গল্প: তুমি আমার কাছে তুমি যা বলবা তাই (পর্ব-৭)
আমাদের বান্দরবানের দিনগুলি স্মৃতির আকাশে গভীর আনন্দ সহকারে জমিয়ে রাখার মতো কয়েকটি নক্ষত্র হয়ে টিকে আছে। মিসিসিপি যেন সেই ক'টা দিন প্রকৃতির সঙ্গে একেবারে মিশে গিয়েছিল। শহুরে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে আমি আগেও বান্দরবান গিয়েছি। লামা বাজারেই। হ্লা মংদের বাসায়। কিন্তু মিসিসিপির সঙ্গে যাওয়ার স্মৃতিটা ছিল একেবারেই অন্যরকম।
কয়েকটা দিনের জন্য আমরা যেন পাহাড়, বনানী, সবুজ প্রকৃতি, মাতামুহুরী নদী, জেলে নৌকা, শিকারের পোশাক আর সরঞ্জামের সঙ্গে একীভূত হয়ে গিয়েছিলাম। লামা বাজার এলাকা থেকে চকরিয়া পর্যন্ত মাতামুহুরী নদীর দুই পাশে অসংখ্য ছোট-বড় পাহাড়। সেসব পাহাড়, তাদের ঘিরে থাকা নদীপথ, সড়কপথ, জনপদ সবকিছু দু'হাত বাড়িয়ে আপন করে নিয়েছিল আমাদের।
বান্দরবানে কয়েকদিন চলাচলের জন্য আমরা দুইটি বাহন যোগাড় করেছিলাম। একটি বৈঠাচালিত নৌকা ও একটা ইয়ামাহা এন্টিকা ১২৫ সিসি মোটরবাইক। কখনো নৌকাযোগে সবাই মিলে হৈ-হুল্লোড় করতে করতে ঘন পাহাড়ের বাঁকে হারিয়ে যেতাম আবার কখনো দুইজন দুইজন করে মোটরবাইকে চড়ে পুরো এলাকায় দলবেঁধে ঘুরে বেড়াতাম। আর যখন ঘোরাঘুরি করছি না, তখন হ্লা মংদের বাসায় সবাই মিলে আড্ডা, রান্নাবান্না আর খাওয়াদাওয়া হয়েছে।
সেই ক'টা দিনে জীবনে একবারও কাজের চিন্তা মাথায় আসে নি আমাদের কারও। আসে নি কোন নিত্যদিনের দুশ্চিন্তারাও। কয়েকটা দিন যেন মহাকালের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলাম আমরা, একদম নিজেদের মতো করে বাঁচার জন্য।
একদিন নৌকাযোগে হ্লা মং, মং পোয়া, মং হ্লা সিং, মিসিসিপি আর আমি সকাল সকাল রওনা দিয়েছিলাম মানিকপুরের দিকে। হ্লা মং-এর পৈত্রিক ভিটে মানিকপুরে। লামা বাজারে সে থাকে স্ত্রী আর সন্তানদের সঙ্গে। মাতৃপ্রধান সমাজ বিধায় ওখানকার মারমা মেয়েরা সাধারণত বিয়ের পরও নিজেদের বাড়িতেই থাকেন। তাদের স্বামীরাও সে বাড়িতে এসে ওঠেন। হ্লা মং-ও তাই। বাড়ি মানিকপুরে। বিয়ে করেছে লামা বাজারে। এখন থাকেও সেখানে।
আমাদের মানিকপুর যাত্রাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রঙিন আনন্দে মোড়ানো ছিল। বেলা সাড়ে আটটার দিকে লামা বাজার থেকে রওনা দিয়েছিলাম। প্রথমে ঘন্টাখানেক আমি বৈঠা বাওয়ার পর ছেড়ে দিই মং পোয়ার হাতে। বৈঠা বাওয়াটা আমি জীবনে প্রথমবার ওখানে গিয়েই শিখেছিলাম।
মং পোয়ার হাতে বৈঠা দিয়ে ছইয়ের ভেতর এসে মিসিসিপির পাশে বসি। জানতে চাই, কেমন লাগছে তোমার?
-একটু মন খারাপ লাগছে কিন্তু ভাল লাগছে অনেক বেশি।
-মন খারাপ লাগছে কেন?
-এই যে আমাদের সুন্দর সময়গুলো ধীরে ধীরে শেষের দিকে চলে আসছে, তাই।
-হয়তো এ যাত্রায় শেষের দিকে চলে আসছে কিন্তু তাই বলে সবকিছু তো আর শেষ হয়ে যাচ্ছে না।
-তাই? তোমার দুই সপ্তাহের ছুটি তো প্রায় শেষের দিকে। এরপর কি হবে তাহলে?
-এরপর তুমি আসবে আমার কাছে বেড়াতে।
-সেটা কি আর বললেই সম্ভব? কত জটিলতা, কত আমলাতন্ত্র রয়েছে। সেগুলোর কথা যদি নাও ভাবি, তো পরিবার, সমাজ- এসব নিয়ে তো ভাবতে হবে নাকি?
-পরিবার, সমাজ নিয়ে কি ভাবতে হবে?
-এই যেমন ধরো, বাসায় কি বলবো, কোথায় যাচ্ছি আমি, কার কাছে? কিংবা অফিসে? কিংবা বন্ধুমহলে? কাউকে কিছু না জানিয়ে জার্মানি চলে যাবো?
-কেন? যুক্তি হিসেবে 'আমার কাছে বেড়াতে আসছো'- এটা কোথাও চলবে না?
-কি করে চলবে বলো? তুমি আসলে আমার কে- যে এভাবে তোমার কাছে বেড়াতে যাবো আমি? মানুষ কি এসব বিষয় মেনে নিতে এখনো অভ্যস্ত? বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশে? আমাকে তো ঘোরাঘুরি শেষে আবার এখানেই ফিরে আসতে হবে।
মিসিসিপির কথার তাৎক্ষণিক কোন উত্তর দিতে পারলাম না আমি। সুনামগঞ্জ থেকে বাসে করে আসার রাতে একই রকম কথা ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমি ভেবেছিলাম। বাস্তবতা আসলে কতোটা অনুকূল আমাদের পক্ষে- তা জানি না আমি নিজেও।
কথার ভেতরে ছেদ পড়লো ছইয়ের বাইরে থেকে হ্লা মংদের হৈ-হুল্লোড় কানে আসাতে। দুইজনে বের হয়ে দেখলাম মাতামুহুরীর বিখ্যাত 'মধুপাগলা' মাছ ধরা পড়েছে আমাদের জালে। নৌকা বাওয়ার পাশাপাশি আমরা ঝাকি জাল দিয়ে মাছও ধরছিলাম বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে।
এবার হ্লা মংয়ের জালে চারটে বড় বড় মধুপাগলা মাছ পড়েছে। ১০-১২ ইঞ্চি লম্বা একেকটা। মধুপাগলা মূলত আমাদের পাবদা মাছেরই পাহাড়ি সংস্করন। একটু বড়, মাছটির শরীরে তেল একটু বেশি এবং সে কারণে স্বাদও সমতলের মিঠাপানির পাবদা মাছের চেয়ে একটু বেশি। তবে এদের ধরা খুব একটা সহজ না। এক জালে চারটে পেল্লাই সাইজের এই মাছ ধরা পড়ার দৃশ্য খুব বিরল। মং পোয়া সে বিরল দৃশ্য দেখে ঘোষণা দিল, পাহাড়ের দেবতারা আজ আমাদের ওপর তুষ্ট। তাই এমন সৌভাগ্যের দেখা মিলেছে।
এদিকে ততক্ষণ বেলাও গড়িয়ে প্রায় ১২ টা বেজেছে। মানিকপুর পৌঁছানোর জন্য আমাদের নৌকা বাইতে হবে আর তিন থেকে চার ঘন্টা। ঠিক করা হলো কাছেপিঠে কোথাও নৌকা থামিয়ে দুপুরের খাবারের আয়োজন করা হবে। দুই ঘন্টা যাত্রাবিরতি। আমাদেরকে আশপাশের কোন বাজারে গিয়ে কিছু জরুরি জিনিস কিনতে হবে রান্না বসানোর জন্য। সে কারণে বিরতির সময়টা একটু বেশিই ধরা হয়েছিল।
কাছেই এক ঘাটে আমরা নৌকা থামালাম। পাহাড়ি লাল মাটি আর ধুলা হাতে-পায়ে মাখানোর জন্য আমরা খালি পায়েই নেমে পড়লাম সেখানে। আশপাশে কোন কাঁচাবাজার রয়েছে কিনা খুঁজে দেখার জন্য।
সে তল্লাটে বাজার বলে কিছু ছিল না। তবে একটি মুদি দোকান পাওয়া গেল। আমাদের প্রয়োজন ছিল রান্নার তেল, পেঁয়াজ, লবণ, চাল, আলু ইত্যাদি। সাধারণত জেলে নৌকায় এসব থাকেই। কিন্তু সঙ্গের নৌকাটি আমরা আরেক জেলের কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছিলাম বলে সেসব ছিল না। নৌকামালিক ভাড়া দেয়ার সময় তেল, চাল আলু ইত্যাদি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল। তাই আমাদেরকেও আলাদা করে সবকিছু একবার কিনতে হয়েছিল। এর ফলে অপরিচিত ওই মারমাপল্লীর কিছু ধুলাবালিও শরীরে মাখার সুযোগ হয় আমাদের।
কেনা-কাটা শেষে আমরা আবার কিছুক্ষণ নৌকা বেয়ে নির্জন একটি পাহাড়ের সামনে বিশ্রামের জায়গা খুঁজে বের করি এবং নৌকা ভেড়াই। নৌকা থেকে নেমেই মং হ্লা সিং মাছগুলো নিয়ে নদীর দিকে দৌড়ে যায়। দুর থেকে দেখা যাচ্ছিল, নদীর পাশের পড়ে থাকা কোন পাথরে সে মাছগুলোকে ঘষতে শুরু করেছে। রান্নার আগে মধুপাগলা মাছগুলোকে এভাবে পাথরে সাঁতলিয়ে নিতে হয়।
হ্লা মং আর মং পোয়া দুজনে মিলে চুলা কাটতে শুরু করে দিয়েছিল আরেকদিকে। তাই দেখে মিসিসিপি আর আমি হাত দিলাম বাজারের ব্যাগটায়। দুজনে মিলে পেঁয়াজ, মরিচ, আলু ইত্যাদি কেটে-কুটে, চাল ধুয়ে সব প্রস্তুত করে ফেলতে সময় লাগলো আধা ঘন্টার মতো। ইতোমধ্যে মাছগুলোকেও ভেতরে-বাইরে পরিস্কার করা এবং চুলা তৈরি করা হয়ে গিয়েছিল।
নৌকার মালিক খাবার-দাবার সঙ্গে করে নিয়ে গেলেও, হাড়ি-পাতিল, বাসন-কোসন সব নৌকাতেই রেখে গিয়েছিলেন। রান্না চড়িয়ে দেয়ার পর যখন মং পোয়া আর হ্লা মং আমাদের পাশে এসে বসলো, তখন আমি পকেট থেকে একটা নর্দান লাইটস্ জয়েন্ট বের করলাম। প্রায় ৩ গ্রাম আসল ডাচ মারিয়ুয়ানা মাত্র এক গ্রাম সিগারেটের তামাকের সঙ্গে মিশিয়ে বানানো জাম্বো সাইজের একটা জয়েন্ট ছিল সেটা। সাত-আটজন জাম্বুবানের জন্য যথেষ্ট ছিল সেটা।
আমরা সবাই মিলে জয়েন্টটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টানলাম। একবার টেনে পাশের জনকে দেয়ার পর, সে যতক্ষণ না টেনে শেষ করে তার পাশের জনকে দিচ্ছে, ততক্ষণ দম ধরে বসে থাকলাম। এভাবে গাঁজা টানলে নাকি টেট্রা-হাইড্রো-ক্যানাবিনল রক্তের সঙ্গে ভাল মেশে!
যদিও প্রথম টানটি দেয়ার পরের মুহুর্ত থেকেই আমার রক্তে নর্দান লাইটস্ মেশা শুরু করে দিয়েছিল। শেষ টানটি দিয়ে ছেড়ে দেয়ার মনে হয়েছিল, আকাশটা বুঝি খানিক নিচে নেমে এসেছে! বেশ খানিক পরে বুঝতে পারি, আসলে আকাশ না। আমরাই সবাই খানিকটা উপরে উঠে গিয়েছি মাটি থেকে। ভেসে আছি সবাই শুন্যে, আকাশের দিকে তাকিয়ে।
মিসিসিপিই বিষয়টা প্রথম খেয়াল করেছিল। ওর কাছ থেকে শুনে আমরাও বিস্মিত হয়ে খেয়াল করি বিষয়টা সত্যি। সবাই মাটি থেকে কয়েক ফুট উপরে উঠে ভাসছি। শুয়েই আছি কিন্তু ভাসছি। বিষয়টা দেখে ভয় পাওয়ার বদলে ক্রনিক হাসির সংক্রমণ দেখা দিলো আমাদের মাঝে। তখন একদফা হাসতে হাসতে পেট খিল ধরে যায় আমাদের সকলের। সামান্য খানিকটা ভেসে উঠেছি মাটি থেকে, এই আনন্দেই থামানো যাচ্ছিল না আমাদের হাসির দমক। একেকজন হাসতে হাসতে বেঁকে যাচ্ছিলাম আমরা এবং ত্রাহি চিৎকারের মাধ্যমে চেষ্টা করছিলাম হাসি থামানোর। লাভ হচ্ছিল না। বরং যত হাসি থামানোর চেষ্টা করছিলাম, তত যেন আরও বেশি চেপে বসছিল সেটা আমাদের ওপর।
অনেকক্ষণ পর যখন বন্ধ হলো, তখন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকি আমরা। তারপর আবার আরেকটা বিষয় নিয়ে ওঠে হাসির দমক। এবার হাসির বিষয়বস্তু, মং হ্লা সিং। সে কিভাবে নৌকা থেকে নেমেই দৌড় দিয়ে মাছগুলো পরিস্কার করার জন্য ছুট লাগিয়েছিল-র মতো নিরীহ, উপকারী একটা বিষয়কে নিয়ে আবার একইরকম ভাবে অনেকক্ষণ হাসলাম আমরা সবাই। তারপর এমন আরও কিছু বিষয় নিয়ে বারংবার এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। তার মাঝে মাঝে বিভিন্নরকম জীবনঘনিষ্ঠ কথাও হচ্ছিল। আর পাশে পাশে চলছিল রান্না। ভাত আর মধুপাগলা মাছের গন্ধে ভরে উঠছিল ওই এলাকাটা ধীরে ধীরে।
মৌতাত যখন সকলের শেষ হলো, তখন ঘড়িতে দেখলাম আমাদের বিরতির সময় প্রায় শেষের দিকে। রান্না শেষ হয়েই গিয়েছিল প্রায়। মং হ্লা সিংকে আবার নদীর দিকে দৌড় দিতে দেখা গেল। এবার সে গিয়েছিল কয়েকটা পেঁয়াজ আর মরিচ নদীর পানিতে ধুয়ে আনতে। মরিচ ভর্তা বানানো হবে ওসব দিয়ে।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পালাক্রমে নৌকা বাওয়াসহ নানান সশ্রম কর্মকান্ডের দরুণ আমাদের সকলেরই ক্ষুধা পেয়েছিল ভীষণ! যা কিছু রান্না হয়েছিল সব চেটেপুটে খেয়েছিলাম আমরা। তারপর হাড়ি-কুড়ি, বাসন-কোসন ধুয়ে, আশপাশের সব নোংরা সাফ করে, মাটি কেটে বানানো চুলাটি আবার বুজিয়ে দিয়ে আমরা নৌকায় উঠে বসি আবার।
এবারের যাত্রায় পরিশ্রম কম আর আনন্দ বেশি ছিল আমাদের। নৌকা স্রোতের দিকেই বইছিল, তাই আমাদের বৈঠা হাতে তেমন কসরত করতে হচ্ছিল না মোটেও। যাত্রাপথে আমাদের নৌকাকে হাত দেখিয়ে থামিয়ে দু-চারজন স্থানীয় যাত্রীও উঠেছিল। কিন্তু তাতে আমাদের আনন্দ ক্ষুণ্ন হয় নি মোটেও। আমরা নিজেদের মতো হেড়ে গলার গান, চিৎকার, একের পর এক ছবি তোলা, ফেসবুক-ইন্সটাগ্রামে সমানে পোস্টিং করতে থাকা আর তুমুল আড্ডা দিতে দিতে মানিকপুরের দিকে এগিয়ে চললাম।
মিসিসিপি ছিল সব আনন্দ আয়োজনের মধ্যমনি। মেয়েটি মারমাদেরকে দু'দিনেই এমন আপন করে নিয়েছিল যে বলার মতো না। আর ওরাও যেন মিসিসিপিকে নিজেদেরই একজন হিসেবে ধরে নিয়েছিল কোন দিরুক্তি ছাড়াই। খুব অল্প সময়ের ভেতর ওর ভক্ত হয়ে গিয়েছিল সবাই।
মিসিসিপি আগে কখনো পাহাড়ের গহীনে কিংবা গভীর বন-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো, থাকা-খাওয়া, আনন্দ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে নি। বন্ধুদের সঙ্গে দলবেঁধে ট্যুর, পরিবারের সঙ্গে ভ্রমণ ইত্যাদি করেছে। কিন্তু এমন না। তাও আবার একেবার নির্জন প্রকৃতির মাঝে। যেখানে কান পাতলে শোনা যায় পাহাড় থেকে পাহাড় ছুঁয়ে আসা বাতাসের হু হু শব্দ, ঘুঘু-ডাহুকের ডাক আর বানরের কিচকিচ। চোখ পাতলে দেখা যায় হরিণের বিস্মিত চোখ, বানর-মাতাদের সন্তান কোলে এক ডাল থেকে আরেক লাফিয়ে চলা, মাতামুহুরীর মনহারা বাঁক আর তারপরের হারিয়ে যাওয়ার হাতছানি।
মানিকপুর পৌঁছাতেই হই হই রই রই শুরু হয় যায়। হ্লা মং-দের বাড়িটি নদীর ঘাটের সঙ্গে লাগোয়া। বাড়ির সদস্য প্রায় শতাধিক। যাদের পক্ষে হাঁটা-চলা সম্ভব তারা সবাই একসঙ্গে ঘাটে এসে আমাদের একটা রাজকীয় অভ্যর্থনাই দিয়ে ফেলেছিলেন সেবার। ছোট ছোট বাচ্চারা নদীর ঘাটে এসে বড়দের আনন্দ দেখে, নিজেরা না বুঝেই ছোটাছুটি আর উল্লাস শুরু করে দিয়েছিল। দেখে মনে হচ্ছিল হঠাৎ যেন কোন উৎসব শুরু হয়ে গেছে সেখানে।
আমরা পৌঁছাই যখন, সন্ধ্যা প্রায় হয়ে গিয়েছিল তখন। নামার পরপরই আমাদের দেয়া হয়েছিল ঐতিহ্যবাহী পাহাড়ি নাস্তা। অনেকটা নেপালী মমর মতো, ভেতরে হরিণের মাংসের পুর দেয়া। সঙ্গে শুটকি ভর্তা, পাহাড়ি নাগা মরিচের ঝাল ভর্তা, টক আম আর সরিষা মাখা, মুন্ডি নুডুলস- আরও অনেক কিছু।
ট্যূরের পুরো সময় জুড়েই আসলে আমাদের ব্যপক খাওয়া-দাওয়া খারাপ হচ্ছিল। সেদিন দুপুরেও নিজেরা পাহাড়ের নিচে মধুপাগলা মাছ রান্না করে ভরপেট ভাত খেয়েছি। সন্ধ্যায় পেট টুপুটুপু করে নাস্তার পরপরই খবর এলো, পাশের বাড়িতে একটা বিয়ে হচ্ছে। আদি মারমা রীতিতে। যার বিয়ে হচ্ছে, সে আমাদের সকলকে দাওয়াত দিয়েছে। শুনে আমরা উচ্ছ্বসিত হয়ে দৌড় লাগালাম বিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে।
বিয়ে হচ্ছিল হ্লা মং-এর প্রতিবেশি এক যুবকের। ছেলেবেলা থেকে তাকে চেনে হ্লা মং। আমরা যেতেই সকলকে জড়িয়ে ধরে অভ্যর্থনা জানালো যুবক। স্থানীয় রীতি অনুযায়ী বিয়ে বাড়ির মদের ট্যাংক-টা দেখিয়ে দিলো আমাদের। বাস্তবিক একটি নীল রংয়ের বড় পিপে ভর্তি মদ রাখা আছে এক পাশে। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সেখান থেকে মগ দিয়ে উঠিয়ে মদ পান করছে।
মিসিসিপি আর আমার মদের দিকে বেশি আগ্রহ ছিল না। আমরা গিয়ে বাবুর্চির রান্না দেখতে লাগলাম। তারা একটা আস্ত হরিণের চামড়া আলাদা করছিল। আমি গিয়ে সে কাজে হাত লাগালাম। দ্রুত চামড়াটা ছিলে, মাংসগুলো নিয়ে সবাই কাটাকুটিতে বসে পড়লাম। এরই ভেতর হ্লা মং কোত্থেকে রাতের আঁধারে একটি বনমোরগ ধরে নিয়ে এলো। জানালো, এটা আমাদের আগামীকাল দুপুরের খাবার। নৌকায় লামা বাজার ফেরার সময় খাওয়া হবে। যেভাবে আজ আমরা নৌকা থামিয়ে মধুপাগলা মাছ আর ভাত রান্না করে খেয়েছি সেভাবে।
বিয়ের অনুষ্ঠানে স্থানীয় রীতি-নীতির অনেক কিছুই আমার শহুরে চোখে ছিল নতুন। আমি ততক্ষণে বিয়ের মূল আয়োজক কমিটির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে গিয়েছি। ঘটনাটা ঘটেছিল যখন বাবুর্চিদের সঙ্গে কাটাকাটিতে হাত লাগিয়েছিলাম তখনই। সবাই ভেবে নিয়েছিল আমি বুঝি বরের কোন আত্মীয়। আল্লাহর অশেষ কৃপায় চেহারায় আমার খানিকটা চৈনিক ভাব থাকায়, অনেকেই আমাকে 'পাহাড়ি', 'চায়না', 'কোরিয়ান' মনে করে প্রথম দেখায়। সেটাও খানিকটা ভূমিকা পালন করে থাকতে পুরো বিষয়টায়। বিয়ে বাড়ির কোন দিকে হ্যাজাক লাইট লাগানো হবে, স্পীকারগুলো কিভাবে সেট করা হবে, কি কি গান বাজানো হবে সব প্রশ্নের জবাব আছে আমার কাছে- হঠাৎ যেন সবাই ভাবতে শুরু করেছিলেন সেটাই।
ওদিকে মিসিসিপিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল মেয়েদের দল। আর টেনে নেবেই বা না কেন? বিয়েবাড়িতে এসে আমার সঙ্গে এটা-সেটা কাটাকুটিতে হাত লাগাচ্ছিল। তাই দেখেই বাড়ির কর্তাব্যাক্তিরা হৈ হৈ করে উঠেছিল! "শহুরে অতিথি কেন আমাদের বিয়েতে এসে রান্নার কাজে হাত লাগাবে!" তখন বাড়ির মেয়েরা এসে মিসিসিপিকে টেনে টুনে ভেতরে নিয়ে গিয়েছিল।
তারপর রান্নার কাজে সহযোগিতা করে, স্পীকারগুলো ঠিকঠাকমতো লাগিয়ে এবং বিয়ে বাড়িতে বাজানোর জন্য হালআমলের যে গানগুলো জনপ্রিয় হয়েছে, স্পটিফাই থেকে সেগুলোর একটা প্লে-লিস্ট চালিয়ে দিয়ে; যখন আমি অনেকক্ষণ পর মিসিসিপিকে আবার দেখি, তখন মুহূর্তের জন্য ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।
ঐতিহ্যবাহী পোশাকের প্রতি আমার কেন যেন একটা দুর্বলতা আছে ছেলেবেলা থেকেই। জার্মানির মেয়েদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের নাম ড্রিন্ডল। সেই পোশাকটি আমার দুর্দান্ত লাগে। অবশ্য কোন মেয়ে যখন ড্রিন্ডল পরে তখন আমি তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকি না কিংবা কাছে গিয়ে ফ্লার্ট করি না। তবে যে আনন্দে মেয়েটি ড্রিন্ডল পরেছে, সে আনন্দ খানিকটা আমাকেও স্পর্শ করতে পারে।
ছেলেবেলাতেও যখন টিভিতে কাশ্মীরের, নেপালের কিংবা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পোশাক চোখে পড়তো, কাছাকাছি অনুভূতি হতো আমার। এখনও বাংলার ঐতিহ্যবাহী শাড়ি পরিহিতা কাউকে দেখলে, তাহলে একই রকম অনুভূতি আমি টের পাই।
মারমাদের ঐতিহ্য ধারণ করে যে পোশাক, সেই 'থামি'তে মিসিসিপিকে দেখে এবার আটকে গেল আমার চোখ। তবে শুধু আমার চোখ দু'টোই না, আশপাশের প্রায় সবক'টি চোখজোড়াকে নিজের দিকে টেনে নিয়েছিল মিসিসিপি সে সময়। নিয়ে আমার কাছে এসে কানে কানে বলেছিল, থামিটা টাইট হয়েছে। হাঁটতে পারছি না ঠিকমতো। তুমি আমার হাত ধরে রাখো তো।
বিয়ের অনুষ্ঠান শেষের পরও আমরা অনেক রাত পর্যন্ত বিয়ে-বাড়ির হৈ-হুল্লোড়ের ভেতর ছিলাম আমরা। মদের পিপে থেকে মগ দিয়ে মদ ঢেলে পান করতে করতে খানিকটা আত্মহারাও হয়ে উঠেছিলাম। ভোর চারটায় যখন সবাই ক্লান্ত এবং ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে যার যার বাড়ির দিকে রওনা হয়, তখন হ্লা মং আমাদেরকে নিয়ে গিয়ে ওদের বাড়িতে দু'টি খাটিয়ায় শুইয়ে দেয়।
মিসিসিপি শুয়েছিল ভেতরে পরিবারের অন্য নারী ও শিশুদের সঙ্গে। আর আমি শুয়েছিলাম বাইরে, ঘরের বাইরে বিছিয়ে রাখা একটি খাটিয়ার ওপর। ঘুমিয়ে পড়ি খানিক পরেই। ঘুমানোর সময় মাথার ভেতর মিসিসিপির সকালে বলা কথাটা খুব স্বল্প গতিতে কিন্তু নিশ্চিতভাবে ঘুরছিল, "আমাকে তো ঘোরাঘুরি শেষে আবার এখানেই ফিরে আসতে হবে।"
---
মন্তব্য করুন