আমার ক্রমশ বাবা হয়ে ওঠা
মানুষ হিসাবে আমি স্বার্থপর। নিজের জন্ম তারিখটা ছাড়া অন্য কারো জন্মদিনের কথা মনে রাখি না। মনে না রাখাটাকে স্মৃতির দুর্বলতা হিসাবে চালাইয়া দিই। আসল কথা মনে রাখতে চাই না। মনে রাখতে না চাওয়াটা এখন এমন অভ্যসে পরিনত হইছে যে আজকাল চাইলেও মনে রাখতে পারি না। এইসব মা, বাবা, ভালবাসার দিন পাশ কাটাইয়া চইলা যায় তবু ছুঁইয়া যায় না। বাবা দিবসটাও পাশ কাটাইয়া চইলা গেছে অথচ বাবারে নিয়া কিছু লেখা হইল না। বড়ই অকৃতজ্ঞ সন্তান আমি। ভাবতেছি বাবারে নিয়া দুই কলম লিখি এইছাড়া পিতৃঋণ শোধ হবে না …. না না শোধ হবে না (বাফড়ার লেখা হইতে মাইরা দিলাম)।
কইত্থিকা আরম্ভ করি? মাইর দিয়াই শুরু করি। পিতৃ শাসন বলিতে যাহা বুঝায় অর্থাৎ মাইর, সেইটা আমার পিতা সারা জীবনে একবারই দিছিলেন। তখনো ইস্কুলে ভর্তি হই নাই। আহ্লাদের অতিসজ্জে উনার পেটের উপরে ডাব্লিউ ডাব্লিউ এফ স্টাইলে একবার একটা লাফ দিছিলাম। প্রতি উত্তরে উনিও মোলায়েম ভাবে একখানা চপেটাঘাত মারিলেন। এই জীবনে আমার মাতৃদেবীর হাতে কম মাইর খাই নাই, কিন্তু একটার কথাও মনে করতে পারি না। বাবার হাতের সেই মোলায়েম চাটি আমি আজও ভুলতে পারি নাই।
আমি ইস্কুলে ভর্তি হইবার পর আমার পিতার মাথায় একটা দুইটা চুল পাকা শুরু করল। খুব সম্ভবত আমার রেজাল্ট দেইখা ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় এই পাকা চুলের দুর্বিপাক আরম্ভ হইছিল উনার। তবে কবি বলেছেন কারু পৌষ মাস কারু সর্বনাশ। এই ক্ষেত্রে পিতার সর্বনাশে আমার পৌষ মাস আরম্ভ হইল। প্রতি চুল আর আনা চুক্তিতে পাকা চুল বাইছা দিতাম। চুল বাছা বাছির প্রথম এক মিনিটে উনি ঘুমাইয়া যাইতেন আর আমি সেই সুযোগে একটা চুলরে দুই ভাগ করিয়া এক টাকা বানাইতাম। আহা কই গেল সেই দিন।
সকাল বেলা ঘুম থিকা তোলার জন্য উনার ছিল এক নিজস্ব স্টাইল। গরমকালে ভোর বেলা পাখা বন্ধ কইরা দিতেন আর শীতকালে জানালা খুলে দিতেন। একেবারে মোক্ষম অস্ত্র। ঘুমের বাবাও থাকবে না এই তরিকায়। এছাড়া তার ছিল একটা টু ইন ওয়ান রেডিও, ঐটারে ফুল ভলিউমে খবর শুনতেন সকাল বেলা। সংবাদ পাঠিকার আওয়াজের চাইতে উৎকট ঘ্যাড় ঘ্যাড় শব্দ বেশি শোনা যাইত। এই দারুন শব্দ দূষণের মাঝে ঘুমাবে কোন কুম্ভকর্ণ। বাধ্য হইতাম বিছানা ছাড়তে।
ব্যক্তি হিসাবে তিনি কবি, তবে উনার কবিতা কোথাও ছাপা হয় না। দুই আলমারি ভর্তি বিশাল বিশাল খাতায় তার জীবনী লিখেছেন তিনি। এত বিশাল ডিটেইল যুক্ত জীবনী মনে হয় না পৃথিবীর কারু আছে, এপ্লাই করলে গিনেস রেকর্ড বুকে নাম উঠবে ইনশাল্লাহ। ধর্ম নিয়া কোন বাড়াবাড়ি নাই। প্রথম যৌবনে জনৈকা হিন্দু বিধবারে বিবাহের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন যেইটা নিয়া আমরা আজও হাসাহাসি করি। তবে আজকাল নামাজ পড়েন বলে শুনছি। কিন্তু আমাদের নামাজ রোজা নিয়া কোন দিনই কোন উপদেশ দেন নাই। তার নীতি ছিল চোখ কান মন খোলা রাখো এক সময় নিজেই নিজের পথ খুঁজিয়া পাইবে। লাভের লাভ হইছে আজও ধর্ম খুঁইজা পাই নাই।
বাড়ি ছাড়ছি প্রায় সাত-আট বছর হবে। হাটে মাঠে ঘাটে জীবন কাটে। বছরে এক আধবার বাড়ি যাই। যতবারই যাই দেখি বাবা আর একটু বুড়া হইয়া গেছেন। ক্রমশ দুর্বল অসহায় হইয়া যাইতেছেন। একসময় আমি বাবারে আঁকড়াইয়া থাকতাম নিগূঢ় ভরসায়। আজকাল আমারে তিনি আকর্ষী দিয়া আঁকড়াইয়া ধরতে চান। ডাক নামের আগে বাবা শব্দটা ব্যবহার করেন। আমার বড় খারাপ লাগে, আবার একই সাথে ভালও লাগে। অদ্ভুত মমতা জন্ম নেয় মনে বারবার; কিভাবে জানি আমি ক্রমশ বাবা হয়ে উঠি।
মন ভরে গেলো তোমার লেখা পড়ে।
সুন্দর আবেগী লেখা। আদ্র হইল মন।
বাবা !!! জানিইনা কি জিনিস ।
সাঈদ ভাই,
মন খারাপ করবেন না। কারো বাবা এমন জিনিষ যেটা জানতে না পারলেই ভাল।
সুন্দর, সুন্দর।।
বাহ !
আপনার বাবার দীর্ঘজীবন কামনা করি
মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখা। ভালো থাকুন বাপ-পুত দু'জনেই
বাপে-পুতে ভালো থাকুক। দুইজনের দীর্ঘ ঝঞ্ঝামুক্ত জীবন কামনা করি।
এইখানেই মানুদারে চেনা যায়
ভালো লাগলো লেখাটা
আহারে, কি এক অদ্ভুত চক্রপাক!
লেখাটা পড়ে কিছুক্ষণ দম ধরে থাকতে হলো
আমারও পোস্ট লিখা হইল না পিতাজীরে নিয়া ... এই ফাদারস ডে টাও মিস গেল
তুমার বাবা হয়ে উঠার প্রসেস টা ভাল্লাগলো ... এই প্রসেসটার ভেতর দিয়া যাওয়াটারে ভয় না পাইলেই ভালো ...
চমৎকার লেখা । মনটা বিষন্ন হলো লেখাটা পড়ে।
মন ছুঁয়ে গেল।
দারুন একটা লেখা, ভাল লাগ্লো বেশ...
দারুণ লিখছো মানু...
বড় ভালো লাগলো লেখাটা।
আমার বাপের পাকা চুল বাছার আগেই উজাড় হয়ে গেছিলো। তবে উত্তমমধ্যম দেয়াতে উনার কোন কার্পণ্য ছিলো না কখনো্ই। সেই অভ্যাস এখনও ত্যাগ করতে পারেন নাই। কিছুদিন আগে কলকাতা-ঢাকা প্লেনে কন্যার বয়সী পাশ্ববর্তিনীর আচরণে বিরক্ত হয়ে কষে এক চড় দিছেন। চড়প্রাপ্ত মেয়ে অথবা মহিলাটি একজন সেলিব্রিটি অভিনেত্রী।
এত সুন্দর করে লিখেন কি করে! অনুভূতির সরল প্রকাশে মুগ্ধ হলাম।
উদরাজী ভাইয়ের মতোন গুরুবাদী ভক্তি আমার নাই, নাইলে মানুষের লেখা পইড়া আসলে তারে প্রণাম করতে ইচ্ছা করে মাঝে মাঝে...
হৃদয় ছুঁয়ে গেল, অসাধারণ লেখা
সবাইকে একসাথেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এমন কিছু অসাধারণ লেখা এটা না। তারপরেও আপনাদের ভাল লাগার কারণ বোধ হয়, এই একই অদ্ভুত চক্রপাক সবার জীবনেই ঘটে। সবাই সবাই ক্রমশ বাবা হয়ে উঠি।
আলাদা আলাদা করে মন্তব্যের উত্তর না দয়ার জন্য ক্ষমা চাইছি। আলস্য এবং ব্যস্ততার সহাবস্থান চলছে জীবনে।
সব বাবাদের গল্পই এক নাকি ! আশ্চর্য!
যেই বাবাকে আকড়ে ধরে আমাদের বড় হওয়া, সেই বাবার কাছেই আমাদের বাবা হয়ে উঠাটা আসলেই ভাল লাগে না।
খুব ভাল লাগল। বাবা নেই আজ ৮বছর। এখন মনে হচ্ছে তিনি থাকলে এই লেখাটা তাকে দেখাতাম।
সুন্দর আবেগী লেখা। আদ্র হইল মন।
মন ভরে গেল।ভালো থাকুন আপনারা দু'জন
মন্তব্য করুন