ইউজার লগইন

পালাও!

[পুরোপুরি ফিকশন]

১.
আর সবদিনের মতোই বেশ মনোযোগ দিয়ে চ্যানেল আইয়ের ন'টার খবর শুনছিলেন প্রফেসর সেলিম হায়দার। শুনতে শুনতে অজান্তেই একসময় তাঁর হাত নিশপিশ করে ওঠে; পুরু গোঁফ আর মোটা-ফ্রেম-মোটা-কাঁচের চশমার আড়াল ভেদ করে ছড়িয়ে পড়া তৃপ্তির হাসিটুকুও লুকিয়ে রাখতে পারেননা তিনি। অবশ্য এই মুহূর্তে সেটার প্রয়োজনও নেই।

খবর হচ্ছিলো অধুনা জনপ্রিয় কুয়েতের গণতন্ত্রপন্থী নেতা হামিদ তালিবের বাংলাদেশ সফর নিয়ে। উত্তর আফ্রিকার আরব বসন্তের ছোঁয়া এসে লেগেছে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যেও, জনতার আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে আগামী বছর নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আশ্বাস দিয়েছেন কুয়েতের বর্তমান আমীর। একই সাথে অন্যান্য পেট্রোডলারের দেশগুলোর আমীররাও কিছুটা নমনীয় হয়ে গণতন্ত্রায়নের পক্ষে নানান আশ্বাস দিতে শুরু করেছেন। এই আশ্বাস আদায়ের আন্দোলনের প্রধান ভূমিকা যাঁর, তিনিই হামিদ তালিব। আরব বসন্তের ফলশ্রুতিতে ২০১২তে জেগে ওঠা পেট্রো-বসন্তের অবিসংবাদিত নেতা বলা হয় তাঁকে।

হামিদ তালিব তাঁর পনেরো সদস্যের দল নিয়ে আজ বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। পশ্চিমা মাধ্যমের ভ্রূ-কূঁচকানিকে খানিকটা বাড়িয়ে দিয়ে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠকে তিনি নির্দ্বিধায় বলেছেন, "মুসলিম বিশ্বকে গণতন্ত্রের মশাল হাতে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে বাংলাদেশ"। নব্বইয়ে এরশাদের পতনের পর গত দুই যুগ যে ধীরপদে হলেও গণতন্ত্রের পথে এগিয়েছে তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার এই দেশটি -- বাংলাদেশের সেই যাত্রাপথ থেকে কিছু শেখার জন্যই তালিবের এই ভ্রমন।

মিটিমিটি হাসতে হাসতেই সেলিম হায়দার ঠিক করে ফেলেছেন কি দিয়ে শুরু করবেন তাঁর পরবর্তী "কটূকথা" কলামের প্রথম লাইন। অত বেশী ভাবতে অবশ্য হয়নি এই তুখোড় কলামিস্টকে, সামান্য চেষ্টাতেই পেয়ে গেছেন তার পাঞ্চলাইন, একদম সেটা দিয়েই শুরু করবেন এভাবে -- 'বর্বর আরবের ভীড়ে যৎসামান্য উন্নত মানসিকতার ব্যক্তিটি অন্তত স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে "মিসকিনে"র দেশ বাংলাদেশ থেকে তাদের অনেক কিছু শেখার আছে।' কটূকথার শুরুটুকু এর চেয়ে খাসা আর কি হতে পারে?

লেখা শুরু করার জন্য সোফা ছেড়ে প্রায় উঠেই পড়েছিলেন সেলিম হায়দার, কিন্তু শেষ মুহূর্তে স্ত্রী সেলিনাকে দুটো চায়ের কাপ হাতে বৈঠকখানায় আসতে দেখায় এ যাত্রা লেখা শুরুর অভিলাস খানিকটা দমাতে বাধ্য হন। চা-টা শেষ করা যাক। এই সিদ্ধান্তে অবশ্য তাঁর শাপে বরই হলো বলতে হবে, কারণ তা নাহলে হয়তো খবরের বাকীটুকু আর দেখা হতোনা, কয়েকঘন্টা ধরে তৈরী করা পুরো লেখাটাই মাঠেমারা যেত।

চা খেতে খেতে স্ত্রীকে আরবদের বর্বরতা নিয়ে ছোটোখাটো জ্ঞান দিচ্ছিলেন সেলিম। তখনই চ্যানেল আইয়ের খবর পাঠিকার কন্ঠের অতিমাত্রিক উদ্বেগ আর উত্তেজনার কারণে টিভিতে চোখ রাখতে বাধ্য হন।
"সামথিং রং?"
ভাবতে না ভাবতেই টেলপে বেশ বড় বড় লাল অক্ষরে লেখা দেখতে পান, "ঢাকায় দুর্বৃত্তের আক্রমণে আরব নেতা হামিদ তালিব নিহত।"
খবর পাঠিকাও বারবার উচ্চারণ করে যাচ্ছেন,
"এইমাত্র পাওয়া খবরে জানা গেল কুয়েতের গণতন্ত্রবাদী নেতা হামিদ তালিব ঢাকার র‌্যাডিসন হোটেলে দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হয়েছেন। বিস্তারিত খবর আমাদের হাতে আসামাত্রই প্রচার করা হবে।"

মুহূর্তের জন্য বিস্ময়ে হা হয়ে যান সেলিম হায়দার। খানিকটা বিমর্ষও বোধ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের এই প্রফেসর। তবে সেটা ঠিক যতটা হামিদ তালিবের মৃত্যুর কারণে, তারচেয়ে অনেকগুন বেশী পাঞ্চলাইনটার কারণে। কত চমৎকার একটা বাক্য দিয়ে শুরু করবেন ভেবেছিলেন! অথচ এখন আর লেখাটিরই হয়তো কোনো মর্ম থাকবেনা। সদ্যমৃত লোককে "বর্বরদের মাঝে সামান্য উন্নত" বলে উল্লেখ করা যায়না। হাজার হোক, পত্রিকার কলাম আর বৈঠকখানার আড্ডা এক না।

২.
র‌্যাডিসন হোটেলের সামনে এয়ারপোর্ট রোড মোটামুটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শুধু বিমানবন্দরগামী আর বিমানবন্দর থেকে আসা গাড়িগুলোর চলাচলের জন্য দু'পাশে একটি করে লেন খোলা। র‌্যাডিসন হোটেল কর্ডন করে ফেলেছে র‌্যাব আর সেনাবাহিনির নয়টি গ্রুপ। তিনটি গ্রুপ হোটেলের তিনটি প্রবেশপথে, আর তাদেরকে কাভার দেয়া হয়েছে বাহিরে ছয়টি গ্রুপ দাঁড় করিয়ে। র‌্যাডিসন হোটেলও সিল করে দেয়া হয়েছে। কাউকে ঢুকতে বা বেরুতে দেয়া হচ্ছেনা।

দেশের প্রায় সবগুলো টিভি আর সংবাদপত্রের লোকেরা এসে জড়ো হয়েছে র‌্যাডিসনের সামনে এয়ারপোর্ট রোডের ওপর। আর শত শত আমজনতার ভীড়। পুলিশ এর মধ্যেই কয়েক দফা ধাওয়া করে জনতাকে হটানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু যেদেশে হাজার হাজার মানুষ বলতে গেলে রাস্তায়ই জীবন কাটায় তাদের ঠেকাবে কিভাবে। রাস্তার একপাশ থেকে দৌড়ে তারা বড়জোর অন্যপাশে যায়।

শুধু দেশী মিডিয়াই নয়, বিদেশী টিভিগুলোতেও কাভারেজ শুরু হয়ে গেছে। রাত সাড়ে দশটার দিকে চার্টার্ড প্লেনে মুম্বাই থেকে চলে এসেছে সিএনএন, বিবিসিসহ ডজন খানেকের মতো বিদেশী মিডিয়ার প্রতিনিধি।এমনকি রাত একটার দিকে আলজাজিরার করেসপন্ডেন্টও চলে এসেছেন খোদ দোহা থেকে।

বিশ্বজুড়ে টিভি চ্যানেলগুলোর আলোচনায় এখন ঢাকা। হামিদ তালিব বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত ব্যক্তিত্ব, উত্তর আফ্রিকায় জন্ম নেয়া আরব বসন্ত তাঁর হাত ধরে প্রসারিত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে, নতুন নাম পেয়েছে "পেট্রো-বসন্ত"। আগামী বছর কুয়েতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে যে তিনি জিতে আসছেন, এটা প্রায় সবারই মুখে মুখে। তাঁর উন্মেষের সাথে সাথে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে নতুন নেতৃত্বের জন্ম হবে, এটাও কোনো উচ্চাভিলাষ ছিলোনা। তাঁর দিকে তাকিয়ে সমগ্র বিশ্ব, মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পুরো বিশ্ব অস্থিরতার হাত থেকে বেঁচে যাবে, এমনটাই ছিলো তাঁকে নিয়ে মোটাদাগে সবার প্রত্যাশা।

সেই ব্যক্তির এমন মৃত্যু বিস্ময়কর। একইসাথে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে এ ধরনের বিশ্বমানের ব্যক্তিত্বের নিরাপত্তার পর্যাপ্ততা, কারা খুনটি করেছে, বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গীবাদ প্রায় নির্মূল বলা হচ্ছিলো অথচ তারপরও এমন ঘটনা কিভাবে ঘটলো -- এরকম নানাবিধ আলোচনায় মুখর বিশ্বের সবক'টি গণমাধ্যম।

৩.
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুব নিয়ম মেনে চলেন। স্বাস্থ্য ফিট রাখার জন্য ডাক্তার তাঁকে খুব কড়া একটি ডায়েট প্ল্যান করে দিয়েছেন, সাবধান করে দিয়েছেন কোনোমতেই যেন রাতের খাবার খেতে আটটার বেশী না বাজে। মোটামুটি আটটার মধ্যেই খাবার সেরে ফেলে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেন সুধাসদনের লনে। তারপর এশার নামাজ পড়ে কিছুটা সময় পড়েন। ইদানিং এসময়টা বঙ্গানুবাদসহ পবিত্র কোরান পাঠ করছেন তিনি, পড়তে পড়তে এক ধরনের প্রশান্তিতে ভরে যায় তাঁর মন। সারাদিনের কাজের ফাঁকে দিনের এই সময়টুকুর জন্য মনে মনে অপেক্ষা করেন তিনি।
আজও ডিনারের পর নামাজ শেষে জায়নামাজ ভাঁজ করছিলেন শেখ হাসিনা, নিজ হাতেই। ঠিক তখনই ব্যক্তিগত সহকারী এসে জানালেন স্বয়ং পররাস্ট্রমন্ত্রী আর স্বরাস্ট্রমন্ত্রী এসেছেন দেখা করতে।
"এই অসময়ে?"
খানিকটা বিরক্ত হয়েই বৈঠকখানার দিকে রওনা দেন শেখ হাসিনা। তখনও তিনি জানেননা আজ বিকেলেই যে সদালাপী ভদ্রলোকের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিলো তাঁর, তিনি আর নেই। প্রধানমন্ত্রীর নিজ দেশেই কিছুক্ষণ আগে তিনি আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন।

রাত সাড়ে দশটার মধ্যেই তিনবাহিনী প্রধান, এনএসআইর প্রধান, র‌্যাবের মহাপরিচালক, পুলিশের আইজি, মন্ত্রীপরিষদের প্রায় সব সিনিয়র সদস্যরা এসে জড়ো হন প্রধানমন্ত্রীর সুধাসদন কার্যালয়ে। বিশেষ ব্যবস্থায় বিশ্বাবাসীকে উদ্দেশ্য করে ইংরেজীতে একটি লাইভ ভাষনও প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী। বক্তব্যে দ্ব্যার্থহীন কন্ঠে বারবার তিনি আশ্বাস দেন এই বলে যে সন্ত্রাসীদের ধরার জন্য কোনোরকমের ত্রুটি বাংলাদেশ সরকারের হবেনা।

রাত দশটা চল্লিশের পর থেকে ঘটনাপ্রবাহ খুব দ্রুত গড়াতে শুরু করে। সরকারের হর্তাকর্তারা আপাতত হোটেল এলাকায় র‌্যাব-পুলিশ মোতায়েন করে পরদিন সকাল থেকে কি করা যায় ভাববেন বলে মনে মনে ঠিক করছিলেন। কিন্তু দশটা চল্লিশের দিকে প্রধানমন্ত্রীর সাথে কুয়েতের আমীরের ফোনালাপের পর পরিস্থিতির গুরুত্ব নতুন করে বুঝতে শুরু করেন তাঁরা। বেশ রূঢ় কন্ঠেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঘটনার পেছনে দায়ী সন্ত্রাসীদের অবিলম্বে সঠিকভাবে চিহ্নিত করে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবী জানান কুয়েতী আমীর। অবশ্য, কুয়েতের পক্ষ থেকে যে কোনো ধরনের সহায়তা যে তাঁর সরকার দেবেন এই আশ্বাসটুকু দেয়ার সময় তাঁর কন্ঠ খানিকটা তরল হয়ে আসে। সবশেষে ততোধিক তরল কন্ঠে মিশনের পেছনে ব্যয়তব্য অর্থ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে কোনোপ্রকার দুশ্চিন্তা করতে তিনি নিষেধও করেন। কুয়েতী আমীরের ফোনে প্রধানমন্ত্রী যা বোঝেন, তার সারার্থ হলো, যত দ্রুত সম্ভব নড়াচড়া শুরু করতে হবে।

তবে সে রাতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জন্য কুয়েতের আমীরের অকস্মাৎ ফোনকলটুকুই সর্বোচ্চ চমক ছিলোনা। রাত এগারোটার খানিক পরেই তাঁকে বিস্মিত করে খোদ আমেরিকা থেকে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ফোন আসে। বারাকের কন্ঠে অবশ্য কুয়েতী আমীরের রূঢ়তা দেখতে পাননা শেখ হাসিনা, বন্ধুসুলভ কন্ঠে হলেও বেশ দৃঢ়ভাবে শেখ হাসিনাকে তিনি যা বলার চেষ্টা করেন তা হলো অপরাধীদেরকে ধরতেই হবে। একাধিকাবার বারাক বলেন, "ব্যাংলাডেশ মাস্ট গেট অল দোজ কালপ্রিটস্, ড. শেখ; ইট'স নট এ্যান অপশন।"

ফোনালাপের শেষ পর্যায়ে এফবিআই আর সিআইএর প্রসঙ্গ আনেন বারাক, প্রয়োজনমতো সব সাহায্যের ব্যাপারে পূর্ণ নিশ্চয়তা দানপূর্বক তিনি শেখ হাসিনাকে এও জানিয়ে রাখেন যে খুব শীগগিরই ঐ দুই সংস্থার কিছু চৌকষ সদস্য বাংলাদেশে আসবেন। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যাতে এদেরকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হয় সেটি মনে করিয়ে দিতেও ভোলেননা তিনি। প্রেসিডেন্ট ওবামার ফোন ছাড়ার পর শেখ হাসিনা অনুধাবন করতে পারেন যে শুধু "যতদ্রুত সম্ভব" না, বরং এই মুহূর্তেই কাজে নেমে পড়তে হবে তাঁর সরকারকে।

ঘটনাপ্রবাহ এখানেই থেমে যায়নি। প্রেসিডেন্ট ওবামার সাথে কথা শেষ হবার আধঘন্টার মধ্যেই সরাসরি শেখ হাসিনার কাছেই ফোন আসে ভারতের মুম্বাইয়ে অবস্থানরত সিআইয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মি. রজার পি রেড্ডির কাছ থেকে। খুব সংক্ষিপ্ত সংলাপে মি. রেড্ডি প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি গ্রহনপূর্বক র‌্যাবের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফজলে রাব্বিকে এ্যাকশন টিম গঠনে কি কি পদক্ষেপ নিতে হবে তা নিয়ে বিশদ পরামর্শ দেন। এমনকি তদন্তের মূল দায়িত্বে মার্কিন যুক্তরাস্ট্র র‌্যাবের কোন কোন সদস্যকে দেখতে চায় সেটাও পরিস্কার করে ব্যক্ত করেন রেড্ডি। নাম আসে র‌্যাবের চৌকষ অফিসার কর্নেল মাহতাব জংয়ের। বেশ কয়েকবার যুক্তরাজ্যে মিলিটারি ট্রেনিংয়ের অভিজ্ঞতা আছে এই ধীমান অফিসারের। দু'মাস আগেও লন্ডন থেকে তিনমাসের এলিট কোর্স শেষ করে ফিরেছেন তিনি।

ফোনালাপের শেষ অংশে প্রয়োজনমতো সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দিতে ভোলেননা তিনিও। সাথে সাথে ফজলে রাব্বিকে এও জানিয়ে রাখেন যে, প্রয়োজনে বাংলাদেশকে মিলিটারি সাহায্যও দেবে যুক্তরাস্ট্র।
"ইউ মাস্ট নো স্যার, দিস ইজ আওয়ার হাইয়েস্ট প্রায়োরিটি নাউ, এ্যান্ড ইউ গাইজ মাস্ট বি রেডি ফর এ্যানি সিচুয়েশন।" এই বলে খানিকটা কমান্ডের সুরেই কথোপকথন শেষ করেন সিআইয়ের কর্মকর্তা।

সবকিছু শুনে রাত বারোটার দিকে জরূরী সভার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আমেরিকার অতিরিক্ত উদ্বেগ, বাংলাদেশকে সহায়তা করার ব্যাপারে তাদের উৎসাহের বাড়াবাড়ি তাঁকে বেশ চিন্তিত করে তোলে। তাঁর সরকারের ইদানিংকার বেশ কিছু সিদ্ধান্ত যে আমেরিকাকে অসন্তুষ্ট করেছে তা তিনি জানেন। তাই মন্ত্রীপরিষদের তো বটেই, বিরোধী দল এবং ব্যবসায়ী সমাজেও মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের ঘনিষ্ট ব্যক্তিদেরকে একে একে ফোন করে করে সভায় যোগ দিতে বলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। এমনকি সব ভুলে ডক্টর ইউনুসকেও ডাকা উচিত কিনা এই নিয়ে অর্থমন্ত্রী মুহিতের সাথে তাঁকে পরামর্শ করতে দেখা যায়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এদিন আর বঙ্গানুবাদসহ কোরানপাঠ হয়ে ওঠেনা।

৪.
বছর চারেক আগে প্রথমবার যুক্তরাজ্যে ট্রেনিংয়ে গিয়ে মার্কিন দুই জায়ান্ট সংস্থা সিআইএ আর এফবিএর আসল শক্তি সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান লাভ করেছিলেন কর্নেল মাহতাব জং। র‌্যাবের ইতিহাসে সবচাইতে সাহসী, চৌকষ আর নির্দয় এই অফিসারও সেদিন শিউরে উঠেছিলেন বিশ্বজুড়ে এই সংস্থাদ্বয়ের প্রভাব আর প্রতিপত্তির তথ্যগুলো জেনে। তারপরও তিনি ধারনা করতে পারেননি যে ঘটনা ঘটার ছয় ঘন্টার মধ্যেই সুদূর ওয়াশিংটন থেকে চার্টার প্লেনে চলে আসবেন এফবিআইর এশিয়াবিষয়ক প্রধান এডওয়ার্ড স্যামুয়েলস আর তাঁর প্রধান সহকারী গ্রেগরী সিম্পসন। এরা কি না পারে? এরপর অবশ্য রাত দুটোর মধ্যেই মুম্বাই থেকে রজার রেড্ডির ঢাকায় চলে আসাটাকে আর বিস্ময়কর কিছু বলে মনে হয়না। হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের ভিভিআইপি-এক্সক্লুসিভ লাউঞ্জের স্মোকিং ক্যাপস্যুলে সিগারেটে টান দিতে দিতে দুই সংস্থার প্রতিনিধিদের সাথে কি নিয়ে কথা হতে পারে, তার একটা কাল্পনিক খসড়া তৈরী করতে থাকেন কর্নেল জং।

পুলিশের আইজি শামসুজ্জোহা তালুকদার চেয়েছিলেন যে এফবিআই প্রতিনিধিরা ঢাকায় এসে প্রথমে তাঁর সাথেই পরামর্শ করুক। এ উপলক্ষে আগেভাগেই বিমানবন্দরের ভিভিআইপি-এক্সক্লুসিভ লাউঞ্জে অবস্থান গ্রহন করে নিয়েছেন তিনি। একটু পরেই অবশ্য চলে আসেন র‌্যাব মহাপরিচালক ফজলে রাব্বি, সাথে কর্ণেল মাহতাব জং; এছাড়া তিন সেনাপ্রধানের মধ্যে শুধু সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আহবাব খানই লাউঞ্জে অবস্থানের অনুমতি পেয়েছেন। তবে তাঁদের কারুর সাথেই পরামর্শ করার কোনো উৎসাহ দেখাননি এফবিআই কর্তারা।

রাত দুটো পনেরো মিনিটে সিআইয়ের রজার রেড্ডি হন্তদন্ত হয়ে লাউঞ্জে প্রবেশ করলে পরিস্থিতির বিবেচনায় হোক বা স্বভাবের দোষেই হোক, ব্যস্তসমেস্তভাবে উঠে দাঁড়ান তিন প্রধান। তাঁদের দিকে একপলক তাকিয়েই, বলতে গেলে কোনোপ্রকার গুরুত্ব না দিয়ে সরাসরি কর্ণেল জংকে নিয়ে বিশেষভাবে প্রস্তুত মিটিংরুমে ঢুকে পড়েন রেড্ডি। মিনিট দশেকের মধ্যে একের পর এক এসে পোঁছান র‌্যাবের আরো কয়েকজন চৌকষ অফিসার, কর্নেল হেদায়েতউদ্দিন, কর্ণেল নঈম হামজা এবং মেজর শিবশংকর ঘোষ। এরা সবাই কর্ণেল জংয়ের অধীনে কাজ করছেন। জংয়ের মতোই ক্রসফায়ার আর ইন্টেরোগেশনে এদের কোনো তুলনা নেই। মূল মিটিং শুরু হয় ঠিক রাত আড়াইটায়, ডিসি থেকে এড আর গ্রেগ এসে পৌঁছুবার সাথেসাথেই।

প্রায় আধঘন্টার লেকচারে খুব সুন্দরভাবে এড ব্যাখ্যা করেন কিভাবে সারাদেশে র‌্যাবের নেটওয়ার্ক বিস্তার করে সন্ত্রাসীচক্রকে ঘিরে ফেলতে হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অপারেশন স্ট্রাটেজি কেমন হওয়া উচিত এবিষয়ে চার অফিসারের নানারকম ফিডব্যাকও তিনি তাঁর মডেলে এ্যাডাপট করে নেন। আধঘন্টা পর বিশেষ সিলগালা খামে এডের মডেলের প্রিন্টআউট নিয়ে একের পর এক বের হয়ে আসেন হেদায়েত, নঈম আর শিবশংকর।
কর্নেল জং আর তিন মার্কিন অফিসারের বের হয়ে আসতে আরো পনেরো মিনিট দেরী হয়।
কর্নেল জংয়ের পিঠে হাত রেখে বন্ধুসুলভ কন্ঠে বলতে থাকে এড স্যামুয়েলস,
"আই থিংক উই হ্যাভ অলরেডি সেইড টু মাচ। নাউ ইটস ইন ইওর কোর্ট, কর্নেল। গেট দেম হোয়াটএভার ইট টেইকস, এ্যান্ড উই উইল বি দেয়ার অন ইওর সাইড।"
বলতে বলতে আলতো করে কর্ণেল জংয়ের পিঠ চাপড়ে দিয়ে লাউঞ্জে অপেক্ষমান তিন ভিভিআইপির দিকে বন্ধুত্বসুলভ সম্বোধনে এগিয়ে যান এডওয়ার্ড স্যামুয়েলস। আইজিপি শামসুজ্জোহা, ব্রি. জেনারেল ফজলে রাব্বী আর জেনারেল আহবাব খান, তিনজনেরই গোমড়া হয়ে থাকা মুখে যুগপৎ হাসির রেখা ছড়িয়ে পড়ে।

লাউঞ্জের এক কোণায় দাঁড়ানো কর্ণেল মাহতাব জংয়ের কপালের দুশ্চিন্তার ভাঁজ দূর হয়না, আনমনে মাথা নাড়তে থাকেন তিনি। কাছেই অপেক্ষমান বাকী তিন সহযোগীকে নিয়ে সিগারেট ক্যাপসুলের দিকে এগিয়ে যান তিনি। বুঝতে পারছেন, বিরাট বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে বাংলাদেশের ওপর, জরূরী ভিত্তিতে কার্যক্রম ঠিক করে ফেলতে হবে। এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করা যাবেনা।

পোস্টটি ২২ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

টুটুল's picture


উরে জিন্টু বস... কিরমাছেন? ম্যালাদিন বাদে... ব্যাস্ততা কি কমাইতার্ছেন?
কোক

পড়তেছি....

জ্বিনের বাদশা's picture


বস্, খবর কি? ... ইয়ারএন্ড ছুটি পাইলাম সপ্তাখানেক Wink

লীনা দিলরুবা's picture


একালের মাসুদরানা দেখি! পড়তে মজা লেগেছে, বাকীটুকু পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম...

মিনিট দশেকের মধ্যে একের পর এক এসে পোঁছান র‌্যাবের আরো কয়েকজন চৌকষ অফিসার, কর্নেল হেদায়েতউদ্দিন, কর্ণেল নঈম হামজা এবং মেজর শিবশংকর ঘোষ। এরা সবাই কর্ণেল জংয়ের অধীনে কাজ করছেন।

কর্নেলের অধীনে কর্নেল! Thinking

জ্বিনের বাদশা's picture


থ্যাংক্যু থ্যাংক্যু (তবে, মাসুদ রানার ধারে কাছেও নিতে পারবোনা :'()

ফিকশন তো, কর্ণেলের আন্ডারে জেনারেলরেও বসাইয়া দিবো ভাবতেছি Wink

মাহবুব সুমন's picture


ল্যা. কর্নেলকে সন্ভাষন করার সময় কর্নেল বলা হয়, লেখার সময় পুরো পদবি লিখতে হয়।
ফোর্সে সিনিয়রের আন্ডারে জুনিয়র কিন্তু র‌্যাংকে সমান কাজ করতে পারে।

ড. হাসিনা গনভবনে বসবাস করেন Wink সুধাসদনে ক্ষমতা হাড়ানোর পর বসবাস করবেন।

শামসুজ্জোহা নামে এক অতি আইজিপি আছে, সে আইজি হয়ে যেতে পারে।

জেবীন's picture


জমজমাট গল্প! পড়তে দারুন লাগছে .।.।।। Smile
কর্নেল জং কি করবে নিজের কোন প্ল্যান নাকি ওদেরই ভারবাহী কেউ হয়ে চলবেন? Stare

অনেকদিন পর জিন্টুরে দেখে ভালো লাগছে সবচেয়ে বেশি! Big smile

জ্বিনের বাদশা's picture


থ্যাংক্যু জেবীনদি

রায়েহাত শুভ's picture


আমি কেমন একটা কন্সপিরেসী থিওরীর গন্ধ পাইতেছি...

ওয়েটিং ফর নেক্সট পার্ট...

জ্বিনের বাদশা's picture


ধরা খাইয়া গেলাম তো মনে হয় Sad

১০

সামছা আকিদা জাহান's picture


ডঃ শেখ হাসিনা এমন প্যাজগীর মধ্যে পরলো দেখা যাক এর পরের পর্বে খালেদা খালাম্মা কি ভূমিকা রাখেন?

১১

জ্বিনের বাদশা's picture


হা হা হা ... জটিল মন্তব্য!

১২

শওকত মাসুম's picture


গ্যালারিতে বসলাম

১৩

জ্বিনের বাদশা's picture


থ্যাংক্যু, বস্

১৪

এ টি এম কাদের's picture


জীনের বাদশা ধরা খেয়েছিলেন বলে শুনেছিলাম । বেরিয়ে এলেন কবে ! মিডিয়া গুলো নিউজের আপডেট দেয়না ক্যান ?

১৫

জ্বিনের বাদশা's picture


ভাই এতদিনে ছাড়া পাইলাম ... আবার একসপ্তা পর হাজিরা দিতে হইবে Sad

১৬

প্রিয়'s picture


জমজমাট গল্প।

১৭

জ্বিনের বাদশা's picture


ধন্যবাদ

১৮

জ্যোতি's picture


গল্প তো পুরা জমে পুডিং হয়ে গেছে। জলদি বাকীটা বলেন দেখি!
ঘটনা হইলো , আছেন কিরাম? কই ছিলেন?

১৯

জ্বিনের বাদশা's picture


পুলিশের হাতে পড়লে কি আর ভালো থাকে কেউ? Wink
মনে হয় পুডিংয়ের চেয়ে ভালো কিছু হবেনা, গতকালের এইটুকু লিখতে পাঁচ/ছ্য ঘন্টা লেগে গেছে Sad

২০

একজন মায়াবতী's picture


খুবই ইন্টারেস্টিং। পরের পর্বের অপেক্ষায়। Smile

২১

জ্বিনের বাদশা's picture


থ্যাংক্যু

২২

তানবীরা's picture


অসাধারণ

২৩

জ্বিনের বাদশা's picture


ধন্যবাদ

২৪

নেয়ামত's picture


মচৎকার।
অনেক ভাল লাগলো। পরবর্তী অংশের রহস্যের অপেক্ষায় রইলাম।

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.