এই দোষে দুষ্ট কমবেশি আমরা সবাই
প্রতিটা সকালে আমি সামনের বিল্ডিংয়ের জানালা, পর্দা, দেয়াল ইত্যাদি দেখতে দেখতে ঘুম থেকে উঠি। আগে খোলা আকাশ দেখতে দেখতে উঠতাম। এখন এক চিলতে আকাশ কোনমতে জানালা থেকে দেখা যায়। নামকাওয়াস্তে এসব নিয়ে মাতামাতি যদিও আমি করি, কিন্তু এটাও জানি বিষয়গুলো এককভাবে খুব সামান্যই গুরুত্ব বহন করে জীবনে। খোলা আকাশ দেখতে দেখতে ঘুম থেকে ওঠার সুযোগ হেলায় হারিয়ে কংক্রীটের জঞ্জাল দেখতে দেখতে ঘুম থেকে উঠছি বলে যে খুব কিছু গিয়েছে বা এসেছে জীবনে, তা না। পৃথিবীর সব মানুষই বুঝি এমন, তাই না?
সব না হলেও বেশিরভাগ তো হবেই। নিশ্চিতভাবে জানি না যদিও। তারপরও যখন খেয়াল করে দেখি মানুষ চায়ের কাপে মাছি পড়লে পুরো কাপের চা ফেলে দেয় কিন্তু ঘিয়ের বয়ামে মাছি পড়লে, মাছিটাকে উঠিয়ে ফেলে দেয়; তখন বুঝতে পারি বেশিরভাগ মানুষই অমন। নিজের ইচ্ছা থাকলে খোলা জায়গায় পরিত্যাগকৃত মলকে নিয়েও উচ্ছ্বসিত হতে পারে। ইচ্ছা না থাকলে সোনায় মোড়ানো জিলাপিরও সমালোচনা ছাড়া আর কিছু করতে পারে না।
এখানে মল কিংবা জিলাপির কিন্তু কোন গুণ বা দোষ নেই। মল দিনের শুরুতেও মল ছিল। সময়ের সঙ্গে তাতে আরও দুর্গন্ধ যুক্ত হয়েছে। তারপরও গণমানুষের চরিত্র বড় আশ্চর্য! যেহেতু ইচ্ছাশক্তি কাজ করছে মলের পেছনে, তাই তাতে মানুষ ক্রমাগত শ্রম ও সময় বিনিয়োগ করে যাবেই। আবার জিলাপির পেছনে যেহেতু ইচ্ছাশক্তির মহামহিমাময় হাত নেই, তাই কি আর করা!
কিন্তু তাই বলে কি জিলাপির উচিত হবে নিজের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে মলের মতো হয়ে যাওয়া? আগে হলে আমি বলতাম, উচিত হবে না। কিন্তু মধ্যবয়সে পৌছাঁলে মানুষের চিন্তাশক্তি অভিজ্ঞতার আলোকে বিবর্তিত হয়। ছেলেবেলায় শিখে আসা নীতিকথাগুলোকে জীবনের প্রতিটি ঘাত-প্রতিঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে দেখতে দেখতে নিজের ওপর একধরনের অবিশ্বাসের জন্ম হয়। যাকে গবেষকেরা "জীবনমধ্যাহ্নের সংকট" তথা Midlife Crisis-এর একটি ধরন/সূচক হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। এই সংকটের কারণেই দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলে দিতে পারছি না যে, জিলাপির নিজের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে মলের মতো হয়ে যাওয়া উচিত হবে না। উচিত হতেও পারে।
তবে উচিত-অনুচিত যাই হোক, জীবনটাকে পড়ে পাওয়া চৌদ্দআনার মতো কানায় কানায় উপভোগ করতে যে কোন বাধা নেই, তা মনে হয় সবসময় সত্য। তবে এটা শুধু মানুষের তার "নিজের" জন্য সত্য। অন্য কাউকে জীবনটা একটু উপভোগ করতে দেখেই দেখুন না। আপনার মাথায় যে কতরকম চিন্তা চলে আসবে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। কিছু উদাহরণ-
১. এই বয়সে এমন কাজ!
২. নারী হয়ে এমন কাজ!
৩. বুড়ো হয়ে এমন কাজ!
৪. এত অল্প বয়সেই এমন কাজ!
৫. এত বয়স হলো তাও স্বভাব গেল না!
কিন্তু নিজের পক্ষে যুক্তিগুলো দাঁড়া করানোর চেষ্টা করে দেখুন। তখন দেখবেন কত উদার আপনার মন। কিছু উদাহরণ-
১. এখনই তো সময়।
২. নারী হয়েছি বলে কি আমার অধিকার নেই?
৩. বুড়োই তো হয়ে গেলাম, এখন না করলে কখন করবো?
৪. অল্প বয়সেই কি প্রতিভা!
৫. বয়স একটি সংখ্যামাত্র। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়।
মানুষ আসলে ধান্দাবাজ। নিজের সুবিধার্থে সে সবসময় নিজের পক্ষে চিন্তা করে। আজকে অন্যের জন্য যে বিচার সে করলো, কাল নিজের জন্য সেই বিচার সে করে না। নিজের জন্য সে একচোখা সুবিধাজনক বিচারটা করে। আবার যাকে পছন্দ করে না তার বানানো সোনায় মোড়ানো জিলাপি দেখে নাক সিটঁকালেও, যাকে পছন্দ করে তার পুরীষের গন্ধ নাক দিয়ে টেনে টেনে ফুসফুস ফাটিয়ে ফেলে। সোনার সঙ্গে পুরীষের তুলনা করে পুরীষকেই শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করে। তার ঘোষণা যে সর্বান্তকরণে ভুল ও স্বার্থপ্রসুত সিদ্ধান্ত- সেটা জেনেশুনেই করে।
আমার ধারণা পৃথিবীর তাবত প্রাণীর তুলনায় আমরা মানুষরা ধান্দাবাজিটা একটু বেশিই করি। এই দোষে দুষ্ট আমরা সবাই। শুধু সুযোগের অভাব থাকলে আমরা একটু কম দুষ্ট (তারপরও দুষ্ট), আর সুযোগের অভাব না থাকলে একেবারে অগ্র-পশ্চাত সমরূপী অমানুষ।
---
মন্তব্য করুন