মস্তিষ্কে বাসা বাঁধছে ঘূণপোকা
বুকে হাত দিয়ে বলো সূর্যের আলো রুখিতে কি পারে কেউ? আমাদের ধরে ঠেকানো যাবে না গণজোয়ারের ঢেউ। ডাকসুর দেয়ালে ঝুলে থাকা কালো হয়ে আসা চিকাটা মলয়দা'র লেখা। আর কয়দিন টিকবে কে জানে। যে রাতে মলয়দা' চিকাটা লিখেছিলেন সে রাতে আমি উপস্থিত ছিলাম না কিন্তু পরদিন ক্যাম্পাসে গিয়ে চিকাটা দেখে সারা দিন মনের ভেতর অজানা উচ্ছ্বাস অনুভব করেছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলাম তখন। আমরা নিয়ম করে রাতের বেলা ক্যাম্পাসের দেয়ালে চিকা মারতাম। ভালো চিকা দেখতে খুব ভালো লাগতো। বিশেষ করে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কথাটা যত ভালোভাবে লিখতে পারতাম, তত বেশি সুখ পেতাম। তখনও গ্রাফিতির চল ঘটে নি সেভাবে। এখন ক্যাম্পাসে অনেক সুন্দর সুন্দর গ্রাফিতি দেখা যায়। আইএমএল-এর দেয়ালে একটা চমৎকার গ্রাফিতি দেখেছি সেদিন। আমাদের ঘাঁটিটায় একটা বড় গ্রাফিতি আঁকবার শখ জেগেছে সেটা দেখে। আর আফসোস জেগেছে যখন আমার সময় ছিলো, তখন এ বিষয়ে কেন কোনো জ্ঞান ছিলো না ভেবে।
চিকা মারার রাতগুলো যথারীতি দুর্দান্ত কাটতো। অনেকগুলো কারণ ছিলো তার। প্রথমত, চিকা মারার রাতে অবধারিতভাবেই করা হতো পিকনিকের আয়োজন। খুব বেশি ম্যানেজমেন্ট-অ্যারেঞ্জমেন্ট ছাড়াই জমে উঠতো পিকনিকগুলো। কোনো কোনো দিন নিজেরা রান্না করতাম। এর অর্থ হচ্ছে বড় আপুরা রান্নার পুরোভাগে নেতৃত্ব দিতো। বড় ভাইয়েরা তাদের উদ্দেশ্যে ক্রমাগত ফুট কাটতো। জুনিয়ররা উভয়পক্ষকে জ্বালানি সরবরাহ করতাম। আবার কোনো কোনো রাতে ৩ টার সময় দলবেঁধে খেতে যাওয়া হতো আলাউদ্দিন রোডে। রান্না-বান্নার দিনে চিকা মারার কাজটা রান্নার সমান্তরালে চলতো।
দ্বিতীয়ত, কাজ ও খাওয়া শেষে রাজু ভাস্কর্যের সিঁড়িতে শুয়ে-বসে, কখনো কখনো টিএসসি'র সড়কদ্বীপে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে চলতো সুরসাধনা। ক্যাম্পাসের ছেলেদের হাতের খুব কমন একটা জিনিস হচ্ছে গিটার। এটা আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের হাতে তুলে দেয়ার চেয়ে স্কুলে পড়ুয়াদের হাতে তুলে দিতে পারলে জাতিগতভাবে বেশি সুফল লাভ করা সম্ভব। বিষয়টা আমাদের দেশের অভিভাবক সমাজ যেকোন কারণেই হোক মানতে নারাজ। যে কারণে ছেলেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীন জীবনে এসেই একটা গিটারের মালিক হবার সুযোগ পায়, সাধারণত। আর যারা ছেলেবেলায়, প্যাশনের কারণেই হোক বা অন্য যেকোন কারণে গিটার-সান্নিধ্য অর্জনের সুযোগ পায়, তাদের আমি বলবো ভাগ্যবান।
তৃতীয়ত, ভোরের স্নিগ্ধ পরিবেশে পরিচিত প্রিয়মুখ গুলোর সঙ্গে দলবেঁধে একটা কিছু করছি, এ বিষয়টা সে সময় আমাকে খুবই আপ্লুত করতো। আমি কখনো কাউকে বুঝতে দিতাম না। প্রায় প্রতিটি চিকা মারার রাতে আমি কোনো না কোনো জুটে যেতাম দলের সঙ্গে। যেসব দিনে জুটতে পারতাম না, সেসব দিনের আফসোস থেকে যেতো বহুদিন পর্যন্ত এমনকি রয়ে গেছে এখন পর্যন্তও।
চিকা মারার প্র্যাকটিসটা হতো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন জায়গায়। কখনো খাতার পাতায়, কখনো মধুর টেবিলে, কখনো ক্লাসের বেঞ্চিতে এবং কখনো আরও উদ্ভট জায়গায়। ক্লাসের বেশিরভাগ খাতার শেষের পাতাগুলোতে বিভিন্ন স্টাইলে দেশপ্রেমের বাণী সম্বলিত স্লোগান লেখা থাকতো। মধুতে বসে চা খাওয়া চলছে? আর কি চাই। দুধ-চিনি গোলানোর চামচে চা তুলে তুলে তাই দিয়ে টেবিল ভরে লিখে ফেলা হলো, জীবন যেখানে দ্রোহের প্রতিশব্দ মৃত্যুই সেখানে শেষ কথা নয়।
ক্লাস টিচারের লেকচার কখন শেষ হয়ে গেছে টের পাই নি। আমি ব্যস্ত ছিলাম ডেস্কের ওপর স্লোগান লেখার কাজে। একবার মান্নান স্যার আমাকে বেসিক ইংরেজির ক্লাস থেকে বের করে দিলেন। তার মনে হয়েছিলো ক্লাস টাইমে টেবিলে স্লোগান লেখায় মনোযোগী থেকে আমি তাকে অপমান করেছি। অথচ বিষয়টা তা ছিলো না। আমার সেদিন লেকচার শোনার চেয়ে স্লোগান লেখার প্রতি আগ্রহ বেশি ছিলো। স্যারকে অপমান করার কোনো অভিপ্রায় ছিলো না।
যাই হোক্ এমন দিন আসলে প্রচুর কেটেছে। একবার আমার সবগুলো টি-শার্টের পেছনে মার্কার দিয়ে বড় বড় করে লিখে ফেললাম, ঐক্য শিক্ষা শান্তি প্রগতি। বেশ কিছুদিন পর্যন্ত মানুষ আমায় দেখলেই বড় বড় চোখ করে জিজ্ঞেস করতো, আমি কি মানবকল্যাণে কোনো বিশেষ ব্রত গ্রহণ করেছি কিনা? আমি তাদের কোনো জবাব দিতাম না। প্রতিটি মানুষ জন্ম নেওয়ার মধ্য দিয়ে মানবকল্যাণে বিভিন্ন রকম ব্রত গ্রহণ করে ফেলে। দেখার বিষয় হচ্ছে, কে সেটা কত ভালোভাবে মেনে চলতে পারে। থাইল্যান্ডে নাকি ভিক্ষুরা নীরবতার ব্রত গ্রহণ করে সারাজীবন কোনো শব্দ না করে, কোনো ইশারা না দিয়ে এবং কোনো অক্ষর না লিখে জীবন পার করে দেয়। তাদের মনের অভ্যন্তরের শক্তিটা কি অপরিসীম সেটা ভেবে আমি অবাক হই।
আমি অবশ্য আজকাল ভদ্র-সভ্য পোশাকে ঘুরে বেড়াই, বেলালের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চা খাই, অফিসে যাই, বাড়ি ফিরি। আমার আগেকার মনোজাগতিক কর্মপন্থার যৎসামান্য নিদর্শন হয়ে টিকে থাকে নোটপ্যাডের শেষ পাতায় বিভিন্ন টানে লেখা বাংলাদেশ শব্দটা।
এক সময় বেলালের চায়ের দোকানটা ছিলো এক বিশাল গাছের গুঁড়ির ধারে। ওই গাছের গুঁড়িতে বসে জীবনের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বেলা আমি গড়িয়ে দিয়েছি। তারপর সরকারীভাবে গাছের চারপাশটা ইট-সুড়কি-দেয়াল ইত্যাদিতে ঘিরে ফেলা হলো। বসার জায়গা বলতে তখন ছিলো রাস্তা থেকে একটু উঁচু ওই ফুটপাথটা, যেটা এখনও আছে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে, কেবলমাত্র চা পানের উদ্দেশ্যে কিংবা অন্য যেকোন কারণে ওই ফুটপাথে গিয়ে ধপ করে বসে পড়তে দ্বিধা হয় নি কখনো্ই। এখনও হয় না।
তবে মাঝে মাঝে মনে হয় মস্তিষ্কে ঘূণপোকা বাসা বাঁধছে। প্রথাগত ও তথাকথিত চিন্তাভাবনারা হয়তো গ্রাস করে নেবে অচিরেই। জীবন চলে যাবে সামাজিকতার অন্তরালে। অধীনস্ত হয়ে পড়বো সকলের এবং তারপর শুধু একরাশ চাপা কান্না নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে কেননা সেভাবে বেঁচে থাকতে না জানাটাকে আমার চারপাশে ভালোভাবে দেখা হয় না।
---
এই জায়গাটুকু অসাম --------- পাচটা লাইক
আহা সেই দিন আর নেই। দিনগুলি মোর সোনার খাচায় রইল না।
পোস্ট পড়ে খুব আবেগ প্রবন হয়ে গেলাম। সে দিনগুলিতে আর ফিরে যাওয়া যায়
জোস!
লেখা পড়ে নস্টালজিক হয়ে গেলাম..
-- খুবই সত্য কথা ।
আপনার জন্য শুভ কামনা। ভালো থাকবেন ভাই।
ঢাকা ভার্সিটির হল জীবন গুলো রূপকথার মতই মনে হয়। জীবনে এমন কিছু কাজ যা কখনো করা হয়নি বা কখনো করা হবে না অথবা জীবনের মানে আলোর মাঝে খুজে ফেরার একটা বড় সুযোগ পাওয়া যায়। যতই পড়ি ততই মন্ত্রমুগ্ধ হই।
আরেকটি মন্ত্রমুগ্ধকর স্মৃতিচারন
বুড়া হইয়া যাইতাছেন মীর
... পড়তি ফর্ম আপনারে মানায় না 
ঘটনা খুবি সত্য। বুইড়া হইয়েন না পিলিজ লাগে।
মন্তব্য করুন