ইউজার লগইন

বিকল্প ভাবনা যেখানে ব্রাত্যদের ভাবনা

ফেব্রুয়ারী থেকে জুন, দেশ যেন দু-দুটো বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে গেল। ফেব্রুয়ারীতে হঠাতই ফুঁসে উঠল প্রথমে তরুণরা- মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবীতে। তার সাথে সায় দিল দেশের আবালবৃদ্ধবণিতা সহ হাজার হাজার মানুষ। দেশ-বিদেশের অসংখ্য বাঙ্গালীরা চাইল-এদেশের মাটিতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতে হবে। তাল মেলালেন প্রধাণ মন্ত্রী সহ অনেক রাজনীতিবিদ। মনে হচ্ছিল, মানুষ জেগে উঠেছে। জেগে উঠেছে একটা ঘুমিয়ে থাকা সময়। কিন্তু রাজনীতির ফাঁদে পড়ে হেরে গেল তারুণ্য, হেরে গেল অসাম্প্রদায়িকতা। দেশের ভেতর আরেকটা বিল্পব শুরু হল- আস্তিক এবং নাস্তিক এর। দলে দলে মানুষ প্রমাণ দিতে শুরু করল-“আমরা আস্তিক”। চালু হল নতুন কথা- ব্লগার মানেই নাস্তিক। কিম্বা অমুক নাস্তিক অথবা তমুক আস্তিক। ধর্ম রক্ষায় এগিয়ে এল ঢেউয়ের মত মানুষ। অনেককেই পাওয়া গেল ইসলামের হেফাজত করতে। দেশের বাঘা বাঘা সংস্কৃতমনা মানুষও বার বার বলতে শুরু করলেন, তাঁরা মুসলমান। তাঁদের জীবন-যাপন পদ্ধতি ধর্ম দিয়ে মোড়া। শুরু হল দ্বিতীয় বিপ্লব – রাস্ট্রীয় বিধান জারি হল, ধর্মের বিপক্ষে গেলেই-তাকে দেখে নেওয়া হবে। বিভিন্ন জায়গায় নজির পাওয়া গেল সাম্প্রদায়িকতার।

বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ধর্ম এবং সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে একটু পিছু ফিরে দেখে আসি।
গত ১০০ বছর ধরে যারা বাংলাদেশের সংস্কৃতি নিয়ে ভাবছেন এবং লিখছেন, তাঁরা বলছেন- সংস্কৃতির ধারনা সংস্কারের সাথে সম্পর্কিত। সংস্কার বলতে বোঝায়, শুদ্ধিকরণ, পরিশোধন, সংশোধন, উৎকর্ষসাধন এবং সৌন্দর্যায়ন। কেবল নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটক এবং বিনোদনকে সংস্কৃতি বলে মনে করা ভুল। নাচ, নাটক কিম্বা আবৃত্তি সংস্কৃতির বাহন মাত্র কিন্তু সংস্কৃতি নয়। সংস্কৃতির ধারণা আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত।
সংস্কৃতি-কথা বলে, মোতাহার হোসেন চৌধুরী একটি লেখা লিখেছেন, তার কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করলাম।
“ধর্ম শিক্ষিত লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত, মার্জিত লোকের ধর্ম।
ধর্ম মানে জীবনের নিয়ন্ত্রণ। মার্জিত আলোকপ্রাপ্তরা কালচারের মারফতেই নিজেদের নিয়ত্রিত করে। বাইরের আদেশে নয়, ভেতরের সূক্ষ্ণ চেতনাই তাদের চালক। তাই তাদের জন্য ধর্মের ততটা দরকার হয়না। বরং তাদের ওপর ধর্ম তথা বাইরের নীতি চাপাতে গেলে ক্ষতি হয়। কেননা তাতে তাদের সূক্ষ্ণ চেতনাটি নষ্ট হয়ে যায়, আর সূক্ষ্ণ চেতনার অপর নাম আত্মা।
সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত কালচারের উদ্দেশ্য নয়- উপায়, উদ্দেশ্য, নিজের ভেতরে একটা আল্লাহ বা ঈশ্বর সৃষ্টি করা। যে তা করতে পেরেছে সে-ই কালচার্ড অভিধা পেতে পারে, অপরে নয়।
ধর্ম চায় মানুষকে পাপ থেকে, পতন থেকে রক্ষা করতে, মানুষকে বিকশিত করতে নয়। গোলাপ ফোটানোর দিকে তার নজর নেই, বৃক্ষটিকে নিষ্কণ্ঠ রাখাই তার উদ্দেশ্য। অপরপক্ষে কালচারের উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবনের বিকাশ, পতন পাপ থেকে রক্ষা নয়। গোলাপের সঙ্গে যদি দু-একটা কাঁটা এসেই যায় তো আসুক না, তাতে ক্ষতি নেই, দেখতে হবে তাতে ফুল ফুটল কিনা- এ-ই কালচারের অভিমত। মনুষ্যত্বের বিকাশই সবচেয়ে বড় কথা, চলার পথে যে স্খলন-পতন তা থেকে রক্ষা পাওয়াটাই বড় কথা নয়। বরং বড় জীবনের তাগিদে এসে এই স্খলন-পতনের মর্যাদাও অনেক বেড়ে যায়”।
আমাদের দেশে চিরটা কালই কালচার্ড, সুশিক্ষিত বা স্বশিক্ষিত মানুষের অভাব। সেটা হ্য়ত আমাদের দোষ নয়। এর পেছনে আছে হাজার বছরের সংস্কৃতি, ধর্ম এবং অশিক্ষা। বঙ্গদেশ বা বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবেই নানান মতে-পথে বিভক্তির দেশ।

বাংলাদেশের হাজার বছরের সংস্কৃতি নিয়ে যারা কাজ করেছেন, তারা দেখিয়েছেন যে- খ্রীষ্টপূর্ব আমলের সংস্কৃতি ও সাহিত্যে বঙ্গদেশকে বলা হত, অপবিত্র বা ব্রাত্যদের দেশ। ব্রাত্যদের দেশ বলার কারণ সে দেশের লোকেরা বৈদিক পূজা পার্বণ পালন না করে স্থানীয় ব্রতাদি পালন করতেন। এর সাথে সাথে ভৌগলিক কারণে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় এ অঞ্চলের লোকজন ছিল অশিক্ষিত এবং নিম্ন বর্ণের। সেইজন্য তখঙ্কার শাস্ত্রকাররা “সে দেশে যেও না” বিধান দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস বলে, বঙ্গদেশ কখনো অখণ্ড ছিল না। ছোট ছোট রাজ্যে এবং ভূখণ্ডে খণ্ডিত ছিল। তেমনি নানান ধারায় বিভক্ত ছিল এর সংস্কৃতি। ধর্মও প্রধাণ দুটিভাগে বিভক্ত। হিন্দু এবং মুসলিম। হিন্দু ধর্মের মধ্যে আছে নানান বিভেদ। উচ্চবর্ণ এবং নিম্ন বর্ণ। মুসলমানদের মধ্যে আশরাফ ও আতরাফ ইত্যাদি।
ধারণা করা হয়, দেবদেবী, স্বর্গ নরক, ইহলোক পরলোক এসবের ভাবনা থেকেই ধর্মের উদ্ভব। অতি প্রাচীনকালে গুহাচিত্রের উপর কিন্তু ধর্মের কোন প্রভাব পাওয়া যায়না। তাই মনে করা হয়, মানুষের ধর্মবোধ জন্মায় শিল্পবোধের পরে। মানুষের ইতিহাসে শিল্প অগ্রজ এবং ধর্ম তার অনুজ।
বঙ্গদেশ বা বাংলাদেশ আমরা যাই বলিনা কেন, এটি বরাবরই বিদেশীদের দ্বারা শাসিত ছিল। বিদেশীরাই নিয়ে আসে আমাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি। আমাদের সংস্কৃতিতে ধর্মের প্রভাব ভীষণ এবং যারা আমাদের মধ্যে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছিলেন, তাদের মধ্যেও ছিল নানা বিভক্তি। যারা ইরান থেকে এসেছিলেন, তারা এক ধরণের আচার-আচরণ করতেন আবার যারা আরব থেকে এসেছিলেন, তারা আরেক ধরণের ইসলামিক আচার-আচরণ পালন করেছেন। বিভিন্ন ভাষা ব্যবহার করেছেন। কেউ বলেছেন, সালাত আবার কেউ বলেছেন নামায। বেহেশত কিম্বা জান্নাত।
বখতিয়ার খিলজি ১২০৪ সালে বঙ্গ বিজয়ের মাধ্যমে, ইসলাম ধর্ম প্রচারকেরাও এদেশে আসা শুরু করেন। বঙ্গদেশে ইসলাম প্রচারের কারণ হিসেবে চারটি মতবাদ দেখানো হয়। তার মধ্যে একটি হল তরবারীর সাহায্যে ইসলাম প্রচার। তখন মুসলমানরা প্রচুর মন্দির ধ্বংস করেন বলে দাবী করা হয়। অবশ্য যারা পীর এবং সুফি এসেছিলেন ধর্ম প্রচারের জন্য তাঁরা যোদ্ধা ছিলেন না বরং তাদের ধর্ম প্রচার ছিল শান্তির বাংলার ধর্ম চিরকালই ছিল গুরুমুখী এবং ভক্তিমুখী। তাই অদৃশ্য বা অমূর্ত ঈশ্বরের চেয়ে দৃশ্যমান পীর বাংলার মানুষের মনোযোগ বেশী আকর্ষণ করেছিল। আর এসব ভক্তি থেকেই গড়ে উঠেছিল অসংখ্য মাজার। যেটি মূল ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক।

আর তাছাড়া ভিন দেশে থেকে যে সব ভিন ভাষাভাষী ধর্মপ্রচারকেরা এসেছিলেন, এ দেশে তাঁদের ভাষার সাথে এ অঞ্চলের মানুষের ভাষার পার্থক্য ছিল। সে কারণে এ দেশের অশিক্ষিত নিম্নবর্ণের মানুষের সংস্পর্শে এসে বিশুদ্ধ ইসলাম খানিকটা তার নিজস্ব গতিপথ বিচ্যুত হয়। ঊনিশ শতকের গোড়া থেকে বাংলার মুসলমানেরা শিক্ষিত হতে শুরু করলেন এবং তাও খুব ধীরে ধীরে। বিশ শতকের শুরুর দিকে মুসলমানরা শিক্ষিত হয়ে বিশেষ করে মৌলবাদীরা সমসাময়িক ধর্মের “বিকৃতি” শোধন করে বিশুদ্ধ ইসলামকে ফিরিয়ে আনতে আন্দোলন শুরু করলেন। তখন শুধু রোজা নামাজ হজ্ব যাকাতের উপর গুরুত্ব দিলেন না, ইসলামি পোষাক, দাড়ি, খৎনা, ইসলামি নামের উপর জোর দিলেন।
১৯৭০ এর দশক থেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাব এবং ফিলিস্তিনীদের সন্ত্রাসবাদী মুক্তিযুদ্ধের সূচনা মৌলবাদী ইসলাম প্রসারের ফলে, বাংলার মুসলমানদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে নতুন উৎসাহ দেখা গেল। বিশেষ করে মেয়েদেরকে আবার পর্দায় ফিরিয়ে নেবার প্রবণতা দেখা দিল।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর, বাংলাদেশের রাজনীতিও প্রধাণ দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। বাংলাদেশের রাজনীতিও হয়ে গেল ধর্ম ভিত্তিক। এত কিছুর পরেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কেন্দ্র করে একদল মানুষ এবং একঝাঁক তরুণ কিছুটা অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠেছিল। তারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করণের দাবী জানিয়েছিল কিন্তু ২০১৩ তে এসে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি যেন সব কিছুকে গ্রাস করে নিতে চাইছে।

যে কোন ধর্ম মানেই এক একটা সম্প্রদায়। আর এসব সম্প্রদায়ের মধ্যে হাজার হাজার বছর ধরে টিকে আছে সাম্প্রদায়িকতা। যে কোন সাম্প্রদায়িকতার উর্দ্ধে উঠে কোন মানুষ যদি সত্যি সত্যি অসাম্প্রদায়িক হতে চায়, বিকল্প ভাবনা ভাবে অথবা কেউ যদি কোন ধর্মের সমালোচনা করতে চায় (অবশ্যই নোংরামী করে নয়) সেই সুযোগ সেই মুক্তভাবনা এখানে নিষিদ্ধ এখন। হয়ত সারা পৃথিবীতেই নিষিদ্ধ। আমাদের দেশ এখন প্রধাণ দুই ভাগে বিভক্ত। একদল আস্তিক এবং বাকি সবাই নাস্তিক।

তথ্য সূত্রঃ হাজার বছরের বাঙ্গালি সংস্কৃতি- গোলাম মুরশিদ
বাঙ্গালির সংস্কৃতি চিন্তা - আবুল কাসেম ফজলুল হক এবং মিজান রহমান

পোস্টটি ১০ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

আরাফাত শান্ত's picture


ফেসবুকেই পড়লাম। সামগ্রিক ভাবে আপনার সাথে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নাই!

শওকত মাসুম's picture


হুমম

টুটুল's picture


পীর এবং সুফি এসেছিলেন ধর্ম প্রচারের জন্য তাঁরা যোদ্ধা ছিলেন না বরং তাদের ধর্ম প্রচার ছিল শান্তির বাংলার ধর্ম চিরকালই ছিল গুরুমুখী এবং ভক্তিমুখী। তাই অদৃশ্য বা অমূর্ত ঈশ্বরের চেয়ে দৃশ্যমান পীর বাংলার মানুষের মনোযোগ বেশী আকর্ষণ করেছিল। আর এসব ভক্তি থেকেই গড়ে উঠেছিল অসংখ্য মাজার। যেটি মূল ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক।

Sad

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

শাপলা's picture

নিজের সম্পর্কে

আমি ভালোবাসি, মা, মাটি, আমার আত্মজা এবং আমার বন্ধুদের যারা আমাকে প্রকৃতই বুঝতে পারেন।