আমি এবং একটি লবস্টার
সে বছর ফাঁকা পেনু কিছু টাকা করিয়া দালালগিরি।
করিলাম পণ সিটি লন্ডন বারেক আসিব ঘুরি।
ঐখানেতে বাস করে আমার জনৈক বন্ধু। বহুকাল ধরে আমরা প্ল্যান করে আসছি লন্ডন শহরের কোন এক সুঁড়িখানায় হানা দিয়ে মদ্যপ হব। সেই কবে যৌবনের ঊষালগ্নে যবে আমার বন্ধুটি হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে ধরাটরা খেয়ে হৃদ রোগাক্রান্ত হয়েছিল সেই ক্ষণে তার একান্ত সহযোগী হিসাবে আমিও এক ছিপি মেরেছিলাম। অনুভূতি কাহাতব্য নহে। মনে হল জ্বলন্ত দেশালই বাক্স গলধকরণ করেছি। বন্ধুটির অবস্থাও তথৈবচ। কিন্তু প্রেমিকা হারানোর শোকের চেয়ে অতগুলি টাকা হারানোর শোক অধিকতর হওয়ায় নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে বোতলখানা নিঃশেষ করার পণ করল। তার পরের ইতিহাস আমরা আর না বলি। সেই ভয়াবহ শোকের ইতিহাস শরৎ বাবুর পিতামহও লিখে প্রকাশ করতে পারবেন না। তবে তারপর আর ও মুখো হইনি।
কথা হল মানুষ ভাবে এক, ইবলিশ ভাবে আর এক আর উপরওয়ালা প্ল্যান করে রাখেন অন্য কিছু। তিনি পণ করেছেন আমার ফুলের মতো চরিত্রে কোনক্রমেই কলঙ্কের কালিমা লাগতে দিবেন না। আর তাই সপ্তাহান্তে সুঁড়িখানায় হানা দেবার সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষা ধূলিসাৎ করে হাজির হল আমার চাচাত ভাই। আমার এই ভাইটি আবার আন্তর্জাতিক মানের ভোজন রসিক। জীবনের বিভিন্ন ক্ষণ সে সুবিশাল পৃথিবীর বিভিন্ন কোণে অতিবাহিত করেছে এবং চিংড়ি থেকে শুরু করে উচ্চিংড়ে পর্যন্ত বহু জিনিসই গলধকরণ করেছে, অন্তত সে সেইরকমটাই দাবি করে থাকে। এসপারাগাস, ক্যাভিয়ার, স্যামন ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য যা কিনা আমরা এইচএসসি পড়িবার কালে গল্পেই শুধু পড়ে গেছি, কখনো চেখে দেখার সুযোগ হয়নি, সেসব তার জিহ্বার ডগায়। মানে খেয়ে হজম হয়ে গেছে অনেক আগেই তবে গপ্পো এখনো যায়নি। তবে কিনা সে চিনাদের মতো দিব্বি কাঠি দিয়ে খাবার খেতে পারে। এই একটা কারণেই খানা খাদ্য বিষয়ে তাকে আমি গুরু মানি। এই চিনা কাঠি আমি কোনমতেই আয়ত্তে আনতে পারি নাই। সেবার গেছিলাম এক চাইনিজ রেস্তোরাতে, চাচাতও সংগে ছিল। আমাকে চপ স্টিক হাতে নিতে দেখে সে বলল, “ভাইজান, সমস্ত বাঙালী জাতির ইজ্জত এখন তোমার হাতে, আল্লাহর দোহায় লাগে ডুবাইয়ো না।” তারপর আর কি। আমার কসরত দেখে ওয়েটার দয়াপরবশ হয়ে ছুরি আর কাঁটা চামচ দিয়ে গেল। চিনা কাঠি দুইটা পকেটে করে নিয়ে এসেছিলাম সেইবার, বাসায় বসে প্র্যাকটিস করবো বলে। যেই পরিমাণ সাধ্য সাধনা করেছি, দধীচি দেখলে নির্ঘাত কেঁদে ফেলতেন। কিন্তু ফলাফল ঐ শূন্যই থেকে গেল। সুতরাং চপ স্টিকধারিরা আমার নমস্য ব্যক্তি হবেন এতে আর আশ্চর্য কি।
সে যাই হোক, আমি চাচাত এক জায়গায় হলেই বিবিধ রেস্টুরেন্ট পানে ধাবিত হই। সেই ধারাবাহিকতায় এইবারও ছুটলাম এক রেস্টুরেন্টে। নাম হল দি ব্যাংক। নির্ঘাত নিখিল যুক্তরাজ্য ব্যাংকার কল্যাণ সমিতির রেস্টুরেন্ট হবে এইটা। বেশ ছিমছাম সাজানো গুছানো রেস্তোরা। বারান্দায় বিশাল বিশাল গদি আঁটা সোফা। চাইলে পা টান করে দিব্বি শুয়েও পড়া যাবে। মেন্যু হাতে আসার পরে বুঝলাম ঐটা আসলে ঘুমানোর বন্দোবস্ত না। দাম দেখে লোকজন ধুমধাম অজ্ঞান হয়ে পড়ে জন্য এই ব্যবস্থা। সচরাচর চাচাতই সব কিছুর অর্ডার দেয়। কিন্তু এইবার আমার চোখ আটকে গেল এক বিশেষ স্টার্টারে। নাম গ্রিলড এ্যাসপারাগাস উইথ ফ্রি রেঞ্জ পোচড এগ। ছেলেবেলায় এই বস্তুর নাম পড়ে কত লালা ঝরিয়েছি। হে এসপারাগাস এইবার এসপার ওসপার করেই ছাড়ব। দিলাম অর্ডার। এলো ডাঁটা সিদ্ধর উপর ডিম পোঁচের মতো একটা জিনিস। খেতে খানিকটা ঘাসের মতো। একবার আমার মা বাড়ির উঠানে ডাঁটা গাছ লাগিয়েছিলেন। তারপর সকাল বিকাল সব কিছুতে ডাঁটা খেতে খেতে ঐ জিনিসটার উপরে একদম ভক্তি শ্রদ্ধা উঠে গেছে। তবু খেতে হল, এতগুলো টাকা শুধু শুধু গচ্চা যাবে এই ভয়ে।
ছোট বেলা থেকে পালং শাক আর কুচো চিংড়ি, লাউ আর কুচো চিংড়ি, কুমড়া আর কুচো চিংড়ি, সিম আর কুচো চিংড়ি খেয়ে খেয়ে বড় হয়েছি। বিদগ্ধ পাঠক এতক্ষণে বুঝে গেছেন নিশ্চয় চিংড়ি বলতে আমি কুচো চিংড়িই বুঝি। চাচাতও সেটা বিলক্ষণ জানে। তাই আমার জ্ঞানের মহিমা বাড়াতে অর্ডার দিল এক অতিকায় গলদা চিংড়ি বাংলায় যাকে বলে লবস্টার। এই বস্তু আমি খুব চিনি। টেলিভিশনে কত দেখেছি, দেখে দেখে লালা ঝরিয়েছি। অর্ডার করা পর্যন্ত ঠিকই ছিল, ভুল বুঝতে পারলাম খাবার টেবিলে আসার পর। যুক্তরাজ্যে ঢোকার পর টের পেয়েছি লোকে ডান হাতে ছুরি আর বাম হাতে কাঁটা চামচ ধরে খায়। কিন্তু সে কায়দা এখনো আয়ত্তে আসেনি। চাচাতও দেখলাম মুখটা ভার করে বসে আছে। তাকে বললাম,
“হে চাচাত, ছুরি কাঁচি দিয়ে এই বস্তু ক্যামনে ম্যানেজ করবো?”
“আমি জানি না” বলল সে।
“সে কি! ভূলোক, দ্যুলোক, গোলক ভেদিয়া তোমার পিতার পকেট ছেদিয়া কত কত রেস্টুরেন্ট দাবড়ে বেরিয়েছো আর আজ বলছ জানি না! ছিঃ কি পশ্চাৎপদতা! সে যাই হোক আইসো, বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী।”
অতঃপর শুরু হল আমাদের ছুরি কাঁচি নিয়ে যুদ্ধ। আমরা ভার্সাস লবস্টার। চিরকালীন বাঙালীর কি খাবার হাতে নিয়ে কুড়মুড় করে চিবিয়ে খেতে না পারলে ভাল লাগে? তারপরেও বিদেশ বিভূঁইতে বাঙালী জাতির ইজ্জত-জনিত বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে এই বেলা ক্ষান্ত দিলাম আমরা। আর কাঁটা চামচ দিয়ে খুঁটে খুঁটে যেটুকু পাওয়া যায় ঐটুকুই আধপেটা খেয়ে রেস্তোরা থেকে বের হয়ে আসলাম।
বেরোনোর সময় সুন্দরী ওয়েট্রেস মিষ্টি হেসে আমাদের বিদায় জানালো। আজকের প্রাপ্তি এটুকুই।
হে হে হে

বহুত দিন পর মানুষীয় লেখা
ধন্যবাদ
ইনিয়ে বিনিয়ে খাবার দেখে লালা ঝড়ানোর গল্প তো জমাইয়া করলা কিন্তু তেতুল দেখে লালা ঝড়লো কত সেই গল্পও কিছু করো ।
সিরাম পোস্ট
আমি কি শফী হুজুর নাকি?
ভোজন কাহিনী বেশ পাইলাম!
থ্যাংকু
দধীচি মানে কি?
আর সাধু ভাষার পোষ্ট, সেই আদ্দিকালের কুড়মুড়া স্বাদই আছে! তবে না তোমায় ভেবেছিলুম ভালু ছেলে, এতদকাল তাহাই তো জানিতুম! এখন দেখি ছোকরা তুমি পেয়াঁজখোর, হোক না ছিপি দিয়েই!!! তা এমনি করে নিজের কম্মটির সংবাদ ঢ্যাড়া পিটিয়ে জানালে যে, তুমার কি হেফাজতের ভয় ডর নেইকো?
দধীচি এক মুনি ঋষী টাইপ লোক।
তুমি হেফাজতিদের কথা বলছ? আমি তো আমার বাপ-মা'র কথা ভাবছি। তারা যদি এই ব্লগ পড়ে কোন দিন তো আমার খবর আছে
দধীচি এক মুনি ঋষী টাইপ লোক।
তুমি হেফাজতিদের কথা বলছ? আমি তো আমার বাপ-মা'র কথা ভাবছি। তারা যদি এই ব্লগ পড়ে কোন দিন তো আমার খবর আছে
ছুড়ি-চামচ দিয়া উয়াবড় লবস্টার খাওয়ার অভিজ্ঞতা একবার আমারও হয়েছিল। সে কথা মনে করে একলক্ষ বারের মতো দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।
(
মন্তব্য করুন