জাতীয় শোকদিবসে রাষ্ট্রের স্থপতি স্মরণে
পিতৃমাতৃ হত্যার দায় কাঁধে থাকা সন্তানের বিকাশ ও উন্নয়ন যেমন অবিরত প্রশ্নসাপেক্ষ, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রের স্থপতি হত্যার দায় কাঁধে থাকা জাতিরও বিকাশ প্রশ্নাতীত নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের এত বছর পরেও এটি দিবালোকের মতো সত্য হয়ে আছে। সত্যটা প্রতিদিনের হলেও ১৫ আগস্ট-এলে বড়বেশি স্পষ্ট হয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দায় শুধু রাষ্ট্রের স্থপতিহত্যাজনিত নয়; ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা নির্মম হত্যাকান্ডের বিচারকার্য বন্ধ করে রাখারও। বছরের পর বছর। নেতা, রাষ্ট্রনায়ক, শাসক অথবা ব্যক্তিমানুষ হিসেবে তিনি অতিপ্রাকৃত ছিলেন, সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে ছিলেন- এমন কথা কখনো বলি না, বিশ্বাসও করি না। তারপরও তাঁর তুলনা তিনি নিজেই; অন্যকারও সাথে নয়। ৭৫’ পরবর্তী কোন নেতার সাথে তুলনার প্রয়াস তো রীতিমতো অসুস্থ্যতা; অবশ্যই একটি রাজনৈতিক ভাঁড়ামি। ‘দুই বাঙালীর লাহোর যাত্রা’-নামে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটা বই আছে। এতে তিনি পঁচাত্তুর পরবর্তী নয়; বরং ‘শেখ মুজিব পূর্ববর্তী’ নেতা এ কে ফজলুল হকের সাথে তুলনা করেছেন। সে তুলনায় নেতা হিসেবে উত্তরজনের শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তও টেনেছেন। তার কার্যকারণও বিশ্লেষণ করেছেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, পাকিস্তানের একই শহরে দুই বাঙালী দু’টি প্রস্তাব তুলেছে। একজন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার। অন্যজন পাকিস্তান ভাঙ্গার। মাঝখানে ২৬ বছরের ব্যবধান ( চৌধুরী, ১৯৯৬)। প্রস্তাব দু’টির প্রসঙ্গ টেনেই চৌধুরী, ফজলুল হক আর শেখ মুজিব এর মধ্যে তুলনাটা এভাবে করেন-
‘হক সাহেবের জন্য কাজটা মোটেই অস্বাভাবিক ছিল না। তিনি ছিলেন স্রোতের সঙ্গে। ওই প্রস্তাব তাঁর জন্য কোন বিপদ ডেকে আনে নি। কিন্তু শেখ মুজিবের জন্য কাজটা ছিল বিপজ্জনক। লাহোর শহর তাঁর ছয়দফা’র কথা শোনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না.... শেখ মুজিবকে জেলে যেতে হয়েছে, ঝুঁকি নিতে হয়েছে ফাঁসিকাষ্ঠে চড়বার ( চৌধুরী, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা-৮)।
তবে
‘ শেখ যদি নিবৃত্ত হতেন, যদি ছয় দফা না দিতেন তাহল তিনি অতবড় নেতা হতেন না; আর পাঁচজনের একজন হয়ে থাকতেন। পাঁচজন কে ছাড়িয়ে অতিরিক্ত হবার সম্ভাবনা থাকতো না। ছয়দফা তাঁকে দিতেই হতো, যদি তিনি শেখ মুজিব হতে চাইতেন.. (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৯)।
এ কে ফজলুল হকের সাথে শেখ মুজিব এর পার্থক্যটা কীসের? চৌধুরী (১৯৯৬) বলছেন, দু’জনের মধ্যে পারস্পরিক ব্যবধানটা শুধু কালের নয়; শ্রেণীরও। এবং এ শ্রণীগত পার্থক্যটাই উত্তরজন পূর্বজনকে ছাড়িয়ে গেছেন, নেতৃত্বের প্রশ্নে, জনপ্রিয়তার প্রশ্নে, মানুষের পাশে দাঁড়াবার প্রশ্নে, মানুষের হৃদয়ে টিকে থাকার প্রশ্নে।
‘ফজলুল হক ছিলেন প্রতিষ্ঠিত মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি। এক পুরুষ আগে শুরু করেছেন, তাঁর প্রজন্মে তিনি প্রথমে ডেপুটি, পরে খ্যাতিমান উকিল, আরো পরে বাঙলার প্রধানমন্ত্রী। এই মধ্যবিত্ত পাকিস্তান চেয়েছে। মধ্যবিত্তের যে-অংশ অতটা প্রতিষ্ঠা পায় নি, যে মাত্র উঠছে, পরিচয় যার নিম্নমধ্যবিত্ত হিসেবে, তার সঙ্গে হক সাহেবের যোগ ছিল অবশ্যই, কিন্তু প্রাণের যোগ নয়, অবস্থানেরও নয়, কেবল স্থানের.... অপরদিকে শেখ মুজিব এসেছেন নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে, কলকতায় তিনি থাকেন কলেজের হোস্টেলে, ঢাকায় এসে উঠতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে। প্রথমে ডেপুটি হবেন, পরে ছেড়ে দিয়ে ওকালতির পাশাপাশি রাজনীতি করবেন- এ তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়; তাঁকে রাজনীতি করতে হয়েছে সার্বক্ষণিক ভিত্তিতে। এ রাজনীতি রাউন্ড টেবিলের নয়, ভোট সংগ্রহের নয় শুধু, এ হচ্ছে মিছিলের, সংঘর্ষের, বারম্বার কারাভোগের। হকের রাজনীতিতে ভয়টা ছিল মন্ত্রীত্ব হারাবার; শেখ মুজিবের জন্য ভয় প্রাণ হারাবার। শেখ মুজিব বের হয়ে এসেছেন নিম্ন মধ্যবিত্তের সেই দিকটির প্রতিনিধি হিসেবে যেদিকে সে আপোসবিমুখ ও উত্তেজিত। এ রাজনীতি বিত্তবান হক সাহেবের জগত থেকে অনেক অনেক দূরে (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১০)।
ঐ যে ভয়টা প্রাণ হারাবার, সে ভয়টা শেষ পর্যন্তই ছিল। এবং তাঁকে প্রাণ হারাতেও হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানিদের হাতে নয়। পথভ্রস্ট মেজরদের হাতে। যারা স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনীরই সদস্য ছিল। তবে প্রাণ হারাবার ভয়টা সম্ভবত তাঁর মহান ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছিল না। থাকলে তিনি নিশ্চয় সাবধান হতেন। অন্তত গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আস্থা রাখতেন। সেটা না করে তিনি আস্থা রেখেছিলেন, সাধারণের প্রতি, এমনকি যারা তাকে হত্যা করেছে, তাঁকে একা নয়, পুরো একটি পরিবারকে, নৃশংসভাবে, তাদেরকেও তিনি বিশ্বাস করতেন। আপন ভাবতেন। এটাও নিশ্চয় নেতা হিসেবে একটা ব্যতিক্রম বৈশিষ্টেরই অংশ। মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাসের কারণেই হয়তো হত্যাকান্ডটা এত সহজে সংঘটিত হতে পেরেছিল। আর জাতি হিসেবে আমাদের কাঁধে পড়ে রইলো রাষ্ট্রের স্থপতি হত্যার কলংকের দাগ। চিরদিনের জন্য।
তবে আমাদের জন্য এটাও দুর্ভাগ্য যে, রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিব, বঙ্গবন্ধু, রাজনৈতিক কারণেই শেষ পর্যন্ত সর্বজনের হতে পারেন নি। এটা তাঁর দুর্বলতা নয়; দুর্বলতাটা প্রথমত আওয়ামী লীগের। তারপর নষ্ট রাজনীতির। এ নষ্ট রাজনীতি যতদিন থাকবে, ততদিন তিনি সর্বজনের না হয়ে দলীয়সম্পত্তি হিসেবেই বিবেচিত ও ব্যবহৃত হতে থাকবেন। বঙ্গবন্ধুকে সর্বজনের করে তুলতে হলে এ নষ্ট রাজনীতির বিপ্রতীপ যাত্রাটা শুরু হওয়া জরুরি।
তথ্যসূত্র:
১. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (১৯৯৬), ‘দুই বাঙালীর লাহোর যাত্রা’ আফসার ব্রাদার্স, ঢাকা
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখাটা আমি পড়েছি অনেক আগেই, দারুন!
স্যারের আরো একটি লেখা আছে। বঙ্গবন্ধু আর ভাসানি কে নিয়ে। সে লেখাটাও আমার খুব ভাল লেগেছিল। ঠিক কোন বইতে পড়েছিলাম আজ আর মনে পড়ছে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কেন ভাসানির নেতৃত্বকে ছাপিয়ে এগিয়ে যেতে পেরেছিলেন, তার একটা বিশ্লেষণ দিয়েছিলেন।
ঐ লেখাটাও আমি পড়েছি, দারুন বিশ্লেষণ!
"তবে আমাদের জন্য এটাও দুর্ভাগ্য যে, রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিব, বঙ্গবন্ধু, রাজনৈতিক কারণেই শেষ পর্যন্ত সর্বজনের হতে পারেন নি। এটা তাঁর দুর্বলতা নয়; দুর্বলতাটা প্রথমত আওয়ামী লীগের। তারপর নষ্ট রাজনীতির। এ নষ্ট রাজনীতি যতদিন থাকবে, ততদিন তিনি সর্বজনের না হয়ে দলীয়সম্পত্তি হিসেবেই বিবেচিত ও ব্যবহৃত হতে থাকবেন। বঙ্গবন্ধুকে সর্বজনের করে তুলতে হলে এ নষ্ট রাজনীতির বিপ্রতীপ যাত্রাটা শুরু হওয়া জরুরি।"
ধন্যবাদ আপা
মন্তব্য করুন