আমার কর্পোরেট কয়েদী জীবন: এগারো বছর
অন্যের জন্যে আমরা প্রতিদিন বাঁচি-সে বাঁচা ঘরে বাইরে সর্বত্র। নিজেকে খুঁজবার দেবার মতো সময় আমাদের নেই। অদ্ভূত রুটিনে আমাদের প্রত্যহ কেটে যায়। সবার কাটছে, এ জাল যারা ছিন্ন করতে পারে তারা গুটিকয়েক সৌভাগ্যবানদের মাঝে পড়েন; যারা সাহস করে ভুল জীবন যাপনে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। গড়পড়তা মানুষের সাথে যুদ্ধে যেমন আনন্দ নেই, তাদের সাথে যূথবদ্ধতায় ও তেমন কোন ভিন্নতা নেই। এরকম উত্তেজনাহীন সময় কাটাতে কাটাতে আমরা ভোঁতা হয়ে যাই। যে যত বেশী ভোঁতা তাকে আমরা ততো বেশী পরিপক্ব, প্রফেশনাল, প্রকৃত কর্পোরেট কর্মী বলে থাকি। আমাদের জগতে নিজেরা নিজেরা কিছু নিয়ম কানুন বানাই-কেউ তা ভাঙ্গতে চাইলে আমরা তার মেরুদন্ড সুনিপুণভাবে ভেঙ্গে দেই। আমরা কোন ব্যতিক্রম সহ্য করি না। আমাদের রুটিন ঠিক করে দেয় আমরা কি খাবো, কতটুকু খাবো, কেমন পোশাক পরব, ঠিক কতটা আরেকজনের সাথে মিশব, কেমন করে পরিমিত হাসব, কি করলে ভালো বলব আর কি করলে খারাপ।
প্রথম প্রথম এগুলো মানতে আমার খুব কষ্ট হতো, একটা আকাশ দেখার জন্যে আমি কতদিন অফিসের কাঁচের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি বিকেলে! আমার বন্দী বন্দী লাগতো। সেই তো শুরু ২০০৩ এর ১ জুন। চাকুরী পাওয়ার আনন্দে ডিগবাজি দিচ্ছি..কারণ সবার সমান হতে পারা। ইঁদুর দেৌড়ে পিছনে পড়ে গিয়েছিলাম শিল্পী হতে গিয়ে। এখন বুঝি-
“ আমার আমি কে হারিয়ে ফেলেছি
চাকুরী শুরুর বছর
সেই থেকে কর্পোরেট কয়েদী
গুণে চলেছি মুক্তির প্রহর”
মুক্তি কি কখনো সত্যিই হবে?মুক্ত হবো এই বাসনায় হাউজ বিল্ডিং লোন হলো না, আমার ফ্ল্যাট হলো না, গাড়ি হলো না, বছর বছর প্রমোশন হলো না-এসব নিয়ে খুব সকাতর দুঃখ হলো না।
অনেকদিন লিখতে না পারা আমাকে যেভাবে ভাবায় সেভাবে কেন এ অপ্রাপ্তিগুলো আমাকে হণ্ট করে না!
তবু মনে হয় তেমন নির্লোভ হতে পারলাম কই!
“পকেট ভর্তি টাকার লোভে
বিক্রি হয়েছি সেই কবে
স্বপ্নগুলো ঘুমের ঘোরেও
আর আসে না ফিরে
শান্তি কোথায় শান্তি কোথায়
মিছে খোঁজা না-মানুষ এর ভীড়ে”
নিজের পরিস্থিতির জেন্য কাউকে দোষারোপ করি না, নিজেকে ই সর্বাগ্রে দায়ী ভাবি-আমার পেশা নির্বাচন আমি ই ভুল করেছি। তার মাশুল এগারো বছর ধরে দিচ্ছি।
“আমি জানি তুমি জানো
এ জীবনের নেই কোন মানে
অনেক কিছু করছি
কেটে গেল ১১ বছর এই
এক ভানে”
চাকুরী দিয়েছে অনেক নিয়েছে তার চাইতে বেশী্ এত বিচিত্র মানুষের দেখা কর্মক্ষেত্রে না এলে পেতাম না। মানুষের বৈচিত্র্য আজও আমাকে মুগ্ধ করে। অন্যের সাথে করা অহেতুক প্রতিযোগীতা দেখে আমি হাসি। চাকুরীর বদৌলতে বছর বছর বই বের করতে পেরেছি, আমার ভেতরে থাকা অপরিপক্বতা, ছেলেমানুষী অনেক কমেছে চাকুরীর কারণে।
আনমনে মনে হয়-
“অফিস দিয়েছে অনেক
নিয়েছে তার চাইতে বেশী
হিসাব কষতে গিয়ে দেখি
আমি আজ মধ্যবয়সী
পক্ককেশী”
কাজের চাপে থাকতে থাকতে মন যখন বিদ্রোহ করে তখন কি ফানি ফানি লাইন ভাসে আমার চোখের সামনে-
“দেখার চোখ তৈরী হয়ে যায়
রেখায় রেখায়
কে কাকে কি শেখায়!
তুমি ভাবছো বসে নিজেকে মহাজ্ঞানী
আমি আড়ালে হাসি
দেখে তোমার ভাবখানি।
কর্পোরেট কেরানী – একটু কম্পিউটার
এক চিমটি ইংরেজী জানলেই
সাফল্য দোরগোড়ায়, বলছি শোনো
টিপস্ টা জরুরী, নয় একদম ফানি!”
সেই এবি ব্যাংকে আমারে ব্যাচের আর কেউ নেই। ব্যাংক অব সিলনের উত্তরা ব্রাঞ্চটা দেখে মাঝে মাঝে নস্টালজিক হই। প্রাইমের এসএমই ডিভিশনের ক্রেডিট অ্যাডমিন এখন গুলশানে-উত্তরা টু মতিঝিল কি জার্নিটাই করেছি।
আমাদের কোন মনুমেন্ট তৈরী হবে না, আগামীকাল হুট করে মরে গেলে কেউ নামও নেবে না। আমরা ব্যাংকাররা ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে আসলে তো সেবা কাজে নিয়োজিত কর্মী। প্রতিদিন আট ঘণ্টার জায়গায় ৯-১০ ঘণ্টা খাটুনী করি, কত জটিল জটিল সমস্যা পার হই। আমাদের কোন বন্ধু নেই পেশার স্থলে-হয়তো বন্ধুত্বের অভিনয় করি।
এক একটা দিন যায় আর নিজেকে নিঃসঙ্গ শেরপার মতো মনে হয়, যে প্রতিদিন এভারেস্টে উঠছে কিন্ত তার নাম কোন রেকর্ডে আসে না-কারণ অভিযাত্রীদলকে এভারেস্টে উঠানোই শেরপার পেশা।
নিঃসঙ্গ ব্যাংকার আফসানা কিশোয়ার, বন্ধুদের লোচন তোমাকে এগারো বছর অতিক্রমের লাল সেলাম।
আপনার মতোই কেটে গেল একটা জীবন নানা কো্ম্পানি আর নানা জনের সাথে চাকুরি করে । বলতে গেলে টেরই পাইনি কখন বুড়িয়ে গেছি ! জীবনের সাধ-আহ্লাদ গুলো হৃদয়ের গোপন কোটরে রেখে দিয়েছি ! অলস কোন দিনে হয়তো একটু উঁকি দিয়ে দেখি । পরদিন আবারো ঝাঁপিয়ে পরি করপোরেট সেবায় ! যাদের জন্য জীবন ক্ষয় তারা কি আদৌ মনে রাখবে ?
তো মেলাদিন পরে লিখলেন । ভাল থাইকেন ।
জীবনের দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় চির মুক্তি! চলছে, চলুক না...
এটা মোটামুটি সব পেশার স্থলেই এক
(
মন্তব্য করুন