মতিন সাহেবের সাধারণ গল্প
মূল্যস্ফীতি ইদানীং এত বেশি হয়ে গিয়েছে যে সাধারণ মানুষের ত্রাহি মধূসুদন অবস্থা। সরকারের ভুলভাল ও ঢিলেঢালা অর্থনীতি, ব্যাবসায়ীদের অযাচিত মুনাফার লোভ সবকিছুতে পিষ্ট দেশের বেশিরভাগ মানুষ। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে দেশের সিংহভাগ সম্পদ কুক্ষিগত। বাসাভাড়া বাড়তে বাড়তে ঘরের ছাদ ছুঁয়েছে। কাঁচাবাজারে এমন কিছু নেই যার দরদাম করতে গেলে গরম আগুনের ছ্যাঁকা না খেয়ে বের হয়ে আসার উপায় আছে। গ্যাস-পানি-বিদ্যুত সবকিছুর দাম চওড়া। কোথাও যাওয়া-আসারও উপায় সীমিত হয়ে এসেছে উচ্চভাড়া ও যানজটের কারণে। সেই সঙ্গে রাস্তাঘাটের দুরাবস্থা আর অনিরাপত্তা যেন সব সমস্যাকে এক সুতায় বেঁধে পরিণত করছে একটা মহাসংকটে। নগরবাসী প্রতিনিয়ত এ মহাসংকটের আবর্তে নিজেকে সঁপে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। কোনকিছুর কোন নিরাপত্তা নেই জেনেও করুণাময়ের কাছে দু'হাত তুলে শান্তি চাইছেন। এমন এক শনিগ্রস্থ সময়ের গল্প এটা।
পুরান ঢাকার চানখাঁর পুল এলাকার দিকে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন মতিন মিয়া। কেন্দ্রীয় কারাগারের নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কাজ করেন পুলিশে। যদিও পুলিশে কাজ করেন বলে অনেকেই তাকে অল্প-স্বল্প সমীহ করতে চায়। কিন্তু মতিন সাহেবের ব্যাক্তিত্বটা একেবারেই অমন না যে, সরকারি চাকুরীর বড়াই বাইরে কোথাও করতে পারবেন। তাই চাকুরীর প্রায় দুই যুগ পেরিয়ে আজ মানুষ ভুলেই গেছে মতিন সাহেবও পুলিশের লোক। তাকে সবাই জেলেগেটের প্রহরী হিসেবেই চেনে।
তিনটি ছেলে-মেয়ে রয়েছে মতিন সাহেবের। প্রথম জন মেয়ে। তারপর ছেলে। তারপর আবার মেয়ে। সবাই বড় হয়ে গিয়েছে। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন ধানমন্ডির জিগাতলাতে। জামাইয়ের জুতার কারখানা আছে সেখানে। কারখানার জুতার ধানমন্ডি-মিরপুর রোডের সব মার্কেটে দেদারসে বিক্রি হয়। চলে নিউমার্কেট আর গাউছিয়াতেও। তাদের অবস্থা মতিন সাহেবদের চেয়েও ভাল। তবে সেটা বাহির থেকেই শুধু। ভেতরে ভেতরে পরিবারটিতে যে ভাঙন ধরেছে জানেন মতিন সাহেব। জামাইয়ের অর্থলোভ দিন দিন লাগামের বাইরে চলে যাচ্ছে। ইদানীং সে নাকি প্রতিদিন সন্ধ্যার পর জুয়াও খেলে অনলাইনে। অবধারিতভাবে বাড়ি ফেরার পর মেয়ের সঙ্গে জামাইয়ের ঝগড়াও হচ্ছে প্রতিদিন। যদিও মতিন সাহেব জানেন, তার মেয়ে শক্ত ধাঁচের। এসব ঝগড়া-ঝাটি যেন কখনোই বড় হয়ে না দেখা দেয়, সেজন্যই সবসময় চেষ্টা করবে সে। তারপরও বাবার মন তো। মতিন সাহেব কখনোই পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারেন না- মেয়ে কি শান্তিতে আছে না অশান্তিতে।
আর ছেলেটা তো বখেই গিয়েছে সেই ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময়ে। বংশালের ওদিকেই কোথায় নাকি একটা স্যানিটারি সামগ্রীর দোকানে কাজ করে এখন। কাজে যেতে অবশ্য তাকে প্রায় কখনোই দেখা যায় না। সারাদিন এলাকার ছেলেদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে রাজ্যের যত অপকর্ম আছে, তাই করে বেড়ানো। যার ভেতর মদ, জুয়া ইত্যাদির আসর বসানো, এলাকায় এলাকায় মারামারি করা; স্থানীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মানুষগুলো, যাদের হয়তো ছোট দোকান বা কামলা-মজুর ধরনের মানুষের জন্য ভাতের হোটেল রয়েছে- তাদেরকে হুমকি-ধামকি দিয়ে চাঁদা আদায় করা, সবকিছুই আছে। মতিন সাহেবের কানে মাঝে মাঝে খবর আসে।
ছোট মেয়েটা বড় হওয়ার আগেই মাত্র ১৪ বছর বয়সে একবার পালিয়ে গিয়েছিল ২১ বছর বয়সী এলাকার এক ছোকড়ার সাথে। প্রায় বছরখানেক পর তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তারপর আবার সে বাড়ি ফিরে আসে। তখন থেকে গত তিন বছর বাড়িতেই আছে সে। পড়াশোনা আর এগোয়নি মেয়েটার।
সে এখনও মতিন সাহেবকে প্রায়ই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়। ছোট মেয়ে বলে মতিন সাহেব আদরটা একটু বেশিই করতেন তাকে। সেই সুযোগে মেয়ের কিছু চাওয়ার থাকলে; বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেটা হয় টাকা, নাহয় বন্ধুদের সঙ্গে কয়েকদিনের জন্য বাইরে ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি- মেয়ে এখনও অত্যাচারটা বাপের ওপর দিয়েই শুরু করে।
এইসবের অন্যপাশের আছেন মতিন সাহেবের স্ত্রী। এই একজন মানুষের জন্য মতিন সাহেবের আসলেই মনটা খারাপ লাগে। সারাটা জীবন মানুষটা মতিন সাহেবের বিরুদ্ধে কখনো একটা কথাও বলে নি। তার ছাপোষা জীবনের সঙ্গে মুখ বুজে মানিয়ে চলেছেন। যদিও মতিন সাহেব নিজে যে খুব ভাল মানুষ, তা পাড়া-প্রতিবেশিরা সবাই জানে। ঘরের মানুষের না জানার কোন কারণ নেই। তারপরও ঘরের মানুষের সঙ্গে অনেক সময় টুকটাক ঝগড়াও তো হয়! মতিন সাহেব ও তার স্ত্রী'র তেমন কিছুও নাকি ঘটে নি কখনো। অনেক আগে মতিন সাহেব একবার তার স্ত্রী'কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমার কি কখনো আমারে কোনকিছুর জন্য অভিযোগ করতে ইচ্ছা হয়? তার স্ত্রী মৃদু হেসে বলেছিলেন, সারাজীবন আপনার সঙ্গে ঘর করার স্বপ্ন দেখছি আমি। অভিযোগ করতে যখন ইচ্ছা হয়, তখন এই কথাটা শুধু ভাবি একবার। কোন অভিযোগ মনের ভিতর বেশিক্ষণ টিকতে পারে না তারপর আর।
সুখে-দু:খে কেটা যাচ্ছিল মতিন সাহেবের জীবন। আর সব পাওয়া আর না-পাওয়ার পাশাপাশি, শেখ হাসিনার শাসনামলের ১৫ বছর পার হইলেও দেশে শান্তি আসলো না- এটাও জীবনের একটা বড় না-পাওয়া হয়ে ছিল তার মনে। আজন্ম বঙ্গবন্ধুর সমর্থক মতিন সাহেব এখনও প্রতিবার ভোট দেন নৌকায়। যদিও এখন যে আর তার ভোটের মাধ্যমে কোন পার্থক্য যে তৈরি হয় না, সেটাও জানেন তিনি। তারপরও মনে মনে আশা করে থাকেন, একদিন দেশের সাধারণ মানুষের সহজ সমস্যাগুলো সমাধান হবে। মানুষ একটু শান্তিতে থাকতে পারবে।
সেদিন কাজের শেষে বাড়ি ফেরার বেলায় অন্যমনস্কভাবে দেশের অবস্থা নিয়েই কিছু একটা ভাবছিলেন তিনি। তাই রাস্তা ছেড়ে একটা মটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যে দ্রুতগতিতে ফুটপাথে উঠে পড়ছিলো, সেটা খেয়াল করেন নি। যতক্ষণে দেখতে পেয়েছেন, ততক্ষণে মটরসাইকেল মাটিতে পড়ে ছেঁচড়ে একদম তার পায়ের কাছে চলে এসেছে। মতিন সাহেব তার হাঁটুর নিচে, গোঁড়ালির ঠিক উপরের দিকে, আঘাত পেয়েছিলেন। আঘাতটা মটরসাইকেলের কোন অংশের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে পেয়েছিলেন সেটা খেয়াল করার আগেই সব ঘটে গিয়েছিল সেদিন। রাস্তায় পড়ে গিয়ে বেশিক্ষণ জ্ঞান ধরে রাখতে পারেন নি আর।
জ্ঞান ফিরে তিনি নিজেকে আবিস্কার করেন পঙ্গু হাসপাতালে। দুই পায়েই প্লাস্টার অফ প্যারিস। পাশে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছেন স্ত্রী। তার দিকে তাকিয়ে একটু মৃদু হাসার চেষ্টা করলেন। স্ত্রী জানালেন, দু'টো পাই ভেঙ্গেছে। তবে সেরে যাবে কয়েক মাসের ভেতরে। মতিন সাহেব মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ পড়লেন।
হাসপাতালে ধীরে ধীরে মতিন সাহেবের মানুষের আনাগোনা বাড়তে লাগলো। তিন সন্তানই প্রথম দিন এসে দেখা করে গেলো। তারপর থেকে কোন একজন দিনে একবার আসতো। কারাগারের জেলার সাহেবও এসেছিলেন একবার। অন্যান্য কারারক্ষীরাও যার যার সময় মতো এসে দেখা করে গিয়েছিল। ট্রমা বা এমন কিছু আছে কিনা চেক করার জন্য তরুণ একজন ডাক্তার তাকে নিয়ে তিন-চারদিন নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন। অনেক কথা বললেন। প্রায় এক সপ্তাহ পর হাসপাতাল থেকে ক্রাচে ভর করে বাড়ি ফিরলেন মতিন সাহেব।
বাড়ি ফিরেই অবশ্য বুঝতে পারলেন কিছু একটা হয়েছে। তিন সন্তান, জামাই সবাই বাড়িতে। হাসপাতাল থেকে ফেরার দিন আর কথা-বার্তা কিছু হলো না। তবে পরের দিন জামাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বললো, যে তার দশ লাখের মতো টাকা দরকার। দেনা জমে গেছে জুয়ার আসরে। না দিতে পারলে সামনে বড় বিপদ।
মতিন সাহেব কথাটা শুনে ক্ষীরের মতো জমে গেলেন। চাকুরী শেষে সাকুল্যে হয়তো সাত-আট লাখ পেনশন পাবেন। যা দিয়ে নিজের আর স্ত্রীর শেষ দিন ক'টা পাড়ি দেবেন বলে ভেবে রেখেছেন। মাথার ওপর ছোট যে ছাদটা রয়েছে সেটা রইলে, পেনশন ও ক'টা টাকা দিয়ে বুড়ো-বুড়ির দু'টো ডাল-ভাত জুটেই যাবে। কারো কাছে হাত পাততে হবে না। কিন্তু জামাইয়ের কথায় তো মনে হচ্ছে না সেটা আর সম্ভব হবে কোনভাবে!
তারপরও সেদিন কিছুই বললেন না মতিন সাহেব তার জামাইকে। ভেবে-চিন্তে কি করা যায় জানাবেন বলে তখনকার মতো কাটিয়ে দিলেন বিষয়টাকে। আসলে পা ভেঙ্গে যাওয়ার জন্য তিনি ওভাবে সেবার বাসায় থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন অনেককাল পর। উপভোগও করছিলেন সময়টা। বাসায় সকাল থেকে কতরকম কর্মকাণ্ড শুরু হয়। ভোরবেলা বুয়া এসে উঠানে কলের পাড়ে গিয়ে ঝনঝন করে বাসন-কোসন কাচে। সেই শব্দেই ঘুম পালায় মতিন সাহেবের চোখ থেকে। তারপর থেকে সারাদিন কাপড় ধোয়া, বাজার, গোসল, খাওয়া, দুপুরের ঘুম, বিকেলে স্ত্রীর সাথে বসে দুটো কথা আর একটা চা, সন্ধ্যায় ছেলেমেয়েদের বাসায় ফিরতে দেখা- সবই উপভোগ্য লাগে তার কাছে। দেখতে দেখতেই সময় কেটে যায়।
তবে জামাই টাকা চেয়ে যাওয়ার দু'দিন পর; যখন ছেলেও এসে বললো তার ১০ লাখ টাকা লাগবে বন্ধুদের সঙ্গে ঝুটের ব্যাবসা শুরু করার জন্য, তখন তিনি একটু বিচলিত হয়ে উঠলেন। জামাইকে দেয়ার জন্যই তার কাছে কোন টাকা নেই। বুঝতে পারছিলেন না কি করবেন তিনি! তবে অভাগা যেদিকে চায়, সাগরও নাকি শুকিয়ে যায়। সেদিনই ছোট মেয়েটাও এসে জানালো, সে দুবাই যেতে চায়। ওখানে গিয়ে কাজ করবে। সেজন্য মতিন সাহেবের দুই থেকে আড়াই লাখের মতো খরচ পড়বে।
মেয়ের কথা শুনে অবশ্য মতিন সাহেবের হাসি পেয়ে গেল। এরা বাবাকে বাড়িতে পেয়ে যার যা ইচ্ছে, দাবি-দাওয়া সব জানিয়ে যাচ্ছে ইদানীং। অথচ বাবার চিকিতসার টাকাটুকুও যে নেই; সেটুকু পর্যন্ত জানে না কেউ। নেই কারও মুখে সেই ব্যাপারে একটি প্রশ্নও। এদেরকে তিনি কি উত্তর দেবেন? কি উত্তর দেয়া উচিত আসলেই।
পরদিন অফিসের লোকজনদেরকে ফোন করে করে খোঁজ নিলেন মতিন সাহেব। পেনশনে যাওয়ার কথাটা আসলেই ভাবতে শুরু করেছিলেন তিনি। যদিও আরও কয়েক বছর চাকুরি রয়েছে তার। কিন্তু পেনশনের টাকাটা দরকার।
অফিসের এক বড়সাহেব আগেভাগেই পেনশন ভেঙ্গে ফেলার পরামর্শ দিলেন। এছাড়া আর যারা তাকে গত দুই যুগ ধরে চেনেন, সবাই বললেন এসব কথা একেবারে কানে না তুলতে। ছেলেমেয়েরা এভাবেই যুগে যুগে বৃদ্ধ বাবা-মা'র শেষ সম্বল কেড়ে নিয়ে তাদের ফেলে চলে যায়, এ কথা পইপই করে মনে করিয়ে দিলেন তারা। তাদের প্রায় সকলেরই নিজেদের পরিচিত মানুষজনদের সঙ্গেই এমন ঘটেছে। সকলেই নিজেদের সেসব গল্প শুনিয়ে গেল মতিন সাহেবকে।
সেদিন রাতে মতিন সাহেব বাড়িতে সকলকে নিয়ে বসলেন। কথা বললেন খোলাখুলি সবার সঙ্গে। অবশ্য তার কথা শুনে সন্তানেরা কেউ আনন্দিত হতে পারলো না। তিন ছেলেমেয়েরই টাকা দরকার এবং এখনই দরকার। তারা যখন মতিন সাহেবকে কোনমতেই বোঝাতে পারছিল না, তখন জামাই এগিয়ে এলো সমস্যার সমাধান নিয়ে। সে পরামর্শ দিলো মতিন সাহেবের বাড়িটা বন্ধক রাখার। এখন আপাতত সকলের প্রয়োজন মেটানোর জন্য এটাই সবচেয়ে ভাল সমাধান। জামাই তো একেবারেই নিশ্চিত, আর কয়েকমাসের ভেতরেই তার অবস্থা পাল্টে যাবে। এত অভাব আর থাকবে না কোনভাবেই। তখন সে নিজেই নাকি বাড়ি বন্ধকের পুরো টাকা দিয়ে বাড়ি ছাড়িয়ে মতিন সাহেবকে বুঝিয়ে দেবে। জামাই দিয়ে দেবে তার শালা আর শালী অর্থাত মতিন সাহেব ছেলে আর ছোট মেয়ের টাকাও।
শুনে মতিন সাহেবের ছেলে আর ছোট মেয়েও হৈ হৈ করে সমর্থন দিলো। মতিন সাহেব শুধু একবার খাটের এককোণায় বসে থাকা স্ত্রীর দিকে তাকালেন। আরেকবার নিজের ব্যান্ডেজ করা পা দু'টোর দিকে তাকালেন। তার স্ত্রী মাথা নিচু চোখ মুছছিলেন সে সময়। মতিন সাহেব দেখলেণ, ছেলেমেয়েগুলো বৃদ্ধ বাবা-মা'এর ভবিষ্যতের কথা একটাবার ভাবার কথা মনেও করছে না। অথচ তারা দু'জনে কি কষ্টই না করেছেন, এ তিনটা সন্তানকে বড় করার জন্য। নিজেরা না খেয়ে বাচ্চাদের খাইয়েছেন বছরের পর বছর। নিজেদের সব সুখ আর সব স্বপ্ন হাসিমুখে জলে ভাসিয়ে দিয়েছেন, সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে। আজ তারাই কত সহজে, হাসিমুখে কিন্তু ভয়ংকর জোর গলায় বাড়ি বন্ধক রাখার কথা বলে দিতে পারছে! মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল মতিন সাহেবের।
সেবার মন খারাপ করলেও শেষ পর্যন্ত বাড়িটা বিক্রি করে দিতেই হয়েছিল মতিন সাহেবকে। জামাই খুব বেশি অত্যাচার শুরু করে দিয়েছিল বড় মেয়েটার ওপরে। আর ছেলেটা বাড়িতেই কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে বসেছিল প্রায়। একে মারে তো তাকে ধরে। সারাদিন খিস্তি-খেউড়। আর সবই তার নিজের জন্মদাতা পিতা আর জন্মদাত্রী মাতার উদ্দেশ্যে। ছোট মেয়েটা বলেই দিয়েছিল, টাকা যে দেবে তার সাথে চলে যাবে যদি বাড়ি থেকে টাকা না দেয়া হয়। অনেকবার ভেবেছিলেন মতিন সাহেব, এমন স্বার্থপর ছেলেমেয়েদের জন্য বাড়িটা হাতছাড়া করবেন না তিনি। কিন্তু বেশিরভাগ বাবা আর মায়ের মনই এমন সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারে না বেশিদিন। বিশেষ করে যখন সন্তানেরা অশান্তিতে ঘর-বাহির সবকিছু ভরিয়ে ফেলে। তাই বাপ-দাদাদের কাছ থেকে পাওয়া ছোট্ট দোচালা টিনের ঘরটি এলাকার মহাজনের কাছে বিক্রি করে দিতেই হয়েছিল তাকে সে বছর। জামাইয়ের দেয়া বন্ধকের পরামর্শে তার সায় ছিল না কখনোই। বন্ধকের নামে বাড়িটা দখল করার ইচ্ছাই ছিল ওর মনে। যে কারণে নিজে যে জুয়াড়ীর কাছে আকণ্ঠ ঋণে নিমজ্জিত, তার কাছেই বন্ধক রাখতে জোরাজুরি শুরু করেছিল সে। তাই উপায়ন্তর না দেখে, এলাকার বাকরখানি মহাজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন বাড়িটা। মহাজন অনেকদিন ধরেই মতিন সাহেবের ছোট্ট বাড়িটার প্রতি আগ্রহী ছিল, নিজের নামে আরেকটা দোকান খোলার জন্য।
মতিন সাহেবকে আমি চিনতাম সাংবাদিকতার সূত্রে। জেলখানায় মাঝে মাঝেই বড় সংবাদ সৃষ্টি হয়। সেরকম এক সংবাদের খোঁজে সেখানে গিয়েই তার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। মানুষটার ভেতরের নিস্পৃহ ভাবটা আমাকে আকর্ষন করেছিল সবচেয়ে বেশি। মনে হয় দীঘির জলের মতো শান্ত একটা মানুষ।
বাড়ি বিক্রি করে দেয়ার পর উনার সঙ্গে আর একবারই আমার কথা হয়েছিল। জেলখানায় গিয়েছিলাম একটা কাজে। গিয়ে শুনি চাকুরি ছেড়ে গ্রামে গিয়ে থিতু হয়েছেন তিনি। একটু হকচকিয়েই গিয়েছিলাম শুনে। বাড়িঘর, সন্তান-সন্তনি নিয়ে তার ভরা সংসার- সব উঠিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছেন? জেলখানার অন্য কারারক্ষীদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, করোনার জন্য কিছু হয়েছে নাকি? তারা বলেছিলেন, না। ছেলেমেয়েরা মিলে সব সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারা করে খেয়ে ফেলেছে।
এরচেয়ে বেশি কিছু জানা যায় নি সেবার জেলগেটের কারারক্ষীদের কাছে থেকে। তবে আমার কাছে মতিন সাহেবের নাম্বার ছিলো। কল দিতেই সেই হাসিমাখা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। তার কাছেই শুনেছিলাম সব কথা। জামাইয়ের অত্যাচার, ছেলের জোরাজুরি, মেয়ের হুমকি- সবকিছু মিলিয়ে বাড়ি বিক্রি করে টাকাটা সবাইকে ভাগ করে দেয়াকেই তিনি সমাধান হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
জানতে চাইলাম, সন্তানেরা কেমন আছে এখন? বললেন, আছে কোনরকম। জামাইটা এখন জুয়ার পাশাপাশি মদেও আসক্ত হয়ে পড়েছে। গ্রামেও একবার এসেছিল। মতিন সাহেবকে আবার টাকার জন্য চাপ দিতে। গ্রামে মতিন সাহেবের চেনাজানা মানুষ অনেক। তাই চাপাচাপিতে বেশি লাভ হয় নি। তাই সে মতিন সাহেবের মেয়েকে তালাক দেবে বলে হুমকি দিয়ে চলে গেছে। তারপর অবশ্য আর কিছু ঘটে নি।
বললাম, ছেলেটা? জানালেন ছেলেটার ভাগ্যটা খারাপ ছিল। ঝুটের ব্যবসা না কি যেন করতে গিয়ে অনেক পুলিশি ঝামেলায় জড়িয়ে যায়। এখন পালিয়ে পালিয়ে থাকে। যোগাযোগ করে না একেবারেই। যোগাযোগ করলে নাকি তারই সমস্যা। পুলিশের লোকজন সবসময় পেছনে লেগেই আছে। বললাম, আপনে কিছু করতে পারেন না? বললেন, না রে বাবা। আমি জীবনে কোনদিন অন্যায় কাজ করি নাই। এই বুড়া বয়সে তো আরও পারতাম না।
তারপর জানতে চাইলাম, আর ছোট মেয়েটা? মতিন সাহেব বললেন, ছোট মেয়েটা দুবাই গিয়ে কিছুদিন ভাল ছিল- এমন খবরই পাওয়া যাচ্ছিল। পরে জানা গেছে, দেশ থেকে বড়লোকদের বাড়ির কাজ করার জন্য দুবাই যাওয়া আর বেশিরভাগ মেয়ের মতোই করুন পরিণতি হয়েছে তারও। তবে মেয়েটা এসবের মধ্যেও লড়াই করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের কোন একটা এনজিও নাকি তাকে ফিরিয়ে আনারও চেষ্টা করছে। বললেন, মাইয়াটা ফিরে আসলে ওরে বাড়িতে রেখে দিবো। অনেক কষ্ট করছে সারাজীবন। এইবার যদি একটু মাথাটা ঠান্ডা হয়।
বললাম, আপনার খারাপ লাগে না? মতিন সাহেব হেসে বললেন, না বাবা। খারাপ লাগে না। আল্লায় যা করে ভালোর জন্যই করে। কে জানে, হয়তো এর মধ্যেও সবার জন্য ভালই লুকায় আছে।
আমি শান্ত, নিস্পৃহ মানুষটার কথা শুনে ভাবি, জীবনকে নিয়ে সবাই কি এত সহজ করে ভাবতে পারে? মাঝে মাঝে মনে হয়, পারাটা খুবই জরুরি। মতিন সাহেবের কথাতেই রয়েছে কেন সেটা জরুরি। হয়তো এর মধ্যেই সবার জন্য যেটা ভাল, সেটা লুকিয়ে আছে। ক্ষুদ্র মানুষ আমরা বিশাল এ ধরনীর কতটুকুই বা আর জানি!
---
মন্তব্য করুন