যেভাবে কবিতা পড়িঃ কবিতা নিয়ে অসামান্য স্মৃতিজাগানিয়া গদ্য
কবিতা নিয়ে গদ্যের কথা আসলেই নাম এসে পড়বে জয় গোস্বামী আর শঙ্খ ঘোষের কথা। বলাবাহুল্য তারা দুজনেই কবি। কবিতার নিবিড় রহস্যময়তা তাঁরা ধরতে চেয়েছেন গদ্যের ছুতোয় সাথে জানিয়ে গেছেন নিজের বিখ্যাত কবিতা গুলোর ভাবনা ইতিহাস আর দুনিয়ার নানান ভাষার বিখ্যাত কবিকে নিয়ে আলোচনা। এ সময়ের প্রখ্যাত গদ্যশিল্পী আহমাদ মোস্তফা কামাল এইসবের ভেতরে যান নি, তিনি নিজেও কবি নন। তবে তিনি কবিতার এক মুগ্ধ পাঠক। কবিতা পাঠে তিনি আনন্দ পান, কবিতার সাথে সন্ধি করেন, কবিতাকে নিংড়ে বের করতে চান সেই কাব্যরস। বিশ্বাস করেন কবিতা না পড়লে ভালো গদ্য লেখা কিছুটা অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু কবিতার আসলে ব্যাখা হয় না, সেই ব্যাখ্যাতীত বিষয় নিয়েই তিনি লিখেছেন মুক্তগদ্যের বই -- যেভাবে কবিতা পড়ি। লেখক জানিয়েছেন, তার প্রিয় কিছু কবিতার আনন্দ পাঠ ও তার শুলুকসন্ধান বের করার চেষ্টা।
এই বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যাপার হলো নষ্টালজিয়া। কিশোর বয়স থেকে কবিতা তিনি কিভাবে পড়া শুরু করেছেন। রবীন্দ্রনাথ দিয়ে শুরু করে কিভাবে লেখক কবিতা পাঠে শৈশব থেকে নিজেকে সমবেত রেখেছেন তা নিয়ে মনোগ্রাহী আলাপ। লেখক যখন নটরডেমে পড়তে আসেন, তখন অতি সাধারণ 'নিমন্ত্রণ' কবিতাটি ভিন্নভাবে পাঠ হতে পারে তা জেনে অবাক হয়েছি লেখকের মত আমিও। যেহেতু বইটা ফিচারের দিক থেকে তুমুল নষ্টালজিক, তাই লেখকের প্রিয় কবি জীবনানন্দ নিয়ে আছে তিনটা লেখা। লেখা গুলো ব্লগে ও সামাজিক বিভিন্ন মাধ্যমে জনপ্রিয়, আগে থেকেই পড়ার সুবিধা নিয়ে আবার যখন পড়তে গেলাম দেখি একজন সংবেদনশীল লেখক, ধরতে চেষ্টা করেছেন কবিদের প্রিয় কবি জীবনানন্দকে। আসলেই কি ধরা যায়? লেখক তার অগ্রজ সাহিত্যিক রশীদ করীমের কথা টেনে জানাচ্ছেন, কবিতা চির অধরাই। কিছুটা বোঝা যায়, কিছুটা থেকে যায় আবছায়ায়। আবার যতটুকু বোঝা যায় সেটাই সত্য কিনা তাও ভাবনার বিষয়। জীবনানন্দকে বোঝার যে আমাদের চিরকালীন অক্ষমতা তা ভেদ করেও লেখক দেখাতে চেয়েছেন জীবনানন্দের কবিতার অনুপম সৌন্দর্য। 'মরিবার হলো স্বাদ' আর 'বহুদিন আগে আমি করেছি কি ভুল'- এই দুটো নিবন্ধ আমার ব্যাক্তিগতভাবে বেশী প্রিয়। এই দুটো জায়গায় লেখক জীবনানন্দের বহুল পঠিত কয়েকটি কবিতাকে নিয়ে নিজের ভাবনা জানিয়েছেন নিখুঁত ভাবে।
'এই মাতোয়ালা রাইত' বাংলাদেশের প্রখ্যাত কবি শামসুর রাহমানের বহুল প্রচারিত কবিতা। ঢাকাইয়া ভাষায় লেখা কবিতাটা আমাকে তো বটেই, মুগ্ধ করে সব তরুণকে। আমার এক বন্ধু যে তেমন কবিতা পড়ে না সেও জানিয়েছিল, 'কবিতাটা পড়লে তার পুরান ঢাকায় গিয়ে মরে যেতে ইচ্ছে করে'। লেখক এই অসাধারণ কবিতাটা পড়ার অনুভূতি জানিয়েছেন নিপুণভাবে। পড়ে মনে হবে- এ তো আমারও কবিতাটি পড়ার পর মাথায় এসেছিল। শামসুর রাহমান কেন অসাধারণ নাগরিক কবি তার জন্য তিনি আশ্রয় নিয়েছেন- 'ক্ষমাপ্রার্থী' কবিতাটার। যার ছত্রে ছত্রে লুকিয়ে আছে নিম্নমধ্যবিত্তের ঈর্ষা- জীবন যাপন ও অবস্থাপন্ন সুশোভন বন্ধুর প্রতি হতাশা। সব হতাশা হারিয়ে গেছে বন্ধুর অকাল প্রয়াণে। তখন সে জানাচ্ছে তার জীবনটাও অসুন্দর নয়, এই বেঁচে থাকাটাও তুচ্ছ কিছু নয়। 'পরাণের গহীন ভিতর' শিরোনাম দেয়া নিবন্ধে লেখক ছোট্ট আলোচনা করেছেন পঞ্চাশ ষাটের বড় তিন কবি নিয়ে। সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ আর শহীদ কাদরী। সীমিত পরিসরে লেখক এই কবিদের কিছু প্রিয় কবিতা ও তাদের কাব্য অনুষঙ্গ নিয়ে ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন। এত বড় কবি আল মাহমুদের ব্যাপারেও লেখক জানাচ্ছেন, স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে তার কিছু সখ্যতা কিভাবে তাঁকে বেদনার্ত করে।
বাংলা কবিতা নিয়ে লিখতে গেলে শক্তি সুনীলকে আনতে হবেই। কারন তাঁদের কবিতা আমরা পড়েই বড় হয়েছি। শক্তি সুনীলের কবিতার বিভিন্ন লাইন লেখককে কিভাবে আন্দোলিত করে তা জানিয়েছেন। শক্তি, সুনীলের কবিতার যে চমৎকার রূপকল্প তার কিছুটা তুলে ধরে আনার চেষ্টা করেছেন এই অল্প পরিসরে। বইটার শেষ দিকের লেখা- অকাল প্রয়াত কবি আবুল হাসানের কবিতা নিয়ে। কবি আবুল হাসান নিজেই একজন বিষ্ময়কর তরুণ। মাত্র সাতাশ আটাশ বছরের জীবনে তিনি রেখে গেছেন অসামান্য সব কবিতা। তার সমসাময়িক কবিদের থেকেও তিনি তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে আলাদা ধরণের কবি। লেখক আহমাদ মোস্তফা কামাল দেখাতে চেয়েছেন আবুল হাসানের সুনিবিড় কবিতার সাথে বোঝাপড়া ও কবিতার সাথেই নিজের জীবনকে যাপন করার চেষ্টা। আবুল হাসানকে নিয়ে এত মায়াময় লেখা খুব বেশী নাই এই সময়ে। বইটা শেষ হয়েছে কবিতার যে চিরকালীন হাহাকার, যে আনন্দ বেদনার এক মিশ্রতা তা নিয়ে বলতে বলতে।
এই গদ্যের বইটাও ঠিক তেমন। বাংলা ভাষার বিভিন্ন বিখ্যাত কবিদের কবিতার পাঠের- আনন্দ- বেদনা-বিষণ্ণতা- উল্লাস নিয়ে এক নিটোল গদ্যের বই সাথে আছে কবিতা নিয়ে স্মৃতি আর নষ্টালজিয়ার অনাড়ম্বর ভাষ্য।
নামঃ যেভাবে কবিতা পড়ি
লেখকঃ আহমাদ মোস্তফা কামাল
দামঃ ১৫০ টাকা
ফাঁকিবাজি লেখা হয়েছে শান্ত -- আরও বড় হতে পারতো
হায় শান্ত হায় !
মন্তব্য করুন