ইউজার লগইন

বব ডিলানের লিরিকে চেপে কাটিয়ে দেয়া সেই সন্ধ্যায়

বাপ্পী'দার দোকানটা আড্ডার জায়গা হিসেবে বেশ। দোকানের পাকা অংশের ভেতরে বসেন বাপ্পী'দা। তার সামনে রয়েছে দু'টো গ্যাস স্টোভ। যেগুলোর একটাতে অনবরত গরম পানি ফুটতে থাকে, আরেকটাতে ফুটতে থাকে চা পাতা মেশানো পানি। তার একপাশে সিঁড়ি আকৃতির সিগারেটের আলনা। সেখানে থরে থরে সাজানো রকমারি সিগারেটের প্যাকেট। সেটার নিচে রয়েছে একটা ক্ষুদ্রাকৃতি ড্রয়ার। ওটাই বাপ্পী'দার ক্যাশবাক্স। এছাড়া দোকানের ভেতরে আর কিছু নেই। বাইরে দু'টো বেঞ্চি আছে। ছিমছাম চায়ের দোকান বলতে যা বোঝায়, বাপ্পী'দার দোকানটা তাই। চা আর সিগারেটের কাঁচামাল ছাড়া তিনি এক ছড়া কলাও কখনো দোকানে রাখেন না। কলা, বিস্কিট, ড্যানিশ ইত্যাদি রাখলে নাকি দোকানে রিকশাওয়ালাদের ভিড় লেগে থাকে সবসময়। বাপ্পী'দা তার দোকানে নন-এলিট শ্রেণীর কাস্টমার দেখতে খুব একটা পছন্দ করেন না। আমি সৌভাগ্যবান কারণ হতদরিদ্র হওয়া সত্বেও তিনি আমাকে নন-এলিট মনে করেন না।

সেদিন সরকারী ছুটি থাকায় সকাল থেকে নিবিষ্ট চিত্তে ওই দোকানে বসে আমি, পাপ্পুু, সাগর, মেহরাজ, রাজন, জনি, আসিফ এবং আরও কয়েকজন আড্ডা দিচ্ছিলাম। সদ্য ইতালি ফেরত জনি সেদেশের ললনাদের ভারী শরীরের গুণাবলী বর্ণনা করছিলো। বেশ ক'দিন আগে এদের সামনে দিয়েই ভেগার সঙ্গে লুবে চড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। সে ব্যপারে যাবতীয় তথ্য বন্ধুদেরকে দেয়া হয়েছে। তারা ব্যপারটিকে স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে। আমি বসে ভাবছিলাম, এরপর কোনোদিন সুযোগ হলে ভেগার সঙ্গে আমার বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দেবো।

হঠাৎই চেনা ভটভট আওয়াজ কানে আসায় ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পেলাম একটা কালো রংয়ের স্লিভলেস গেঞ্জি আর জিন্স পড়ে এগিয়ে আসছেন উনি। একেই কি বলে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি? আমার জানা নেই। উনাকে দেখে ছেলেমহলে একটা উচ্ছ্বাসের বান দেখা দিলো। মেয়েটি দোকানের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আমার বাসার দিকে চলে যাচ্ছিলো। সবাই মিলে চেচাঁমেচি করে তাকে থামানো হলো এবং দোকানে ডেকে আনা হলো।

গরমে অনেকক্ষণ ধরেই সেদ্ধ হচ্ছিলাম আমরা। বৃষ্টির জন্য হা-হুতাশও চলছিলো সমানতালে। বৃষ্টির বদলে যে ঝড় চলে আসবে সেটা কল্পনায় ছিলো না কারোই। বাপ্পী'দা এক কাপ স্পেশাল মালাই চা ভর্তি কাপ-পিরিচ ভেগার হাতে তুলে দিতে না দিতেই একটা দৈব ঘূর্ণি রাস্তার সব ধুলোকে বাতাসে উড়িয়ে চারটা দিক অন্ধকার করে ছেড়ে দিলো। ভেগাকে দেখলাম ধুলোর প্রকোপ টের পেয়েই চায়ের কাপটা হাতের তালুতে ঢেকে ফেলতে। মেয়েটির যেকোনো একটা ব্যপারের সঙ্গে মিশে যেতে এক সেকেন্ড সময়ও লাগে না। মুহূর্তকাল আগে হাতে পাওয়া চায়ের কাপটাকেও ঠিকই সামলে নিয়েছে। ধুলোর চাপ একটু কমতেই আকাশে কয়েকবার দেয়া ডাকলো। গুরুগম্ভীর সেই ডাকের শব্দে আপ্লুত হলাম প্রায় সবাই-ই। ভেগা চায়ের কাপে আলতো একটা চুমুক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললো, ইজ ইট গনা রেইন? দুর্দান্ত ঠান্ডা একটা বাতাস আমাদের সবার আগে প্রশ্নটার উত্তর দিতে হাজির হয়ে গেলো। জনি লাফ দিয়ে উঠে একটা আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দিয়ে বললো, মাম্মা মিয়া। আর আমার এত ভালো লাগছিলো যে প্রিয় গানের কলিটা অজান্তে একবার গুনগুনিয়ে উঠলাম, আ'ভ বীন টেন থাউজ্যান্ড মাইলস্ ইন দি মাউথ অফ আ গ্রেভইয়ার্ড...

শুনেই ভেগা বড় বড় বিস্মিত চোখ তুলে আমার দিকে তাকালো, নিষ্পলক কয়েক সেকেন্ড কাটতে দেখলাম, তারপর ওর চোখে খুশি খুশি ভাব ছড়িয়ে পড়লো এবং সে সুরেলা গলায় পরের লাইনটা গেয়ে উঠলো, অ্যান্ড ইট'স আ হার্ড, ইট'স আ হার্ড, ইট'স আ হার্ড, অ্যান্ড ইট'স আ হার্ড, ইট'স আ হার্ড রেইন'স আ' গনা ফল...।

আমাদের ডুয়েট শুনে পাপ্পু, রানারা যারপরনাই উল্লসিত হয়ে ওঠে। ততক্ষণে ঝুম বৃষ্টিও নেমে গেছে। আমরা নগেনের দোকানের বিশাল স্পীকারগুলোয় কিছু পরিচিত হিন্দি গান চালিয়ে রাস্তায় নেমে আসলাম সবাই হৈ-হুল্লোড় করতে করতে। নগেন আমাদের মহল্লার ক্ষৌরকাড়। বংশ পরম্পরায় এ ব্যবসা তারা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেখাদেখি মহল্লার যত পিচ্চি-পাচ্চা আছে সবগুলো বাঁধন ছিড়ে বেরিয়ে এলো রাস্তায়। স্পীকারে তখন বেজে যাচ্ছিলো প্রভুদেবের বানানো সিনেমার গান। ''কাভি ছোড় দিয়া দিল/ কাভি ক্যাচ কিয়া রে...।'' আলো-আধাঁরির ভেতরে প্রবল বৃষ্টি আর কালবোশেখী হাওয়ার তোড়ে ভাসতে ভাসতে আমরা কয়েকজন ওই গানের তালে নাচছিলাম স্থান-কাল-পাত্র ভুলে। আনন্দ মাঝে মাঝে মানুষকে মাতাল করে দেয়। আশপাশের বাসা-বাড়ি থেকে উৎসাহী মুখের উঁকিঝুকি আমাদের আনন্দকে বাড়িয়ে দিচ্ছিলো বহুগুণ।

সেদিন সবচেয়ে বেশি নেচেছিলো ভেগা। পরদিন ওর ফ্লাইট। দেশে ফিরে যাবে। মাঝের কয়েকটা দিন আমাদের দুইজনের ঝড়ের মতো কেটেছে। কাটার পর দু'জনের উপলব্ধিটা হলো- জীবনের জন্য এমন ঝড়গুলো খুব, খুবই উপকারী। দু'দিনের জন্য কক্সবাজার গিয়েছিলাম। সড়কপথের ঝক্কি না থাকলে কক্সবাজারটা যে কি দারুণ একটা বেড়ানোর জায়গা সেটা টের পেয়েছি আবারও। আমরা অবশ্য ওই দু'দিনে রুম থেকেই বের হই নি খুব একটা। একেবারে বের হই নি বললে ভুল হবে। সন্ধ্যে নামার পর ঘন্টা-দেড়ঘন্টার জন্য বের হতাম। হোটেলের সামনের প্রাইভেট বীচে কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করে দু'য়েকটা ভাজা মাছের স্বাদ চেখে চলে আসতাম। তারপর হোটেলের ছাদে কয়েক শট ভদকা-হুইস্কি ট্রাই করে ফিরে আসতাম রুমে। বন্দি হয়ে পড়তাম ২৩-২৪ ঘন্টার জন্য আবারও।

এছাড়া আমরা ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচে ঘুরেছিলাম। সেসব ঘোরাঘুরির স্মৃতি বলতে রয়ে গেছে ২০-২৫ গিগাবাইট ছবি। আমি মাঝে মাঝে একেকটা ছবি ভেগাকে মেইল করে দিই। বেচারী নস্টালজিক হয়ে পড়ে। তারপর স্কাইপে'তে দীর্ঘ রাত কেটে যায় আমাদের, কথা বলে বলে।

ভেগা অবশ্য এখনও বলে নি, কিভাবে সে বাংলা ভাষা শিখেছে। বলেছে নেক্সট সামারে আবার যখন সে আসবে, তখন বলবে। আমি জানতে চাই নি কেন সে আবার বাংলাদেশেই আসবে। যার যা ভালো লাগে করুক না। জীবনটা তো আসলে সেজন্যই আমাদেরকে দেয়া হয়েছে, তাই না?

---

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

মীর's picture

নিজের সম্পর্কে

স্বাগতম। আমার নাম মীর রাকীব-উন-নবী। জীবিকার তাগিদে পরবাসী। মাঝে মাঝে টুকটাক গল্প-কবিতা-আত্মজীবনী ইত্যাদি লিখি। সেসব প্রধানত এই ব্লগেই প্রকাশ করে থাকি। এই ব্লগে আমার সব লেখার কপিরাইট আমার নিজেরই। অনুগ্রহ করে সূ্ত্র উল্লেখ না করে লেখাগুলো কেউ ব্যবহার করবেন না। যেকোন যোগাযোগের জন্য ই-মেইল করুন: bd.mir13@gmail.com.
ধন্যবাদ। হ্যাপি রিডিং!