এম্নেই ৯
কালকে যখন শহীদ মিনার পৌছলাম, তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা। অনেক মানুষ এসে হাজির আল্পনা দেখার জন্যই মনে হয়, বাঙালি আজকাল পুরা পরিবার মিলে বের হয়ে যায় যেকোনো উপলক্ষে, এইটা গত কয়েকদিন ধরে বুঝতে পারতেছি। তবে পুলিসের সংখ্যা বেশি নাকি বেড়াতে আশা লোকজনের সংখ্যা বেশি সেইটা জিগ্গেস করলে একটু চিন্তায় পড়ে যাব। শহীদ মিনারের সামনে গিয়ে দেখি চত্বরে কাউকে উঠতে দিচ্ছেনা, অল্পকয়েকজন ক্যামেরাওয়ালা উঠে ছবি তুলতেছে। আমার ক্যামেরা আমার মতই ছোটখাটো, মোটামুটি নিশ্চিত যে আমাকে ঢুকতে দেয়ার কোনো কারণ নাই, তারপরেও গিয়ে ভয়ে ভয়ে বললাম, 'ভাই একটু ছবি তুলতে চাইছিলাম'.. পুলিস কয় স্যান্ডেল খুইলা উইঠা যান, তবে একজনই যাইতে পারবেন। বেচারা বন্ধুরে দাঁড় করায় রাইখা আমি উইঠা গেলাম। ছবি তোলা আসলে আসল উদ্দেশ্য ছিলনা...চত্বরটাতে অনেক অনেক আলো, তাই দেখতে অনেক সুন্দর লাগতেছিল, আর শহীদ মিনার চত্বরে জীবনেও উঠিনাই আমি, ঐটাও উঠতে চাওয়ার একটা কারণ। অনেকখানি খোলা জায়গায় লাল রঙের বাঁধানো চত্বরে খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হইলো দুই পাক নাইচা নেই ..আল্পনা জিনিষটা আমার অনেক সুন্দর লাগে..একুশে ফেব্রুয়ারীতে আল্পনা দেখতে প্রত্যেক বছর যাইতাম শহীদ মিনারের ঐদিকটাতে যখন ক্যাম্পাসে থাকতাম।
ঘুরতে ঘুরতেই মনে হইলো রাত পর্যন্ত থাকতে হবে, মানুষ দেখব। বন্ধু থাকতে পারবেনা, তাকে বাসায় পৌঁছায় দিয়ে আসতে হবে...তাই বইমেলায় গেলাম এক চক্কর দিতে, ভাবছিলাম আজকে অনেক লোকজন থাকবে, কাউরে পাইলাম না। শুধু লীনাপুর সাথে দেখা হইলো, তার কেনা বইগুলা দেখতেছিলাম, সে আমাকে 'অপরবাস্তব' গিফট কইরা দিল ...১৫ মিনিট ছিলাম মেলায়, তারপর বাইর কইরা দিলো.. একুশে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষে ৮টায় মেলা বন্ধ। শাহবাগ আসতে আসতে দেখি ততক্ষণে ক্যাম্পাস সিল করে ফেলা হইছে, চারুকলার সামনেই ব্যারিকেড। শাহবাগে আধা ঘন্টা পার করার পর একজন ট্যাক্সিওয়ালাকে অনেক কাকুতিমিনতি করে রাজি করানো গেল, বারিধারা ডিওএইচএস হয়ে আবার শাহবাগ পৌঁছাইলাম রাত ১০টায়। কিছু সঙ্গীসাথী জুটল, তারা সারারাত থাকবে...তাদের সাথে থাকতে থাকতে আমার প্ল্যান পাল্টাইল, সারারাত-ই থাকতে হবে, কারণ প্রধানমন্ত্রী যাবে ১২.৩০ টায়, তার আগে তো শহীদ মিনারের আশেপাশে ঢুকতেও দিবেনা। তাই আমরা দলবল সোহরাওয়ার্দী উদ্দ্যানে ঘুরঘুর করতে লাগলাম। শুকনা পাতা দিয়া আগুন জ্বালানো হইলো, 'ট্রাইবাল ড্যান্স' এর ছবি তোলার উদ্দেশ্যে। একজনের সাথে কিছুদিন আগে তর্ক করছিলাম সিগারেট থেইকা শুকনা পাতায় আগুন ধরে কি ধরেনা এইটা নিয়া, কালকে বুঝলাম আসলেই এত সহজে আগুন ধরেনা, ১০-১২টা ম্যাচের কাঠির শ্রাদ্ধ শেষে কাগজ জ্বালাইতে হইলো পাতায় আগুন ধরাইতে। সেই আগুন অবশ্য অনেকক্ষণ ছিল, সেইটা ঘিরে নাচানাচিও হইলো, ছবিও তোলা হইলো। উদ্যানে একটা নাগরদোলা আছে, ঐটার চৌকিগুলা খুইলা একজায়গায় রাখা। ঐটাই ছিল আমাদের আস্তানা, ঐখানে বৈসা দুইজন ফুঁকে ঘাস, আর আমরা বাকি তিনজন খাই অত্যধিক মিষ্টি চা আর বিড়ি। হঠাৎ দেখি গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হইলো...ভালই অবস্থা!
রাত দেড়টার দিকে হাঁটা শুরু করলাম শহীদ মিনারের দিকে, আগাছাখোর দুইজন একটু গাঁইগুঁই করতেছিল, দুইটারে দাবড়ায় নিয়া আসা হইলো। ফুলার রোড, পলাশী সব ঘুইরা শহীদ মিনার পৌঁছাইতে আমাদের পুরা খবর, তবে যাইতে যাইতে দেখি প্রচুর মানুষ যাচ্ছে এই রাতের বেলাও...কোনো সংগঠন না, পিচ্চি পাচ্চা নিয়ে পুরা পরিবার হাজির, অনেক অল্পবয়স্ক পোলাপাইন-ও আছে...মনে দুঃখ লাগলো, আহা, ঢাকার রাস্তা যদি বছরের সবদিন এত নিরাপদ হইত! শহীদ মিনারের সামনে দেখি সুন্দর অবস্থা, সবাই কিউ দিয়া আস্তেধীরে যাইতেছে, তবে মাইকে মুখস্ত কবিতা বলার মত আবৃত্তিটা না থাকলে কানটা একটু শান্তি পাইত। ছবি তোলার চেষ্টা করলাম, তবে বুঝলাম ভিতরে ঢুকতে না পারলে আসলে সম্ভব না। কিছুক্ষণ ঐখানে থাকার পর আবার রওনা দিলাম ছবির হাটের দিকে। এইবার টের পাইলাম পায়ের অবস্থা কাহিল, খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে অল্প একটু যাই, আবার পাঁচ মিনিট বসি। বাংলা একাডেমির সামনে বসে আড্ডা দিলাম আধা ঘন্টা. এই করে করে যখন ছবির হাট পৌঁছাইলাম তখন আরেক যন্ত্রণা। বাথরুম যাইতে হবে। এইটা রাত ৩.৩০টার সময় একটা মহাবিপদ স্বরূপ। চারুকলায় গেলাম অনেক আশা নিয়া। মামারা এই রাত্রে দরজা খুলবে? অসম্ভব। আড্ডা দিতেছিল, আমরা গিয়া বিরক্তই করলাম বোধ হয়। শাহবাগ মোড় পার হইয়া প্রথমে গেলাম পিজি হাসপাতাল...সেইখানে একটা কাক্পক্ষিও নাই। ওয়ার্ড না কি জানি একটা বিল্ডিং প্রথমেই, সেইটার ভিতরে চইলা গেলাম, কোথাও কেউ নাই! এইদিকে পায়ের ব্যথা বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থা ভাবতেছি ইমার্জেন্সিতে চইলা যাব নাকি, সেইখানে গেলে বাথরুম-ও পাওয়া যাবে, এক ঢিলে দুই পাখি! শেষ পর্যন্ত কাউরে না পাইয়া রাস্তা পার হইয়া গেলাম বারডেম। সেখানের গার্ড বেশ ভালো, সে জরুরি বিভাগে ঢুকাইয়া দিল, ভিতরেই নাকি আছে। ভিতরে ঢুকে একটু ভড়কায়ে গেলাম...কয়েকটা স্ট্রেচার রাখা, সেইখানে মানুষ ঘুমায় আছে। এক কোনায় দেখি লেখা 'বিশ্রামাগার (পুরুষ)'...মহিলাদেরটা কোথায় সেইটা খুঁজতে খুঁজতে দেখি আরেকটা দরজা আছে লেখা 'মহিলা কিছুএকটা' ঢুকে দেখি একই অবস্থা, তবে এইখানে স্ট্রেচার এবং ঘুমায়ে থাকা মানুষের সংখ্যা কম। পাশেই মহিলাদের বিশ্রামাগার, সেটার দরজার সামনে কমপক্ষে সাত আট রকমের পোকা ইতস্তত ঘোরাফেরা করতেছে। আমি সাধারণত পোকামাকড় চরম ডরাই, তাই আতংকের সাথে দরজাটা খুললাম, কিন্তু নিশ্চিন্ত হইলাম কিছু নন-ভয়ংকর ছোট ছোট উড়ন্ত পোকা ছাড়া আর কোনো পোকা ভিতরে নাই দেখে। দরজা আটকাতে গিয়া আরেক বিপত্তি..দরজা শুধু দরজাই, তাকে ভিজিয়ে রাখা যাবে, লক করা যাবে না। আল্লাহর নাম নিতে লাগলাম যাতে কেউ ধাম করে না ঢুকে যায়। বের হয়েই চমকে গেলাম, এক মহিলা স্ট্রেচারের উপর উঠে বসে আছে, আর আমার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকায় আছে। আমি তাকে আশ্বস্ত করার জন্য একটা হাসি দিলাম, মহিলা দেখি পাত্থর মুখে তাকায়েই আছে। কি আর করা, বের হয়ে আসলাম। আমার কাজ উদ্ধার হইছে এতেই আমি খুশি।
আবার হাঁটতে হাঁটতে ছবির হাট...এইবার দেখি খোলা জায়গাতে ক্রিকেট খেলা শুরু হইছে, একটা ঝাকড়া চুলা লোক, আর কয়েকটা ছেলে মিলে. একটা বল করা হলো, ব্যাটসম্যান একটা লাঠি দিয়া পিটাইল, ফিল্ডার ঝাপায় পৈরা বলটা ধরল, এর মধ্যে এক রান নিল ব্যাটসম্যান, বলটা যখন ফিল্ডারের হাত থেইকা বোলারের হাতে ফেরত আসল তখন বুঝলাম বলটা কাল্পনিক। এয়ার ক্রিকেটিং চলতেছে! এদের অঙ্গিভঙ্গি দেখে বোঝার কোনই উপায় নাই যে বলের কোনো অস্তিত্ব নাই। কিছুক্ষণ খেলা দেখলাম। স্বভাবতই একটা মেয়ে দাঁড়ায়ে খেলা দেখতেছে তাতে খেলোয়াররা বেশি উৎসাহে একটু গুলায়ে গেল...সেইটা বুঝতে পেরে আমি উদ্দ্যানের ভিতরে চলে গেলাম আবার। নাগরদোলার কাছে গিয়ে দেখি ঘাস খাওয়া চলতেছে পুরাদমে...ঐগুলারে পটায়ে আবার নিয়ে আসলাম ক্রিকেট খেলা দেখতে...বসে বসে অনেকক্ষণ দেখলাম, এতক্ষণে তারা আবার স্বমহিমায় ফিরেছেন, বেশ একটা ভালো খেলা চলতেছে, সেইটা গুবলেট হইলো আবার যখন একটা তরুণতরুণী গ্রুপ আসল, তিনটা মেয়ে এইবার, তাই খেলায় বারবার ভুল হওয়া শুরু হইলো। প্যাথেটিক অবস্থা! প্রায় ভোর হয়ে আসতেছে, তাই ঠিক করলাম একবার শহীদ মিনার ঘুরে বাসায় চলে যাব, ঐদিকে হাঁটা দিলাম আবার। টিএসসি গিয়ে একবার থামলাম পায়ের ব্যথায়...ভাপা পিঠা খাইলাম, ডিম পরোটা খাইতে চাইছিলাম কিন্তু দোকান বন্ধ বৈলা খাওয়া গেলনা। বইমেলার গেইট এর সামনে আমরা যখন পৌঁছাইলাম ততক্ষণে চারদিক আলোয় ঝকমক..কারোর-ই আর সামনে যাওয়ার শক্তি অবশিষ্ট নাই। আমি ভাবছিলাম প্রভাত ফেরির কয়েকটা ছবি তুলব, কিন্তু সেইটা আসলে পায়ের যন্ত্রনায় সম্ভব না...তাই আবার শাহবাগ রওনা দিলাম বাসায় ফেরার উদ্দেশ্যে। ক্যাম্পাসেই পাওয়া গেল ওয়াশিংটন হোটেলের এক মাইক্রোবাস, আমরা সুন্দর সেইটায় উইঠা পড়লাম। আসতে আসতে ভাবতেছিলাম, একুশেতে সারারাত ঘোরাঘুরি করা যায় এইটা আগে ক্যান জানতাম না! প্রেমিকের সাথে সারারাত হাঁটার যেই একটা আকুলতা ছিল ওই সময়ে, জানলে কত ভালো হইত! এখন তো আকুলতা থাকলেও কোনো উপায় নাই, যার সাথে হাঁটতে চাই সে আমার সাথে হাঁটবেনা, আর যে আমার সাথে হাঁটতে চায় তার সাথে হাঁটার জন্য আমার ব্যাকুলতা নাই। বড় হইলে আসলেই জীবনটা অনেক কমপ্লিকেটেড হইয়া যায়।
আমিও আপনে না বলে দিলে বুঝতাম না। অসাধারণ লিখসেন।
নির্জলা হিংসা। নিজের ইচ্ছেমতো জীবন যাপন করা, রোজ দিনের এই ছোট ছোট সাধগুলো পূরন করে নেয়ার জন্য ভাগ্যবতী হয়ে জন্মাতে হয়রে।
পায়ের অবস্হা এখন কিরাম? পুষ্ট ভালা পাইলাম
ছবি নিয়া এত গল্প দিলেন আর ছবি দিলেন না এই জন্য মাইনাস।
তয় পোস্ট সেইরকম হয়ছে।
আপনাকে হিংসা, সারারাত ঘুরলেন।
কাল সকালে একবার দুনিয়া ঘুড়ে গেলাম শহীদ মিনারে। দুপুরে আবার গেলাম বইমেলা, তারপর অনেক হাঁটলাম, ঘুরলাম, আড্ডাবাজি, খাওয়াদাওয়া।
যদিও কাল লিজা'র বাসায় বেশ ভালো একটা সময় কাটিয়েছি, তবু কাল কোথাও বের হবেন না বলেও শেষে বের হওয়ার জন্য আপনারে

কাজটা ঠিক করেন নাই
আগে বললে লিজা'কে সহ অভাবে প্রোগ্রাম করতাম।
নাজ, ২১ শে তে বিকালে বইমেলায় অনেক ভীড় হয় বলেই সবাই মিলে যাওয়ার প্ল্যান করি নাই। সবাই গেলে বিকাল হতোই। আমি এমনিতেই হয়ত দুপুরে যেতাম একবার। লীনাপাও হঠাৎ বললো যে যাবে, তারপর সবাইকে বললাম।
দুনিয়ার সব মাইনাস আপনারে দিলাম।

ইস, যদি এভাবে পিছুটান বিহীন ভাবে বিন্দাস ঘুরতে পারতাম
কোন কারণ নাই, মন খারাপ হয়ে গেছে এমনেই!
ভালোই তো চলছিল..... শেষ অংশটা একটু কমপ্লিকেটেড হয়ে হগল...... আপনার জন্য শুভকামনা।
একুশে ফেব্রুয়ারীতে একবার রাতেরবেলা গিয়ে এমুন ডলা খাইছিলাম !!! হেরপরে ক্যাম্পাসে থাকলেও রাতে না গি্যে সকালে যাইতাম ।
হাঁটার ইচ্ছার কথাটার জায়গায় আইসা আটকায় গেলাম। কথাটা বিষণ্ন টাইপ হলেও বড়ই সুন্দর।
সহমত জানিয়ে গেলাম। বুড়ো হবার অনেক জ্বালা!
একটু খুঁইজা-টুইজা দেখেন। কালকে প্রায় আপনের মতো একজনের সঙ্গে কথা হইলো। তারে আপনের কথা বললাম
হাহ?
আপনারা দুইজনই কোক ইমোটার সেকেন্ডজনের মতো।
কার কথা কন? সেকেন্ডজনের মত ক্যান?
এইটা অবশ্য বুঝার কথাও না। কারণ আপ্নেরা দুইজন তো আর একই লুক না।
একি লোকতো অবশ্যই না, কারন কালকে আপনের সাথে আমার দেখা হয়নাই এইটা আমি শিওর। কিন্তু আমি কোন কারনে সেকেন্ডটার মতো?
সেকেন্ডটারে দেখে কিন্তু আমার মনে হইতেসে না যে সে হাই। তবে যেইটা মনে হইসে সেইটাও বলা যাবে না।
নেন গানে হাই হন
রেইনকোট দেখসেন?
না দেখিনাই
গানটা অন্তত দেখেন।
গানটা দেখছিতো
...এক মিনিট ক্যানো মাত্র? আপনি ইনটু দ্য ওয়াইল্ড দেখছেন?
নাহ্ কপাল খুবই খারাপ।
এবারেরটা বেশি জোস্ হয়ে গেছে।
হ, আপনেরটাও বেশি জোস
থ্যাংকু ভ্রি মাচ
অসাধারণ পোস্ট!
মন্তব্য করুন