ার খাওয়ার এন্তেজাম করে তা দেখি। আমার অবশ্য এইসব নিয়ে কোনো পিনিক উঠে না, খাওয়ার ইচ্ছেও জাগে না। তবে মাঝে মধ্যে বন্ধুদের মুখে লা ডিপ্লোমেট কিংবা হোটেল জাকারিয়ার গল্প শুনে সেখানে গিয়ে আড্ডা মারতে ইচ্ছে করে গ্রীল খেতে খেতে। কিংবা উচ্চপদস্থ মাতাল মানুষরা কেমন আচরণ করে তা দেখার ইচ্ছা হয়। পুলক আসে, সাইফ আব্দুল্লাহ আসে, ইভান আসে, শুভ আসে। আড্ডা জমে। সাইফের জন্মদিন, সবাই খেতে যাবে। আমি সুকৌশলে একটা গল্প বানাই তাতে নিজে বাসায় যাই একা আর সবাই রেষ্টুরেন্টে। এইসব মানুষের আনন্দ ফুর্তির খাবার খেতে আর ভালো লাগে না। বাসায় ফিরছিলাম এমন সময় ডাক, ক্যাডার নিয়োগ না পেতেই চিনেন না মানুষকে। আমি দেখি এইটাতো তসলিম, বাল্যবন্ধু- ক্লাসমেট- একটা সময় খুব কাছের বন্ধু, তার বাপ আমার বাপের ব্যাচমেট। সেও ইন্টারমিডিয়েটের পর ভালো কোথাও চান্স না পেয়ে নেভীর সেইলরের চাকরীতে ঢূকে যায়। এখন লিডিং সীম্যান। নেভাল হেডকোয়ার্টারে কোন কাজে জানি আসছে, তার সাথে আবার তিন বন্ধু। এখানে আসছে তার কোন কলিগ লুমিয়া সেটের বিজ্ঞাপন দেখছে বিক্রয় ডট কমে। লুমিয়া সেট সেই কলিগের কেনার কারন তার বউএর আবদার সকাল বেলার, সন্তান হবে, সন্তানের ছবি ভালো ক্যামেরা মোবাইলে সমানে তুলবে। আমাকে বললো এই নিয়ে কিছু লেখ। আমি বললাম যে বালের লেখা লিখি আমি তার আবার গল্প লেখা। ফারুকের দোকানে বসালাম। চা খেলাম। বিয়ে করেছে- বউএর ছবি দেখলাম। খুব সুশ্রী। নামটাও নায়িকাদের, মৌসুমী। ওর আপন বড়বোন আর ছোটো ভাইয়ের কি খবর তা জানলাম। নেভীর অফিসার বন্ধুরা আর সেইলর বন্ধুরা কেমন আছে- গুনে গুনে সবার খোজ নিলাম। চাকরীতে হতাশা তাঁদের তা জানলাম। আমার আব্বুও যেমন তার বন্ধুদের সাথে আড্ডায় চাকরী জীবনেও হতাশা ঝড়ে পড়তো সেই আমলে, আমাদেরও তাই। জেনারেশন চেঞ্জ হলো সেই একই অবস্থা আমাদেরও। অবশ্য আমার বন্ধুটি খুব ভালো করছে, ডিগ্রী পাশ করে ফেলছে চাকরীর ফাকেই, টু ইয়ারসের এলএলবি করবে। আমি ল নিয়ে যত পড়াশুনার খোজ জানি সব বলে দিলাম চা খেতে খেতে। রাত বাড়ছে তাঁদের আবার এগারোটার মধ্যে ফিরতে হবে। লেগুনায় তুলে দিলাম আর হাটতে হাটতে ভাবছিলাম। এই বন্ধু আর আমি কত সময় গেছে জীবনের কিশোর বেলার খেলাধুলায়, এক ক্লাসের পড়াশুনায়, কত ঠাট্টা মশকারিময় সন্ধ্যা কাটতো। আর এখন হঠাৎ শুন্যতা। বয়স একটা বোঝার নাম। কতো কি চাপিয়ে দিবে আপনার কাঁধে, ভেবেও দেখবে না যে আপনার মনটা এখনো পনেরো কিংবা পচিশেই হয়তো আটকে আছে!
এপিক একটা ডায়লগ দিলা তো। বাহ।
থ্যাঙ্কস এ লট দোস্ত। ব্লগে দেখি না কেন?
অনেকদিন পর পড়লাম। ভাল লেগেছে
আপনাদের ভালো লাগা আর উৎসাহের কারনেই এই লেখালেখি!
লেখাটা একটু বেশিই ভালো হইছে। শেষ ৪/৫ লাইনই একটা আলাদা ব্লগ হৈতে পারতো।
টিবিবিটি কয় সিজন দেখছেন? আমার আট চলে এখন, স্টিল ফেভারিট।
পারফিওম একটা মুভি আছে, দেখছেন? আর রমানাথ রায়ের একটা গল্প আছে 'কমলালেবুর গাছ', খুজে পেলে পড়ে দেইখেন।
বরিশাল ট্যুর কেমন চলে?
পারফিওম আমার ভাল লেগেছে, মেঘের ততোটা নয়
নতুন লেখা দেন না একটা..
আমি গত মাস থেকে শুরু করছি, সিজন সেভেনে আছি। ব্যাপক মজা পাই!
গল্পের নাম মনে রাখলাম। ট্যুর দারুন হলো/
আমি এ ব্লগেই আসি শান্তর ব্লগ পড়ার জন্য
এক কথায় বাহ , আমি হিংসিত
এই কমেন্টটা বারবার দেখি আর মুগ্ধ হই!
চমৎকার লেখা
কোন একদিন দুপুর বা সন্ধ্যায় কারওয়ান বাজার আইসেন, এক সাথে খাওয়াদাওয়া করব 
মনে রাখলাম ভাই। দেখা হবে সামনেই!
মন্তব্য করুন