কোনো এক ধীরগতির পড়ন্ত অক্টোবরের সকালে
১.
শরীরের ওপর থেকে কম্বলটা সরিয়ে দেয়ার কাজকে সকালের সবচেয়ে কঠিন কাজ মনে হয় আমার। ইদানীং এই প্রবণতা আবার বেড়েছে খানিকটা। বেলা ১১টা-১২টা বেজে যায়, তাও পড়েই থাকি বিছানায়। আজও তেমনি বিছানা ছাড়তে খুব আলসেমি লাগছিল। কি করা যায় ভাবছিলাম। সকালের রুটিন হচ্ছে, এক মগ কফি আর একটা সিগারেট। কফির মগটা লাস্ট বান্ধবী উপহার দিয়েছিল। 'স্টার ওয়ার্স: দি ফোর্স অ্যাওয়েকেন্স'-এর একটা স্যুভেনির মগ। গরম যেকোন কিছু ঢাললে সাথে সাথে মগের রঙ পাল্টে যায়। সাধারণত দুধ গরম করে, আগে থেকে মগের ভেতর দিয়ে রাখা কফির মধ্যে ঢেলে দিই। দ্রুত মগটা কালচে নীল থেকে একটু অফবিটের শাদা রঙ-এ পাল্টে যায়। সকালে ওটা দেখেই মনটা ভাল হতে শুরু করে আস্তে আস্তে।
তবে এই কাজটা করার জন্য যেতে হয় করিডরের শেষ প্রান্তের রান্নাঘরটায়, এবং সেখানে যেতে হলে অবধারিতভাবেই কিছু কাপড়-চোপড় গায়ে চড়াতে হয়। করিডরে এখন কোনো মেয়ে থাকে না কিন্তু সব প্রতিবেশীরই কম-বেশি বান্ধবী কিংবা 'ফ্রেন্ডস্ উইথ বেনিফিটস্' আছে। তাদের সামনে বক্সার পড়া অবস্থায় পড়ে গেলে একটা অপ্রস্তুতির একশেষ হয়। আর আমার সাথে সেটাই ঘটে নিয়মিত। হয় শাওয়ার নিয়ে কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে রুমে ফিরছি, দেখা হয়ে যাবে সাইফেদ্দিনের বান্ধবীর সাথে। নাহয় কফি নিয়ে ফিরছি, দেখা হয়ে যাবে মিখাইলের বান্ধবী কিংবা সাশার 'বন্ধু'র সাথে।
তারপর যা হয় আরকি। আমি একটা অকওয়ার্ড হাসি দিই, ওরা একটা অকওয়ার্ড হাসি দেয়। যে যার পথের পানে ফিরে যাই। ভুলে যাই ঘটনাটা দ্রুতই। তবে পরে আবার যখন ওদের কারও সাথে দেখা হয়, তখন স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। মনে হয়, মেয়েটি কি সেদিন আমার লোমশ কালো উরু দেখে ফেলেছিল নাকি না? একটু ভাল বোধ করার জন্য প্রশ্নের উত্তর 'না' ধরে নিয়ে নিজের কাজ চালাতে থাকি।
২.
ইদানীং রান্না-বান্নাটা চলছে পুরোদমে। দুই বন্ধুর প্রযোজনা, পরিচালনায় প্রতিদিনই ভাল-মন্দ কিছু না কিছু তৈরি করা হচ্ছে। গরুর মাংস, ভুনা মুরগি, টমেটো আর মটরশুঁটি দিয়ে লেকের মাছের ঝোল, মুগডাল আর মসুরডাল দিয়ে খিচুড়ি, সরিষার তেল দিয়ে আলুভর্তা, পাঁচফোড়নে ভাজা সবজি- কি নেই মেন্যুতে? দু'জনের মধ্যে শুভ্র হচ্ছে মাংস, মাছ ইত্যাদি আইটেমের ঈশ্বর; আর শিশির হচ্ছে খিচুড়ি বা সবজি জাতীয় আইটেমের মাস্টার, কিংবা বলা যায় সেনসেই। বাংলাদেশে এইসব আইটেম খুব একটা স্পেশাল কিছু না জানি, কিন্তু মধ্য জার্মানীর ছোট্ট ইলমিনাউ শহরে এই আইটেমগুলো করতে বেগ যেটা পেতে হয়, সেটা মোটেও ফেলে দেয়ার মতো নয়। যেকোন বাংলাদেশি কাঁচামাল, যেমন কাঁচামরিচ, ধনে পাতা, আদা বাটা, রসুন বাটা, ধনে গুড়া, জিরা গুড়া ইত্যাদি কিনতে হলে যেতে হয় ৬০ কিলোমিটার দুরের শহর এরফুর্ট-এ। ইদানীং একটা ছোট্ট দোকান খুলেছে ইলমিনাউয়ে, নাম দামাস্কাস। সেখানে এসব জিনিস অল্প-বিস্তর পাওয়াও যায়। তাও আবার সবসময় না। কখনও কাঁচামরিচ থাকে তো, ধনে পাতা থাকে না, মসলা থাকে তো, তেল থাকে না- নানান কাহিনী।
এসবের মধ্য দিয়েই আমরা যে যার সুবিধামতো সময় ও সুযোগে জিনিসপত্র কিনে কিনে জড়ো করি। সারাদিন পড়াশোনা করি, একজন আবার পড়া শেষ করে এখন নিজের ডিপার্টমেন্টেই চাকুরি নিয়েছেন। তিনি উনার চাকুরী করেন। রাত আটটায় লাইব্রেরিটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরই শুরু হয় আমাদের সান্ধ্যকালীন আয়োজন।
লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে প্রথমে যাই 'নেটো' নামের সুপারশপটাতে। ওটা লাইব্রেরির পাশেই প্রায়। ওখান থেকে চাল, পিঁয়াজ বা তেলের মতো জিনিসগুলো লাগলে নেয়া হয়। আর না লাগলে শুধু একটা 'লিবলিশ' রেড ওয়াইনের বোতল।
ওয়াইন হয় তিন প্রকারের। লিবলিশ, ট্রোকেন আর হাল্ব-ট্রোকেন। আমার লিবলিশ-টাই ভাল লাগে। যদিও ওটা হচ্ছে মিষ্টি ওয়াইন, এবং হ্যাঁ প্রচুর শর্করা থাকে যা শরীরের জন্য ভালো নয় মোটেও। কিন্তু তাতে কি? আমরা তো প্রতিদিন একটা করে বোতল শেষ করি না। আর খাটা-খাটুনিও কম হয় না। চিনি যেটুকু শরীরে প্রবেশ করে লিবলিশ ওয়াইন থেকে, তাদের একটা হিল্লে হয়েই যায় কোন না কোন এক দিকে। এক বোতলে আমাদের দুই-তিন দিন অনায়াসে যায়। অনেক সময় খাইও না। ওয়াইন কিংবা যেকোন কিছু পান করতেই হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতায় আমরা বিশ্বাস করি না। বরং টনি স্টার্কের সেই দুর্দান্ত ডায়লগটায় বিশ্বাস করতে চায় মন-
"If you are nothing without the suit, then you do not deserve the suit."
তাই যদি কোনো পানীয় ছাড়া আমাদের নিজেদের সঙ্গ উপভোগ্য না লাগে, তাহলে পানীয় সহযোগে সেটাকে উপভোগ্য লাগানোর কোনো অর্থ নেই বলে মনে হয়। আর তখনই পানীয় কিংবা অন্য যেকোন বাড়তি অনুষঙ্গকে বাতুল হিসেবে গণ্য করা সহজ হয়ে যায় পানির মতো।
ডায়লগটাকে দুর্দান্ত বললাম এই জন্য যে, আমার মনে হয় ওটা একটা পারফেক্ট হাইপোথিসিস, যেটাকে জীবনের অনেকগুলো ক্ষেত্রে সুন্দরভাবে বসিয়ে দেয়া যায়। হাইপোথিসিসটাকে একটা কোয়ান্টিটেটিভ গবেষণার মাধ্যমে চেক করা দরকার। টনি স্টার্ক ওই ডায়লগটা দিয়েছিল পিটার পার্কারকে, 'স্পাইডার-ম্যান: হোমকামিং' সিনেমাতে। সিনেমাটা দি অ্যামেজিং স্পাইডারম্যান-এর চেয়ে ভাল লেগেছে। যদিও টবি ম্যাগুয়ার এখনও সেরা স্পাইডারম্যান আমার চোখে। তারপরও কাহিনীর ভিন্নতা, আন্ট মে-কে ভিন্নভাবে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা, সর্বোপরি অ্যাভঞ্জার্সদের দলে পাকাপাকিভাবে পিটারকে ভিড়িয়ে নেয়া- এই সবকিছু স্পাইডার-ম্যান: হোমকামিং সিনেমাকে একটা আলাদা উপভোগ্যতা দিয়েছে। তারপরও সুপারহিরো মুভি আসলে শুধুই সুপারহিরো মুভি। এমন না যে, এখান থেকে ক্লাসিক সিনেমা-রস তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করা সম্ভব। তবে সিজিআই, সিনেমাটোগ্রাফি, ক্যামেরার কাজ, অভিনয় ইত্যাদি নিয়ে তো কথা বলাই যায়। সেই বিচারে হোমকামিং উতরে গেছে ভালভাবেই।
৩.
আজ বিস্তর হিজিবিজি কথাবার্তা লিখে ফেললাম। জাহিদ হাসানের সেই 'হিজিবিজি হিজিবিজি' ডায়লগটা মাথায় ঘুরছে। আজ রবিবার নাটকের সিরিজটা আসলে বাংলা নাটকের ইতিহাসে একটা মাইলফলক। এখনও সমান এবং ক্ষেত্রবিশেষে বেশি রস আহরণ করা সম্ভব ওখান থেকে। মতি মিয়ার একেকটা ডায়লগ যেন পেটে বোমা পড়ার মতো অনুভূতি। হাসতে হাসতে খিল ধরে যায় হাতে-পায়ে। লিখে বোঝানো সম্ভব না। কিন্তু আজ রবিবার দেখার একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো, এরপর আর কোনো কম গুণগত মানের নাটক ভাল লাগে না।
নিয়মিত আরেকটা কাজ করা হয় ইদানীং। সেটা হচ্ছে ছোট্ট ভাগনীটার সাথে ভিডিও-চ্যাটিং। ওর দুর্বোধ্য ভাষাটায় একসময় আমিও কথা বলতে পারতাম। যখন আমি ওর মতো ছোট ছিলাম। বড় হওয়ার সাত পাকে পড়ে ওই অসম্ভব সুন্দর ভাষাটা আমি ভুলে গেছি। তাও সে যখন আমাকে মামা বলে ডাকে, তখন আনন্দে মন ভরে যায়। মনে হয়, যদি মোবাইলের স্ক্রীনে হাত ঢুকিয়ে ওকে কিছুক্ষণের জন্য ওইপাশ থেকে আমার কাছে নিয়ে আসা যেতো! ও জন্মেছে আমি দেশ ছেড়ে চলে আসবার পর, এবং এখনও আমার দেশে যাওয়ার সুযোগ হয় নি; যার অর্থ আমরা দু'জন দু'জনকে শুধু মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই চিনি। ও যখন বড় হবে, তখন কি জানবে, সেই প্রথম মানুষটা যার সাথে ওর মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল, সেটা ছিলাম আমি?
তারপর একবার বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেই শুরু, সারাদিনের ব্যস্ততা। আর মাত্র দুই সপ্তাহ পর থিসিস জমা দিতে হবে। যতোটা কঠিন ভেবেছিলাম, বাস্তবে কাজটা তারচেয়েও কঠিন ছিল, কিন্তু উপভোগ্যও ছিল সমান পরিমাণে। আমি জাস্ট পড়াশোনাটাকে মিস্ করবো মাস্টার্সটা শেষ হয়ে গেলে। বুঝতে পারছি এখন।
৪.
কেন যেন বয়স হয়ে যাওয়ার কারণে ইদানীং রাগ লাগছে নিজের ওপর। তাই এডেল-এর ওই গানটা খুব শোনা হচ্ছে- When we were young.
মেয়েটির গানের গলা এত ভাল যে বলার মতো না। আর আমি এ ধরনের গায়কী এবং গানের কথা পছন্দ করি বেশি। যে কারণে আগে একবার এমি ওয়াইনহাউসে ধরা পড়েছিলাম। আর এবার ধরা পড়েছি এডেল-এ।
তবে বাংলা গানও শুনি। 'আমি যদি ডুইবা মরি, কলংক রবে নামে' গানটা শুনলে বয়স হয়ে যাওয়ার কারণে সৃষ্ট রাগটা একটু কমে আসে। মনে হয়, ঠিক কথাই তো বলেছে বাউল। ডুবে মরার কোন অর্থই হয় না।
তারচেয়ে শরীরের ওপর থেকে কম্বলটা সরিয়ে একটা পিজে খুঁজে বের করা যাক এবং সেটা গায়ে চাপিয়ে আগে গতর ঢাকা যাক। তারপর কফির মগ, জার আর দুধের প্যাকেটটা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যাই। পিজেটা পড়া থাকলে, করিডোরের কোনো বাসিন্দার অতিথির সামনে বেমক্কা পরে গেলেও কোন সমস্যা হবে না। আর একবার কফিটা প্রস্তুত হয়ে গেলে তো হলোই। দিনের বাকি সবকিছু ঘটতে থাকবে নিজস্ব নিয়মেই।
দিনশেষে আমি নিজেকে নিয়ে আবারও ফিরে আসবো এই ১২ দশমিক চার বর্গমিটারের কুঠুরিটাতে। এখানে ফেরার আলো-আঁধারিতে ঢাকা পথটুকু পাড়ি দেয়ার সময় হয়তো একফাঁকে মনে পড়বে, বহুকাল আগে কোনো এক সুন্দরী আমার হাত ধরে জিজ্ঞেস করেছিল, তোকে কি আমি ভালবেসে ভুল করেছি রকি?
আসলে সে ভুলই করেছিল। কিন্তু সেসব অনেক আগের কথা। বেশি ভেবে কোন লাভ নেই। এই এখন যেমন মজে আছি এডেল-এ, এমনটাই আসলে থাকা দরকার অবস্থার একটা স্থিতিশীল পরিবর্তন আসা পর্যন্ত। বেশি খারাপ লাগলে লাউডস্পীকাররা তো আছেই। আজকাল শুধু ইউটিউবে 'Someone like you' লিখে সার্চ দেয়ার দুরত্বে অবস্থান করে অতীত আর বর্তমানের ভালবাসা।
গানের লিরিকটাও যেন ঠিক ওই আলো-আধাঁরিতে ঢাকা পথ পাড়ি দেয়ার সময়ের জন্য বিশেষভাবে ছেঁকে তোলা! সময় আর স্থানের বুননে গড়া আমাদের এই মহাজাগতিক চাদরে যারা ওই গানের মতো সুন্দর আর সৎ ছবি ফুটিয়ে তুলতে পারে, তাদের প্রশংসা না করে কি পারা যায়? ধন্যবাদ এডেল। আমার প্রিয় সঙ্গীতশিল্পীদের তালিকায় তুমি বরে চিরকাল। তোমার এই গানটা যে কত লক্ষ যুবক-যুবতীকে নতুন করে বাঁচার প্রেরণা দিয়েছে তা হয়তো তুমি নিজেও জানো না-
"Nevermind I will find, someone like you
I wish nothing, but the best for you
Don't forget me I beg, I will remember you say
Sometimes it lasts in love, sometime it hurts instead."
---
সামটাইমস ইট লাস্টস ইন লাভ, সামটাইমস হার্টস ইন্সটেড...এই লেখাটা পড়ার ভিতর দিয়েই মনেহচ্ছে আবার ব্লগ পড়ার নেশাটার কাছে ধরা দিলাম। আর ব্লগ পড়া মানে আরো অনেক কিছু, কখনো কখনো অনেক শুণ্যতার কাছে, কিছু কিছু ছেলেমানুষির কাছে ধরা দেওয়া। সত্যি বলতে কী, আজ শূণ্যতার কাছে ধরা দিতেই হলো।
লেখাটা আবার পড়ছিলাম। লাস্টের কয়েক প্যারায় এসে মনে হচ্ছিল এই লেখাটার একটা এক্সটেনডেড ভার্সন বের করা দরকার। আজ থেকে ঠিক চার মাস আগে এটা লেখা হয়েছিল। এখন অবস্থা পরিবর্তিত। তারপরও অনেক কিছু একদম আগের মতোই রয়ে গেছে। ব্লগ পড়ার একটা নেশাটা একসময় ব্যপকভাবে ছিল। নিজের এবং প্রিয় ব্লগের লিস্ট থেকে পুরোনো লেখা বের করে পড়াটা ছিল অনেক প্রিয় একটা অভ্যাস। পুরোনো লেখার কমেন্টগুলো পড়তে সবচেয়ে মজা লাগতো। অনেকদিন হলো অভ্যাসটা মরে গেছে। কিংবা কে জানে হয়তো এখনও খুব ক্ষীণ একটা জলের ধারা হয়ে কোথাও বয়ে বেড়াচ্ছে। তবে মাঝে মাঝে পুরান লগ পড়া ভাল।
মন্তব্য করুন