Reply to comment
সূর্যের সমুদ্র স্নান
বিকেলের ডাকে আসাদের চিঠি এসেছে। চিঠির মুল বক্তব্য : " ইদানিং কালের অবিবাহিত মুসলিম বাঙালি মেয়েদের বোরকা প্রিয়তা এতই বেড়েছে যে, উপলক্ষ্য লক্ষ্যকে ছাড়িয়ে গেছে। যাতে মূখ্য হয়ে উঠেছে গৌণ আর গৌণ হয়ে গেছে মূখ্য। বোরকা মূলতঃ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে তৈরি মেয়েদের জন্য এক প্রকার বিশেষ পোশাক। যা পরিধানের উদ্দেশ্যে নারীকে আচ্ছাদিত রাখা, সহজ কথায় নারীদের পরপুরুষের চোখের আড়াল রাখা। এটি হচ্ছে তাদের স্টাইল। আবহমান কাল ধরে ধর্মভীরু মুসলিম নারীরা নিজেদের একটু অবরোধ করে রাখতে পছন্দ করে আসছেন এবং এখনও করেন। তাই তারা এই বোরকার অভ্রুতে নিজেদের মুড়িয়ে রেখে বেশ সাচ্ছন্দ বোধ করেন। কিন্তু বর্তমান কালের অবিবাহিত বাঙালি মুসলিম নারীগোষ্ঠী বোরকাকে ফ্যাশন হিসেবেই গ্রহণ করেছে। তাদের পর্দা প্রথা মেনে চলা লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য হচ্ছে নিজেদের আর একটু কামনাময়ী করে তোলা। মেয়েদের চোখের আর্ট সর্বদাই চমৎকার। কুৎসিৎ চেহারার একটি মেয়েকেও নাসাগ্র পর্যন্ত কালো পর্দায় ঢেকে দিয়ে তার চোখের দিকে তাকালে স্পষ্ট লক্ষ্য করা যাবে, চোখ থেকে ভিন্ন এক দ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। আর সে যদি হয় কালো থেকে একটু ফর্সা তবে সে বিশ্ব সংসারের সকল হাটে দু পয়সা কড়া মূল্যে সমাদৃত হবে। হোক নাক বোঁচা, গাল ভাঙা, দাঁত উঁচু অথবা ক্ষীণ স্বাস্থের কিংবা নিচের ঠোঁট উপরের ঠোঁটের তিনগুণ বা দুটিই চমৎকার পাতলা যা বানরকেও হার মানায় অথবা পুরুত্বের গুণাগুণে দুটির ওজন আড়াইশত গ্রাম- লেপ্টে লিপিস্টিক মাখলে মানুষ খেকো প্রাণী হিসেবে চিড়িয়াখানায় চালিয়ে দেয়া যাবে। এদেরও আকষর্ণীয় করে তুলতে বোরকার তুলনা কেবল বোরকাই।"
আসাদের এত সব কিছু লিখার পেছনে কারণ হচ্ছে- সে এক বোরকা আলী নিনজার খপ্পরে পরেছিল প্রায় ছ মাস আগে। পাঁচ ফিট চার ইঞ্চি দেহগড়নের মেয়েটির আগাগোড়া বেশ চমৎকার। চোখ যেন সাক্ষাৎ বনলতা সেনের কাছ থেকে ধার করা, ফর্সা যৎসামান্য বেশি। আসাদের বাবা মোল্লা টাইপের মানুষ। তাই ওর ধারণা হয়েছিল, বোরকা পড়া মেয়ের ক্ষেত্রে তার বাবার পক্ষ থেকে কিছুটা হলেও ছাড় পাওয়া যাবে হয়তো। ছয় মাসের প্রেমের পরে অনেক চেষ্টা তদবীরে মেয়েটির মুখের উপরের কালো পর্দাটি সরাতেই তার সৌন্দর্যের তীব্রতায় ঝলসে গেছে আসাদ। তার বর্ণনায় : " তিন বিঘে জমিজুড়ে নাক, তার নিচে বাঁকা দুটি ডলফিন মাছ (ঠোঁট) দাতের কথা বলতে হারি যাই গ্রিনিজ রেকর্ড বুকে হাতির দাতের সাথেও তার দাতের জুড়ি মেলা ভার।"
অথচ এই মেয়ের পাত্তা পেতে আসাদকে অনেক কাঠখড়ি পোড়াতে হয়েছে, তেল-নুনও কম যায় নি। আসাদের চিঠি পাবার পর থেকে লগ্নর মন বেশ হালকা হয়ে উঠেছে। অন্তরজ্বালা কিছুটা হলেও কমেছে। আসাদের তুলনায় লগ্ন এখনও তৃষার জন্য তেমন কিছুই করে নি। তবে তৃষা সুন্দরী তা অকপটে স্বীকার্য । সৌন্দর্যের বিবেচনায় তার কোনো দিকে কমতি নেই। বনলতা সেন, পিয়েটা, মোনালিসা বা হেলেন মতো তৃষাও একজন বলেই লগ্নর ধারণা। তাই বলে তৃষা লগ্নকে একদম পাত্তা দেবে না এটা মেনে নিতে লগ্নর যথেষ্ট কষ্টের উদ্রেক হচ্ছে। ছেলে হিসেবে সে শিব নারায়ণ না হলেও তৃষার তুলনায় অযোগ্য বলে বিবেচিত হবার কোনো কারণ নেই। সুন্দরী মেয়েদের অহংকার একটু-আধটু থাকবে এটাই স্বাভাবিক । লজ্জা নারীর ভূষণ রূপ নারীর অহংকার এটা চিরায়ত। তাই বলে সেই অহংকারের দর্পে সে ধরাকে সরা জ্ঞান করলে তা হয়ে যায় কদার্য- মেনে নেয়া যথেষ্টই কষ্টসাধ্য। লগ্ন আজ পর্যন্ত মুখ ফুটে তৃষাকে যদিও তার আলোচ্য কথাটির প্রসঙ্গ এবং ব্যাখ্যা কোনোটিই করে নি কিন্তু ইঙ্গিতে বুঝিয়েছে সবটুকুই। তৃষাদের বাসায় লগ্নর অবাধ যাতায়াত। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনেই যায়। প্রয়োজন তৃষার সাথে দেখা হওয়া আর অপ্রয়োজন যে উদ্দেশ্য দেখিয়ে সে তৃষাদের বাসায় যায়। তৃষার সাথে দিনে অন্তত এক বার দেখা না হলে সে দিনটিকে লগ্ন তার জন্য শোক দিবস হিসেবে ধরে নেয়। কিন্তু তৃষা লগ্নকে দেখলেই চেহারাটা এতটা সংকুচিত করে ফেলে যেন হঠাৎ করে একরাশ মেঘ পূর্ণিমার চাঁদকে গ্রাস করল। রাত-বিরাত হুতুম পেঁচা দেখলে মানুষ যতটা ভয় পায়, লগ্ন তৃষাকে ওই অবস্থা দেখলে তার চেয়ে কিছু কম যায় না। ভয় না পেলেও নিজের কাছে নিজে খুব ছোট হয়ে যায়। ক দিন আগে লগ্ন তৃষাকে প্রাসঙ্গিকভাবেই বলেছে হাসলে তোমাকে চমৎকার দেখায় এবং তুলনাটি দিয়েছে মোনালিসার। এতে তৃষা রেগে আগুন; পরেতো সংসদ থেকে ওয়াক আউট করে সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করে। লগ্ন বোঝে না এ কথায় তৃষায় এতটা রেগে যাবার কী কারণ থাকতে পারে। সে তো সত্যটিই প্রকাশ করেছে। সত্য প্রকাশ করায় আর যা-ই হোক কোনো অপরাধ থাকতে পারে না। মেয়েটি আশ্চর্য রকমের পায়াভারী!
গতরাতে লগ্ন চারটায় ঘুমোতে গেছে। আবার সকাল সাতটায় তাকে উঠতে হয়েছে। তাই সকালের নাস্তাটা সেড়ে আবার ঘুমাতে গেছে কিন্তু ঘুম চোখের পাতায় বসতে নারাজ। হয়তো ঘুম চোখের পাতায় বসতে চাইলেও তৃষা তাকে তাড়িয়ে নিজেই সে স্থান দখল করে নেয়। আপন মনে বিচরণ করে। যতই ঘুমানোর চেষ্টা করছে লগ্ন ততই তৃষা এসে মনের দরজায় কড়া নাড়ছে। অসহ্য একটা যন্ত্রনা। যতই তৃষাকে ভুলতে চাওয়া ততই তৃষার তৃষ্ণায় কষ্ট পাওয়া। অথচ তৃষা লগ্নর কষ্ট বুঝেও কষ্টের ক্ষতে আরো আঘাত হানে। ক দিন আগে লগ্ন ডেক্স কেলেন্ডারে উপর গোটা গোটা অক্ষরে লিখেছে : " প্রেম এমন আগুন যা জ্বালাতে চাইলেই জ্বলে না, আবার নেভাতে চাইলেই নেভে না।" তা দেখে লগ্নর বন্ধু হাবু হাটে ঢোল দিয়েছে। হাবুর ধারণা লগ্ন কারো খপ্পরে পরেছে।
লগ্ন চাপা স্বভাবের ছেলে না এটা সত্য কিন্তু সে প্রতিজ্ঞা করেছে তৃষার ব্যাপারটি সে কারো কাছে বলবে না। এমন কি তৃষাকেও না। তৃষা তার কাজকর্মে ব্যবহারে বুঝতে পারলে বুঝুক না পারলে নাই। অবশ্য লগ্নর দ্বারা "আমি তোমাকে.... ইত্যাদি," একথা বলাও অসম্ভব। তৃষাকে দেখলেই যার গলা শুকিয়ে যায় তার বলবার যোগ্যতাই বা কোথায়! হাবু অবশ্য গত পরশু থেকে লগ্ন ও তার প্রেম বিষয়ে ব্যর্থ বিজ্ঞাপন দেয়া বন্ধ করেছে। কারণ লগ্ন সোজা বলে দিয়েছে- " তোরা যাকে প্রেম-ভালোবাসা বলিশ ওসব আমাকে স্পর্শ করে নি, করবেও না। ওসব ফালতু ব্যাপার নিয়ে আমার সামনে এলে এক চড়ে বত্রিশ পাটি দাঁত বিনাশ করে দেব।" পরক্ষণেই বেশ ভারিক্কি সুরে বার্নাড শ' র উক্তির সাথে আরো একটু লেজ লাগিয়ে বলেছে : " ওসব Love-টাব কিছু না ও হচ্ছে মা হবার Instinct আসল কথা Sex. এতো গেল মেয়েদের ক্ষেত্রে, ছেলেদের ক্ষেত্রে যা তা হচ্ছে- নিজের অতৃপ্ত যৌনতাকে চরিতার্থ করার একটা কৌশলমাত্র। ফ্রয়ডের মনোবিকলন তত্ত্বই হচ্ছে খাটি জিনিস। তোরা তো আবার ওসব পড়ে-টড়ে দেখিস নি।
ফ্রয়েড বলেছেন,মানুষমাত্রইভোগবাদী-..................................ইত্যাদি ইত্যাদি|"
দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আবারও ঘুমের চেষ্টা চালিয়ে যেতে লগ্ন। ঘণ্টাখানে হলো বিছানায় এপাশ ওপাশ পর্যন্তই সার। সারাটা দিন মাটি কাজের কাজ কিছুই হলো না। কেবল ঘুমের চেষ্টা তাও যদি হতো। আজ রাতটাও মাটি হবে। এ জন্য লগ্ন কখনো বেশি রাত জাগে না। অথচ বন্ধুনামের এই প্রাণপ্রিয় বাদরগুলো এক জায়গায় হলে...... যেমন গতরাতে হলো। বিকেলে পাবলিক লাইব্রেরিতে যেতে হবে। লগ্ন শুনেছে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের মাথায় নিউরণের সংখ্যা বেশি। এ কোষগুলো ছেলেদের কি কাজে লাগে তা লগ্ন ক দিন থেকে বেশ ভাবিত। জানতেই হবে। আর জন্মগতভাবেই মেয়েদের মাথায় নিউরণ কোষের সংখ্যা কম কেন- এটিও একটি সমস্যা অন্তত লগ্নর কাছে।
অনেক চেষ্টার পর ঘুম এলো সত্যি কিন্তু যখন ঘুম ভাঙল তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সাতটা ত্রিশ মিনিট। তৃষার ছোটবোন তানু ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রী। ওকে মাঝে মাঝে কিছু বাড়ির কাজ Solve করে দিতে হয় লগ্নকে। কোনো রকম হাতমুখ ধুয়ে তৃষাদের বাসার দিকে রওনা হলো সে। যেতেই তানু বলল- ভাইয়া তুমি না এলে কি যে অবস্থাটাই না হতো আজ।
কেন? কী হয়েছে?
কী হবে আবার, আগামীকাল আমার ক্লাস পরীক্ষা অথচ প্রশ্নের উত্তরগুলো তুমি এখনো তৈরি করে দাও নি।
পড়ার টেবিলে যাও আমি আসছি।
তানু আর লগ্ন বেশ কষে পড়ালেখা শুরু করেছে। এরি মাঝে রুমে ঢুকল তৃষা। সে তার বান্ধবীর বিয়েতে যাবে। ওয়ারড্রবে থেকে কাপড় বের করতেই তার এ রুমে আসা। লগ্নকে পাশ কাটাতে গিয়ে ওয়ারড্রবের সাথে ধাক্কা খেল। এমনি সময় নেই, তার ওপর কাকে নিয়ে যাবে তাও এখনো ঠিক হয় নি; তার মধ্যে আবার ওয়ারড্রব খুলতে গিয়ে ধাক্কালাগা- এ আরেক যন্ত্রণা! বেশ বিতৃষ্ণার সাথে তৃষা বলল- লগ্ন, চেয়ারটা একটু টান দিয়ে বসো না !
লগ্ন বিনে বাক্য ব্যায়ে চেয়ার টেনে বসল। ড্রেসিং করে আবার তানুর রুমে এলো তৃষা। সম্ভবত তার বিখ্যাত কসমেটিকস্ বক্সটি দরকার। হ্যাঁ দু চার সেকেন্ড পরে তাই প্রমাণিত হলো। এবার সোকেস খুলতে গিয়ে পুরানো সমস্যাটি নতুন করে দেখা দিলো। আগের বার বাম পাশ থেকে ওয়ারড্রবে ধাক্কা খেয়েছিল। এবার ডান পাশ থেকে সোকেসের সঙ্গে ধাক্কা না খেলেও খেয়েছে লগ্নর সাথে। ফলে আবার মেজাজ এবার সপ্তমে। তৃষা কিছু বলার আগেই লগ্ন ওর চেয়ার সোকেস তো বটেই টেবিল থেকে বেশ দূরে সরিয়ে নিল। তৃষা তার কাজ শেষ করে বের হয়ে গেল। লগ্ন-তানু আবার পড়ায় মন দিল। পাঁচ মিনিটের মাথায় তৃষার পুনঃ প্রবেশ। একেবারে সাজুগুজু করে। লগ্ন আবার চেয়ার সরাতে যাচ্ছিল এমন সময় তৃষা তার সভাব সুলভ যথেষ্ট বিতৃষ্ণা নিয়ে লগ্নর উদ্দেশ্যে বলল : " তোমরা আজ ড্রয়িং রুমে বসতে পারতে। দেখছো এ রুমে কত ঝামেলা অথচ দেখেও তোমরা না দেখার ভান করে আছো।"
লগ্ন চুপ করে থাকলেও ফোঁস করে উঠল তানু। “আপু তুমি অতিরিক্ত করছ। কাকে নিয়ে তুমি তোমার বান্ধবীর বিয়েতে যাবে সে চিন্তা আগে করতে পার নি? এখন ঝাল ঝাড়ছো আমাদের উপর। আর ভাইয়াকে তুমি রিতিমতো অপমান করছ। শুধু আজই না সেদিনও করেছ। লগ্ন ভাইয়া বলেই তোমার এসব সহ্য করে অন্য কেউ হলে করত না।
স্পষ্ট ভাষায় মুখের ওপর জবাব দেয়া এবং পাকামো করা তানুর জন্য নতুন কিছু না হলেও তৃষার প্রায় মিনিট খানেক সময় লাগল ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝে নিতে।
তা তোমার লগ্ন ভাইয়ার জন্য এখন কী করতে পারি ?
তুমি আবার নতুন করে কী করবে। বরং আমি যদি ভাইয়াকে বলি তবে ভাইয়া তোমার সাথে গিয়ে তোমার আজকের সমস্যাটা মিটিয়ে দিতে পারে। তাতে আমাদেরই তোমার জন্য কিছু করা হলো।
ঠিক আছে তোমার ভাইয়াকে আমার সাথে যাওয়ার ব্যবস্থাটা করে দিয়ে পরোপাকারে নিজেদের ব্রত কর। আর তোমার ভাইয়া যদি আমার কোনো ব্যবহারে কষ্ট পেয়ে থাকেন তবে যেন নিজ গুণে ক্ষমা করেন। ক্ষমা মহৎ গুণ। তোমরা তো আবার মহৎ প্রাণী।
আমাদের প্রাণ আছে মনও আছে তাই আমরা মানুষ। কিন্তু তুমি প্রাণী আর মানুষের তফাৎটা সম্ভবত মেজাজের সাথে মিশিয়ে স্যুপ বানিয়ে খেয়ে ফেলেছো - তানু বলল।
এতক্ষণ পর লগ্ন বলে উঠল : ওসব ক্ষমাটমা আমার দ্বারা হবে না। আমি আমার দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণার প্রতিশোধ নেব। কষ্টের পরিবর্তে কষ্ট দেব। আমি শিব নারায়ণ হয়ে বিশ্ব সংসারের সমস্ত কষ্ট-যন্ত্রণার বিষ পান করে নীলকণ্ঠ ধারণ করতে চাইনে। আমি এর একটা সুরাহা চাই। এর রিফর্ম হবে ইভোলিউশন দিয়ে নয় একেবারে রক্তমাখা রিভোলিউশন দিয়ে।
একথায় তৃষা বেশ থমথমে ভাব নিয়ে লগ্নর চোখের দিকে তাকালো। লগ্ন তা উপেক্ষা করে তানুকে পড়ানোর কাজে ব্যস্ত হবার ভান করল। তৃষা মিনিট খানেক লগ্নর দিকে তাকিয়ে থেকে তানুকে বেশ শীতল কণ্ঠে বলল
তোমার লগ্ন ভাইয়াকে বল আমাকে এখনি একটু দিয়ে আসতে আমার হাতে সময় নেই।
ভাইয়া প্লিজ একটু যাও না, আপুকে দিয়ে আসো।- বলল তানু ।
গত শতকের স্বামী-স্ত্রীর মতো পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি এ্যাঙ্গেলে কথা না বলে সরাসরি বলতে সমস্যা কোথায়?
এ কথায় তৃষা রুম থেকে বের হয়ে গেল। লগ্ন তার কাজে মন দিল। দু তিন মিনিট পর তানু ঘোষণা করল-
" ভাইয়া আমার এখন আর পড়তে ইচ্ছে করছে না।"
কেন?
আমার মন খারাপ হয়ে গেছে। আপুকে কাঁদতে দেখলে আমারও কান্না পায়।
তোমার আপু যে কান্না করছে এটা তুমি কী করে দেখলে ? তুমি তো এখানে।
আমি জানি, সেদিনও তোমার সাথে রাগ করে আপু কেঁদেছে। আপুর রুমে গিয়ে দেখগে এখন সে কাঁদছে।
লগ্ন মোটামুটিভাবে আহাম্মক বনে গেল। এরকম তুচ্ছ একটা ঘটনায় কাঁদার কী থাকতে পারে। তাও তৃষার মতো মেয়ের। যে মেয়ে যে কোনো মুহূর্তে লগ্নর ঘার মটকে দেবার যথেষ্ট ক্ষমতা রাখে- তার লগ্নর কথায় কান্না মানায় না। লগ্ন তৃষার রুমে গিয়ে দেখলো তৃষার ‘হাপুস নয়নে’ কাঁদছে। কান্নার দমকে দমকে হেস্কী তুলছে। খুবই বিস্ত্রি ব্যাপার। খালাম্মা দেখে ফেললে কি তুলকালাম কাণ্ডটাই না ঘটে যাবে। লগ্ন উপায়-অন্ত না দেখে তৃষার আরো কাছে গিয়ে বলল- " তৃষা দয়াকরে কান্না বন্ধ করে হাতমুখ ধুয়ে নতুন করে রেডিও হও। তোমাকে দিয়ে আসি। এইটুকু করতে পারলেও অন্তত কিছুটা পাপ মোচন হবে।"
তৃষা কোনো জবাব দিল না। উপরন্তু তার কান্নার তীব্রতা একটু বাড়ল বৈ কমল না। লগ্ন কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে আবার বলল- " আমার কথায় কষ্ট পেয়ে থাকলে তা আমার অনিচ্ছায়। বিশ্বাস করো আমি ইচ্ছে করে তোমাকে কোনো কষ্ট দেয়ার কথা চিন্তাও করতে পারি না। তাছাড়া আমারা দু জন তো তোমার সাথে ফান করছিলাম।" কান্না চলল অবিরাম গতিতে; সাথে হেস্কী। যেন নদীর স্রোত আর ঢেউ এর সহ-অবস্থান। লগ্ন তানুর পড়ার রুমে ফিরে গেল। তানু চুপচাপ বসা। বইয়ের পৃষ্ঠায় চোখ থাকলেও মন নেই। তার মন এখন কোথায় বিচরণ করছে সে নিজেও জানে কি না সন্দেহ। লগ্ন তানুর মুখোমুখী অন্য চেয়ারটিতে বসে রইল কিছুক্ষণ। শেষে তানুর দিকে তাকিয়ে হেসেবলল- " তানু যাও তো দিদি ভাই, বড় আপুর কান্না থামিয়ে মান ভাঙিয়ে পাঠিয়ে দাও।"
" আপনি যেমন আপুও তেমন। বাসায় একসঙ্গে দুটি পাগল জুটছে।" বলেই তানু চলে গেল। প্রায় দশ মিনিট পরে তৃষা স্বশরীরে এসে হাজির। বেশ ফ্রেস লাগছে ভদ্র মহিলাকে। তারপরেও চোখের দিকে ভালো করে লক্ষ্য করলে কিছুক্ষণ আগের ঝড়ের তীব্রতা উপলব্ধি করা যাবে। তৃষা এসে ফিক করে হেসে দিয়ে বলল-
তুমি কি এভাবেই যাবে?
অন্য ভাবটা পাব কোথায়?
না- মানে হাতমুখ ধুবে কি না।
আমি তো আর লগ্নর তৃষ্ণার উদ্রেক করে দিয়ে গঙ্গা, যমুনার জন্ম দিয়ে আবার নিজেই ফারাক্কার বাধ সাধি নি যে....।
হয়েছে হয়েছে এখন জনাবের প্রস্থান করতে আজ্ঞা হয়।
লগ্ন উঠল। তিন তলা থেকে সিড়ি দিয়ে নামার সময় তৃষার শরীর থেকে চমৎকার একটা ঘ্রাণ পেল লগ্ন। এ ঘ্রাণের সাথে অন্য কোনো ঘ্রাণের তুলনা করতে পারছে না সে। বাসার গেট থেকেই রিক্সা পেল তারা। রিক্সায় উঠে সুযোগ সন্ধানী লগ্ন তৃষার শরীরের ঘ্রাণ বুক ভরে নিঃশ্বাসের সাথে নিতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল।
এই কী ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছো কেন বারবার।
কই? কখন?
এটিও কি আমি বানিয়ে বললাম তোমাকে কষ্ট দেবার জন্য।
কষ্ট পাওয়া যার স্বভাব তাকে কেউ কষ্ট না দিলেও সে পায়। পুরানো কষ্টগুলোকে বপন করে নতুন কষ্ট উৎপাদন করে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল দু জনই। তারপরে তৃষা লগ্নর বাম হাতটি ধরে বেশ নিচু গলায় বলল : লগ্ন আমার কথায় রাগ কর না। আসলে তোমার নিঃশ্বাস সত্যি সত্যি আমার ঘাড়ে লাগছিল। আমার সমস্ত শরীর শিরশির করছিল।
" তোমার শরীরে চমৎকার একটা ঘ্রাণ আছে, তা আজই প্রথম আবষ্কিার করলাম- যা পৃথিবীর আর সমস্ত ঘ্রাণ থেকে আলাদা। আর এটি যখন আবিষ্কার করলাম তখন আমি এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলাম যে... ...। " একটু থেমে আবার শুরু করল লগ্ন - " আর এতটা বেখেয়ালী হওয়ার ফলেই আমার নিঃশ্বাস তোমার ঘাড়ে পড়েছিল। তৃষা তোমার শরীরে ওই ঘ্রাণে কী যে আছে তা তুমি বুঝবে না। ওই ঘ্রাণের নেশায় কবে যে আমি উন্মাদ হয়ে যাই ঠিক বলতে পারি না।" তৃষা লগ্নর কথায় প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
রিক্সা চলছে বেশ গতিতে। রাস্তা বেশ ফাঁকা। সোডিয়াম লাইটের হালকা আলোয় সামনে যা কিছু দেখছে সবই স্বপ্নীল মনে হচ্ছে। পুরানো রাস্তাঘাট, দুপাশের বিল্ডিংগুলো নতুন হয়ে উঠেছে। তৃষা লগ্নর হাতটি আরো শক্ত করে ধরেছে। তৃষার মধ্যে কেমন যেন একটা ‘ছটফটানি’ কাজ করছে। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করতে গিয়ে তৃষা ধরা পরে গেল লগ্নর কাছে।
তৃষা তোমার কোনো কষ্ট হচ্ছে?
না, কেন?
কেমন যেন থেমে থেমে নিঃশ্বাস ছাড়লে এইমাত্র।
ও কিছু না। আমি ভাবছি অন্য একটা কথা।
কি?
তোমার ধারণা আমি তোমাকে কষ্ট দিয়ে বেশ আনন্দ পাই। বিশ্বাস করো এ তোমার ভুল ধারণা।
যা ভুল যা মিথ্যে তার আলোচনা নিঃপ্রয়োজন। তবে কিসে তোমার আনন্দ-সুখ আর কিসে তোমার কষ্ট তা জানার আকাঙ্খা আমার অনেক দিনের।
কিন্তু কখনই তা বল নি তুমি।
এই যে আজ বললাম।
আচ্ছা, তোমার কি কোনো কষ্ট আছে?
সম্ভাব্য একটি কষ্ট ছাড়া আমার অন্য কোনো কষ্ট নেই আমার।
তোমার সম্ভাব্য কষ্টাটা কী?
যখন তৃষা অন্যের হবে।
তৃষা একটু চুপ করে থেকে লগ্নর আরো গভীরে চলে যায়। লগ্নর হাতটি সে কোথায় রাখবে বুঝে পাচ্ছে না যেন দিশেহারা এক পাখি। হালকা কাঁপুনি অনুভব করছে শরীরে। তৃষা কাঁপাকাঁপা কণ্ঠ লগ্নর কথার জবাব দেয়- " তৃষা কখনো অন্যের হবে না। লগ্ন তৃষাকে যতটুকু ভালোবেসেছে, তৃষার ভালোবাসা লগ্নর প্রতি তার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। লগ্নর কষ্টে তৃষা কেঁদেছে অহর্নিশ। অথচ লগ্ন কখনো তার এ কান্না উপলব্ধি করে নি। জানায় নি তার ভালোবাসার কথা দৃঢ়তার সাথে। এখানেই ছিল তৃষার সমস্ত কষ্ট-যন্ত্রণা। আজ যখন লগ্ন বলল কষ্টের পরিবর্তে কষ্ট দেবো তখন অন্তত এইটুকু প্রমাণিত হল যে লগ্নর ভেতরে দৃঢ়তা বলতে কিছু আছে। ছেলেদের দৃঢ়তা তার ব্যক্তিত্বে যার অপর নাম পৌরষ- যা মেয়েদের সবসময় কাম্য।"
তৃষা থেমে যেতেই লগ্ন তার পৌরুষদীপ্ত কণ্ঠে আবৃত্তির ভঙ্গে উচ্চারণ করতে লাগল-
মানুষ হয়ে বাঁচা প্রয়োজন-
এই সত্যটি উপলব্ধির বাইরে ছিল
অন্তত তোমাকে দেখার পূর্ব পর্যন্ত
অথচ তোমাকে দেখার পর থেকে
অহর্নিশ জ্বলে
শশানে এক চিতা... ...।
রিক্সার গতিতে বাতাসের তীব্রতা বেড়েছে। একটা হিমেল হাওয়ার ঝাপটা বারবার স্পর্শ করছে তৃষাকে। তৃষা নিজের কোলে লগ্নর একটি হাত রেখে সে হাতে সমর্পণ করেছে নিজেকে। লগ্নর ঘাড়ে মাথা রেখে উম্মনা হয়ে রয়েছে লগ্নের কবিতায়। আর লগ্ন উজ্জিবীত তৃষার শরীরের সেই তুলনাহীন ঘোর লাগা সৌরভে।