ইউজার লগইন

গল্প: তুমি আমার কাছে তুমি যা বলবা তাই (পর্ব- ৩)

কলেজ ছেড়ে চলে আসতে অবশ্য আমার খুব একটা খারাপ লাগছিল না। শুধু মিসিসিপির সঙ্গে কোনো কলেজের এক ক্লাসে বসে আর সময় কাটানো হবে না কিংবা একই ক্যান্টিনে সিঙ্গারা, চা-সমুচা'র অর্ডার দেয়া হবে না, অথবা কলেজের বাস স্ট্যান্ড থেকে ক্লাসরুমের ছোট্ট যে পথটুকু, সে পথে হয়তো এরপর থেকে ওকে বুঝতে না দিয়ে ওর কাছাকাছি হেঁটে যাওয়ার অভিনয়টুকু অন্য কেউ করবে- আমি না; এমন কিছু ছোট-খাটো খারাপ লাগা ছাড়া বেশি কিছু মনেও হচ্ছিল না। তবে কলেজের ক্লাসে যে আমরা ছেলে আর মেয়ে একসাথে বসতাম- এমন না। কিংবা ক্যান্টিনেও কখনো আমরা একই টেবিলে বসি নি। আসলে দূরেই ছিল মেয়েটি। দূরেই রয়ে গেল আজীবন।

বাংলাদেশে কলেজ জীবন দুই বছরের। এর মধ্যে এক বছর পর যদি কলেজ পরিবর্তন করা লাগে, তাহলে সেটা একটা ঝক্কি হয়ে তো দাঁড়ায় বটেই। শুধু নিজের জন্যই নয়, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জন্যও। আমার বেলায় সেসবের কিছুই টের পেলাম না। আমি কলেজ থেকে টিসি নিয়ে আসার কয়েকদিন পর আমার আরেক বন্ধু রোমেলও চলে এলো টিসি নিয়ে। আমরা দু'জন একসঙ্গেই কলেজে যাওয়া-আসা, ক্লাস, খেলাধুলা, ঘুরাঘুরি করতাম। আমার মতো নিয়ম-শৃঙ্খলা নিয়ে ঝামেলায় ছিল সে-ও। তাই দেরি করে নি বেশি একটা, ওখান থেকে আমি চলে আসার পর।

এরপর বগুড়াতেই আরেক কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। যথাসময়ে ইন্টারমিডিয়েট পাশও দিয়ে বসি। তারপর দুম করে ভর্তি হয়ে যাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওখানে ভর্তি হওয়ার আগে অবশ্য আমাদের পরিবারও বগুড়া থেকে ঢাকায় সরে আসে। বাবার সরকারী চাকুরির সুবাদে জীবনে এমন সরে যাওয়া আমায় আগেও দেখতে হয়েছিল।

একে বলে সব বন্ধু-বান্ধব, সকল প্রকার দরকারী যোগাযোগ, প্রতিদিনকার রুটিন- পেছনে ফেলে রেখে চলে যাওয়া। বাবা চলে গিয়েছিলেন আমার পরীক্ষার মাস ছয়েক আগেই। আর আমার এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথে চলে গিয়েছিলাম আমরাও। পেছনে ছিল সূত্রাপুরের সেই দোতলা বাসা, আমার জানালার পাশের লিচু গাছ, রিফাতদের বাড়ির ছাদ, বন্ধু-বান্ধব, পছন্দের মানুষ-জন, সবাই, সবকিছু।

ঢাকায় গিয়ে অবশ্য বেশিদিন মুষড়ে থাকার সুযোগ পাই নি। কেননা গিয়েই ভর্তি হতে হয়েছিল ইউসিসি কোচিং সেন্টারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোচিং। সেখানে একসঙ্গে ক্লাস হয় ছেলেমেয়েদের। আমার মতো মফস্বলের বালকের পাশেও মাঝে মাঝে ভিকারুন্নিসার ফার্স্ট গার্ল কিংবা হলিক্রসের হার্টথ্রবেরা এসে বসে পড়ে।

এক অদ্ভুত অনুভূতি সেসব সময়ের! নিজের সব চলন-বলনকে তখন বোকা-বোকা লাগে। কিন্তু সেই বোকা-বোকা লাগা অনুভূতিটাকে নিয়ন্ত্রণে না রাখলেই বিপদ! একটু পর সেটা ক্ষোভে পরিণত হয়। প্রথমে নিজের ওপর ক্ষোভ। তারপর আস্তে আস্তে অন্যদের ওপর। মাঝখানে সে ক্ষোভ বয়ে এসেছে নিজেরই নানান পুরোনো ব্যর্থতার স্মৃতির ওপর দিয়ে। সেই লাভা চুইয়ে কারো ওপর পড়লে সর্বনাশ। সবসময় সাবধান থাকতে হয়।

এসবের ভেতর দিয়ে সময় খুব দ্রুত কেটে যাচ্ছিল। যেখানে কোচিং করতাম সেই মৌচাক মোড়ে, সেখানে একটা ক্যাসেটের দোকান ছিল। অর্নবের বিখ্যাত "সে যে বসে আছে" গানটি তখন কেবল বের হয়েছে। সারাদিন উচ্চস্বরে সেই গানটাই শুধু বাজে ক্যাসেটের দোকানগুলোতে। কোচিং সেন্টারে ঢোকার পূর্বমুহূর্তে রিকশা ভাড়া মেটানোা সময়, যখন কানে ঢুকতো "সে যে বসে আছে, একা একা...!" তখন মনে হতো, তাড়াতাড়ি যাই। কতক্ষণ ধরে একা বসে আছে কে জানে!

যদিও আমার জন্য বসে থাকার মতো কারো সঙ্গে দেখা হয় আরো পরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর। সেই মেয়েটি আমার জন্য মেয়েদের কমনরুমে বসে থাকতো যখন আমার ক্লাস হতো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর, আমার বগুড়ার বন্ধুরা যারা ঢাকায় চলে এসেছিল, তারা প্রথমদিকে খুব ঘন ঘন ক্যাম্পাসে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতো। আমাদের ক্যাম্পাসটি সুবিশাল। সরকারি হিসেবমতে ঢাকারই বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এর প্রায় ৬০০ একর জমি। মূল ক্যাম্পাসও দাঁড়িয়ে আছে প্রায় আড়াইশ একর জমির ওপর।

চলমান সহস্রাব্দের শুরুর দিকের যে সময়ের কথা আমি বলছি, তখন ৩০ হাজারেরও বেশি ছিল নিবন্ধিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা। প্রতিদিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে বসে প্রাণের মেলা। মানুষজনের ঘন ঘন সেখানে ঘুরতে আসাটাই স্বাভাবিক আসলে। সেই বন্ধুদের ভেতর গালিব একবার ক্যাম্পাসে ঘুরতে এসে, আমার ক্লাসের একটা মেয়েকে দেখিয়ে বলেছিল, এই মেয়েটা তো আগুনের মতো! এর সাথে কেন প্রেম করিস না? গালিবটা ছেলেবেলা থেকে অমনতর। কথাবার্তায় ঠোঁটকাটা। কোন কিছু মুখে আটকায় না।

এর আগে কখনো সেই মেয়েটিকে আমি আলাদাভাবে খেয়াল করে দেখি নি, প্রিয় পাঠক। সেদিন গালিবের কথা শোনার পর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে, আমিও যেন আগুন দেখতে পেয়েছিলাম। কিসের আগুন, কোথায়- তা বুঝতে পারি নি। কিন্তু চোখ ঝলসে গিয়েছিল। আর তারপর শুরু হয়ে গিয়েছিল সেই মেয়েটির সঙ্গে আমার প্রায় দশ বছরের পথচলা।

চলার শেষে একদিন যখন আমাদের দু'জনের দু'টি পথ দু'টি দিকে বেঁকে যায়, তখন খুব বেশি খুশি মনে বিদায় জানাই নি আমরা একে অপরকে। মনের ভেতর ভাঙচুর ছিল অনেক। সেসব সারতে সারতেই পেরিয়ে গিয়েছিল পাঁচ কিংবা ছয় বছর। তারপর বহুকাল মনের ভেতর কারো জন্য সত্যিকারের দোলা অনুভব করি নি আর। আমার জন্যও কেউ করে নি হয়তো। পড়াশোনা, চাকুরি ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার সাথে সাথে বয়স বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। কলেজ জীবনের সেই উত্তাল আবেগ স্তিমিত হয়েছে এখন অনেকাংশে।

মাঝে মাঝে সেসবই আমি ভাবতাম, জানেন? অল্পবয়সে কতোটা অস্থির ছিলাম! কতো কম জানতাম। আর সেই জ্ঞানের ওপর ভর করে কি ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে নিজেকে বারংবার ঠেলে দিয়েছিলাম! শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে কেউ একটা ভাল কথা বলতে আসলে তাকে দুইটি কথা শুনিয়ে দিতে ছাড়তাম না। এমনি ছিলাম আমি!

এমন আত্মবিধ্বংসী মানুষ বোধহয় কমই হয়। কতো যে না জেনে মা-বাবা আর অন্যান্য কাছের মানুষদের কষ্ট দিয়েছি, তাদের প্রতি অন্যায় করেছি এবং তাদের অকৃত্রিম ভালবাসাকে পদদলিত করেছি তার ইয়ত্তা নেই। আবার হয়তো কখনো দেখা গেছে, ভালমতো চেনা নেই, জানা নেই- এমন কোন মানুষের জন্য কানায় কানায় টইটম্বুর হয়ে উঠেছে মন।

আর ইদানীং? ইদানীং আমার একদিকে যেমন ভালভাবে না জেনে-বুঝে, কোন কিছুতে হাত দিতেও আস্থা হয় না; তেমনি কাউকে খুব ভালভাবে না জানলে বা চিনলে তার ওপর ভরসাও পাই না। আবেগ অনুভূত হওয়া তো আরও পরের ব্যাপার।

অথচ কলেজে পড়ার সময় মিসিসিপির সঙ্গে কোনদিন আমাকে একটা কথাও বলতে হয় নি, এক পৃথিবী ভালবাসা ওর জন্য বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে। কি অদ্ভুত ছিলাম সেই সময়টায়! মেয়েটি হয়তো কোনদিন জানতেও পারে নি আমার কথা।

আসলে স্কুলের শেষের বছরগুলো থেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর বছরগুলো পর্যন্ত, মাঝখানের দুইটি কলেজ-জীবন, আমার যেন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কেটেছে। মাঝে মাঝে নিজেকে গল্পের সেই রিপ ভন উইংকেল-এর মতো লাগে।

সেবার প্রায় দুই দশক পর মিসিসিপি যখন আমাকে মেসেজ পাঠায়, তখন কিংবা তার আশপাশের খুব কাছাকাছি একটা সময়ে ঠিক ওই কথাটাই আমি ভেবেছিলাম। পৃথিবীতে প্রায়ই কাকতালীয় ঘটনা ঘটে। সেসবের নানারকম কারণ থাকে। মাঝে মাঝে সেসব ঘটনা থেকে জন্ম হয় দারুণ সব স্মৃতি আর গল্পের। জানতাম না যে, মিসিসিপির সঙ্গে হঠাৎ করে যোগাযোগ হয়ে যাওয়াটা তেমনি একটা বিষয় হয়ে উঠতে যাচ্ছিল আমার জন্য।

---

পোস্টটি ২ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

মীর's picture

নিজের সম্পর্কে

স্বাগতম। আমার নাম মীর রাকীব-উন-নবী। জীবিকার তাগিদে পরবাসী। মাঝে মাঝে টুকটাক গল্প-কবিতা-আত্মজীবনী ইত্যাদি লিখি। সেসব প্রধানত এই ব্লগেই প্রকাশ করে থাকি। এই ব্লগে আমার সব লেখার কপিরাইট আমার নিজেরই। অনুগ্রহ করে সূ্ত্র উল্লেখ না করে লেখাগুলো কেউ ব্যবহার করবেন না। যেকোন যোগাযোগের জন্য ই-মেইল করুন: bd.mir13@gmail.com.
ধন্যবাদ। হ্যাপি রিডিং!