মুক্তিযুদ্ধের অজানা-অলিখিত ইতিহাসঃ বাসুদেবস্মরণ বনাম বাউধরন !
মোঘল , বর্গি , ইংরেজ ক্রমান্বয়ে এল , এ গায়ে কিংবা আর পাঁচ-দশ গাঁয়ে যে আর্থ-রাজনৈতিক পরিবর্তন সেভাবেই বোধকরি পরিবর্তন হয়েছিল কিংবা হয়ে থাকবে। চারিদিকে নলুয়ার হাওর বেষ্টিত । চারিদিকে জল আর জল । যেদিকে চোখ যায় অথৈ জল । বছরের প্রায় আট মাস জলবেষ্টিত থাকে এই গ্রামসহ আশেপাশের সহোদর গ্রামগুলি । ঠিক উত্তর-পূর্ব দিকে থানা/উপজেলা সদর , আর উত্তর-পশ্চিম জেলা শহর । সোজা দক্ষিণে মাইল দুয়েক হাঁটলেই কুশিয়ারা নদী । আর্থ-রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনে তাই এই গ্রাম কিংবা আশেপাশের গ্রামগুলোর যে ভূমিকা কিংবা চিন্তা-ভাবনা নাই তা এতোটা সরল করে বলা যায় না । কারণ
হেমন্তে নাও , বর্ষায় পাও
এই আপ্ত বাক্যটি কিন্তু এই গ্রাম কিংবা আশেপাশের গ্রামগুলোর ক্ষেত্রে পুরাই গরহাজির । যেখানে স্রোতস্বিনী কুশিয়ারা তৎকালের প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম সিলেট-ভৈরব বায়া ঢাকা লঞ্চ সার্ভিস আজোও খুঁড়িয়েখুঁড়িয়ে তার সাক্ষ্য বহন করে যাচ্ছে । তো এইসব ভাঁটির জনপদের মানুষজনদের কীভাবে বলি যে , কালপরিক্রমায় এঁরা গরহাজির ?
আজ এই গ্রামগুলো মোবাইল কোম্পানির আকাশছোঁয়া টাওয়ারের উচ্চতায় খর্বকায় । পল্লীবিদ্যুতের তারে গ্রামগুলো প্যাঁচানো , বিদ্যুতের রোশনাই নয় , আজও গ্রামগুলো কুপিবাতি নয়তো বেনিয়া কর্পোরেট দোকানের সৌরবাতির ঝিলিকে চোখে ঝিঁঝিঁপোকা দেখে মাসকাবারি সুদসমেত সৌরবাতির কিস্তি জমা দিতে দিতে চোখে সর্ষেফুল দেখছেন । তো বলছিলেম , ইংরেজ সাম্রাজ্যের রোশনাই কাটতে না কাটতেই এলো পাকিস্থান জমানা । চারিদিকে তুমুল আন্দোলন-সংগ্রাম । ১৯৪৭-১৯৫২ , ১৯৬৯-'৭১ হয়ে যে বৈপ্লবিক ফলাফল হল তাতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয় । এটা মোটাদাগে বলা সত্যকথন , তয় ভয়াবহতা , প্রাণহানি-বেবুশ্যতাকে একেবারেই উপস্থাপন করে না বললেই চলে । আমার কথা সেটাও না । তবে এর সাথে এই সময়কালের গভীর সংযোগ আছে বিধায় এই ভূমিকার অবতারণা করলাম ।
তখনো এই গ্রামে হাতেগোনা দু'ঘর কী তিনঘর মুসলমান গরীব কৃষকের বসবাস । এরা কবে , কখন , কীভাবে এল তা এই গ্রামসহ আশেপাশের সব্বাই জানে , বলা যায় এই কেচ্ছা সবার মুখস্থ । গ্রামে আর সবাই হিন্দুজনগোষ্ঠী । ব্রাম্মন , কায়েত থেইকা নমঃশূদ্র যে যার মতো করে বসবাস তখনো করে । নলুয়ার হাওরও জানে এরা এই মাটির এই জল-হাওয়ার সন্তান তার নিজের গর্ভের সন্তান , কুশিয়ারাও জানে সন্তানপ্রশ্নে বাছবিচার নাই , হউক না সে সন্তান দুরের অধিবাসী , সন্তান তো সন্তানই । 'কৃষ্ণ-রাঙা সন্তান'কে জননী কখনোই মাতৃস্নেহ থেইকা দুরে রাখে না । কিন্তু সন্তান যখন ভ্রাতৃহত্যায় হন্তারক হয় তখন মায়ের আর দুঃখের সীমা-পরিসীমা থাকে না । তখন বড়ই ক্রান্তিকাল । ১৯৪৭ সালের দেশভাগজনিত যে বিষবাস্প এই ভাঁটির জনপদের মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল তা বর্ণনাতীত । দু'তিন ঘর মুসলমান ঘর বছর বিশেকের মইধ্যে হইয়া গেল প্রায় অর্ধেক । '৭১-এ প্রায় হিন্দুশূন্য ! '৭২ , '৭৩ , '৭৪ ও '৭৫ পরবর্তীতে পুরা গ্রামই তখন মুসলমানদের কবজায় । তারপর চললো হিন্দুয়ানি চিহ্ন-পরিচিতি মোছার পালা । তারপর আস্তেআস্তে সমস্ত জমিজমা নিজের ভোগদখলে নিয়ে আসা হল । এই গ্রামের হিন্দুদের কাছে ১৯৪৭ কী '৭১-সালে ভারত পালিয়ে যাওয়া তখনো, আজো নির্বুদ্ধিতা মাত্র । কারণ এই জনপদের মানুষের ভাষা-সংস্কৃতি পুরাই আলাদা , যতোটা না বাঙালি ততোটাই সিলেটি । আর আসাম কিংবা শিলচরের দিকে পালানো কিংবা আশ্রয় অনেকটা বিদেশ যাওয়াই । তাই সেই মহা-মঙ্গার , মহা-সংগ্রামের ক্রান্তিকালে এই গ্রামের মানুষজন রাতের আঁধারে নৌকার পাঠাতনে যে যেভাবে পারে পালিয়েছিল । বেশিরভাগই বেঁচেবর্তে ছিল কারণ ভাঁটির এই জনপদগুলোয় পাকিরা পানিরভয়ে দু'একবার আসলেও ডুবে মরার ভয়ে ওপথ আর মাড়ায়নি । আজ এরা সর্বস্ব হাড়িয়ে কেউ নাপিত , কেউ ধোপা , কেউ কুলি , কেউকেউ মুঠে-মজুর । কিন্তু তাইবলে ''বাসুদেবস্মরণ'' গ্রামখানি কী আর বেদখল পড়ে থাকবে ? না , তখনো প্রায় অর্ধেক মুসলমানের আদা-দখল হিন্দুর গ্রামকে এরা পুরা মুসলমানি করে ফেলেছে । খতনা শ্যাষ ! খতনা পরবর্তী সাবালকত্বের প্রামাণিক সার্টিফিকেট তো চাই , তাই না ?
হ্যাঁ ,
''বাসুদেবস্মরন'' এখন বাউধরন !!!
আশেপাশের গ্রামগুলার ডাকঘর বাসুদেবস্মরণ এখন বাউধরন । চার-চারটে মন্দির ভেঙে গুড়োগুড়ো এর স্থলে কিংবা আশেপাশে এখন সুরম্য মসজিদ নয়তো মক্তবখানা ,শ্মশানখানা ভেঙ্গে এখন পায়খানা আর কী চাই । এর মাঝেও ১৮২৭ ইসায়ি সালে প্রতিষ্ঠিত বাসুদেবস্মরণ প্রাথমিক বিদ্যালয়টির নামাঙ্কিত সাইনবোর্ডটি ছিল সবার কৌতূহল-উৎসাহের কেন্দ্রবিন্দু ! আজ ক'বছর ধরে তাও উধাও !
দিন যায় মাস যায় বছর যায় রাজা যায় রাজা আসে ...মোঘল , বর্গি , ইংরেজ , পাকি হইয়া রাজাকার মুক্তিযোদ্ধারা বীরবেশে এই লাল সবুজের পতাকা পতপত কইরা উরাইয়া ধরে , সবই তখন ইতিহাস পরম্পরায় যুক্ত হইয়া যায় , শুধু বাসুদেবস্মরণ নলুয়ার হাওর আর কুশিয়ারাকে সাক্ষী রেখে খতনা করে বাউধরন হইয়া যায় , এর চেয়ে আনন্দ এই জগৎ-সংসারে কীইবা আছে , কিংবা থাকবার পারে !?
বিঃদ্রঃ পূর্ণঠিকুজী , গ্রাম+ডাকঘর - বাসুদেবস্মরণ (বর্তমান নাম বাউধরন)
উপজেলা - জগন্নাথপুর ,
জেলা - সুনামগঞ্জ ,
বিভাগ - সিলেট ।
কন কি? ঘটনা তো সিরিয়াস মনে হইতেসে। নামটা কবে চেঞ্জ করা হইসে? এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় কোনো লেখা আসে নি?
একটুও অতিরঞ্জিত নয় , পুরাই সত্য ঘটনা
না পত্র-পত্রিকায় আসে নি
আজব! আপনের বিষয়টা নিয়া একটা লেখা দেয়া উচিত পত্রিকায়। বিষয়টা দেশের মানুষকে ভালোভাবে জানানো। এজেন্ডা সেটিং বলতে পারেন। তারপরে মানুষই (বিশেষত স্থানীয়রাই) সিদ্ধান্ত নেবে তারা নতুন নাম চায় কি চায় না।
যাউক্গা বিষয়টা ব্লগে শেয়ার করনের লিগাও
শিজ্ঞিরি লেখমু
এরকম অনেক ঘটনা আছে। আব্বার কাছে শুনেছি আমাদের গ্রামের নাম ছিল শহীদ নগর। পরে সেটা রামকৃষ্ণপুর করা হয়।
পত্রিকায় লেখেন... আরো অনেক বেশী মানুষের জানা উচিত সঠিক ঘটনাটা
টুটুল ভাইয়ের সাথে একমত। পত্রিকায় লেখেন... আরো অনেক বেশী মানুষের জানা উচিত সঠিক ঘটনাটা।
ওপারের চিত্র ঠিক এটার উল্টা । ধর্ম বা দলবাজির কারণে সব দেশে দূর্বলরা নিগৃহিত হয়। তাদের সম্পত্তি দখল হয়ে যায়, তাদের উপসনালয় ধ্বংস হয়, স্থান-স্থাপনার নাম পরিবর্তন হয় । তবে এ অনৈতিক/ অধার্মিক কাজ গুলোর সাথে মুক্তি যুদ্ধের ইতিহাসের সম্পৃক্ততা খুঁজতে যাওয়া ঠিক নয় । ধর্ম-দলমত নির্বিশেষে এদেশের সব মানুষই এদেশের সন্তান, ভুমিপত্র । দুরের কেউ নয় । পোষ্টে উল্লেখিত ঘঠনা খুবই দুঃখজনক । এধরণের ন্যাক্কারজনক ঘটনার বিরুদ্ধে জনসচেতনা গড়ে তোলাই হবে উত্তম কাজ । গতকালের নাঃ গঞ্জের ঘটনার দিকে নজর দে'য়া যেতে পারে। জনসচেতনা কিভাবে প্রবল প্রতপত্তিশালী কাউকে টেনে নামিয়ে দিতে পারে নাঃ গঞ্জ তার উজ্জল উদাহরণ । সবার প্রতি শুভেচ্ছা !
@বল্গটীম,
কি কারণে আমার মন্তব্য প্রকাশ করা হবেনা জানালে বাধিত হব। আমার ই-মেইল এ আপনাদের মতামত জানাতে পারেণ । ধন্যবাদ ।্
ফিরোজ শাহের সময় কালে জায়গার নাম ছিল ফিরোজপুর, কালের পরিক্রমায় মানুষের মুখে মুখে সেটা বদলে হয়েছে "পিরোজপুর’' । বাসুদেবস্মরণ থেকে বাউধরন সেরকমই কিছু হবে, এর সাথে অন্য অনেক কিছুর যোগসূত্র খোঁজা যে কেন...
আমি কিন্তু ফিরোজ শাহের আমলের কথিত কাহিনি ফাঁদি নাই মিয়াঁ ভাই
এইটা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘটনা এইবার বুঝতে পারছেন ?
দুঃখজনক।
শিগগিরই লেখমু
(
মন্তব্য করুন