দাড়িহীন দেবদাসের গল্প
নাহ এ জীবন আর রাখবো না। হয় আত্মহত্যা করব নয়তো বদনা আর কম্বলটা নিয়ে হিমালয়ের দিকে রওনা হবো। যৌবনের এই ঊষা লগ্নে স্বীয় ফ্রেন্ড বন্ধুরা প্রেম নদীতে নির্বিঘ্নে স্পীড-বোট চালিয়ে বেড়াচ্ছে। আর এই অধম এখনো তাদের হেল্পারীতেই ব্যস্ত । স্পীড বোট দূরে থাক, প্রেম নদীতে সাঁতারটা পর্যন্ত দেয়া হল না এখন পর্যন্ত। প্রেমহীন এ জীবন লবণহীন আজ তরকারীর মতোই বিস্বাদ। এজীবন রেখে আর কি হবে। বিছানাতে শুয়ে শুয়ে এই সব সাত পাঁচ ভাবছিলাম। আর লেপের মধ্যে আরামে পা ঘসাঘসি করে শীত উপভোগ করছিলাম।এই সময় আব্বাজান এসে জানালাটা খুলে দিলেন। আমাকে বিছানা থেকে টেনে তোলার জন্য এটা তাঁর আবিস্কৃত লেটেস্ট পদ্ধতি। জানালা দিয়ে হুহু করে ঠান্ডা বাতাস আসে আর আমার ঘুম চোঁচোঁ করে দৌড় দেয়। আমি হলাম গিয়ে মানুষ। সাত সকালে উঠবে সকাল বেলার পাখীরা। মানুষ হয়ে হীন জীবজন্তুর মতো আচরণ করা আমার মোটেই পছন্দ না। কিন্তু আমার শ্রদ্ধেয় আব্বাজান বড়ই বেরসিক। কোন ছোট বেলায় পড়েছিলে, “আর্লি টু বেড এন্ড আর্লি টু রাইজ, মেকস আ ম্যান হেলদি, ওয়েলদি এন্ড ওয়াইজ”, সেই থেকে ব্যাপারটা উনার মাথার মধ্যে সেঁটে গেছে। তিনি সকাল বেলার পাখীদের আগে ঘুম থেকে উঠেন এবং আমাকেও তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে বাধ্য করেন। যদিও আমার আব্বাজান মোটেও হেলদি নন বরং একটু বাতাস দিলে হেলে পড়ে যান, উনার টাকা পয়সারও যথেষ্ট অভাব আছে এবং তাঁর কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে আমার মাতৃদেবি প্রায়শই নানান অভিযোগ করেন তথাপি তার ধারণা ভোরে ঘুম থেকে উঠলেই আমি গামা পালোয়ান হবো, বিল গেটস এসে আমার পায়ের নখ পরিষ্কার করে দেবে আর আমার ঘাড়ে বিদ্যাসাগরের ভূত চেপে বসবে।
ঠাণ্ডা বাতাসের চোটে থাকেতে না পেরে বেজার মুখে বিছানা ছাড়লাম। ছাড়তেই হল, কারণ এই বেলা যদি ঘুম থেকে না উঠি তাহলে আম্মাজান তাঁর জল চিকিৎসা শুরু করবেন। আর সে চিকিৎসা মোটেও সুখের নয়। মাঘ মাসের এই শীতে বিছানায় শুয়ে গোসল করতে কোন ভদ্র মানুষের সন্তানই পছন্দ করে না। চোখ কচলাতে কচলাতে ঢুকলাম বাথরুমে ত্যাগের মহিমা প্রমানের লক্ষ্যে। ক্লোজ আপ দিয়ে কনফিডেন্ট বাড়ানোর পর যখন শেভ করতে যাব এই সময় বুকের গভীরে মোচড় দিয়ে উঠল। হায়রে দাড়ি গোঁফ তোদের জন্য এই শর্মাকে কতই না খাটতে হয়েছে, কত মিথ্যা অপবাদের বোঝা মাথা পেতে নিতে হয়েছে...
ফাস্ট ইয়ারের কথা। কলেজের প্রথম দিনেই দৃষ্টি আটকাল শাহনাজের মায়াবী চোখে। একেবারে সুপার গ্লুর মতই আটকে থাকল। কিছুতেই ছাড়াতে পারি না। প্রাণের দোস্তদের বললাম আমার প্রাণ নিয়ে টানাটানির কথা। দোস্তরা উত্তেজিত, উদ্বেলিত, উৎকন্ঠিত সর্বোপরি বেজাই উৎসাহিত। এইসব ব্যাপারে তাদের উৎসাহের ঘাটতি কোন কালেই ছিল না। কিভাবে শাহনাজের হরীণ চক্ষু এই আমার গিরগিটি মার্কা চক্ষুর দিকে ফেরানো যায়, চার চক্ষুর মিলন কিভাবে সম্ভব এ নিয়ে বিস্তর গবেষনা চলল কিছুক্ষন। গবেষনায় কোন কুল কিনার না করতে পেরে আমি যখন কুল কুল করে ঘামছি সেই সময়ে ফিরোজ বলে উঠল,
“কুল ডাউন। তোর যে হিড়িম্বা মার্কা চেহারা দিয়া তুই শাহনাজের মনোহরণের স্বপ্ন দেখিস কোন হাউসে?”
তীব্র প্রতিবাদ করে উঠলাম,
“আমার চেহারা মোটেও হিড়িম্বা মার্কা না। জনি লিভারের সাথে একটু মিল থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু চেহারাই কি আসল। আমার মনের ভেতর যে ভালোবাসার ফাল্গুধারা সদা প্রবাহমান সেটা কি কিছুই নয়? তবে কি মূল্য এ জীবনের। না, এজীবন আমি আর রাখব না। ওরে... তোরা আমাকে সাজিয়ে দে। আজ আমি মরণের ওপারে যেতে চাই।”
“থাক তোমাকে আর যাত্রা করতে হবে না। তোর এই বিকট চেহারা ঢাকার একমাত্র উপায় হইল দাড়ি গোঁফ রাখা। তা সেটাও তো তুমি আজতক ম্যানেজ করতে পারো নাই। যা তোর বাপের কাছ থেকে কিছু দাড়ি গোঁফ ধার নিয়ে আয়।”
চিন্তা ভাবনা করে দেখলাম, দাড়ি গোঁফ একান্ত ব্যক্তিগত জিনিস, এ জিনিস চাইলে ধারাল ক্ষুর বা ব্লেড দিয়ে কেটে ফেলা সম্ভব কিন্তু কারও কাছ থেকে ধার করা বা ধার দেয়া কিছুতেই সম্ভব না। এ জিনিস অর্জন করতে হয়। কেউ কাউকে ধার দিতে পারে না তা সে যতই ধারাল বুদ্ধির মানুষ হোক না কেন। অগত্যা বলতে বাধ্য হলাম,
“দেখ, আমার আব্বা বেজাই কিপটা। উনার দাড়ি ধার চাইতে গেলে ঝাড়ি ছাড়া আর কিছুই জুটবো না। তার চাইতে আমার গন্ডদেশে ক্যামনে এইডার চাষ করা যায় সেই বুদ্ধি বাইর কর।”
“তুই এক কাম কর। আজই বাজার থেইকা একখান বলাকা ব্লেড কিনা নিয়া যা। ব্লেড দিয়া ডেইলি চাছা দিলে নাকি দাড়ি কোনরকম বাড়াবাড়ি না কইরা নাকি বেশ তাড়াতাড়ি গজায়।”
অতএব বাজার থেকে এক নং বলাকা ব্লেড কিনলাম। আব্বাজানের সেভিং ক্রীম চুপেচাপে আত্মস্বাত করে বাথরুমের নির্জনে চলতে থাকল আমার দাড়ির সাধনা। কিন্তু হায়! বিধি যে আমার ক্ষেত্রে সদা বাম পন্থা অবলম্বন করে!! দাড়ি যেন আমার সাথে জন্মের মতো আড়ি নিয়েছে। মুখের উপর থেকে পুরো এক স্তর চামড়া হাওয়া হয়ে গেল কিন্তু দাড়ি এখনো অন্তরীণ। অবশ্য ডেইলি চাঁছাচাছি করার ফলে একটা লাভ হল। আমার কৃষ্ণকলি মার্কা মুখমণ্ডল বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু আমি তখন দাড়ির জন্য মরিয়া। জীবন দিয়ে হলেও এ পোড়ামুখে দাড়ি আনবই আনব।
অতঃপর ছুটলাম নামি-দামি এক এ্যালোপ্যাথি ডাক্তারের কাছে। এ্যালোপ্যাথি ডাক্তার নিজের দাড়িহীন মুখটা খানিকক্ষণ এলোপাতাড়ি চুলকিয়ে বলল,
“দাড়ি দিয়ে কি করবা? দাড়ির বিস্তর ঝামেলা। ডেইলি সেভ করা লাগে। আর সেভ না করলে সবাই বাংলা ভাইয়ের সাগরেদ মনে করে। দাড়ি ছাড়াইতো তোমার মুখচ্ছবি দেখতে বেশ লাগছে।”
“আমার মুখচ্ছবির প্রশংসা থামান। গত বচ্ছর আমাবস্যার রাইতে ছিদ্দিক ভাই আমার চেহারা দেইখা ভিরমি খাইছিল। সেইদিনই টের পাইছি আমার চেহারা মোবারক কত সুন্দর। আমার দাড়ি চাই এ পোড়ামুখ ঢাকার জন্য। কি করতে হইব সেইটা কন।”
ডাক্তার আবার মুখে খানিকক্ষণ আঙ্গুলের নকশা চালানোর পরে বলল,
“দেখ এ্যালোপ্যাথিতে দাড়ি গজানোর জন্য কোন ওষুধ নাই। তবে তোমার যদি একান্ত জরুরী অবস্থা চলে তাহলে অপারেশন করে মুখে কিছু দাড়ি লাগানো যেতে পারে।”
অপারেশনের নাম শুনে আমার ঘাম ছুটে গেল। ডাক্তারকে বললাম,
“আমার মুখ কি ধান ক্ষেত, যে ধানের মতো করে দাড়ির চাষ করবেন? আল্লাহ হাফেজ।”
ফিরে এসে দোস্তদের বললাম আমার দূঃখের কথা, আর একটু হলেই আমাকে অপারেশন করে দিত! ওরা বলল,
“ব্যাক্কল আর কারে কয়। তুই আলুপাতি আলার কাছে গেলি কোন আক্কেলে। এইসব রোগের জন্য হোমিওপ্যাথির কুনু বিকল্প নাই। তুই হোমিও ডাক্তারের কাছে যা।”
ছুটলাম হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের দ্বারে। সব শুনেটুনে উনি বললেন,
“দেখ বাবা, দাড়ি বার্ধক্যের লক্ষণ। আমার কাছে চির যৌবন ধরে রাখার দাওয়াই আছে। তোমার সাদা দাড়ি কালো করতে হলে আমার কাছে এসো ভবিষ্যতে।”
বিফল মনোরথে ফিরে আসলাম। বিষন্ন বদনে মহল্লার রাস্তা দিয়ে হাটছি এই সময় ছিদ্দিক ভাইয়ের সাথে কলিশন হল। আরে!!! ছিদ্দিক ভাইয়ে কেশবিহীন মস্তকে আজ কেশের ঘনঘটা!!! ঘটনা কি জানার জন্য চেপে ধরলাম। উনি সন্ধান দিলেন এক সাক্ষাত ধন্বন্তরি কবিরাজের। তার মোক্ষম দাওয়াইতেই নাকি আজ ছিদ্দিক ভাইএর মাথায় চুলের সমুদ্রে উকুনের নির্বিঘ্ন সন্তরণ।
অতঃপর ছুটলাম কবিরাজের রাজ্যে। কবিরাজ সবুজ রঙের যে বস্তুটি সকাল বিকাল গন্ডদেশে মাখার জন্য দিল সেটা মোটেও দৃষ্টিনন্দন নয়। আর গন্ধের কথা কি বলব। নাকে গেলে অন্নপ্রাশনের ভাত পর্যন্ত উঠে আসার উপক্রম হয়। তবুও দাঁত দাঁত চেপে নিয়মিত গন্ডদেশে ঘষতে থাকলাম দাড়ির জন্য। নিজে কোনমতে সহ্য করে চলি, কিন্তু অন্যেরা কেন সহ্য করবে এ দুর্গন্ধ? প্রায়শই, আজ দাঁত মেজেছি কিনা এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। কিভাবে বোঝায়, এ গন্ধের উৎপত্তিস্থল আমার আমার মুখগহ্বর নয়। এইভাবে নানান অপবাদ, গঞ্জনা সহ্য করে একদিন শেষ করলাম কবিরাজের শিশি। কিন্তু গণ্ডদেশ তবুও মরুভুমির মতো খাঁ খাঁ করছে। মনে মনে কবিরাজের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে, মনের দুঃখে ঘুমাতে গেলাম।
ঘুম থেকে উঠে দেখি বাড়ির পরিবেশ থমথম করছে। সবাই কেন যেন আমার দিকে জুল জুল চোখে তাকিয়ে আছে! ঘটনা কি? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে টয়লেটে ঢুকলাম। একি! বাথরুমে রবীন্দ্রনাথের ছবি ঝোলাল কোন অর্বাচীন। ছবিটা দেখি আবার নড়াচড়াও করছে! এ্যাঁ! এ যে আমারই মুখচ্ছবি, আয়নাতে ভেসে উঠেছে। ধন্বন্তরি কবিরাজের ওষুধ তাহলে কাজ করেছে এতদিনে! এতদিনে আমার পোড়ামুখে দেখছি গোঁফ দাড়ির সমাহার!!!
কাল বিলম্ব না করে ছুটলাম কলেজ পানে। আজই করব শাহনাজকে মনের কথা ব্যাক্ত। নয় কোন লজ্জা নয় কোন ভয়। কলেজে ঢুকেই দেখি পোলাপান সব মিষ্টি দিয়ে হেভি ফিষ্টি লাগিয়েছে। ওরা আমার দাড়ি দেখে ভ্যাবাচ্যাকা। কিন্তু আমারও তখন ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া বাকি। খবর পেলাম শাহনাজের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সে কারণেই এই মিষ্টির ফিষ্টি। শাহনাজের হবু বরের ছবি অবলোকন করতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম তার মুখে কোন দাড়ি নেই।
সেই থেকে আমি আর দাড়ি রাখি না।
মেলা দিন আগে সামুতে লিখছিলাম। এইখানে আবার ছাড়িলাম :D
এত সুন্দর পুষ্ট দিলাম। কেউ কমেন্ট দিল না :(
চৌর্যবৃত্তিতে মাইনাস! /#)
রেটিং দ
রেটিং দেয়ার ব্যবস্থা থাকলে নিক বানিয়ে তোকে ্আমি মাইনাস দিতাম শ খানেক
হিংসা ভাল নয়।
মাফ চাই
এইটা আগে পরিনাই। ভাল হইছে :)
থেংকু।
.
মাঘ মাসের এই শীতে বিছানায় শুয়ে গোসল করতে কোন ভদ্র মানুষের সন্তানই পছন্দ করে না .... :)
আপাতত এই পর্যন্ত পৈড়া গেলাম...
জোশিলা :)
পুরা না পড়ার জন্য আপনারে মাইনাস।
ডেভুর কাছে নালিশ দেই... প্যারার মাঝখানে লাইনব্রেক হারায়া যায় ক্যান? বড় লেখা পড়তে খুব কষ্ট হয়...
কি মজা! আমার লেখা টপ লিষ্টে আইছে
পড়লাম। যথেষ্ট রসালো (রস+অালো নয়)। বেচারা মানুষ (নাকী কান কাটা রমজান) !! মায়া হয় !!!
পড়ার জন্য ধইন্যা
আমার সাধের কমেন্টখান কই গেল! :(
জানি না
হা হা। মজা পাইলাম। তবে বেশ কিছু চাপাবাজী আছে।
চাপাবাজী ছাড়া কি গল্প হয়?
কি জানি
কমেন্ট দিই এক জায়গায় আর এক জায়গায় :(
নৃত্য না জানিলে চত্বর বক্র
হুমমমম
রম্য ভাল হইছে... নিয়মিত লেখো না কেন?
চমৎকার। আরও রম্য আসুক।
থেংকু
ভাই আপনি / আপ্নারা কই
আছিতো
ব্যাডা মানুষের- 'হিড়িম্বা মার্কা চেহারা' ! ভালাই কইছেন।
খিকজ! হিড়িম্বা নারী চরিত্র হলেও গল্পের প্রয়োজনে এই নামটাই ব্যবহার করেছি।
পোস্ট ভালো হৈসে। তুমি কি শিব্রাম পড়তা নাকি?
এখনো পড়ি। আমার অন্যতম প্রিয় লেখক
আগে পড়ি নাই। অনেক মজা পাইলাম। শিবরাম আমারো প্রিয়।
বেদনা........
লেখাটা পড়ে হাসতেই আছি, হাসতেই আছি
সেরাম মজারু!
মন্তব্য করুন