ইউজার লগইন

আন্ধার রাইতে চান্দের আলো দেখলাম না নজরে

আজ বহুদিন লেখালেখি করা হয় না। এককালে দিনলিপি লিখতাম; গল্প, কবিতা, মুক্তগদ্য লিখতাম। অথচ এখন সেসবের কোনকিছুতে মন বসানোর ইচ্ছেটাকেই পাই না। মাঝে মাঝে ভাবি আবারও সেই আগের মতো একটা জীবন শুরু করা গেলে খারাপ হয় না। কিন্তু চাইলেই কি সব মেলে জীবনে? মেলে না। না মেলে সময়, না মেলে প্রেরণা। মেলে শুধু অজুহাত। আজ গরম, কাল লিখবো। কাল আসলে মনে হয় আজ শরীরটা ভাল না। নাহয় পরদিনই লিখবো। এসবই শুধু অজুহাত তাই নয়। আরও যে কতশত অজুহাত আমার মস্তিষ্কের নিউরণেরা খুঁজে খুঁজে বের করে আনে তার ইয়ত্তা নেই। তাই লিখবো বলে প্রায় প্রতিদিনই একবার ভাবলেও, সে ভাবনাকে বাস্তবে আর রূপ দেয়া হয় না।

শুধু কি লেখালেখিতেই এই আলস্য? তাতো নয়। সর্বশেষ কত বছর আগে যে একটি বই আমি পুরোপুরি পড়েছি, তা মনে করতে কষ্ট হয় ইদানীং। আট বা নয় বছর তো হবেই। এমন আরও আছে। তালিকা তৈরি করতে ইচ্ছে হয় না। শুধু বসে ভাবতে ইচ্ছে করে।

নিজের সর্বশেষ ডেরাটা আমি ঠিক করেছিলাম সাগরের পাড়ে। সেখানে একদিন সমুদ্রতীরের বালুকাবেলায় শুয়ে ভাবছিলাম, আলস্য আর অনুপ্রেরণার অভাবদের উৎস আসলে কোথায়? জীবনের একটি পর্যায়ে তো আমার কোনকিছুই লাগতো না। এমনিই সারাদিন জীবনটাকে ঘুরে ঘুরে আলিঙ্গন করতে পারতাম। অনুপ্রেরণাও যে একটা দরকারি জিনিস, তা যতদিনে বুঝতে শিখেছি, ততদিনে কোনকিছুতে মুগ্ধ হবার ক্ষমতাটাই হারিয়ে ফেলি আমি। আজকাল তাই কিছুই আর প্রেরণা জোগাতে পারে না। তাও জীবনটা টেনে নিয়ে বেড়াতে হয় সকাল থেকে সন্ধ্যা। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত। গভীর রাত থেকে ভোর। তারপর ভোর থেকে সকাল পর্যন্ত দুই বা তিনটি ঘন্টা জীবন দয়া করে আমার উপর। ঘুমিয়ে যাই। ওই ক'টি ঘন্টা আমার জীবনটাকে টানতে হয় না। ঘুম থেকে ওঠার পর শুরু হয় আবার।

এমনটা যখন অনেকদিন ধরে হচ্ছিলো, তখন আমি ধীরে সবকিছু থেকে আপনমনেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। খানিকটা জেনে-বুঝে এবং অনেকটা না জেনেই। সেটা সাগর পাড়ের ডেরাটি বাঁধার আগের কথা। তারপর একদিন যখন নিজেকে নি:সঙ্গ এই দ্বীপে আবিস্কার করি আমি, সেদিন বুঝতে পারি সবাই ছেড়ে চলে গিয়েছে। শুধু থেকে গেছে জীবনের সব চাওয়া, সব আশা আর আকঙ্ক্ষাগুলো আশপাশে। সেইসব চাওয়া, পাওয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে। আশা পূরণ হয়েছে। আকাঙ্ক্ষা মিটেছে। কিন্তু আমার আর সুখী হওয়া হয় নি।

মাঝে মাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দ্বিতীয় বর্ষের কথা মনে পড়ে। সেখানকার সুবিশাল কর্মযজ্ঞের ভেতর ডুবে থেকেও যখন কোনকিছু ভাল লাগতো না, আশপাশে অসংখ্য বন্ধু থাকা সত্বেও একা লাগতো আমার; তখন ছাত্র ইউনিয়নের মলয় দা'কে খুঁজে বের করতাম। সব একাকীত্ব হারিয়ে যেতো মানুষটার সাথে দেখা হলে। সেই মানুষটাও একদিন দুম করে রোড এক্সিডেন্টে মরে গেল! জীবনে যে ক'টি মানুষকে ভালবেসেছিলাম, তার ভেতর এই মানুষটাকে হারানোর জন্যই সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়েছিল। এমনভাবে হারিয়েছিলাম যে দুর থেকেও দেখার কোন উপায় থাকে নি আর।

মলয়দা ছাড়াও আরও কত মানুষকেই তো দিয়েছি ভালবাসার অমূল্য উপহার। কি হয়েছে তাতে কার? বেলাশেষে একাকীত্ব কি আসলেই ঘুচেছে কোনকালে আমার? সুখী হয়েছি। শান্তি পেয়েছি। তারপর একসময় বুঝতে পেরেছি আমি ভীষণ অভিশপ্ত এক জীবন নিয়ে এই পৃথিবীটায় আটকা পড়েছি। যা থেকে মুক্তি নেই আর!

বিষয়টা বুঝতে পেরে এক সময় আমি নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করি। চারপাশে গড়ে তুলি কাঁটাতারের ব্যারিকেড। কাছে আসতে চাইলেও, সেই কাঁটার আঘাত সহ্য করে বেশিদিন টিকে থাকার সাধ্য ছিল না কারো। ধীরে ধীরে একাকীত্বটাই জীবনে পাকাপোক্ত হয়ে গেল। তারপর একদিন পুরোনো জীবনের সবচেয়ে প্রিয় গানটা খুব কাকতালীয়ভাবেই যেন শোনা হয়ে গেল।

"আন্ধার রাইতে চান্দের আলো
দেখলাম না নজরে
এমনধারা জনম আমার
মানুষ হইয়া রে।"

গানটার কিছু কথা অনেকদিন পর্যন্ত বাড়ির দেয়ালে লিখে রেখেছিলাম আমি। কথাগুলো অনেকাংশেই ফলেছে জীবনে। যদিও গানের কথা জীবনে মিলে যাওয়া খুব বড়সড় একটা ক্লিশে, তারপরেও সেই মিল দেখে নিজেকে অন্তত "আগে থেকেই তো জানতাম" বলে প্রবোধ দেয়া যায় দিনশেষে।

সেদিন বহু বছর পর গানটা শুনতে গিয়ে আবার সে কথার সত্যতা পেলাম। গানটার প্রতিটি পঙক্তিতে যেন আমার কথাই লেখা। তাও ভবিষ্যতবাণীর ছলে। যখন গানটা লেখা হয়েছিল তখন বিষয়গুলো ঘটে নি। পরেই ঘটেছে জীবনে!

"হইতাম যদি পঙ্খী তবে
উড়াল দিতাম রে
ডালে ডালে বানতাম বাসা
দেখতো মানুষ রে।"

কত বাসা বেধেঁছিলাম, কিন্তু কোনটায় থিতু হতে পারি নাই। সেটা মেনে নিয়েও আমি জীবনের অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছিলাম। তারপর যেদিন এই দ্বীপটায় এসে পৌঁছাই, সেদিন আর বেশি কিছু ভাবতে ইচ্ছে হয় নি। শুধু জীবনের শেষ ক'টা দিন যে সেখানেই আমি থাকতে চাই, সে'টি মনস্থির করে ফেলেছিলাম। তখনও জানতাম, মানুষ ভাবে একরকম, আর হয় আরেকরকম। তারপরেও শেষ ক'টা দিন কোথায় কাটাবো সেটা ঠিক করে ফেলতে পেরে বহুকাল পর একটুখানি ভাল লেগেছিল।

যেদিন সেই অমোঘ দিনটি এসেই গেল, সেদিন একটা ছেলে আর মেয়েকে সাগরের পাড়ে পাশাপাশি বসে থাকতে দেখেছিলাম। একটা ছোট্ট উকুলেলে হাতে দরাজ গলায় গান গাচ্ছিল ছেলেটা। আর মেয়েটি পাশে বসে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল তার দিকে। বাতাসে ভেসে আসছিল ছেলেটার উদাস আর ভরাট গলার সুর।

"আমার একটা মানুষ হইলো না
যে আগাগোড়া জানবে আমারে!"

শুনতে শুনতেই সেদিন একসময় হৃদযন্ত্র বন্ধের ওই ওষুধটা আমি মুখে পুড়ে দিয়েছিলাম। ডাক্তারের চেম্বার থেকে চুরি করা একটা প্রেসক্রিপশনে আমি নিজের হাতেই ওষুধটার নাম লিখেছিলাম। মুখে পুড়ে দেবার পর একবারের জন্যও সেটাকে ফেলে দেয়ার ইচ্ছে হয় নি। একটু তিতকুটে ওই ওষুধটা চুষতে চুষতে ধীরে ধীরে আমার মন ফাঁকা হয়ে আসছিল। একসময় শুধু ওটার স্বাদই তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিলাম। তারপর সৈকতের বালুকাবেলার চারপাশটায় আমি শেষ একবার চোখ বুলিয়েছিলাম। ততক্ষণে আমার চোখজোড়া ঢুলু ঢুলু আর মণিজোড়া অত্যন্ত সঙ্কুচিত হয়ে এসেছিল।

স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করে নেবার সময়টা আমি যথাযথই বেছেছিলাম। যতক্ষণে আমার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়, ততক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছিল জোয়ার। সাগরের নীল জল ধীর পায়ে এগিয়ে আসে আমার দিকে। আলিঙ্গনে বেঁধে টেনে নিয়ে যায় তার বুকের ভেতরে।

তারপর সমুদ্রে সমাধিস্থ হওয়ার শেষ আশাটাও যখন আর অপূর্ণ থাকলো না, তখন বুঝে গিয়েছিলাম; আরও অনেকবার আমাকে এই পৃথিবীতে জন্মাতে হবে। কোনো এক অমোঘ অভিশাপে প্রত্যেক জন্মে আমার সব ইচ্ছা পূর্ণ হবে, কিন্তু সুখী হবো না আমি কোনবারে।

হা ঈশ্বর! এমনও হয় মানবজীবন?
---

পোস্টটি ১ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

মীর's picture

নিজের সম্পর্কে

স্বাগতম। আমার নাম মীর রাকীব-উন-নবী। জীবিকার তাগিদে পরবাসী। মাঝে মাঝে টুকটাক গল্প-কবিতা-আত্মজীবনী ইত্যাদি লিখি। সেসব প্রধানত এই ব্লগেই প্রকাশ করে থাকি। এই ব্লগে আমার সব লেখার কপিরাইট আমার নিজেরই। অনুগ্রহ করে সূ্ত্র উল্লেখ না করে লেখাগুলো কেউ ব্যবহার করবেন না। যেকোন যোগাযোগের জন্য ই-মেইল করুন: bd.mir13@gmail.com.
ধন্যবাদ। হ্যাপি রিডিং!