পালাও! (২)
পর্ব ১ ~ ৪
[পুরোপুরি ফিকশন]
৫.
ভোর পাঁচটা বাজার কিছুক্ষণ পরে অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে র্যাবের কয়েকটি বিশাল ল্যান্ডক্রুজারকে র্যাডিসন হোটেলর গেট দিয়ে ঢুকে যেতে দেখা যায়। হোটেল থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত রাস্তা র্যাব পুলিশ আর সেনাবাহিনী দিয়ে কর্ডন করে রাখা হয়েছে। শুধু সাংবাদিকরা প্রবেশ করতে পারছেন, তাও বড় বড় মিডিয়ার। সাংবাদিকরা হোটেলেও ঢুকতে পারছেন। তবে হোটেলের ভেতর বিশেষ একটি হলরুমের মধ্যে তাদেরকে থাকতে বাধ্য করেছে র্যাব। অনেকেই চাইছেন ঘটনাস্থলের ছবি, ভিডিও তুলতে, কিন্তু কাউকেই যেতে দেয়া হচ্ছেনা। এমনকি সিএনএন, বিবিসি, আলজাজিরার মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিনিধিদেরকেও না। ঘন্টাদুয়েক পর, ভোর সাড়ে সাতটার সময় নিহত পেট্রোবসন্তের অবিসাংবাদিত নেতা হামিদ তালিবের মৃতদেহটিকে নিয়ে একটি গাড়ীর বহর হোটেল ত্যাগ করে বিমানবন্দরের দিকে রওনা হয়।
এর কিছুক্ষণ পর হোটেলের মর্নিং ব্যুফেতে এসে নাশতা সারেন র্যাবের চার অফিসার। র্যাডিসন হোটেলে ঢোকার সময় বেশ উদ্বিগ্ন অবস্থায় থাকা কর্ণেল জংকে অবশ্য এসময় খুব খোশমেজাজে থাকতে দেখা যায়। এত সহজে এবং দ্রুত যে পুরো ঘটনা গুছিয়ে আনতে পারবেন, কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত কল্পনাও করতে পারেননি। মেজর শিবশংকরও বেশ খুশী, এ পর্যন্ত তদন্তের যে অগ্রগতি, তাতে যে দায়িত্ব তাকে দেয়া হয়েছে সেটা স্রেফ পানিভাত। তবে হেদায়েত আর নঈমের চেহারায় ততটা স্বস্তি নেই, তাদের এ্যাসাইনমেন্ট খুব সহজও হতে পারে, কঠিনও হতে পারে।
ধোঁয়া ওড়া কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলতে থাকে কর্ণেল জং, "কি বলো হেদায়েত, এক সপ্তার মধ্যে এ্যাসাইনমেন্ট কমপ্লিট হয়ে যাবেনা?"
"আই হোপ সো!" ভাষ্যের দৃঢ়তার সাথে কন্ঠের দৃঢ়তা অনুভব করেনা হেদায়েত।
সেটা চোখ এড়ায়না কর্ণেল জংয়ের, ডানহাতের কড়ে আঙুল দিয়ে টেবিলে টোকা দিতে দিতে বলেন তিনি, "ডোন্ট ওরি ম্যান, আশা করি মিনহাজুল ভালো খবরই দেবে।"
নির্লিপ্ত চোখে তাকায় হেদায়েত। তাকে আশ্বস্ত করে কর্ণেল নঈম, বলে, "অত চিন্তিত হচ্ছো কেন? মিনহাজ যদি ভালো খবর না দিতে পারে, তাহলে আমাদের অন্য অপশন নিতে হবে।"
"নো নো নো", কিছুটা উত্তেজিত কন্ঠে বলে ওঠে কর্ণেল জং, "এখনই অন্য কোনো অপশনের কথা ভাবা যাবেনা। অফকোর্স! সবকিছু তো আমাদের মনমতো হবেনা। মিনহাজের তথ্যের উপর বেস করেই ঠিক করতে হবে কিভাবে কি করবো। তবে পরিকল্পনার ঘনঘন অদলবদল আমার পছন্দ না। উই হ্যাভ টু মুভ উইদিন দ্য ফ্রেমওয়ার্ক।"
নীরবতা নেমে আসে নাশতার টেবিলে। তবে সে নীরবতাকে একরকম উপেক্ষা করেই বলে যায় কর্ণেল মাহতাব জং, "গাইজ, হোয়াট উই মাস্ট রিমেম্বার ইজ দ্যাট, সিআইয়ে আর এফবিআই অথবা বলতে পারো কুয়েত সরকার, তারা কি চাচ্ছে? তারা চাচ্ছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কালপ্রিটকে বের করা। উই হ্যাভ নো অপশন। "
টেবিলের নীরবতায় তেমন পরিবর্তন দেখা যায়না, শুধু কমলার জুসের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে খানিকটা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় মেজর শিবশংকর। এ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে তার তেমন দুশ্চিন্তা নেই, অপরাধীকে একবার হাতের কাছে পেলে কিভাবে কড়ায়-গন্ডায় কথা আদায় করতে হয়, সেব্যাপারে তার দল সিদ্ধহস্ত।
সকাল ন'টার সময় সাংবাদিক সম্মেলন হবার কথা। বিশ্বের নামিদামী মিডিয়া সব এসে জুটেছে। কিছু বলাও যাচ্ছেনা, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ভিভিআইপির মার্ডার বলে কথা। তা নাহলে এসব সাংবাদিকদের অযথা ঝামেলা করতে দেয়ার পক্ষপাতি না কর্নেল জং।
সাধারনত ক্রসফায়ারে ক্রিমিনালদের মারার পর কোনো সাংবাদিক সম্মেলনে অংশ নেয়না সে। টিমের জুনিয়র কোনো মেম্বারকে পাঠিয়ে দেয়, তারা মুখস্থ কিছু কথা বলে দিয়ে ফিরে আসে। যদিও র্যাবের সম্মেলনকক্ষে বসে উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করার সাহস যে প্রেসের নেই সেটা কর্ণেল মাহতাব জং জানে, তাও তার ব্যক্তিগত ধারনা হলো, তার মতো সত্যিকারের কাজের মানুষেরা মিডিয়ার সামনে বেশী গেলে হালকা হয়ে যায়। নানান জায়গায় নানা লোক নানান ধরনের অর্থহীন কথা বলা শুরু করতে পারে তাকে নিয়ে। এবং এসব সে একেবারেই উপভোগ করেনা।
প্রেস কনফারেন্স কোনোরকম উত্তেজনা ছাড়াই শেষ হবার কথা ছিলো। ন'টা বাজার মিনিট দশেক আগেও সেভাবেই মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিল কর্ণেল জং আর তার দল। তবে সবকিছু পাল্টে দেয় মিনহাজের একটি ফোন। মূল সন্দেহভাজন সম্পর্কে যা জানা যায়, তা হলো কাল রাতেই গাঁটরি-বোচকাসহ ঢাকা থেকে পালিয়েছে সে। সন্ধ্যার পর থেকে কেউ আর তাকে দেখেনি। রাত দশটার দিকে মেসে ফিরে ভাত খেয়েছে, এরকম সাক্ষ্য পাওয়া গেছে তার মেসে। আর রাত সাড়ে দশটায় মেসমালিকের কাছে চাবি আর পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে যে এলাকা ছেড়েছে সেটাও নিশ্চিত করা গেছে।
"হোয়াট ডু ইউ নীড মোর?" মুচকি হাসতে হাসতে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন কর্ণেল জং।
বিদেশী সাংবাদিকরা নানা ধরনের খতরনাক প্রশ্ন করে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো গরীব আর শক্তিহীন দেশ হলে তো কথাই নেই। কর্ণেল জং ভেবে রেখেছিলো যে কোনো প্রশ্নের জবাবে "সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করা হবে" টাইপের কিছু গৎবাঁধা প্রতিশ্রুতি দিয়ে চালিয়ে যাবেন। আর র্যাবের ক্রসফায়ার নিয়ে কেউ প্রশ্ন করলে "মূল টপিকের বাইরে কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়া হবেনা" বলে এড়িয়ে যাবে। কিন্তু মিনহাজের কাছ থেকে খবর পাবার পর তার সাহস বেড়ে গেলো।
পরিস্কার আর শুদ্ধ ইংরেজীতে বেশ দৃঢ় কন্ঠে বিশ্বব্যাপী মিডিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে কর্নেল জং যা বলল, তার সারমর্ম দাঁড়ায় এমন যে, মূল কালপ্রিট একজন ইসলামী জঙ্গী, তাকে মোটামুটি নিশ্চিতভাবে সনাক্ত করা হয়েছে। এখন কর্তৃপক্ষ তাকে ধরার এবং তার সাথে জড়িত গোষ্ঠীকে সনাক্ত করার কাজ করবে। বাংলাদেশ সরকার সত দ্রুত সম্ভব পুরো ঘটনার পেছনে দায়ীদেরকে কব্জা করবে -- এরকম নিশ্চয়তা দিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বক্তব্য শেষ করে সে।
ইন্ডিয়া টাইমসের তুখোড় সাংবাদিক জয়পাল গাট্টু জিজ্ঞেস করেন কি কি পদক্ষেপ নেবেন তারা। বেশ গুছিয়ে, স্টেপ বাই স্টেপ কি করা হবে তা তুখোড় ইংরেজীতে ব্যাখ্যা করে কর্ণেল মাহতাব জং। জানায় যে, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, আসল কালপ্রিট অর্থাৎ খুনীকে হাতেনাতে ধরা। এরপর বেশ কয়েকটি গনমাধ্যমের অন্যান্য প্রশ্নের জবাবেও অত্যন্ত স্বতঃস্ফুর্ততার সাথে জবাব দিয়ে যায় মাহতাব, রীতিমতো সহকর্মীদের ঈর্ষান্বিত করে দিয়ে।
এক পর্যায়ে খানিকটা কৌতুকের স্বরে বিবিসির কার্ল গার্ডেনহায়ার জিজ্ঞেস করেন, "অপরাধীকে ধরতে গিয়ে ক্রসফায়ারের সম্ভাবনা আছে কিনা?"
শীতলচোখে কার্লের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে কর্ণেল জং, শক্ত হয়ে আসা চোয়ালকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক করে এনে অন্যদের দিকে তাকিয়ে ভরাট কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, "কারো আর কোনো প্রশ্ন আছে?"
হাসি হাসি মুখখানা নিমিষেই চুপসে যায় বিবিসির সংবাদিক কার্লের। অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে আসে হলরুমে। কার্লের পাশে বসা গালফউইকের সাংবাদিক মোহাম্মেদ বিলওয়াল ফিসফিস করে বলেন, "ম্যান, ইটস নট টাইম ফর কিডিং!"
তবে এরপরও যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব নিয়ে কর্নেল জং সমাপ্তি টানেন প্রেস কনফারেন্সের, প্রতিশ্রুতি দেন যে যেকোনো ধরনের আপডেটই সাংবাদিকদের জানানো হবে।
*************** ***************** ************
টিভিতে প্রেস কনফারেন্সের লাইভ সম্প্রচার দেখছিলেন প্রফেসর সেলিম হায়দার। কর্ণেল জংয়ের স্মার্টনেসে রীতিমতো মুগ্ধ তিনি। প্রেস কনফারেন্স শেষে চ্যানেল-আইয়ের তাৎক্ষণিক প্রোগ্রাম পাবলিক ওপিনিয়নেও দেখলেন যে সাধারন লোকজনও কর্ণেলের স্মার্টনেসে মুগ্ধ। বয়স্ক এক লোক পান চিবোতে চিবোতে বলছেন, "বাপের ব্যাডাই একখান!"
মনে মনে ঠিক করে ফেললেন সেলিম, পরের "কটূকথা"য় কর্ণেল জংয়ের ভূয়সী প্রশংসা করে একটা লেখা লিখবেন। অবশ্য সেটার মূল বক্তব্য হবে, এসব ইসলামী জঙ্গীদের ক্রসফায়ার বা গুপ্তহত্যা, যেভাবেই হোক নির্মূল করতে হবে। এদের ক্ষেত্রে মানবতার প্রশ্ন তোলাটাই মানবতার লঙ্ঘন -- এটা হবে তাঁর লেখার ক্যাচকপি। আবারও অদ্ভুত এক শিহরণ অনুভব করতে থাকেন তিনি। মুখের হাসিটা আপনাতেই ছড়িয়ে পড়ে চেহারা জুড়ে।
৬.
সকাল আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে আসার কথা আক্কাসের। তার সাথে এলাকার চেয়ারম্যান মাওলানা শরাফতউল্লাহর বাড়ীতে নাশতা খেতে যাবে ইদ্রিস -- এমনই কথা হয়েছিলো আজ সকালে ফজরের নামাজের পর। নাশতার পর চেয়ারম্যানের দুই নাতিকে ঘন্টাখানেক আমসিপারা পড়ানোরও কথা।
গতকাল সারারাত জেগে থাকতে হয়েছে ইদ্রিসকে, বাসের জার্নিতে কখনই সে ঘুমাতে পারেনা। ভোরে নামাজ শুরুর আগে আগে এই এলাকায় এসে পোঁছায় সে। নাশতার সময় ঠিক হয়ে যাওয়ায় ভেবেছিলো চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ীতে নাশতা আর বাচ্চা পরানোর কাজকর্ম শেষ করে তবে এসে খানিকটা ঘুমিয়ে নেবে।
কিন্তু সোয়া ন'টা বাজার পরও যখন আক্কাসের কোনো পাত্তা নেই, তখন পেটের খিদেটুকু ভোলার জন্য আপাতত খানিকটা ঘুমিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত নেয় ইদ্রিস। তবে তখনও সে জানেনা, জীবনে এমন কোনো সময় আসতে পারে যখন এত সহজে ঘুমানো যায়না। পনেরো মিনিটও ঘুমোতে পারেনি সে, ঘরের দরজায় দুমদাম আওয়াজ শুনতে পায়।
পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ ঘটে যায় খুব দ্রুত।
বারবার শুধু একটা প্রশ্নই তাকে করে যায় আক্কাস, "খুনটা কি আপনে আসলেই করছেন ইদ্রিস ভাই? আপনে কোনো দলের লগে জড়িত?"
যতবারই ইদ্রিস জানতে চায়, "কি খুন? কোন্ দল?" ততবারই আক্কাস ঘুরেফিরে একই প্রশ্ন করে। আর কিছু গুছিয়ে বলতে পারেনা। তার হাত-পা কাঁপতে থাকে, ইদ্রিস স্পষ্ট দেখতে পায়।
মাদ্রাসার নিচতলার পূবকোণের ছোট্ট ঘরটি ইদ্রিসকে দেয়া হয়েছে, আপাতত থাকার জন্য। পাশেই রান্নাঘর, একদৌড়ে রান্নাঘর থেকে পানি এনে আক্কাসকে এগিয়ে দেয় ইদ্রিস। কাঁধে হাত রেখে শান্ত হতে বলে। একঢোকে পানি খেয়ে একটু থিতু হয় আক্কাস, বিছানায় বসে।
ইদ্রিস বলে, "আক্কাস, ঘটনা কি? একটু না খুইলা কইলে তো কিছু বুঝতাছিনা!"
"ইদ্রিস ভাই, টিভিতে আপনের ছবি দেখাইতাছে। সকাল আটটা থেকা, বারবার। কইতাছে, আপনে বলে জঙ্গি, কোন কুয়েতি আমিররে খুন করছেন। কাইল রাইতে বলে? হোটেল রেডিসনে। সত্যি নি?"
"এইসব তুমি কি কও আক্কাস মিয়া?", এবার হাত-পা কাঁপাকাঁপি শুরু হয় ইদ্রিসের, "আমার ছবি দেখাইতাছে? টিভিতে? আমি কি করছি? আমি কি করছি?" বারবার আক্কাসের দু-কাঁধ ধরে পাগলের মতো ঝাঁকায় ইদ্রিস, জিজ্ঞেস করে, "ও আক্কাস, আমি অহনে কি করমু? আমি অহনে কি করমু?"
ইদ্রিসের কথা বিলাপের মতো শোনায় আক্কাসের কানে। যেন, মজলুমের হাহাকার। বিলাপরত ইদ্রিসকে দেখে খানিকটা ধন্দে পড়ে যায় আক্কাস। এই অসহায় চেহারা, এই নিরূপায় কন্ঠ কোনো খুনীর হবার কথা না। আবার টিভিতে যখন দেখাচ্ছে তখন অবিশ্বাসও করা যাচ্ছেনা। ধন্দটা সেখানেই। খাল কেটে কি শেষমেষ এত বড় কুমীরই এনে ফেললো সে! নাকি একটা নিরীহ লোককে কেউ ফাঁসিয়ে দিচ্ছে?
ইদ্রিস থাকতো ঢাকার মিরপুরে, একটা ছোটোখাটো মেসে। কাছেই একটা মসজিদে খাদিমগিরি করতো। অনেক চেষ্টা করেছে ঢাকা শহরে কোনো ভালো কাজ জোগাড় করার, খেয়ে পরে বেঁচে নিজেকে দাঁড় করানোর। লাভ হয়নি। বছর পাঁচেক কাটিয়ে দিয়েছে, তবে মসজিদের খাদিমের এই কাজের বাইরে আর কিছুই করতে পারেনি।
মসজিদের খাদিমদের আয়-রোজগার নাই, খাওয়া-দাওয়াটুকু পাড়াপ্রতিবেশীদের দান-খয়রাতে চলে, আর রাতে মসজিদে থাকার একটা জায়গা পাওয়া যায়। আয় রোজগার যা হয়, সব মানুষের বখশিস থেকে। এভাবে তো আর জীবন চলেনা; ইদ্রিস ঢাকা ছাড়ার কথা ভাবছিলো। তখনই দেখা আক্কাসের সাথে, মাসখানেক আগে। আক্কাস আর ইদ্রিস মফস্বলে একই পাড়ার থাকতো। ঢাকায় দুজনের দেখা তাবলীগের খাতিরে, আক্কাসদের জামাত ঢাকা এসেছিলো। বছর দশেক বা তারও বেশী হবে, এতদিন পর এলাকার বড়ভাইকে দেখে কি বেশ খুশীই হয়েছিলো আক্কাস। ইদ্রিসের বৃত্তান্ত জেনে ভেবেছিলো আল্লাহর রাস্তায় কাজ করে যাবেন এমন একজন খাস বান্দার দেখা আল্লাহ তাকে মিলিয়ে দিয়েছেন।
আক্কাস নিজেও মফস্বল ছেড়েছে অনেকদিন, এখন অন্য একটি জেলার মফস্বল শহরে থাকে। উপজেলা স্কুলের পাশে বইয়ের দোকান তার, দোকানদারিতে রিজিক মোটামুটি চলে যায়, বাকীটা সময় তাবলীগের রাস্তায় দেয়। সেই সুবাদেই ইদ্রিসকে নিজের এলাকায় আসার প্রস্তাব দেয় আক্কাস। এলাকার বড়বাড়ীর মসজিদে খাদেমগিরি, মাদ্রাসায় টুকটাক পড়ানোতে সাহায্য করা আর মানী-গুনী লোকদের বাসায় বাচ্চাদের পড়ানো -- সবমিলিয়ে ভালোই আয় হবে বলে জানায় আক্কাস। শর্ত একটাই, তাবলীগের যেসব জামাত বড়বাড়ীর মসজিদে আসবেন তাদের সাথে যোগ দিতে হবে, খেদমত করতে হবে, এবং বড়বাড়ীর মসজিদ থেকে মাঝে মাঝে যেসব জামাত অন্যান্য জায়গায় যায় সেগুলোতেও যতবেশী সম্ভব যোগ দিতে হবে। শর্তগুলো ইদ্রিসের জন্য কঠিন ছিলোনা, ঢাকাতেও মাঝেমাঝে সে তবলিগের জামাতের সাথে ঘুরেছে। বলতে গেলে এককথায় রাজী হয়ে যায় সে। অনেক ধৈর্য্যের পর মহান রাব্বুল আলামীন তার দিকে মুখ ফিরিয়েছেন -- কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ে সে।
সেই সূত্রেই আজ সকালে এলাকায় এসে হাজির ইদ্রিস। ফজরের নামাজের পর যখন আক্কাস তাকে মসজিদ-মাদ্রাসা কমিটির সভাপতি এলাকার চেয়ারম্যান মাওলানা শরাফতউল্লাহর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, তখন তাঁর অমায়িক ব্যবহার ইদ্রিসকে মুগ্ধ করে। এত বড় পরহেজগার বান্দা আল্লাহর, তার ওপর এলাকার চেয়ারম্যান, অথচ কি সুন্দর করেই না তার মতো নাদান লোককে আপনি করে কথা বললেন। সকালে নাশতার দাওয়াতও দিলেন। দিনের শুরুটা খারাপ ছিলোনা। এদিকে, ইদ্রিসের আদব-লেহাজ, আরবী উচ্চারণও মাওলানা শরাফতউল্লাহকে মুগ্ধ করেছে আজ সকালে। ফজরের পর বাড়ী ফিরতে ফিরতে আক্কাসকে তিনি বলেছেন, "এতদিনে একটা কাজের মতো কাজ করলা, আক্কাস মিয়া।"
অথচ সেই ইদ্রিস ভাইকে নিয়ে সহসাই যে এত বড় বিপদ সে সৃষ্টি করবে সেটা আক্কাসের কল্পনায়ও ছিলোনা। সকাল আটটার দিকে তাকে ডেকে পাঠান মাওলানা শরাফতউল্লাহ, জরূরী ভিত্তিতে। বৈঠকখানায় বসিয়ে টিভির দিকে তাকাতে বলেন। তারপর ফিসফিস করে বলেন,
"সকালে তো মনে হয় তুমি আর আমি ছাড়া কেউ ওরে ভালোমতো দেখেনাই।"
আতংকিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে আক্কাস, "এখন কি করবো, হুজুর?"
"পেরেশান হইওনা, রসুলে করীমের নিষেধ আছে। যা বলি শুনো, তুমি এখনই গিয়া খোঁজ নাও যে ইদ্রিস মিয়া এখনও আছে না পালাইছে। যদি পালায় তো আলহামদুলিল্লাহ, আমরা কাউরে কিছু বলবনা। অযথা ফ্যাসাদ বাড়াবোনা, ঠিক আছে?" চেয়ারম্যান শরাফতউল্লাহর কন্ঠে ভয় নেই।
আতংক ঢাকার চেষ্টা করতে করতে আক্কাস জবাব দেয়, "জ্বি জনাব।"
"আর যদি সে এখনও মাদ্রাসাতেই থাকে, তাইলে তুমি সাথে সাথে আমারে মোবাইলে জানাইবা, কেমন? ইদ্রিস মিয়ারে ভুলাইয়া ভালাইয়া ধইরা রাখবা, আমি দারোগা সাবরে নিয়া যাবো।"
"হুজুর, দারোগা সাব যদি জিজ্ঞাস করে কেন এরে চাকরি দিছেন, তখন কি বলবেন?"
"সেইটা নিয়া তোমারে ভাবতে হবেনা। সেইটা আমি সমলাবো। তুমি শুধু ইদ্রিসরে আটকায়া রাখো।" চেয়ারম্যানের কন্ঠে খানিকটা বিরক্তি টের পায় আক্কাস; সময় নষ্ট করা যাবেনা, বুঝতে পারে সে।
সদ্য ঘুমভাঙা ইদ্রিস যখন তাকে দরজা খুলে দিচ্ছলো, তখন পর্যন্ত আক্কাসের মনে কোনো সন্দেহ ছিলোনা যে ইদ্রিসকে পাওয়া গেলে যেকোনো মূল্যেই হোক, তাকে আটকেই রাখতে হবে। কিন্তু সেসময়ের ইদ্রিসের চেহারায় আর কন্ঠে এমন কিছু ছিলো, যা তাকে সন্দিহান করে তোলে। এই লোকটি কি আসলেই খুনী?
আক্কাসের মতো সামান্য বইয়ের দোকানদার এমন ভয়ানক পরিস্থিতিতে কখনও পড়েনি, নিজের ওপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ হারায় সে। তদুপরি, সব শোনার পর ইদ্রিসের হতবিহবল আচরণ তাকে আরো বেশী সন্দিহান করে তোলে। মনে মনে বলতে থাকে, "ইয়া আল্লাহ, ইয়া মালিক, আমারে দিয়া অন্তত ভুল কাজটা তুমি করাইওনা।"
তখনই, হঠাৎ আক্কাসের হাত চেপে ধরে ইদ্রিস, কাঁচুমাচু কন্ঠে বলে, "আক্কাস, ভাইরে, তুই আমারে বাঁচা। আমি তো কিছু বুঝতাছিনা, তর এইহানে চইলা আইছি, কিছু চিনিওনা; আল্লার দোহাই লাগে, তুই আমারে বাঁচারে ভাই, তুই আমারে বাঁচা।"
"খোদার কসম খাইয়া কন আপনে খুন করেননাই।" খানিকটা অজান্তেই উচ্চারণ করে আক্কাস।
"খোদার কসম কইতাছি রে ভাই, খোদার কসম।"
বেশী সময় নিতে পারেনা আক্কাস। চিত্তের দয়ালু অংশের কাছে হেরে যায় ন্যায়পরায়নতা, কঠোরতা। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, ইদ্রিস ভাইকে সে বিশ্বাস করবে। চেয়ারম্যান মাওলানা শরাফতউল্লাহকে বলবে যে মাদ্রাসায় এসে দেখেছে যে ইদ্রিস পালিয়ে গেছে।
৭.
এলাকার মূল বাজার মোহাম্মদগঞ্জ, মাদ্রাসা থেকে উত্তর দিকে। এখানেই বাস থেকে নেমেছিলো ইদ্রিস। তবে মাদ্রাসা থেকে মাইল তিনেক দক্ষিণে গেলে আরেকটা বাজার আছে, বাশার মোল্লার বাজার। ইদ্রিসকে ওখানে যাবার পথ বলে দেয় আক্কাস। মাদ্রাসার একতলার পূবকোণের যে বাথরুম, সেখানে খুব দ্রুত দাড়ি-গোঁফ শেভ করে নেয় ইদ্রিস। আর একইসাথে আক্কাসের প্যান্টশার্টের সাথে নিজের পাজামা-পাঞ্জাবী পাল্টে নিতেও ভোলেনা। নিজের একটা পুরোনো মোবাইল আর কিছু টাকাও ইদ্রিসের হাতে গুঁজে দেয় আক্কাস, বলে,
"আল্লাহর নামে আপনারে বিশ্বাস করলাম ইদ্রিস ভাই, সবাধানে থাইকেন।"
বাশার মোল্লার বাজারটা যদিও একটু গ্রামের দিকে, তবে সেখানেও টেম্পো/বাস থামে। সেখান থেকেই টেম্পো নিয়ে আরো গ্রামের দিকে চলে যেতে বলেছে আক্কাস। তবে যতই গ্রামের দিকে যাক, কোথায় গিয়ে থাকবে ইদ্রিস? গ্রাম হোক, মফস্বল হোক, এসব জায়গায় প্রায় সবাই সবাইকে চেনে। তাকে দেখে লোকজনের মনে প্রশ্ন জাগবেই। যদিও টিভিতে এখন তার দাড়ি-টুপিওয়ালা ছবি দেখাচ্ছে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ তার দাড়িগোঁফ-বিহীন ছবি বানিয়ে ফেলবে। তখন নিজেকে লুকোনো হয়ে যাবে আরো কঠিন! বড়বাড়ীর মাদ্রাসা থেকে দৌড়ে বাশার মোল্লার বাজারে যেতে যেতে এরকম নানান দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হতে থাকে ইদ্রিস। এঁকে বেঁকে চলে যাওয়া মাটির রাস্তাকে মনে হয় ধূসর অথৈ সমুদ্র, কুল নেই, কিনারা নেই।
তবে বাজারে এসে ওঠার পর অবশ্য নিজেকে খানিকটা শান্ত রাখতে সক্ষম হয় সে। ভয় ছিলো, বাজারে এসে উঠতেই হয়ত লোকজন "ধর্, ধর্" বলে তেড়ে আসবে। কিন্তু বাস্তবতা আতংকের চেয়ে অনেক ভিন্ন হয়, বাজারে সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। তাকে কেউ লক্ষ্য করছেনা। ঢাকায় লম্বা সময় থেকে অনেক কিছু শিখেছে সে, সে বুঝে যায়, নিজে থেকে উল্টোপাল্টা আচরণ না করলে এই বাজারের অর্ধেকের বেশী লোকজন তাকে খেয়ালও করবেনা।
বেলা দশটার মতো বেজে গেছে, বাজারে লোকসমাগম ভালো। শান্ত ভঙ্গিতে একটা চায়ের টুকরি ঢুকে দোকানে ঢুকে এককাপ চা আর দুটো সিঙ্গাড়ার কথা বলে ইদ্রিস। আশপাশের টেবিলে লোকজন কি কি বিষয়ে কথা বলছে শোনার চেষ্টা করে। আশ্বস্ত হয়, বুঝতে পারে, দক্ষিণ দিকে এই একটি বাজারেই রাস্তাঘাট ভালো, শহর থেকে এখানে মালপত্র আসে, এখান থেকে ভ্যানগাড়িতে করে লোকজন নানান দিকে মাল পরিবহন করে। বাজারে এখন ভীড় এসব ভ্যান চালকদেরই। অনেকে আবার মাথায় বহন করেও নিয়ে যায়। চায়ের দোকানে সবার মূলত একটাই আলোচনা, আজ কোন জায়গা থেকে কোন জিনিসের কয়টা চালান আসবে। অবশ্য আরো একটা আলোচনাও আছে, কে কোন ব্যাপারীর কাছে কত টাকা পায় তার ফিরিস্তি।
টেম্পোস্ট্যান্ডে আসা টেম্পোগুলোকেও নিবিড়ভাবে খেয়াল করতে থাকে ইদ্রিস। এতক্ষণের যোগে-বিয়োগে মনে মনে সে ঠিক করেছে, একটু বড় শহরের দিকেই যাবে। আরো কিছু বিষয়ে মনস্থির করে ফেলে সে, যেমন:
১) কাউকে জিজ্ঞেস করা যাবেনা এখান থেকে টেম্পো কোথায় কোথায় যায়, টেম্পোর কন্ডাকটারের হাঁকডাক থেকে জেনে নিতে হবে।
২) টেম্পোতে উঠলেও বসতে হবে একদম বাইরের কোনার দিকে। যাতে যে কোনো মুহূর্তেই চুপেচাপে নেমে হাওয়া হবার পথ খোলা থাকে।
৩) বাসে ওঠা যাবেনা, কারণ একবার কেউ মার্ক করে ফেললে পালানোর উপায় থাকবেনা।
ঘন্টা আধেক পর্যবেক্ষনের পর মোটামুটি একটা ধারনা তৈরী করে ফেলতে সক্ষম হয় ইদ্রিস, মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় যে টেম্পোতে করে রানীগঞ্জের দিকে যাবার চেষ্টা করবে। লোকজনের কথায় সে আঁচ করতে পেরেছে যে রানীগঞ্জে গেরস্থ ঘর অনেক বেশী, টুকটাকও কাজও পাবার সম্ভাবনা বেশী। হাতে তার টাকা বেশী নেই, আক্কাসের দেয়া দু'শো টাকা সমেত মোট সাড়ে পাঁচশো। বড়জোর সপ্তাখানেক যাবে।
কোনোরকম সমস্যা ছাড়াই বাশার মোল্লার বাজার ছাড়তে সক্ষম হয় ইদ্রিস। সকাল আটটায় তার ছবি দেখিয়েছে টিভিতে। এখন সাড়ে দশটা, আড়াই ঘন্টায় এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নাই। আল্লাই বাঁচাবেন তাকে, আল্লাহ মালিক।
তবে তখনও বাশার মোল্লার বাজারের কেউ জানতোনা যে আর ঘন্টাদুয়েকের মধ্যেই এই বাজারে প্রথমবারের মতো র্যাবের ভ্যান চলে আসবে, দাড়িওয়ালা একটা লোকের এ-ফোর সাইজের ছবি হাতে দোকানে দোকানে চলবে ভয়াবহ রকমের জিজ্ঞাসাবাদ।
৮.
র্যাব যখন বাশার মোল্লার বাজারের দোকানে দোকানে জিজ্ঞাসাবাদে ব্যস্ত, ঠিক তখন রাণীগঞ্জ থেকেও আরো মাইলদশেক দক্ষিণে কলাপাড়া পৌরসভা এলাকার এক ছোটোখাটো মার্কেটে একশো চল্লিশ টাকায় একটি পাওয়ার ছাড়া চশমা আর পঞ্চাশ টাকায় একটি কানটুপি কিনছিলো ইদ্রিস। রাণীগঞ্জের টেম্পোতে বসেই সে জেনেছে যে রানীগঞ্জ বাজার থেকে সাড়ে এগারোটার দিকে কলাপাড়া পৌরসভার দিকে একটা বাস যাবে, গেইটলক, বিশ টাকা ভাড়া। এবং গত তিন ঘন্টায় যেহেতু টিভিতে দেখানো জঙ্গী ইদ্রিসকে নিয়ে কোনো আলোচনা সে শোনেনি, তাই মোটামুটি এই সাহসটুকু সে অর্জন করতে পারে যে এই এলাকার বাসে বাসে এখনও তল্লাশী শুরু হয়নি। "আল্লাহ মালিক" বলে এক ধরনের সাহস সঞ্চয় করে বাসে চড়ে বসে।
তবে "জঙ্গী ইদ্রিস"কে নিয়ে লোকের আলাপ-আলোচনা প্রথম সে শুনতে পায় কলাপাড়াতেই, বেলা দেড়টার দিকে, মানে টিভিতে দেখানোর পাঁচ ঘন্টারও পরে। পৌরসভার বড়পীরসাহেবের মসজিদে জোহরের নামাজ পড়ে যখন বের হয়ে মুসল্লিদের আলাপ-আলোচনা শোনার চেষ্টা করে তখন। একেকজন একেক কথা বলছে, কেউ বলছে জেএমবি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, কেউ বলছে রাজাকারদের বিচার বন্ধ করতে জামাত ইসলামির কারসাজি। কেউ কেউ আবার উল্টা কথা বলছে, সরকার মুসলমানদের উপর অত্যাচার করার জন্য এসব সাজিয়েছে, টঙ্গী বলে কিছু থাকলেও জঙ্গী বলে কিছু নেই। কেউ আবার বলছে, সব ভারতের ষড়যন্ত্র, র'এর কুকর্ম। যত লোক, তত মত।
এর মধ্যে একজনের কথাতেই কিছুটা লাভ হয় ইদ্রিসের, বাশার মোল্লার বাজার আর মোহাম্মদগঞ্জ বাজারে যে র্যাব এসেছে সে তথ্যটা জেনে যায়। র্যাব যে এত তাড়াতাড়ি এত কাছে চলে আসবে একটু আগেও সেটা ভাবেনি ইদ্রিস। গাবতলি থেকে একটা সাধারন মানের কোস্টারে উঠেছিলো কাল রাতে। রাত দশটায়ও সেখানে যেরকম মানুষের ভীড় থাকে তাতে তাকে সেভাবে কারো লক্ষ্য করার কথা না। মেসের মালিককেও সে বলে আসেনি কেন মেস ছাড়ছে বা এরপর কোথায় যাচ্ছে। শুধু চাবি আর পাওনা টাকা মিটিয়ে দিয়ে বিদায় জানিয়ে এসেছে। অবশ্য মিরপুর এলাকা থেকে কেউ মেস ছেড়ে চলে গেছে শুনলে পুলিশ প্রথমেই গাবতলীতে গিয়ে খোঁজ করবে, এটা সে বুঝতে পারে। অর্থাৎ, বাশার মোল্লার বাজার থেকে এখন যে র্যাব-পুলিশ টেম্পোর রুট ধরে রানীগঞ্জের দিকে রওয়ানা দিয়ে ফেলেছে এ নিয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই। তার অর্থ দাঁড়ায়, রানীগঞ্জ থেকে কলাপাড়া তারা পৌঁছে যেতে পারে বিকেলের মধ্যেই, মনে মনে হিসেব কষে ফেলে ইদ্রিস। কলাপাড়া এলাকাতেও পোষাবেনা, আরো অনেক অনেক দূর চলে যেতে হবে -- খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। আগে কখনও এরকম বিপদে পড়েনি, তাই এই সংকটমুহূর্তে তার মাথা যে কত দ্রুত কাজ করছে সেটা টের পায়না ইদ্রিস।
মাইজদী স্টেশনে যখন ইদ্রিস নামে, তখন রাত সাড়ে আটটা। এলাকার কিছুই চেনেনা সে, শুধু জানে এখানে একজন পুরাতন তাবলীগের সাথীকে পাওয়া যেতে পারে। আবদুল কুদ্দুস ভাই, গত বছর বিশ্ব ইজতেমার সময় টঙ্গিতে দেখা হয়েছিলো। আল্লাহতালা এমন অমায়িক আর নির্লোভ বান্দাও পৃথিবীতে পয়দা করেছেন -- শুধু এই ভেবেই বারবার মনে মনে সুবহানাল্লাহ বলেছিলো ইদ্রিস।
কলাপাড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠার পর কিছুটা সময় নির্বোধের মতো বসে ছিলো ইদ্রিস। মাথায় কিছু খেলছিলোনা। র্যাব প্রত্যেক স্টেশনে স্টেশনে চেক করতে পারে, এমন ক্ষীণ ভয় কাজ করছিলো মনে। তবে কলাপাড়া এবং তার পরের স্টেশনে যখন সেরকম কাউকেই দেখা গেলোনা, তখন খানিকটা আত্মস্থ হতে পারে সে।
তবে ভবিষ্যত নিয়ে অনিশ্চয়তা ভর করে ইদ্রিসের ওপর, ভাবতে শুরু করে, এই মুহূর্তে যা সে করছে, তাতে কি সে আসলেই বেঁচে যেতে পারবে? এক ফাঁকে কলাপাড়া স্টেশন মাস্টারের ঘরে উঁকি দিয়ে টিভির সম্প্রচারটুকু দেখে নিয়েছিলো সে। হামিদ তালিবকে হত্যার আসামী হিসেবে শুধুমাত্র তার একার ছবিই দেখানো হচ্ছে, এবং র্যাবের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, আগামী একসপ্তার মধ্যে ধরিয়ে দিতে পারলে পাঁচ লক্ষ টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। অর্থাৎ, সরকার খুব দ্রুত ধরতে চাচ্ছে তাকে।
ঠান্ডা মাথায় ভাবতে থাকে ইদ্রিস, চেনা বা অচেনা যেকোনো জায়গাতেই হোক, রাস্তাঘাটে পালিয়ে পালিয়ে বেশীদিন থাকতে পারবেনা সে। গ্রামেগঞ্জে গিয়েও লাভ নেই, কোথায় লুকোবে?
ক্ষেতে?
বাদাড়ে?
বাগানে?
লোকের চোখে তাকে পড়তেই হবে। তাছাড়া, খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপার, কোথায় করবে?
কার কাছে চাইবে?
হাজারটা সমস্যা!
এতসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে এতক্ষণে যে সত্যটা সে বুঝতে পারে তা হলো, আজ সকালে যদি আক্কাস তাকে বিশ্বাস না করত, তাহলে এতক্ষণে সে র্যাবের হাতে থাকতো। হয়তো এরই মধ্যে ক্রসফায়ারে মারা পড়তো, নতুবা গুম হয়ে যেত।
অর্থাৎ, কারো না কারো সাহায্য তাকে নিতেই হবে, কারো না কারো আশ্রয়ে তাকে যেতেই হবে। এমন কারো আশ্রয়ে, যে তাকে বিশ্বাস করবে। এবং একইসাথে এমন কেউ হতে হবে, যার সাথে তার সচরাচর দেখা হয়না, যাতে র্যাবের সন্দেহের তালিকায় ব্যক্তিটি না থাকে। খুব দ্রুত এমন কারো কথা মনে করার চেষ্টা করে ইদ্রিস। সংকটমুহূর্তে স্মৃতিও খুব সাহায্য করে, সহসাই তার মনে পড়ে আবদুল কুদ্দুস ভাইয়ের একটা কথা, গত বছর ইজতেমার সময় তিনি তাকে বলেছিলেন, "ইদ্রিস ভাই, কোনো তবলিগি ভাই যদি বিপদে পড়ে, তাইলে তাকে বাঁচানো হইলো আমগো ইমানী দায়িত্ব।"
আবদুল কুদ্দুস ভাই, মাটির মানুষ, উনার কাছে সাহায্য চাইলে উনি না করবেননা এই বিশ্বাস ইদ্রিসের আছে। ইজতেমায় কার সাথে কার পরিচয় হয় কেউ খবর রাখেনা, তাই ইদ্রিসের প্রসঙ্গে আবদুল কুদ্দুস ভাইয়ের কথা কারো মাথায় আসবেনা বলেই তার বিশ্বাস। গত বছর ইজতেমায় আবদুল কুদ্দুস ভাই তাদেরকে বাড়ীতে যাবার দাওয়াত দিয়েছিলেন। মাইজদি কোর্টের সামনে দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেটা ধরে মাইল পাঁচেক হাঁটলে নক্সাবন্দী বাজার, বাজারের মোড় থেকে পূবদিকে মোড় নিয়ে কিছুদূর গেলেই তার বাড়ী। সারাবছরই তাবলীগের সাথীদের খেদমতে ব্যবহার হয় তাঁর বাড়ীর। এই মুহূর্তে স্মৃতিশক্তিও যে কতটা সাহায্য করছে তাকে, সেটাও টের পায়না ইদ্রিস।
আবদুল কুদ্দুসের বাসায় যখন ইদ্রিস পৌঁছায়, তখন রাত এগারোটার বেশী। নক্সাবন্দী বাজারের মসজিদে এশার নামাজ পড়ার পর, তাবলীগের এক জামাতের বয়ানে বসে সে। সেখানে আবদুল কুদ্দুস ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে যায় তার। প্রথমেই আবদুল কুদ্দুস ভাইকে সব না বলার সিদ্ধান্ত নেয় সে, আগে জানতে হবে আবদুল কুদ্দুস ভাই ঘটনার কতদূর জানেন?
"আসসালামালাইকুম, আবদুল কুদ্দুস ভাই। আমার কথা মনে আছে নি?" ইদ্রিসের প্রশ্নে আবদুল কুদ্দুসের হতচকিত চেহারা দেখেই ইদ্রিস বুঝতে পারে বিশদ পরিচয় দেয়া লাগবে। ধীরে ধীরে সে এটাও জানতে পারে যে, সারাদেশে আজ তাকে নিয়ে যেসব বিজ্ঞপ্তি/আলাপ আলোচনা চলেছে, সেসব থেকে অনেক দূরে আছেন আবদুল কুদ্দুস ভাই আর তাঁর এই তাবলীগি সাথীরা। তাঁরা সাধারণত শয়তানের বাক্স, মানে রেডিও-টিভি দেখেননা।
বয়ানের পর আবদুল কুদ্দুস ভাইয়ের বাসায় রাতের খাবার খেতে খেতে সব খুলে বলে ইদ্রিস। মনে মনে একটা ভয় ছিলো, আবদুল কুদ্দুস ভাই হয়তো তাকে বিশ্বাস করবেননা; একবার ঠিক করে রেখেছিলো, সেক্ষেত্রে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে রাতটা কাটিয়ে সকালে অন্য কোথাও যাবার চেষ্টা করবে। তবে আল্লাহ মেহেরবান, আবদুল কুদ্দুস ভাইয়ের দিলে আল্লার নেক বান্দাদের জন্য খাস বিশ্বাস তিনি পয়দা করে দিয়েছেন। সবশুনে আবদুল কুদ্দুস ভাই বললেন খুব স্বাভাবিকভাবেই বলেন, "ইদ্রিস ভাই, আপনে আমার তবলীগি বেরাদার। যতদিন আল্লাহ চাইবেন, আপনি আমার বাসায় আমার হেফাজতেই থাকবেন।"
আবদুল কুদ্দুস ভাই যত সহজে কথাগুলো বললেন, তাতে তিনি পরিস্থিতির ভয়াবহতা আসলেই বুঝতে পেরেছেন কিনা এই নিয়ে একটা সন্দেহ ইদ্রিসের মনে থেকে যায়। তবে আপাতত আশ্রয় পাওয়া গেছে, বেশী বুঝাতে গিয়ে তার বারটা বাজানো যে উচিত হবেনা সেটাও সে বুঝতে পারে।
একই সাথে আবদুল কুদ্দুস ভাইয়ের এরকম স্বাভাবিক আচরণ তার মনে খানিকটা সন্দেহের দোলাও দেয়। আবদুল কুদ্দুস ভাই কি তবে রাতে পুলিশ ডাকাবেন। অজান্তেই "তওবা আসতাগফিরুল্লাহ" পড়ে নেয় ইদ্রিস, আল্লাহর খাস নেককার বান্দা, ইনাদের নিয়া সামান্য সন্দেহ করাও মহাপাপ।
ইদ্রিসের জন্য মায়া লাগতেছে, আল্লাহর বান্দারে নিয়ে ডর লাগতেছে
প্রথম পর্বের মতো জমাটি লাগলো না
পড়ছি
কাহিনী কোনদিকে যাবে সেটা বোঝা না গেলেও হালকার উপ্রে ঝাপসা বুঝতেছি যে ইদ্রিসকে র্যাব মুরগা বানায়ছে।
ইদ্রিস কি ক্রশফায়ারে পড়লো? আর কর্নেল জং'রে ভাবের কিছু ভাবছিলাম, সেও কি শেষে গতবাধাঁ বুলি কপচাইবো?
এতো ভালো একটা লেখায় যদি এ কয়টা মন্তব্য পড়ে তাহলে লোকে লেখার উৎসাহ কিভাবে পাবে

দারুন হচ্ছে। তারাতারি পরের পর্ব দেন।
মন্তব্য করুন