পাখির মত দিন
হে খোদা এতো রোদ দিওনা, এতো গরম হল্কা দিওনা, বৃষ্টি দিওনা, শুধু ছায়া আর ঝিরঝিরে বাতাস দাও । তোমার কাছে এই একটাই চাওয়া । আর কিছু কখনও চেয়েছি বলো?
সকালের ঘুম ভাঙ্গা প্রথম প্রার্থনা তন্ময়ের । প্রতিদিন একই চাওয়া ওর ইশ্বরের কাছে । যতই বলুক আর কিছু চাইনি, ও কিন্তু শীতে একটা গরম কম্বল দিতে বলেছিল ইশ্বরকে । তখন শুধু পাতলা একটা লেপ ছিল ওর । তারপর সত্যি একদিন মিলেছিল একটা নতুন ফুলতোলা কম্বল ।
তন্ময়ের অসীম বিশ্বাস ইশ্বরে । আর ওর মা সেরকম নিস্পৃহ । ওর মা শবনম কখনো ছেলের অন্তর গড়ে দেয়নি, ধর্মের আস্তরও শবনম লাগায়নি । তাহলে এই ইশ্বর এলো কোত্থেকে ? তন্ময় বলে, পাশের ঘরে ওর যে মামা দিনরাত শুয়ে থাকে, শুয়ে শুয়ে বই পড়ে, তার নাকি একজন ইশ্বর আছে । মামা তাকে বলে খোদা । মাঝেমাঝেই তন্ময়ের সামনে হে খোদা বলে বড় একটা শ্বাস ছাড়ে । সেই থেকে মামার উত্তরাধিকারী হয়েছে তন্ময় ।
এই যে কাক ভোরে ঘুম থেকে উঠে খোদাকে ডাকা এটা কিন্তু ওর নিজস্ব আবিষ্কার । শবনম মাঝে মাঝে অবাক হয়, আবার বেশ ভালোও লাগে । সে নিজে আস্তিক না নাস্তিক বোঝে না । সে শুধু বোঝে জন্ম, বেঁচে থাকা আর মৃত্যু । সব নিয়ম মাফিক ঘটবে । এর পেছনে কারো হাত আছে কিনা সে ভেবে দেখেনি । টাইম কই তার! সেই যে কবে থেকে শুধু খেটেই যাচ্ছে । খুব ছোটবেলায় হয়তো ধর্ম টর্ম কিছু একটা ছিল । তখন অবশ্য মা বাবাও ছিল, ছিল অনেক ভাইবোন আর অগুন্তি আত্মীয় । এরা সবাই ছিল মুসল্মান । এরা নামাজ পড়তো, রোজা রাখতো, আর বছরের দুটো ঈদে বিশাল মৌজ মাস্তি করতো । শবনম ওদের আগামসি লেনের বাড়িতে এই ধর্মটা দেখেছিল । ধর্মের বাড়াবাড়ি দেখেছিল । সাদা দাড়িওলা দাদাজিকে দেখতো দিনের বেশির ভাগ সময় একটা মখমলের আসনে বসে থাকতে । সব কিছু কেমন যেন ঝাপসা ঝাপসা লাগে । মনে হয় ওই সবকিছুই অনেক অনেক কাল আগে ঘটে যাওয়া কিছু । শবনমের মনে তাই তার ছিটেফোঁটাও কিছু নেই । আর তারপরে সেই লোকগুলোও একে একে হারিয়ে গেলো । তাদের পুরোনো প্লাস্টার খসা বাড়িতে ধর্মটা আর জেকে বসতে পারলো না ।
এক অদ্ভুত কাকতালই বলতে হবে, শবনম যাকে বিয়ে করেছে সেই লোকটাও ওরই মত । শুধু জানেনা পাশের ঘরে যে ভাই তার সাথে সারা জীবন বাস করলো সে কি রকম । তবে তন্ময়কে দেখে এখন তার মনে হয়, ভাইজান বুঝি নাস্তিক নয় । একটা স্বস্তির শ্বাস কি বের হল এটা ভেবে । শবনমের এটাও বোঝার সময় নেই ।
তন্ময় সকালের নাস্তা নিয়ে মামার ঘরে যায় । তার ইচ্ছা আজ পূরন হয়েছে, খোদা আকাশে গাদা গাদা মেঘ দিয়েছেন । হাল্কা বাতাসও বইছে । কি যে আনন্দ এই ইচ্ছাপূরণে । কিন্তু মামা সেটা জানেনা । তাকে বলতে হবে । কিন্তু ঢুকেই দেখে ঘর আধার হয়ে আছে । মামা ঘরের সবকটা জানালা বন্ধ করে দিয়ে ঘরটা গুমোট করে রেখেছেন । তন্ময় মামাকে ডাকে, ওর মামা শাহেদ টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে ওকে ঘরে ডাকে ।
সব জানালা বন্ধ করে দিয়েছো ক্যানো? তন্ময় প্লেট গ্লাশ রাখতে রাখতে শুধায় ।
শাহেদের চোখে মুখে বিতৃষ্ণা ফুটে ওঠে । ভুরু কুচকে রেখেই বলে, নিচে সব জঞ্জাল । সব পিপড়ের বাচ্চারা নিচে দাঁড়িয়ে হইচই করছে । ওদের আর কোন জায়গা নেই? মনে হয় সব কটাকে হ্যামিলনের বাশিওয়ালা ডাকিয়ে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিয়ে আসি । মরুক ব্যাটারা ।
তন্ময় মনে মনে হাসে । ও জানে শুক্রবারের এই সময়টায় নিচে পাড়ার বাচ্চারা ক্রিকেট খেলে । প্রচুর চিল্লাচিল্লি হয় তখন । তার অবশ্য খারাপ লাগেনা । ওতো মামার মতো নয় যে, সকাল দশটা পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে থাকে ।
একটা কথা তার মনে হয় । সব বাচ্চারা বুড়িগঙ্গায় ডুবে মরলে, ওদের মায়েরা তো আবার বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করবে । মামা সেটা সৈহ্য করবে কিভাবে? এটা ভেবে নিয়ে সে হাসতেই থাকে । মামা খেয়াল করেনা, একটা মোটা বই উলটে যায় কেবল । তন্ময়ের কেবল দশ বছর বয়স হলেও অনেক কিছুই বোঝে সে, যদিও এই বোঝাবুঝিটাও একটু ছেলেমানুষি ভরা । যেমন সে সঠিক জানেনা, তার মামা কেন ঘর থেকে বেরুতে চায় না । সে একটা নিজের মত করে যুক্তি দাড় করিয়েছে । মামা বিয়ে করেনিতো এ জন্য বাইরে যাবার দরকার হয় না । তার বাবা মায়ের মত বিয়ে করলে নিশ্চই বাইরে যেতো, কাজ করতো । এ যুক্তিটি খাড়া করে তন্ময় বেশ সন্তুষ্ট ।
মামার বদ্ধ ঘরে বেশিক্ষন থাকতে ইচ্ছা করে না । তন্ময় ছাদে চলে আসে । বেশি বড় না আবার একদম পিচ্চিও না ওদের ছাদটা । ছাদে কিছু গাছ ছাড়া টব আছে । অনেক পুরোনো চল্টা ওঠা টব । তন্ময় ওগুলোকে উপুড় করে বসার উপযোগী করে রেখেছে । বাড়ির পাশের নারকেল গাছ থেকে একটা শুকনো ডাল ছাদের গায়ে হেলে পড়েছে । তন্ময় সেটাকে টেনে খসানোর চেষ্টা করে । তারপর দেখে গলির মোড় থেকে বাবা ফিরছে বাজার করে । বাবার মাথার টাকটা দেখা যায় । বাবা তার কাছে এক মজার খেলনা । মায়ের মত গম্ভীর নয় আবার মামার মত ঘরকুনোও নয় । বাবাটা দারুণ!! কত গল্প বাবার ঝুলিতে । সারাক্ষন হাসছে । তন্ময় বোঝেনা, মা কেন বাবার মত নয় । যদিও এক্ষেত্রে একটা নিজস্ব যুক্তি আছে তার । মায়ের মাথায় যেদিন টাক পড়বে সেদিন মাও বাবার মত হাসিখুশী হয়ে যাবে । তন্ময় অপেক্ষায় আছে কবে মা আর মামা দুজনের মাথায় টাক পড়বে ।
দুপুরের দিকে আকাশ কালো হয়ে যায় । কিছুক্ষনের মধ্যেই বাতাস আর বৃষ্টিরাও চলে আসে । ঝুম বৃষ্টি । পথঘাট ভিজে নেতিয়ে যায় মুহূর্তেই । তন্ময়ের আজ বিকেলটা মাটি হবে । বাবার সাথে ঘুরতে যাওয়াটা আর হল না । নির্জন ঘরে ততোধিক নির্জন মানুষদের সাথে তন্ময়ের দুপুর পেরুতে থাকে । বাবা আজ ভাত ঘুম দিচ্ছে বৃষ্টি দেখে । মা আর মামা বই পড়ছে । তন্ময়ের ভীষন একা লাগে । চিলেকোঠার ঘুনে ধরা চৌকিতে বসে বসে বৃষ্টি পড়া দেখে । ইশ্বর আজ কথা রাখেনি । অবশ্য সব ইচ্ছেই যে ইশ্বর পূরণ করবে এমন তো নয় ।
* গল্পের বাকিটুকু লেখা হলে পোষ্ট করবো । ছবি নেট থেকে ।
ঈশ্বর সব ইচ্ছে পুরন করে না আবার কোন ইচ্ছেই পুরন করে না। ইচ্ছে পূরনের উপকরন আলাদা।
লেখাটা চমৎকার।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ
দারুণ! অসাধারণ লিখেছো।
বাচ্চাদের চিন্তা ভাবনা গুলি খুব মজার । পড়তে খুব ভাল লাগছিল । ভালই তো চলছিল থামালেন ক্যানো? হাত ব্যাথা হয়ে গেছে নাকি?
হাত তো ব্যাথা হয়ই, টাইপ করলে ব্যাথা হবে না?
পরের পর্ব তাড়াতাড়ি ছাড়েন
ঠিকাছে ।
হ, পরের পর্ব লেখেন তাড়াতাড়ি
হ, ঠিকাছে ।
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম! তন্ময়ের কান্ডকারখানা ভালোই তো!
ছবিটা পছন্দ হইছে!
তন্ময় আমার চাচাতো ভাইয়ের নাম । সে এতো পাকনু !! আসলে ওকে কল্পনা করেই গল্পের এই বাচ্চা চরিত্রটা হঠাত মাথায় আসলো ।
পরের পর্ব দ্রুত লেখেন।
ওক্কে
ঠিক যে লেখাটির অপেক্ষায় ছিলাম আমি...
থ্যংকিউ, থ্যংকিউ ভেরী মাচ।
খুব আগ্রহ তৈরী হলো, পরের পর্বের অপেক্ষায় লিজা
আমি নিজেও অপেক্ষায় ।
আপনের কি খবর? ব্লগে আসার সময়-টময় কি পান, নাকি পান না? জানায়েন সুযোগ হইলে।
মন্তব্য করুন