ইউজার লগইন

কে?

১.
"পিং পং, পিং পং!"
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দরজা খোলার জন্য হাঁটা শুরু করা মাত্র লায়লা বুঝে ফেলে ওটা আসলে কলিংবেলের শব্দ না। বিস্ময়করই বটে। পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়েটি তার, নিঝুম। খেলার ছলে কিভাবে যেন আয়ত্ত করে ফেলেছে, অবিকল কলিংবেলের মতো শব্দ করতে পারে। তারপর শুরু হয় তার কথার বন্যা।

"কে? কে?"

ওপাশের কথা আর কেউ শোনেনা, শুধু নিঝুম শুনতে পায়।

নিঝুমের অনর্গল কথোপকথন চলতে থাকে, "ও! নানা ভাই? কতদিন পরে আসলা!"

"আচ্ছা দাঁড়াও নানা ভাই, আম্মুকে বলছি দরজা খুলে দিতে। আমি তো ছোট! আরেকটু বড় হলে, আমিই খুলে দেবো।"
এটুকু বলে সে ঠিকই, কিন্তু দরজা খোলার জন্য আম্মুকে আর ডাকেনা।

নানা ভাইর সাথে হাজার আলাপ জুড়ে দেয়। ঠিক যেন পান খাওয়া ফোকলা দাঁতের বুড়ি, এক নাগাড়ে বলে যায়, "তারপর বলো, তোমরা কেমন আছো? নানুকে আনলেনা কেন? আচ্ছা, তুমি এত পরপর আসো কেন? ওমা! এত সুন্দর জামা? খালি খালি এত খরচ করলা!"

মাঝে মাঝে কথার স্রোত গতিপথ পাল্টায় দ্রুত, পাল্টায় দরজার ওপাশের মানুষটিও। শোনা যায়, "জানো দাদা ভাই, আব্বু না কালকেও দেরী করেছে। এত কি কাজ তার? সে না তোমার ছেলে? তুমি বকা দিতে পারোনা?"

নিজেকে আড়াল করে পেছনে দাঁড়িয়ে মেয়ের কান্ড-কারখানা দেখে আর মিটিমিটি হাসে লায়লা।

এ এক অদ্ভুত খেলা, সারাদিনে যখন তখন। দরজার কাছে গিয়ে "পিং পং, পিং পং", "কে? কে?"।
তারপর শুরু কথার ফুলঝুরি। কখনও ওপাশে নানা ভাই বা দাদা ভাইর সাথে নানু বা দাদুও থাকে, আবার কখনও তার ভীষন প্রিয় চপল মামা, কিটক্যাট চকলেটের প্যাকেট হাতে।

প্রথম প্রথম লায়লার ভয় হতো, মেয়েটা কি অস্বাভাবিক? এমনিতে খুব লক্ষ্মী, শান্তশিষ্ট, পাকা পাকা কথা বলে। সেটা সমস্যা না। সমস্যা হলো তার ভাবুক প্রকৃতি। অন্য বাচ্চাদের সাথে যে খেলতে খুব অপছন্দ করে তাও না, তবে একা একাও বেশ খেলতে পারে সে -- ঘন্টার পর ঘন্টা। ডাক্তারও দেখিয়েছে তারা, অটিস্টিক সিনড্রোম আছে কিনা জানার জন্য। ডাক্তার হায়দার মাইডিয়ার ধরনের লোক। বেশ কিছুক্ষণ নিঝুমের সাথে কথা বলে তারপর লায়লা আর তার স্বামী সজীবকে মিষ্টি করে বকা দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, "শী ইজ পারফেক্ট। একটু ক্রিয়েটিভ প্রকৃতির। বড় হলে হয়তো নামকরা কিছু হয় যাবে।"
ডাক্তারের কথার ওপর আর কিছু চলেনা। আশ্বস্ত বোধ সে করেছিলো বটে, তবে একেবারে নিশ্চিন্ত হতে পারেনি। মেয়ে তো তার নিজের, ডাক্তারের না।

প্রায়ই তাই মেয়ের কার্যকলাপে খেয়াল রাখে লায়লা, ঘরের কাজের ফাঁকে ফাঁকে। যেমন ইদানিং সে খেয়াল করেছে, সন্ধ্যার পর নিঝুমের দরজার ওপাশে এসে ভীড় করে আশপাশের ফ্ল্যাটের বন্ধু-বান্ধবীরা। তখন আর নানা-দাদা বা মামা-চাচারা আসেনা। কেন দিনের বেলা বান্ধবীরা আসেনা? ভাবতে গিয়ে সে টের পেয়েছে, দিনের বেলা তো বান্ধবীদের সাথে চাইলেই দেখা করতে পারে নিঝুম। আম্মুকে বললেই আন্টিদের ফোন করে তারপর কাজের মেয়েটির সাথে পাঠিয়ে দেবে। সন্ধ্যার পর যে আর অন্য বাসায় খেলতে হয়না সে নিয়ম নিঝুম জানে।

মেয়েটি কি খুব একা বোধ করে? ভাইয়াকে স্কুলে দেয়ার পরপরই যে এমন শুরু করেছে তাও না। রাবিদ স্কুলে যায় আজ প্রায় দু'বছর। আগামী জুলাই থেকে নিঝুমও যাবে। এটা ঠিক যে বিদেশী শিক্ষাপদ্ধতির ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের জন্য রাবিদকে সকাল সাড়ে আটটায় ভ্যানে চড়তে হয়, ফিরতে ফিরতে বিকেল সাড়ে পাঁচটা। কিন্তু নিঝুমের এই একাকিত্বে মোড়ানো মেহমান মেহমান খেলা শুরু হয়েছে আজ মাত্র পাঁচ-ছ'মাস হলো, সেটার সাথে রাবিদের গত দু'বছরের নিয়মিত অনুপস্থিতি খুব একটা সম্পর্কিত না।

একদিন নিঝুমকে জিজ্ঞেস করেছিলো লায়লা। সেদিন দরজার ওপাশে ছিলো নানু আর শায়লা খালামনি। পটরপটর করে কথা বলেই যাচ্ছিলো। লায়লা চুপিসারে পাশে গিয়ে দুহাতে আলতো করে নিঝুমের কাঁধ ধরে বলেছিলো, "আম্মু, কার সাথে কথা বলছো?"
একটু লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়েছিলো নিঝুম, তারপর আহলাদে গলতে গলতে বলেছিলো, "কেন? নানু আর খালাতো।মনি আসছে তো!"
"কোথায়?"
"ঐ যে, বাইরে?"
তখন জিজ্ঞেস করেছিলো লায়লা, "তাহলে দরজা খুলে দিচ্ছোনা কেন? নানুরা বুঝি বাইরে দাঁড়ায়ে থাকবে?"
"ওমা, তুমি জানোনা? দরজা খুললে তো ওরা চলে যাবে!" শেয়াল পন্ডিতের মতো চোখ-মুখ গোল গোল করে নিঝুমের উত্তর।
"তাহলে তো ওরা এখনও ওপাশে নেই।"
"নাতো! দরজা বন্ধ থাকলে থাকে তো! খুললে চলে যায়।" যেন নিউটনের গতিবিদ্যার সূত্র বলছে এতটাই আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে নিঝুম।

এই বাচ্চাকে কে যুক্তি দিয়ে বোঝাবে? তার মাথায় একটা ধারনা ঢুকে গেছে।
তবে এতে অতটা আতংকিতও হয়নি লায়লা। সে জানে, একসময় চলে যাবে এসব ভুত। তার বান্ধবী নওরিনের ছেলেটিও নাকি দিনরাত ফোন করে কাজিনদের সাথে রাজ্যের কথা বলে। নওরীন বলেছিলো, মাঝে মাঝে সে কনফিউজড হয়ে যায়, ছেলে কি খেলছে না আসলেই কথা বলছে? বাচ্চাদের এরকম পাকনামোর কথা আরো শুনেছে সে, এখানে ওখানে।

তবে যে একটা ব্যাপারে লায়লা নিশ্চিত হয় তা হলো, এক ধরনের একাকীত্বে ভুগছে নিঝুম। হয়তো বাসায় দাদা-দাদী বা নানা-নানীরা থাকলে অতটা একা হতোনা সে। লায়লার নিজের মনে আছে ছোটবেলার কথা; তার মা সারাদিনই সংসারের নানান ঝামেলায় ব্যস্ত থাকতেন। কত সকাল বিকেল সে কাটিয়েছে নানুর কোলের কাছে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থেকে। নানু তাকে গল্প শোনাতেন, ছড়া বলতেন, দোয়াদুরূদ মুখস্থ করাতেন। মাঝে মাঝে হয়তো কিছুই করতেননা, তাও নানুর গা ঘেঁষে শুয়ে পান-শুপুরির ঘ্রান পেতে তার ভালো লাগতো।

হয়তো নিঝুমটাও তার মতোই হয়েছে। যুগ পাল্টেছে, এখন নানা-নানী বা দাদা-দাদীরা শেষ বয়েসটা নিজেরা নিজেরা একা কাটাতে চান। মাঝে মাঝে মন টানলে নাতি-নাতনীদের দেখতে আসেন। কেউ অন্যের সংসারে নিজেকে বোঝা করতে চাননা।

মাঝেমাঝে লায়লা ভাবে, সে নিজেও কি খুব নিঃসঙ্গ নয়? সেও কি একাকীত্বে ভুগছেনা? বিয়ে করেছে দশ বছর হতে চললো, সজীবের সাথে এখন বলতে গেলে সেই অর্থে দেখাই হয়না। রাত বারোটা বা একটার সময় সজীব যখন ফেরে, তখন আর দু'দন্ড অবসর নিয়ে কেউ কারো মুখের দিকে একটু তাকানোর প্রয়োজন বোধ করেনা। যেন ছায়া বা অবয়ব থেকে পরস্পরের অস্তিত্বের যতটুকু টের পাওয়া যায় সেটা নিয়েই বেঁচে থাকা উচিত। খাবার টেবিল থেকে বিছানা পর্যন্ত।

ব্যাপারটা এমন না যে সজীবের সাথে সম্পর্ক খারাপ তার। ব্যাপারটা যেন প্রাকৃতিক, ধীরে ধীরে সেই তাকিয়ে থাকার দিনগুলো ফিকে হয়ে গেছে। তবে এ নিয়ে তার মনোভাবটুকু জটিল, একমুখী নয়। একদিকে সেই দিনগুলোর জন্য মন কাঁদে, আবার অন্যদিকে নতুন করে সেরকম দিনের সম্ভাবনার কথা ভাবলে মনে হয়, "কত ছ্যাবলামো করেছি। কিভাবে করতে পেরেছি?" একটা ক্ষীণ অসহায়ত্ব টের পায় লায়লা। কি করতে চায়, সেটা না বুঝতে পারার অসহায়ত্ব।

অবশ্য সজীবের ব্যাপারে যে মনে মনে অনেক অভিযোগ তার জমা না, তাও না। মেয়েটার কথাই ধরা যাক, যতবারই প্রসঙ্গটা টেনেছে সে, সজীব পাত্তাই দিতে চায়নি। তার ওপর সেদিন ডাক্তার দেখানোর পর তো এ প্রসঙ্গ আসলে রীতিমতো বিরক্ত হওয়া শুরু করেছে। কিন্তু লায়লার মনে হয় ব্যবসার সময় নষ্ট করতে চায়না সজীব, আকারে ইঙ্গিতে এমনটাও বলতে চায় যে বাচ্চাদের সব দায়িত্ব লায়লারই নেয়া উচিত। অথচ লায়লা চায় সজীবও শেয়ার করুক, তা না হলে বাচ্চারা ওকে কতটুকু আপন ভাববে?

অন্যান্য ব্যাপারেও উদাসীন সজীব। গত কয়েকবছর ধরেই। এমনকি নিজের বাবা-মা'র সাথেও তার দেখা হয় কালেভদ্রে। একদম রুটিন করে প্রতিদিনই রাত এগারোটার পরে বাসায় ফেরে, কখনও কখনও একটা দেড়টা। ইউরোপিয়ান ক্লায়েন্ট তার বেশী, কমিউনিকেশনের জন্য বিকেল তিনটা থেকে রাত বারোটা আদর্শ সময়। এসব হাবিজাবি বলে সে। লায়লা অবিশ্বাসও করতে পারেনা। কারণ গত তিন বছরে তাদের আর্থিক উন্নতি হয়েছে কল্পনারও বাইরে। এমন অবস্থায় সব পুরুষই চাইবে ব্যবসা আরো বাড়ুক। প্রথম প্রথম লায়লাও এতে শুধু সুখই খুঁজে পেয়েছ. কিন্তু সময়ের সাথে ধীরে ধীরে টের পেয়েছে, যুগপৎ এক ধরনের আসহায়ত্ব এসে গ্রাস করতে শুরু করেছে সবকিছু।

২.
এক রাতের গল্প। ভীষন অস্থির বোধ হয় লায়লার। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। রাতের বেলায় এমন ঝুম বৃষ্টি হয়না সাধারণত। তবে তার অস্থিরতার কারণ সেটা না। ঝুম বৃষ্টির রাত নিয়ে এক ধরনের ভালো লাগা তার মধ্যে আছে। এই মুহূর্তে সেই ভালো লাগাটুকু টের পেলেও ঠিক কেন এই ভালো লাগা সেটা মনে করতে পারছেনা সে। বারবার মনে হচ্ছে খুব আনন্দের কোন স্মৃতি আছে ঝুমবৃষ্টিকে ঘিরে। হয়তো নানুর সাথে, অথবা ভাই-বোনদের সাথে, অথবা হয়তো সজীবের সাথে। নাকি অন্যকিছু? অস্থিরতা বাড়ে লায়লার। রাবিদ আর নিঝুম ঘুমিয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে দরজার দিকে যায় লায়লা।

মাঝে মাঝে তারও ইচ্ছে হয় নিঝুমের মতো দরজার ওপাশে দাঁড়ানো কারো সাথে কথা বলতে। এর আগেও দু'য়েকবার দরজার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে চেষ্টা করেছে। কিন্তু, প্রত্যেকবারই একই সমস্যা, কার সাথে কথা বলবে? কি বলবে? তার কথা তো নিঝুমের মতো অমন স্বতঃস্ফুর্ত হবেনা। সত্যি বলতে নিঝুমের মতো অমন নিঁখুত করে পিংপংই তো বলতে পারেনা সে, যদিও সেটা কোন সমস্যা না।

আজও তাই হলো। কিছুতেই যেন কাউকে দাঁড় করাতে পারছেনা লায়লা। বারবার মনের ভেতরের একটা অংশ চাইছে সজীব দাঁড়াক দরজার ওপাশে, তারপর বিয়ের পরপরের সেই দিনগুলোর মতো হাজার রসিকতায় ভরা সেরকম কোন কথোপকথন হোক। কিন্তু তখনই মনের অন্য কোন অংশ বাঁধা দেয়, বলে, ন্যাকামোর বয়েস কি আর আছে?
তাছাড়া সজীবকে সে দাঁড় করাবেই বা কেন? সে কি এখন সেভাবে সজীবকে মিস করে যেভাবে তার ছোট্ট নিঝুম নানা-নানী, দাদা-দাদীকে করে। তাঁরা বেড়াতে আসলে যেরকম উল্লাসে ফেটে পড়ে তার মেয়ে, সজীবের উপস্থিতি কি তাকে সেরকম কোন উচ্ছ্বাস এনে দেয়? লায়লা জানে, দেয়না। সে চায় সেরকম উচ্ছ্বাস আবার ফিরে আসুক, কিন্তু বাস্তবতা হলো আসেনা। অথবা আসতে চাইলেও কি মনের অন্য কোন অংশ সেখানে বাঁধা দেয়? লায়লা বুঝতে পারেনা কেন এমন হয়, শুধু তার অস্থিরতা বাড়ে।

এই অস্থিরতা থেকেই হয়তোবা, বৃষ্টির একঘেঁয়ে শব্দের তালে তালে জেগে ওঠা স্মৃতিকাতরতা একসময় সব সংকোচ দূর করে দেয়। অনেকক্ষণ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে একসময় সে অনুভব করতে পারে যে দরজার ওপাশে সজীব থাকলে তার কোন অসুবিধা নেই। অজান্তেই মুখ ফসকে ফিসফিস কন্ঠে বেরিয়ে আসে,
"এরকম কাকের মতো ভিজে এসেছো কেন?"
আশ্চর্য হয় লায়লা। ওপাশ থেকে সজীবের কন্ঠ ভেসে আসে, সে স্পষ্ট শুনতে পায়, "কাকভেজা হয়েছি বলে তো আর কাউয়া হয়ে যাইনি ম্যাডাম। তাড়াতাড়ি তোয়ালে, গামছা, অথবা এ্যাট লীস্ট ন্যাকড়া টাইপের কিছু একটা নিয়ে এসো।"

হঠাৎ করেই দরজায় গায়ে হেলান দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে লায়লা। সব মনে পড়ে যায় তার। এক ঝুম বৃষ্টির রাতের কথা। বিয়ের দু'মাস পরই হয়তো এমনই কোন এক সন্ধ্যায়, ভীষন বৃষ্টি হচ্ছিলো। কাকভেজা হয়ে বাসায় ফিরেছিলো সজীব। সারা শরীর ভিজে চুপচুপে, প্যান্টে, জুতোয় যেন ঢাকা শহরের অর্ধেক কাদা-ময়লা মাখিয়ে এসেছে। কি বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। এর মাঝেও রসিকতা, খুনসুঁটি সবই ছিলো। সেই সন্ধ্যায় তারপর বাড়ীওলার ছেলেকে ফুসলিয়ে ছাদের চাবিও জোগাড় করে ফেলেছিলো সজীব।

অস্থিরতাকে সরিয়ে ফেলে এক ধরনের চাপা উল্লাস। লায়লার ইচ্ছে হয়, আলমিরা থেকে সদ্য ভাঁজখোলা একটা তোয়ালে নিয়ে এসে দরজাটা খুলে দেখে। হয়তো সত্যিই ওপাশে সজীব দাঁড়িয়ে থাকবে।
এটুকু ঘটলে দোষ কি? ভাবতে ভাবতে একটা তোয়ালে নিয়েও আসে সে। অন্যসময় হলে হয়তো সে ভাবতো, এসব আমি কি করছি। কিন্তু আজকের রাতটা অন্যরকম, বর্ষণের একঘেঁয়েমির ঘোরে বাস্তববাদী ভাবনাগুলো পাথর চাপা পড়ে।

তোয়ালে হাতে ধীরে ধীরে আবারও দরজার পাশে এসে দাঁড়ায় লায়লা। ফিসফিস করে বলে, "দরজা খুলে দিচ্ছি, তবে সাবধান, হৈ চৈ করবেনা। বাচ্চারা ঘুমুচ্ছে।" এই প্রথম স্পষ;ট করে কথা বলে লায়লা, এবং সে টের পায়, কথা বলাটা খুব কঠিন কিছু না।

ওপাশ থেকে কি কিছু শোনা যায়?

শোনা যাক বা না যাক, একের পর এক বলে যায় সে,
"আহা একটু দাঁড়াও না, দরজা খুলছিতো!"
"একটা ছাতা কিনে নিলেই তো পারতে! কত আর দাম"
"ইশশ্, ঢং! ছাতা কিনলে বউ তোয়ালে হাতে দরজা খুলতোনা! দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।"
"এ্যাই ভালো হবেনা বলছি। আমি কিছুতেই ছাদে যেতে পারবোনা। এমনিতেই ঠান্ডা লেগে আছে।"
হঠাৎ রিনরিনে কন্ঠে হেসে ওঠে লায়লা, বলে, "অসভ্য!"

হাসতে হাসতেই সম্বিৎ ফিরে আসে তার। সত্যিসত্যিই কলিংবেলের শব্দ শোনা যায়, "পিং পং, পিং পং!" খানিকটা স্তব্ধ হয়ে যায় লায়লা, বুঝতে পারেনা আসলেই কেউ এসেছে কিনা। কিন্তু পিপ হোলে চোখ রেখে দেখতে পায় যে ওপাশে ঠিকই সজীব দাঁড়িয়ে আছে।

কিছুটা দ্বিধায় পড়ে যায় লায়লা, সত্যিই সজীব চলে এসেছে? সাড়ে দশটাও তো বাজেনি! নাকি তার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে? নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তার।

এর মাঝেই আবারও বেজে ওঠে, "পিং পং, পিং পং।" আবারও চোখ রাখে পিপহোলে। আশ্চর্য! আবারও সজীবকে দেখা যাচ্ছে।

ধীরে ধীরে দরজার নব ঘুরাতে থাকে লায়লা। আতঙ্কে শিরশির করে ওঠে সে, দরজার ওপাশে কি আসলেই কেউ আছে!

হঠাৎ তার মনে হয় সজীবকে না ভাবলেই হতো। বাবাকে নিয়ে ভাবলেই হতো। এমন সময়ে বাবার আসার কোন সম্ভাবনাই নেই, তাই তার অবচেতন মন হাজার চেষ্টা করলেও দরজার ওপাশে বাবার প্রতিকৃতি দাঁড় করাতে পারতোনা। কিন্তু রাত সাড়ে দশটা সজীবের ফেরার জন্য একটু তাড়াতাড়ি হলেও সম্ভাবনাটাকে শূন্য করে দেয়না।

খুব দ্রুত ভাবতে থাকে লায়লা। আসলে সে কি চায়? ওপাশে সজীব থাকুক? নাকি কেউ না থাকলেই সে খুশী হবে? ভীষন অসহায় বোধ করা শুরু করে সে। বারবার তার মনে হয় মারাত্মক কোন ভ্রমের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে সে।

ধীরে ধীরে প্রশ্নের জবাব মেলে। এই প্রথম সে টের পায় সামান্য নবটুকু ঘুরিয়ে দরজা খোলাটা কত কঠিন! ওপাশে কি ঘটবে সে জানেনা। ঐ মুহূর্তে লায়লার শুধু মনে পড়ে, দশ বছর আগের সেই বৃষ্টির রাতে কাকভেজা সজীব হাত পেছনে লুকিয়ে রেখেছিলো, ছাদে নিয়ে গিয়ে তারপর লায়লার হাতে তুলে দিয়েছিলো এক গোছা টকটকে লাল গোলাপ।

দরজার নব ঘোরাতে ঘোরাতে সে অনুভব করতে শুরু করে যে তার সমস্ত মন উজাড় করে কি তীব্রভাবে সে চাইছে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকুক সজীব, আর তার হাতে থাকুক একগোছা ফুল। গোলাপ না হলেও চলবে। সেই ফুল হাতে নিয়ে সে চীৎকার করে বলবে, "এরকম একাকীত্বের হাত থেকে আমাকে রেহাই দাও।"

আর পারেনা লায়লা। ধীরে ধীরে নব ছেড়ে দেয়। দরজা আর খোলা হয়না তার।

সে জানে এসব কিছুই বাস্তবে ঘটার নয়। দশ বছরের দাম্পত্য জীবনের বাস্তবতাকে অস্বীকার করে আজ সজীবকে ওপাশে কল্পনা করাটাই একটা ন্যাকামো হয়েছে তার। এক ধরনের অভিমানে ফেটে পড়ে সে। অভিমান, ক্ষোভ আর একাকীত্বের ঘূর্ণি-আবর্তে বিহবলতায় হঠাৎ করেই একটা জঘন্য ধরনের নির্মম সত্যের উপলব্ধি হয় লায়লার।

তার খেয়াল হয়, নিঝুমের দরজার ওপাশে কখনও তার বাবা-মা থাকেননা।

পোস্টটি ১১ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মীর's picture


ভয়াবহ লেখা জ্বিনজি। শিহরিত মনে পড়লাম।

জ্বিনের বাদশা's picture


খাইছে! এত ভয়াবহ! Wink

রাসেল আশরাফ's picture


খাইছে এ দেখি পুরা সেই এবি ফুটবল টুর্নামেন্ট।একদমে টেনশন নিয়া পড়লাম।

জ্বিনের বাদশা's picture


আহারে! মনে করায়া দিলেন
আবার যে কবে আসবো ওয়ার্ল্ড কাপ!!

মুক্ত বয়ান's picture


আরিব্বাস, চমৎকার তো, শুরু হল মেয়েকে দিয়ে শেষে গিয়ে দেখি কাহিনী মা'র!!!
সবাই কি নি:সঙ্গ হইয়া যাইতেছে নিকি!!! Shock

জ্বিনের বাদশা's picture


হুমম ... উল্টা পথে গেছে ... নরমালি তো মা দিয়া শুরু হয়ে মেয়ে দিয়া শেষ হয় Wink

ভাঙ্গা পেন্সিল's picture


দুর্দান্ত। অর্ধেকখানি পড়ে বাকি অর্ধেক নিয়ে আমি মনে মনে ঠিক একই স্ক্রিপ্ট লেখছি Smile

জ্বিনের বাদশা's picture


তাই? আপনিও একই রকম ভাবছেন?
আমি অবশ্য লেখাটা নিয়া এক ধরনের অসন্তুষ্টিতে আছি ... ঠিক যেভাবে উপস্থাপন করতে চাইছি, সেটা হয়নাই Sad

নুশেরা's picture


গ্রেট দেশী, সিম্পলি গ্রেট। খুব সহজসরল কিছু ট্রিটমেন্ট দিয়েই মেয়ে আর মেয়ের মা দুজনেরই মনের অন্ধিসন্ধি নেড়েচেড়ে ফেলছেন, সফলভাবে। অনেকদিন পর এমন একটা গল্প পড়লাম। নিয়মিত লেখা চাই।

অপনা উল্টোটা করে। দরজার বাইরে গিয়ে ডোরবেল বাজায়, নিজেই জানতে চায়, কে? নিজেই উত্তর দেয়, "আমি এট্টা ম্যাডেম" (আমি একটা ম্যাডাম Laughing out loud )

১০

জ্বিনের বাদশা's picture


বাব্বাহ ... অপনামনি তো হেব্বি কিউট! ... এট্টা ম্যাডাম Wink

১১

শওকত মাসুম's picture


দুর্দন্ত। শেষ লাইনটার চমক আরও দুর্দান্ত। নিয়মিত লেখা চাই।
ভাবছি, দরজার ওপাশে আমি কাকে কাকে চাই.......................দিলেন তো ঝামেলা বাজাইয়া...

১২

জ্বিনের বাদশা's picture


বস্। একেবারে আসল জায়গায় ফোকাস করছেন ... দরজার ওপাশে কে থাকবে? ... একবার ভাবছিলাম গল্পের নাম দিই দরজার ওপাশে ... পরে মনে হইলো এই নামে মনে হয় গল্পটল্প আছে

১৩

মেসবাহ য়াযাদ's picture


ভাবছি, দরজার ওপাশে আমি কাকে কাকে চাই.......................দিলেন তো ঝামেলা বাজাইয়া...

এক কাম করেন মাসুম ভাই, দরজার ওপাশে কারে কারে চান... এইটা নিয়া একখান পোস্ট দিয়া দেন

প্রথমত আমি অমুকরে চাই
দ্বিতীয়ত আমি তমুকরে চাই
শেষপর্যন্ত যে কারে চাই......???

১৪

জ্বিনের বাদশা's picture


Wink
অমুক, তমুক, প্রমুখ

১৫

মেসবাহ য়াযাদ's picture


Big smile

১৬

সাঈদ's picture


দারুন্স

১৭

জ্বিনের বাদশা's picture


ধন্যবাদস Wink

১৮

শাপলা's picture


বস দুর্দান্ত লেখা। সত্যি বলছি, সরল প্রকাশে কি গভীর এক বোধ।

"বয়স হচ্ছে বলেই বওধ হয় মাঝে মাঝে একলা লাগে।"

অনেক অনেক শুভ কামনা রইল।

১৯

জ্বিনের বাদশা's picture


হুমমম ... নিঃসঙ্গতার সংজ্ঞা নির্ধারণটাই এক ধরনের নিঃসঙ্গতায় ডুবে যাওয়ার মতো কাজ

২০

নীড় সন্ধানী's picture


দরোজার ওপাশে কাকে চাই?

অদ্ভুত সুন্দর একটা লেখা। প্রচুর ভাবনার খানা খোরাক। রোজার দিনেও চিবোতে ইচ্ছে করছে। প্লাস প্লাস!!

২১

জ্বিনের বাদশা's picture


থ্যাংকস বস ... তারপর ইফতার কি দিয়া করলেন? Wink

২২

বোহেমিয়ান's picture


দুর্দান্তিস! আসলেই জোশ

২৩

তানবীরা's picture


প্রিয়তে রাখলাম বস

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.