জলের জলসায় এক সানকি বিষণ্ন রোদ
তলিয়ে যাচ্ছি। হারিয়ে যাচ্ছি। পানিতে আলোড়ন তুলে ধীরে ডুবে যাচ্ছি আমি। নিপাট বিস্ময়ে বেদনামথিত আত্মা খুঁজে নিচ্ছে মুক্তির সোপান। দৃষ্টিসীমায় তখনও সূর্যের কড়কড়ে আলোর অবগাহন। অবশ শরীরে মৃদু হাওয়ার গুনগুন নামতা। নাকের ভাঁজে কারো মোহনীয় রূপের ঘ্রাণ।
চোখের কোণে কেঁপে ওঠে একটি চঞ্চল প্রজাপতি। লাল নাকি নীল ? ধুসর অথবা সাদা ? দূরে একটি নিঃসঙ্গ চিল এক মনে চক্কর দিচ্ছে। আমি ওর স্বাধীন একাকী আত্মার কাছে ফরিয়াদ জানাই!
আহ্ আকাশ কত নীলাভ। কী নিসীম নিঃসঙ্গ এই চরাচর। আকাশের ভাঁজে ভাঁজে সাদা মেঘের নিপুণ বিন্যাস। যদি মেঘ হতাম! যদি হতাম আকাশ! আকাশের কোণে গড়ে তুলতাম যদি আমার একাকী জীবনের এক চিলতে উঠোন! আলোর সমীকরণে জেগে ওঠে নতুন ধাঁধাঁ।
অনাথ শিশুটি পানিতে কোমড় ডুবিয়ে এখনো খেলছে। ওর কোন খেদ নেই? না পাওয়ার বেদনা ওকে আহত করেনা? চারদিকের চাকচিক্যের ভীড়ে কী নিদারুণ গ্লানিময় ওর জীবন! এখনো কেন বেঁচে আছে ও?
আমি আরো তলিয়ে মাটির সমান্তরালে পৌঁছে যাই। বুদবুদগুলি এখন আর নেই। নিথর পড়ে আছি একটুকরো মাটির মত। চোখ খোলা অথচ সব অন্ধকার। চারদিকে পানির থৈ থৈ ভূবন অথচ নেই কোন শ্বাস নেবার তাড়া। আমার মনে পড়ে শৈশবের কোন এক দুপুরে পুকুরে খেলতে গিয়ে ডুবতে ডুবতে ভেসে উঠেছিলাম। নুরু বুবু টেনে তুলেছিলো।
বুবু তুই এখন কোথায় ? যেদিন তুই পালিয়ে গেলি- ভীষণ কেঁদেছিলাম। ছোট কাকা তোকে মারার জন্য দা-কুড়াল জোগাড় করছিল। সবাই যখন তোকে ঘৃণার তীব্র দহণে পুড়িয়ে মারছিল; শুধু এক অসহায় বালক তোর জন্য নিরবে আশ্র“পাত করেছে। তুই এত নিষ্ঠুর কেন বুবু?
তুই চলে গেলে ভেঙ্গে গেল আমাদের প্রতিদিনকার চোর পুলিশের মহড়া। নিত্যদিনের কেচ্ছার আসর হঠাৎ উধাও হয়ে রাতের নিস্তরঙ্গ অন্ধকারে হারিয়ে গেল। আম গাছে আমার নির্ভয় ঝোলাঝুলি কোথায় পালিয়ে গেল! স্কুলের পথ ভুলে আমি হয়ে গেলাম পথহারা কিশোর। তোর শরীরের ঘ্রাণ এখনো আমার নাকে লেগে আছে বুবু!
একটি মাছ সহসা আমার ঘ্রাণ শুঁকে নিল। আমাকে তুই চিনতে পেরেছিস ? নাহ্ তোর তো চিনতে পারার কথা নয়। এখানে আমি একেবারেই আনকোড়া নতুন। চেনা জীবনের গলি থেকে পালিয়ে এসেছি। দূরের ওই পাহাড় থেকে ঝাপ দেয়ার প্ল্যান ছিল। কথা ছিল আমার অন্তীম মুহুর্তের ছবি তুলে জীবনের মোড় পাল্টিয়ে নেবে কোন এক সুদর্শনা। কেউ আর কথায় অটল থাকেনি। আমি শোকার্ত বিলাপের বেলাভূমিতে মুষড়ে পড়েছিলাম।
ডুবতে ডুবতে ভেসে ওঠার তাগাদা আমাকে টেনে তুলতে পারে। চেতনা বিনাশী টেবলেটের দঙ্গল গিলে সোজা চলে এসেছি এখানে। সূর্যের দিকে মুখ রেখে ধীরে ভাসিয়ে দিয়েছি শরীর। পেছনে ফেলে আসা অনাথ ছেলেটির চোখ বড় হয়ে গেলে নির্ভয় হাসি উপহার দিয়েছি। পায়ের তলায় পড়েছিল যে ঝিনুক নিরব ভাষায় তাকে জানিয়েছি বিদায়। কোন নুরু বুবু এবার টেনে তুলবে না আমাকে। আমি হারিয়ে যাব। মিলিয়ে যাব। বিলীন হব জলের জলসায়।
দুদিন পর দুর্বিসহ গন্ধে নদীকূল কেঁপে উঠলে শকুনের মেলা বসবে আমার শরীরে। আমার চোখ দুটো ঠুকরে খাবে স্বাধীন এক শকুনী। আমার শরীরে ওদের ঠোঁট ডাক্তারের কাঁচি হয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করবে। আমি অনুভূতিহীন হয়ে নিরব অভিমানে কেঁদেই যাব। কেউ আমার দুঃখ বুঝবেনা। না মানুষ না মাছ না পাখি।
বুবু! তুই তো আমাকে বুঝতি। মন খারাপ হলে ঠিকই আমাকে খুঁজে নিত তোর মায়াময় হাতের ছোঁয়া। নতুন কেচ্ছার উপহার মন ভরিয়ে দিত। তুই চলে গেলে আমি দিকভ্রান্ত হয়ে যাব-কখনো ভেবেছিলি বুবু ? আমার সেই জীবন বার বার ভরে উঠেছে পাওয়ার বেদনায়। অথচ না পাবার আনন্দগুলো খুব দ্রুত ঘিরে ধরত আমাকে। তারপর একদিন আমি সত্যিই হয়ে গেলাম মাস্তুলহীন নৌকা!
তুই চলে যাবার পর কোন রাতেই ঠিকঠাক ঘুম হয়নি আমার। তোকে বলার অনেক কথা জমে আছে আমার। জানিস, সেই ময়নার বাচ্চা দুটো বড় হয়ে তোর নাম ডাকতে শিখেছিল। প্রতি মেলায় একটি করে মাটির পুতুল কিনে আমাদের পাটাতনের পুরনো বক্সটা ভরে ফেলেছি। ওগুলো সব তোর!
কয়েকটি শামুক আমার শরীর বেয়ে উঠে আসছে। কাঁকড়াও উঠছে কিছু। ওরা আমাকে নিয়ে ভীষণ কৌতুহলী। এবার আসবে কিছু মাছ। মানুষের ঘ্রাণ শুঁকে চলে আসবে আরো কিছু জলজ প্রাণী। ব্যবচ্ছেদের পর আমাকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করবে। যেভাবে দীর্ঘদিনের পুরনো বাড়ি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। ওদের বুকের কষ্টগুলো আমাকে আলোড়িত করত খুব। একদিন ডুমুরিয়ার জমিদার বাড়ির কষ্টগুলো মুছে দিতে ওর গায়ে হাত বুলিয়ে বলেছিলাম ‘তোর কষ্ট আমি বুঝি। এতগুলো বছর যাদের যত্ন নিলি আজ তারাই তোকে পরিত্যক্ত বলে চলে গেল। কষ্ট নিসনা, একদিন দেখবি ওরাও পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে থাকবে পথের ধারে।’ আমার কথায় খুশীতে বাক-বাকুম করে উঠেছিল সবগুলো দেয়াল। হঠাৎ বাতাসে জানিয়েছিল তাদের আনন্দের হিল্লোল।
কেউ টানছে আমাকে। ধীরে উঠে যাচ্ছি উপরে। আমার শরীর মুক্ত বাতাসে ভেসে উঠলো। বুবু তুই তবে এলি ! আমি জানতাম, যদি কখনো ডুবে যাই, তুই ঠিকই টেনে তুলবি আমাকে। কেন আরো আগে ডুবে গেলাম না! কিন্তু বুবু তোর শরীরের সেই মোহনীয় ঘ্রাণ কই ? তুই কি তবে আসিসনি ? পাঠিয়েছিস কোন দূত !
তুই সেই নিষ্ঠুরই রয়ে গেলি বুবু!
অন্যরকম লেখা।
ভালো লেগেছে।
জেনে ভাল লাগল।:)
দারুণ!
বেদনামাখা সুন্দর...
কাজলা দিদি.. :'(
লেখায় এত অস্থিরতা ক্যান?
নাকি বিষননতা?
অন্যরকম লেখা।
ভালো লেগেছে।
খুব সুন্দর লেখচেন্ ..... দাদভাই আমার,
ওরা ... (আমিসহ হি..হি..হিহ...) যে যাই বলুক ভাই
................................. ইহার জুড়ি নাই ।।
ভাল থাকুন আর উপহার দিন এইরকম মিলনাত্বক বেদনার ।
খুব সুন্দর লেখা
মন্তব্য করুন