হারায়ে খুঁজে ফিরি
ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে এর মাঝে সব ভুলে কাথাঁমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকার আমেজটা নিতে চাইতাম কত করে। কিন্তু বৃষ্টি আসার লক্ষনেই ছুটে গিয়ে উঠান থেকে কাপড় তোলো, পূব-দক্ষিনের জানালা টেনে দাও, বসার ঘরে কার্পেটটার কোনা বড় করে ভাঁজ করে দেও, ঘরে ঘরে বৃষ্টির পানি পড়া জায়গায় ফলস সিলিং সরিয়ে তার নীচ বরাবর ঘটিবাটি দেও, আল্লাহ আল্লাহ করো পশ্চিমের গাছটার ঝাপটায় যেন কাচঁ না ভেঙ্গে পড়ে প্রায় যেমনটা হয় - এমনি কতো, কতো কি যে ছুটাছুটি লেগে যেত এক বৃষ্টি এলেই! এতকিছু করেও মা'র বকুনি শুনে বারান্দাতেই বৃষ্টির ছাঁটে বসে থাকা নইলে তো বড় বড় আম-কাঠাল-নারকেল-জাম-বেল গাছে ঘেরা টানা উঠানে ঝপাঝপ ভিজতে নেমে পড়া, শিল কুড়ানো। বৃষ্টির ফোঁটা পড়তেই সোঁদামাটির এক ভাপে ভরা গন্ধ বেরোয় চারপাশে, ধূলার আস্তরে ভরা রঙ্গনগাছটার পাতা ঝকঝক করে উঠে, পাচিলের কোনাঘেষা বেলি ফুলগুলো আরো ঝুমকো হয়ে যেন মাটি ছুঁতে চায়, গন্ধরাজ,লিলি, বেলি, দোলনচাঁপা - সাদারঙের ফুলগুলো সব যেন পাল্লা দিয়ে ঝাপিয়ে ফুটে রইত এই বরষাতে, নারকেল গাছ জড়ানো বিশালাকায় মানিপ্ল্যানটা সবুজে সবুজে আলো ছড়াতো, কলতলার মেহেদিগাছের নীচটা সজীব এক ঘ্রানে মৌ মৌ করতে থাকে, আর হরেক রকমের পাতাবাহারগুলো আরো বাহারি হয়ে যায়, আর টিনেরচালে শুরুর দিকের শোঁ শোঁ বাতাস, পরিনত বৃষ্টির ঝমঝম ঝঙ্কার, আবার কমে আসতে থাকার মিয়ানো টুপটাপ ফোঁটা - সব, সব অনুভব করা যেত ধাপে ধাপে। বৃষ্টি হলে এই ছিল নিত্যদিনের চিত্র। হারায়ে খুঁজে ফিরি সেসব।
এখন কেবল দেয়ালজোড়া স্লাইডিং দরজায়, বারান্দার গ্রিলে জমে থাকা পানির ছাঁটেই বুঝতে পারি বৃষ্টি হয়ে গেছে! দোর লাগালেই গন্ধহীন বৃষ্টি, ঝমঝম শব্দহীন নিস্তব্ধতাইয় জুড়ে থাকে। আটতলা অব্দি মাটির সেই গন্ধ এসে পৌঁছায় না, আশপাশের কংক্রিটে ছাদে ছাদে বৃষ্টিতে ভেজার ধুম লাগে,। চেয়ে চেয়ে দেখিই কেবল, ভিজতে এতোটুকু মন টানে না। আমার কাদামাটির পিছল উঠান বারংবার মনে পড়ে।
আমার পছন্দের সময় শীতকালটা রয়েসয়েই যেত। উঠানে আলাদা করে বাশঁ লাগানো হতো লেপগুলো শুকাতে দেয়ার জন্যে। সূর্যের তাপ বাড়লে লেপগুলোকে রোদ্দুর দেখাও য়াবার বেলা থাকতে থাকতে ঘরে নেও। ভেন্টিলেটরগুলো কাগজ দিয়ে ঢেকে দিতাম, যদিও চালের ফাঁক দিয়ে যথেষ্ট বাতাস চলাচল করতে পারতো। কাচঁ, চাল ঘেমে কুয়াশার আনাগোনা, ঠান্ডা লেগে টন্সিল ফুলেফেঁপে একাকার, বিরক্তিকর গার্গেল করো নিয়ম করে। সকালের অপরুপ সূর্যটা কি দারুন কুসুমরঙ্গা সেই সূর্যটা, ওর প্রেমে পড়েছিলাম ঠিকঠিক, নইলে এত্তো আরামের মলমল কাপড়ে ঘেরা গাব্দাগোব্দা লেপের মাঝ থেকে উঠে রইতাম কেবল ঐ সকালের সূর্যকে দেখব বলে। উঠনের কোনাকাঞ্চির ঘাসগুলো হীরেরকনা মেখে বসে রইত। লজ্জাবতিটা সবচেয়ে সাজুনি, কিন্তু ছুঁতে গেলেই সব গলিয়ে নাকের পানি চোখের পানিতে একাকার হয়ে যেত। ঝাকায় বাওয়ানো গাছের লকলকে শশার গায়ের সাদা আস্তরের উপর শিশিরকনা মন খুশি করে দেয়। ঘরভরা ভাইবোনের প্রতিযোগিতায় আগে আগে না উঠলে দিনের পত্রিকার দখল পাওয়াতে ঝক্কিই ছিল। রোদে পিঠ দিয়ে বসে সকালের পত্রিকা পড়তে পড়তে গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ের চুমুকে সেকি আবেশ। রাতটা এসে যেত যেন ঝুপ করেই, শীতের সেই হিমহিম হালে হিটার জ্বেলে দিয়ে লেপের ওম নেয়ার মজাই আলাদা।
এখন শীতের হাঁড়কাঁপুনিও টেরই পাইনা, লেপগুলো রোদের দেখা পায়নি, হালকা কাঁথাতেই চলে যায় শীতকাল। ঘনপাতার আলিঝালি ফাঁক দিয়ে আকাশ জুড়ানো জ্যোৎস্নার আলোতে পুরো উঠানটা যেমন মায়াতে ভরে রইত, এখন ঝকঝকা চাঁদটার এতো কাছে রয়েও শুন্যতা ছেয়ে থাকে সবটা জুড়ে, স্নিগ্ধতা নয় জ্যোৎস্নার তীব্রতায় ভরে থাকে গোটা বারান্দা।
গরমকালটায় টিনের চাল তেতে কিযে ভ্যাপসা গরম ছেয়ে থাকতো গোটা ঘর জুড়ে, মোটা পরতের ফলস সিলিং কতইবা গরম কমাতো, আর মধ্যবিত্তের ঘরে দিনভর এসি চালিয়ে রাখা মুশকিলই ছিল, সেটা মাঝেমধ্যেই চলতো। পশ্চিমের ঘরটা গড়পরতা ঠান্ডা থাকতো বিশালদেহী জাম-নারকেল-কাঠাল-সুপারি গাছগুলোর কল্যানে। গরমেরকাল বিরক্তিকর ছিল, টুপটাপ পাকাজাম পড়তেই থাকতো, আর বাতাস হলেতো আস্ত নারকেলই ধুম করে মাঝরাতে পড়তো ঠিক যেন মাথার তালু বরাবর। দুপুরের ঘুমও হবার জো রইত না এই মধুমাসে, সীমানাপ্রাচীর পেরিয়ে আসার চেয়ে পাশেরবাড়ির কার্নিস দিয়ে চালের ওপর এসে সহজেই নাগালে এসে যেত ডাসা আমগুলো। টকমিষ্টি আমগুলো একেকটা কেজি দেড় কেজি হতো যদি পুরো সময় থাকতে পারতো গাছে, আমের ভারে নুয়ে গাছের ডাল মাঝা উঠানে ঝুলে থাকতো। চালের ওপর দিয়ে হেটে আসা আমচোরের পায়ের শব্দ ধরে ধরে কত্তোদিন চোর তাড়িয়েছি! তুলনামূলক কাঠালগাছ বেশিই ছিল বাড়িতে, বাড়ির সামনের দিকে, ডানেবায়ে এমনকি পেছনের উঠানেও, ফলনও ছিল বেশ। কাঠাল বিলিয়ে কুল পেতাম না আমরা। শুনতাম যে বেল পাকলে কাকের কি! কিন্তু আমাদের বেল পাকার জো ছিল না, পোক্ত হলে কাঁচাই পেড়ে ঘরে রাখতে হতো। ডেউয়া বলে যে মজার একটা ফল আছে তা অনেকেই জানতো না, আমাদের পেছনের উঠানে এত্তো বড় এক ডেউয়া গাছ, ফলটা টক স্বাদের কিন্তু পাকলে কিযে মজার। পূবদিকটা বাড়ির সবজিক্ষেত, তার মাঝবরাবর ছিল সৌদিপেয়ারা গাছ। কি করে যেন বারোমাস এতে পেয়ারা থাকতো, বর্ষায় তো পেয়ারা যেন ঝাপিয়ে পড়তো উঠান জুড়ে, বিলিয়ে জেলি বানিয়ে খেয়েও কত নষ্ট হতো। বাড়ির দু'কোনায় কয়েকপদের লেবুর ঝোপ হয়ে থাকত, একটার তো খোসাও চিবিয়ে খেয়ে ফেলা যেত মোটেই তেতো লাগতো না। করমচা আমাদের কেউ খেতাম না, সবুজগাছটায় লাললাল ফলে কি যে সুন্দর দেখাতো, পাশেরবাড়ির খালারা এসে ঝাপি ভরে নিয়ে যেতেন। নিমের বাতাসে নাকি রোগবালাই দূর হয়, নিমেরপাতাও যে দূর্মূল্যের তা বুঝেই আসেনি কখনো, চালের পোকা তাড়াতে, আলমারির তাকের কাগজের নিচে দেয়াতে, উপটানে দিতে হাত বাড়ালেই নিমপাতা পেতাম। আর এখন টবে একহাত লম্বা নিমগাছ বাচাঁনোর সেকি চেষ্টা আমার।
এই বাসার প্রতি কোনাতে কোথায় কি আছে চোখ বুজেঁ বলে দিতে পারবো, অন্ধকারে এখনো হাঁতড়ে বেড়াই চেনা সেই ঘরের পর ঘর। কোন সুইচবোর্ডের কোন সুইচটা নষ্ট, কোন পিলারের আস্তর খসে গেছে, উঁইপোকারা কোন দেয়ালে বাসা বানিয়ে বিচিত্র নকশা করে রেখেছে, কোন টেবিলেকোনায় খোঁচা রয়েছে কাপড় ফাঁসিয়ে দিতে পারে অনায়াসেই, পানির মটারের শব্দটা কেমন হলে মূহুর্তেই বলে দিতে পারবো পানি উঠছে নাকি কেবলি বাতাস আসছে - সব, সবটা মনে করতে পারি এই এখনো।
খালি পায়ে উঠানের মাটিতে হাটা পছন্দের কাজ আমার, কত বকা খেয়েছি মা'র কাছে এই নিয়ে। চাইলেও আর সময়ে অসময়ে তেমন করে হাটঁতে পারি না, রাত নামলে গা ছমছমে ভয় পাইনা, চোরের ভয়ে তটস্থ থাকি না। দারুন সব সুযোগসুবিধার মাঝে থেকেও অবিরত কি এক শান্তির না থাকাকেই অনুভব করি।
কাকে যেন বলছিলাম, মা-বাবা ঘরে নেই, বাসায় গেছেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সেটা আবার কেমন? বলেছিলাম এই যে ফ্লাটটাতে থাকছি তাই এটা ঘর, আর ডেভেলপারের যন্ত্রপাতি যে বিশাল জায়গাটার গাছপালা-ঘরবাড়ি কেটে গুড়িয়ে খাঁ খাঁ বিলীন করে দিয়েছে সেটা আমাদের বাসা। ৮১ ডিসেম্বর থেকে ২০১২ নভেম্বর, দুঃখ-কষ্টে পার করা সময়, আমাদের বাসায় থাকার সময়।
জীবনটা কেমন অদ্ভুত তাই না? যা কিছু শুভ্র, সুন্দর, সুখের সবটা শুধু অতীতে পড়ে থাকে।
গানের একটা লাইন আছে না, "কেন এতো সুখ ফেলে গেলো, জীবনের সেরা স্মৃতিগুলো"
আসলেই তো। দারুন এক সময় কেটেছে আপনার!
ঢাকা থেকে বাড়ী যখন যাই আজকাল সবসময়ই মনে হয় আবার জন্মাতাম যদি তাহলে এই গ্রামের বাড়ীটাতেই জন্মাতে চাইতাম। এখন আগের মত উঠানভরা দোলনচাঁপা নেই, হাসনাহেনার তীব্র সুগন্ধে ভরে উঠেনা বাড়ী কিন্তু গাছগাছালী ঘেরা বাড়ীটা আছে। ঝুম বৃষ্টিতে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে কাথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাই, সন্ধ্যা নামতেই সামনের খোলা জায়গাটায় যেখানে কিছু পানি জমে সেখানে ব্যাঙ অবিরাম ডাকতেই থাকে। সন্ধ্যার পর বারান্দায় চা খেতে বারান্দায় বসে সবসময়ই মনে হয় এর চেয়ে শান্তির জায়গা পৃথিবীতে আর নেই।
সেটাই সবারই এমনি একটা বাড়ী এখনো কোথাও না কোথাও রয়ে গেছে, আমারি কেবল নাই
বাসায় মাছ পালার অনেক শখ হয়েছিল আমাদের ভাইবোনদের মাঝে, পেছনের উঠানে ডোবার মতো কেটে তাজা মাছ কিনে ছাড়াও হয়েছিল, আব্বা-আম্মা মানা করা স্বত্তেও, কিন্তুক ২দিন না যেতেই সব মরে গিয়েছিল কেন জানি
আমরা ছোট ছিলাম যখন ঝিঝি পোকার ডাকও শুনতাম, তবে আস্তে আস্তে সেটা কমতে কমতে নাই হয়ে গিয়েছিল
আমরা বন্ধুতে ছাড়া অন্য ব্লগে এই রকম লেখা পাওয়া বড়ই ভার৷
সুন্দর একটা লেখা উপহার দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ!
ধন্যবাদ পড়ার জন্যে
কী মায়াময় বাড়ি আর কী মনকাড়া লেখা ...... আমার সেভাবে এমন বাড়িতে থাকাই হয়নি। এমন বাড়ি দেখলেই ঢুকে বলতে ইচছে করে, আমাকে তোমাদের সাথে খেলায় নিবে? আমি তোমাদের একজন হতে চাই
১।
জেবীন,
এতদিন
কোথায় ছিলেন ?
বলুন আগে !
পেয়েছেন কি আপ্নারা ?
যখন খুশি ডুব দেবেন,
ডুবে ডুবে জল খাবেন,
ইচ্ছে হলে নাক দেখাবেন !
আজ যেমন দেখালেন !
এসব কিন্তু চলেবেনা বলছি ।
পাঠকই আপনাদের সব !
পাঠক যদি খেপে যায়
পালাবেন কোন চুলায় ?
কেন লিখেননা ?
কেন্ কেন্ কেন্ ? ? ?
২ ।
আহা ! কি মিষ্টি ছিল
বৃষ্টির ফোঁটা গুলো !
টিনের ছাদের 'পর !
হিমের কণাঁ গুলো
সবুজ ঘাসের শিরে
স্কালের সোনারুদে !
আহা কি মিষ্টি ছিল !
তোমার বলা সব কিছুই
আছে যথাস্থানে,
কেবল তুমি-আমি চলে গেছি
সোঁদা গ্নধের সে গাঁ থেকে !
৩ ।
এমন সুন্দ্র লেখার জন্য ধ্ন্যা পাতা নাদিলে কেউ না কেউ কৃপ্ন বল্বে ৃ!
বড়ই চমেদকার লেখারে... এখন কেবলি স্মৃতির জাবর কাটা
অনেকদিন পর মহামতি'র লেখা...তোমার লেখা পড়লেই সামু'র কথা মনে পড়ে যায়...
আহ!
মন্তব্য করুন