আদমের মুক্তি ! ময়নার অন্তর্যাত্রাঃ রানওয়ের তারেক মাসুদ ।
কতো সাধের ছাওয়াল আমার রাস্তায় পইরা মরে ... 'মুক্তির গান' । নাই । সব শ্যাষ ! তারেক মাসুদ জীয়ে নাই ! আছে তার মুক্তির গান মাটির ময়না অন্তর্যাত্রা রানওয়ে . . .
আদম সুরত(১৯৮৫) । বরেণ্য শিল্পী এসএম সুলতানের উপর করা তারেক মাসুদের তথ্যচিত্র । ক্যানভাসের সুলতান বন্দী হলেন সেলুলয়েডের ফিতায় । নড়াইলের আদম সুলতানের কীর্তিকে জানান দিতে ভালবেসে শ্রদ্ধা জানাতে মাসুদ সিনেবন্দী করলেন তাঁকে । নাম দিলেন
'আদম সুরত' । তারেক আপনি জানতেন ... জেনেই আপনি এই নামকরণ করেছেন । এই পোড়াদেশে আদমের চেহারা কী হয় তা আপনার জীবন দিয়েই প্রমাণ করে গেলেন ।
মুক্তির গান (১৯৮৯) । যে অসমাপ্ত কাজ '৭১ এ সম্পাদিত হয় নি তার খেসারত আজোও আমরা দিয়ে যাচ্ছি । এই 'মুক্তির গান' আপনাকে আমৃত্যু তাড়া করে বেড়িয়েছে ।
'৭১ এর উপর যে তথ্যচিত্র আপনি করেছেন তা আজতক সিনেজগতের মাস্টারপিস । যে জনমুক্তি আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মুক্তি সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছিল তা কতিপয় দুর্বৃত্তের হাতে ছিনতাই হয়ে যায় । বিপ্লব বেহাত হয়ে যায় । বেসুরো হয়ে যায় মুক্তির গান । সেই হতাশাই কি আপনাকে তিলেতিলে চিরমুক্তি দিয়ে দিলো , নাকি অভিমানে পলায়ন করলেন ?
মাটির ময়না (২০০২) । ময়না আজ আর কথা কইবে না ! যে মাদ্রাসা পড়ুয়া বালক নিজ হাতে বোনকে কবরে শুইয়ে দিয়ে ধর্ম-সংস্কারের মাঝে দাঁড়িয়ে নিজেকে এক মহাসত্যের-মহাবিদ্রোহের (১৯৭১) ইতিহাসের একজন হয়ে যায় , আজ সেই
ময়নাই কী না উদাও ! তারেক মাসুদ সেই সংগ্রাম-ময়নার স্বাধীনতা আজো হয় নাই । ময়না তার স্বাধীনতার জন্য প্রস্থুত । লাইট ক্যামেরা রেডি ... কই শুরু করেন ! একশন ... মাসুদ প্লিজ লেন্সে চোখ রাখুন-আহবান করুন । ময়নারা কোরাস গাইছে ... সোয়াচান পাখি , আমি এতো ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইতাছো নাকি ... ! ?
অন্তর্যাত্রা (২০০৬)। সিমন মাছ নদীতে জন্ম নেয় , বেড়ে ওঠা থেকে যৌবন-বৃদ্ধকাল অবধি সাগরেই কাটায় । মৃত্যুর ঠিক আগে আগে সে তার মাতৃভূমি নদীতেই এসে দেহ রাখে ।
ইউরোপের সাগরে সাঁতার কেটে বুড়িগঙ্গার বিষাক্ত জলকে শুদ্ধ না করেই অভিশপ্ত কংক্রিটের রাজপথে অকালে জীবন দিলেন , যাত্রাভঙ্গ করে আদমের মুক্তি , ময়নার স্বপ্ন , স্বাধ-আহ্লাদ তথা স্বাধিকারের অন্তর্যাত্রায় নায়কের প্রস্থান কতোটুকু যৌক্তিক তারেক মাসুদ ? যে যান্ত্রিক ট্রেন সেই ইউরোপের জল-হাওয়ায় গড়াগড়ি হামাগুড়ি দিয়ে এই পোড়া বাংলাদেশে এসে শিকড়ের সন্ধানে যাত্রা প্রস্তুতি নেয় সেই কীনা বলা নেই, কওয়া নেই উধাও ! তারেক এসে দেখে যান আপনার 'নরসুন্দর' বিহারি আজ কেমন অসহায় ।
তার ক্ষুর সৌন্দর্যের অহংকারে আজ হিংস্র নয় , সেই ক্ষুরে আজ হাজার বছরের জং ধরে বিবর্ণ । সেই ক্ষুরের প্রতি টানে আজ হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণ হয় যা নরসুন্দরের জন্য আত্মহত্যার সামিল । তবুও আপনি শুনবেন না ? ফেরেন । দোহাই আপনার ! যাত্রা শুরু করেন ...তবে এখনই 'অন্তর্যাত্রা' নয় । এখনো অনেক রাত তারেক মাসুদ । প্রভাত হোক তখন দেখা যাবে ... সে যাত্রা অন্তর্জলী যাত্রা না অন্তর্যাত্রা ।
রানওয়ে (২০১০) । আজ কাল পরশু কিংবা তরশু পৃথিবীর সব বিমানবন্দরে বিশেষ কোন ব্যত্যয় না ঘটলে 'রানওয়ে'তে বিমান ওঠানামা করবে । মানুষের জীবনের
'রানওয়ে'ও কিন্তু সমান গতিতে ওঠানামা করবে । আপনি তারেক মাসুদ কিন্তু আপনার রানওয়ের বিমানের যাত্রীর কথা একবারও ভাবেন নি ! ২০১০ এর নভেম্বর কি ডিসেম্বর হবে , রানওয়ে নিয়ে সিলেট এসেছিলেন । এই-ই প্রথম আপনাকে সরাসরি দেখলাম , কথা বললাম । আপনার রানওয়ের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছিলাম । ভাল লাগা , মন্দ লাগা , প্রাপ্তি , অপ্রাপ্তি সব বিষয়েই বোধকরি কমবেশি অল্প-স্বল্প আলোচনা হয়েছিল । আপনাকে নানাভাবে প্রশ্নভানে জর্জরিত করেছিলাম । আপনি সেই চিরচেনা হাসি হাসি মুখে উত্তর দিয়েছিলেন ।
বলেছিলেন ... মনির , রানওয়েতে আমি এনজিও , গার্মেন্টস ও জঙ্গিবাদের মতো জাতীয় প্রধান প্রধান ইস্যুতে লেন্স ফেলেছি ঠিকই হয়তো সেইসব জায়গার ক্ষত আমি চিহ্নিত করতে পেড়েছি কিংবা পারিনি । আমি যা পারিনি তুমি-তোমরা সেই জায়গায় কাজ করবে । আমার অক্ষমতা সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে কিংবা হয়তো আছেও । কিন্তু আমি আশা করি তুমি-তোমরা সেই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠে সিনেমাকে সিনেমা করে তুলবে । আপনি আরও বলেছিলেন ...আর আমি সেই লক্ষে প্রতিটি বিভাগে বিভাগে তোমাদের মতো তরুণ ভবিষ্যৎ সিনেমা নির্মাতাদের জন্য কর্মশালার আয়োজন করবো । আমি আগামি ডিসেম্বরে আবার সিলেটে 'রানওয়ে' নিয়ে আসবো । তুমি-তোমরা তৈরি থেকো , কর্মশালা হবেই হবে । মাসুদ ভাইয়া , আমরা ডিসেম্বরের জন্য প্রস্তুত ... 'রানওয়ে'ও প্রস্তুত । আপনি কবে রানওয়েতে বিমান নিয়ে অবতরণ করবেন ???
ভালো লেখা।
ধন্যবাদ
অসাধারণ লেখা। হৃদয়ে দাগ কেটে গেল। মনটা আবারও খারাপ হলো্।
ধন্যবাদ ।
এই শোক-শূন্যতা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়
অসাধারণ।
উদাও না কথাটা আসলে উধাও। এতো ভালো লেখায় বানান ভুলটা কেমন যেন লাগছিল তাই বলা
ধন্যবাদ পড়ে ভাল লাগার জন্য
বানান ঠিক করে দিয়েছি
লেখাটা ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ ভাল লাগার জন্য
অ সা ধা র ন।
পড়ার জন্য এবং ভাল লাগার জন্য ধন্যবাদ
১৯৮৯ বা ৯০ তে মনে হয় আদমসুরতের প্রথম প্রদর্শনী হয় গ্যটে কালচারাল সেন্টারে, সেই প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলাম। সম্ভবতঃ তারেক ভাইয়ের সেরা কাজ। প্রথম ৩৫ মি.মি.'তে শ্যুট করা ছবি। প্রামাণ্যচিত্র যে কতোটা সৃজনশীল হইতে পারে তার নজীর আদমসুরত। সুলতানের সুরত এমন নৈকট্য নিয়া আর কেউ দেখে নাই। যদ্দূর মনে পড়ে প্রায় সাত/আট বছর তারা গবেষণা আর শ্যুট করছিলেন। মিশুক ভাই তখন সব বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রকারদের অটোমেটিক চয়েস সিনেমাটোগ্রাফিতে। তখনো অন্য চলচ্চিত্র কর্মীরা পুনে থেইকা ফিরে নাই। তখনো বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র কর্মীরা বিজ্ঞাপন বানাইতে শুরু করে নাই। আর তাই অন্তর ছিলো ঐ সময়কার সৃজনে।
লিয়ার লেভিন তার তোলা ফুটেইজে একটা ডক্যু বানাইতে শুরু করছিলেন। কিন্তু শেষ করতে পারেন নাই। তার ঐ ১০/১২ মিনিট দেখার পর মুক্তির গান'রে মনে হয় অভাবনীয় সৃষ্টি। নিজেরে ধন্য মনে হয় ছোট্ট হইলেও ঐ ছবির সাথে একটা ভূমিকা থাকার জন্য।
তবে এই তালিকায় তারেক ভাইয়ের একটা ছবি নাই, মুক্তির কথা'র সাথেও আমার একভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিলো। তারেক ভাই যেইটারে মুক্তির গানের কাউন্টার রিডিং বলতেছিলেন। মুক্তির গান মধ্যবিত্তরা যতোটা ভালো পাইছিলো নিম্নবর্গীয় গ্রহণযোগ্যতা তার ধারে কাছেও ছিলো না। আর তাই দেশের আনাচে কানাচে মুক্তির গানের প্রদর্শনীর অভিজ্ঞতা আর কথ্য ইতিহাসের বয়ান নিয়া মুক্তির কথা তৈরী করছিলো তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ।
যথোপযুক্ত সময়ে পোস্টের জন্য ধন্যবাদ...
ভাস্কর দা , জেনে ভাল লাগছে যে আপ্নে একসময় তারেক মাসুদের সাহচর্য লাভ করেছিলেন
ধন্যবাদ পড়ার জন্য
মন্তব্য করুন