প্রসঙ্গতঃ ফকির লালন শাহ্ ও তার রচিত পদ
জাত গেল জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা
সত্য কাজে কেউ নয় রাজী
সবই দেখি তানা না না।।
সময়ের কালপর্বে প্রায় দুই শতক বছরেরও অধিক পূর্বে নিতান্তই সাধারন এক অজঁ পাড়াগায়ের প্রিয় কুটিরে বসে যে মানুষটি সৃষ্টি করেছেন আত্মদর্শন ও মানবতাবাদী এরকম অসংখ্য পদ আর উপহার দিয়েছেন নতুন এক আধ্যাতিকতা ও আত্মদর্শনের জগত, তিনিই ফকির লালন শাহ্। চরম অস্তিত্ত্ব ও পরম তত্ত্বের সন্ধানী লালন ছেউড়িয়ার আখড়াতেই প্রকাশ করেছিলেন তার ঐশি জ্ঞানের এইসব দিব্যবানী। গেয়েছিলেন সেই অমর সত্ত্বার প্রসস্তি গীত -
এলাহী আলামিন গো আল্লাহ, বাদ্সা আলমপানা তুমি।
তুমি ডুবায়ে ভাসাইতে পার
ভাসায়ে কিনার দাও কারো
রাখ মার হাত তোমার,
তাইতে তোমায় ডাকি আমি।।
সেই পরম সত্ত্বার প্রসস্তি গাইতে গাইতে এভাবেই শুরু হয় বাউল সম্প্রদায়ের আসর সাধুসঙ্গ। প্রার্থনার মাধ্যমে স্রষ্টার উপর সম্পুর্ন সমর্পন করে অনাসক্ত দেহ তত্ত্ব সাধক স্রষ্টার কাছে তার আর্তি পেশ করেন। প্রার্থনামুলক এ ধরনের অজস্র বাস্তব সঙ্গীতে লালন সাইঁজীর জ্ঞানের গভীরতা ও সৃষ্টিকর্তার প্রকৃত ও বাস্তব ক্ষমতার অবস্থানেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে।সাইঁজী লালনের সঙ্গীতগুলো চরম জ্ঞানবাদের, দেহ তত্ত্বের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষন ও সকল
অন্তর্মূখী অবস্থাকে লক্ষ করে বিস্তারিত প্রসঙ্গমূলক সঙ্গীত -
আট কুঠুরী নয় দরজা আটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাটা
তার উপরে সদর কোঠা
আয়না মহল তায় ।।
দেহ তত্ত্বই বাউল সম্প্রদায়ের মূল ভিত্তি। দেহই সকল রহস্যের মূল। দেহকে দেখার অর্থ দেহকে পাঠ করা বা আত্মদর্শন করা। আপনাকে জানার মাধ্যমে পরম সত্তার অস্তিত্ত্ব জানা যায়। লালন পরমাত্মাকে উপলব্ধি করেছেন আপন অস্তিত্ত্বের মধ্যে এবং বিশ্বাস করেছেন, অস্তিত্ত্বের রহস্য গভীরভাবে ও একনিষ্ঠভাবে দেখলে, পাঠ করলে ও আত্মদর্শন করলে অচেনার সাথে সংযোগ হতে পারে। তাই সত্যকে জানা ও পাওয়ার মাঝখানে একমাত্র দেহকেই অবলম্বন করেছেন পরম প্রাপ্তির উদ্দেশ্য সাধনের জন্য।
সাইঁজী লালনের সঙ্গীতে ধর্মীয় সাধনার মূল ধ্যানতত্ত্বে শ্বাস-প্রশ্বাস বা দমের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, লালন বলেন -
ধর চোর হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে
সে কি সামান্য চোরা
ধরবি কোনা কাঞ্চিতে।।
দেহের যতক্ষন শ্বাস ততক্ষন আশ বলে একটি প্রবাদ রয়েছে।হাওয়া বা দম বন্ধ হলেই তা মৃত। বাউল সম্প্রদায় হাওয়ার গতিধারা নিয়ন্ত্রনের জন্য যোগ সাধন ও সার্বক্ষনিক ধ্যানের উপাদান হিসেবে আপন সত্তার রকম ও প্রকারের উপর সর্বদা সচেতন। বাউল নিজস্ব অবস্থানে অবলোকন করে হাওয়া নামক অস্থির পোষা পাখীটিকে। এই হাওয়াই হলো মনের চলাচলের পথ। সাধকের দেহ-মন, হাওয়া ও আত্মতত্ত্বকে জ্ঞানের উপাদান হিসেবে না জেনে ভজন সাধন বৃথা। মন আদৌ ধ্যানে ও জ্ঞানে থাকতে চায় না। তাই লালনের অমিয় বানীতে সাধক পায় অস্থির দেহ মনের সাধনার শক্তি।
সাইঁজী লালনের সঙ্গীত, সংস্কৃতি ও সাহিত্যে মানুষের ধর্ম, সম্প্রদায় ও স্রষ্ঠার নানাবিধ শব্দে ও নামে পরিচয় এবং আবেগ আপ্লুত হয়ে বাহ্যিক দৃষ্টিতে রচিত হয় নাই। লালন সর্বযুগের ও সর্বকালের মানুষের জন্য তত্ত্বের রূপরেখা অবলোকন করে পদ রচনা করেছেন। তার আধ্যাত্মবাদে কোন ভেদজ্ঞান নাই। তিনি বলতে চেয়েছেন -
এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে
যেদিন হিন্দু মুসলমান, বৌদ্ধ খৃষ্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে।।
মানুষের ভেদ সৃষ্টি, ধর্ম সৃষ্টি, সম্প্রদায় সৃষ্টি ও স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাকে বিভিন্ন নাম প্রদানের কুফল লালন অত্যন্ত দুরদর্শিতার সাথে বর্ননা করেছেন তার সজ্ঞীতে। আল্লাহ্, হরি, ভগবান, ঈশ্বর শব্দগুলো শুধু মুখে উচ্চারন করে আল্লাত্ব অর্জন হয় না। একই মানুষ শুধুমাত্র ভেদজ্ঞানে বন্দী হয়ে আমিত্বের জালে ভিন্নতর। অত্যন্ত স্বার্থপর ভাবে মানুষ শুধু আগুন, বাতাস, পানি, মাটি ও ধর্মকেই ভাগ-বাটোয়ারা করেনি, স্রষ্টা ও সৃষ্টির সীমানাকে পৃথক করে আমিত্বের শক্তিকে দানবে রুপান্তরিত করেছে। বাউল ধর্ম এই ভেদজ্ঞানের অজ্ঞানতা থেকে মুক্ত। আমিত্বের স্থান বাউল ধর্মে নাই। সাইঁজী বলেন -
গঙ্গায় গেলে গঙ্গা জল হয়
গর্তে গেলে কুপ জলই কয় বেদ বিচারে
তেমনি সাইঁর বিভিন্ন আকার
জানায় পাত্র অনুসারে।।
একে বয় অনন্তধারা
তুমি আমি নাম বেওয়ারা ভবের পরে
লালন বলে আমি কে বা
জানলে ধাঁধা যেত দূরে।।
বাউল সুর মরমী সঙ্গীতে সাধকের সাধনার জন্য ভাব তৈরীতে আশ্চর্য ফলদায়ক।
লালন মুক্তির রহস্য উদ্ধার করে উপমা, রুপক ও ভাবের ভাষাতেই পদ রচনা করেছেন। যেমন -
তিন পাগলে হলো মেলা
ন’দে এসে
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।।
লোভ, দ্বেষ, মোহ হলো তিন পাগল আর এই তিন পাগলের সহাবস্থানেই দেহে সৃষ্টি সংস্কার। অস্তিত্ত্বের আকার নিভিয়ে দেয়ার জন্য এই তিন পাগল সর্বদাই ব্যস্ত। সাইঁজী
লালন তাই এই অজ্ঞানী, অধ্যানী ও বিকার দেহ মনের পাগলদের নিকট না যাওয়ার
জন্য সাবধান করেছেন। রিপু ইন্দ্রীয় বশবর্তী হয়েই অস্তিত্ত্ব সমর্পিত হয় জগতের সকল
কর্মে ও ধর্মে। ধ্যানের উপকরন না থাকায় আপন অস্তিত্ত্ব আহত হচ্ছে রিপু ইন্দ্রীয়ের
নিকট। আল্লাহ জাগ্রত হচ্ছে না আর অবিকল জাতের সাথে একাকার না হওয়ায় তৈরী হচ্ছে অজাত, বেজাত। পাগলের স্বভাব, আচরন ও ব্যবহার সম্পুর্ন আসক্তির মধ্যে বন্দী। তাই সবার আগে ইন্দ্রীয় দ্বার দিয়েই খালি বা শুন্য করতে হবে দেহ মনের সংস্কার। তবেই মিলবে আপন ঈশ্বর, ভগবান বা আল্লাহ্কে। সাইঁজীর আকুল আর্তি -
মিলন হবে কত দিনে
আমার মনের মানুষের সনে।।
সকল লোকসমাজই তত্ত্বগত প্রার্থনায় আপনার খবর কোথায় তা জানতে চায়।
মনের মানুষের সঙ্গে মিলন ঘটবে কবে এ প্রশ্ন সবার। মনের মানুষের সঙ্গা কি এবং মিলন হবে কত দিনে-এর রহস্য ভেদ করারই চেষ্টা করেছেন বাউল সম্রাট তার পদগুলোতে। মনের মানুষের সঙ্গে মিলন ঘটানোর জন্যই সাধকের সব সাধন ভজন। সৃষ্টিকর্তার সকল শক্তি যেমন পরিপুর্ন জ্ঞানাকারে নবী ও আদমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে বার বার, তাই মানুষ তত্ত্বই মূল হিসেবে বিবেচনা করেছেন লালন। মানুষ যেমন সৃষ্টির রহস্য তেমনি স্রষ্টাও সৃষ্টির রহস্য। মানুষের মধ্যেই মানুষ রুপে অবতার, সাঁই বিরাজ করেন ত্রি-ভূবনে। তাই লালন পরিপূর্নভাবে স্রষ্টা ও সৃষ্টিতে দুরত্ব না রেখে সাধন ভজনের বলে পরমতত্ত্বের গুনাবলিতে মানুষকেই মনের মানুষ হিসেবে তুলনা করেছেন এবং মানুষেরই জয়গান করেছেন মুক্তি ও নাজাতের উপায় অবলম্বন হিসেবে। তার গানেই রয়েছে -
যখন ঐ রুপ স্মরন হয়
থাকে না লোক লজ্জার ভয়
অধীন লালন ভেবে বলে সদায়
প্রেম যে করে সে জানে।।
বাউল মতে শাস্ত্রের চেয়ে সত্য বড়, আচার অনুষ্ঠান ও বিধি-বিধানের চেয়ে
মানুষ বড়। আত্মসত্ত্বার মাঝেই নিহিত রয়েছে পরমাত্মার ঠাই। মানুষের মধ্যেই নিহিত
মানুষ রতন, আলেক সাঁই। পরমাত্মার স্বরুপ সেই অসীম আলেক সাঁইকে খুঁজে
পেতে হবে সসীম মানুষেরই মধ্যে।
লালন সাঁইজীর রচিত পদ বা সঙ্গীতে সুর, ছন্দ, পদ ইত্যাদি নানাবিধ বিন্যাসের
প্রকৃত ও আলঙ্কারিক সংযোগ সৃষ্টি হয়েছে আত্মদর্শনের কারনে। অস্তিত্ত্ববোধই লালনের
সঙ্গীতের মৌলিক রহস্য। তাই লালনের সঙ্গীতে লালনের নিজস্ব উপলব্ধিই মহান দিকদর্শন
হিসেবে সাধকের সাধনার অনুপ্রেরনা হিসেবে কাজ করে। আপনাকে জানার রহস্যই লালনের
সঙ্গীতের আহ্ববান। এ সব কিছু চিন্তা করলে বলা যায়, লালনের অসাধারন সঙ্গীতগুলো
মানুষের মধ্যে আত্মদর্শনের সাধ সৃষ্টিতে অনেক বড় ও কার্যকর ভূমিকা রাখে। আর এ
সবই সম্ভব হয়েছে মরমী সঙ্গীতে মানুষের প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের চেষ্টার কারনেই। লালন একাই সকলের হয়ে উপলব্ধির বানী প্রদান করেছেন সত্ত্বার আদি রহস্যের দর্শনে। চেষ্টা করেছেন জাতি, ধর্মের উর্ধে উঠে মানুষকে সৃষ্টিকর্তার কাছাকাছি পৌছানোর উপায় প্রদর্শনের।
১৮৯০ইং সালের ১৭ই অক্টোবর বাংলা ১২৯৭ সনের ১লা কার্তিক ছেউড়িয়ার আখড়াবাড়ীর এই গানের পাখীটা চিরদিনের জন্য পালিয়ে গেল ইহজগতের মায়া থেকে। মুখে ছিল তার রচিত শেষ গানের শেষ বুলি -
পার কর হে দয়াল চাঁদ আমারে
ক্ষম হে অপরাধ আমার
এ ভব কারগারে।।
কমেন্ট সংক্রান্ত সমস্যার জন্য পোষ্টটি আবার দিলাম।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ নাহীদ সুন্দর একটি লেখার জন্য।
আমি সেদিন অনেক চেষ্টা করেও আপনার পোষ্টে কমেন্ট করতে পারছিলাম না,
লালনের দুটো লাইন আমার খুব প্রিয়,
খতনা করলে হয় মুসলমান
নারীর তবে কি বিধান .........
লালন কয় মানুষ কি জাত সংসারে
ভালো থাকবেন, আপনি
জাত বলিতে কি হয় বিধান
হিন্দু যবন বৌদ্ধ খৃষ্টান
জাতের আছে কি বা প্রমান
শাস্ত্র খুজিলে
ধন্যবাদ তানবীরা
চমৎকার লেখা। শিল্পীর উপলব্ধি অবশ্যই বিশেষ কিছু। এমন পোস্ট আরও আশা করি।
ব্লগে কিছু সমস্যা হচ্ছে। আপনার পোস্টে আগে মন্তব্য আসছিলো না, কিছুক্ষণ আগে আমি লগইন করতে পারছিলাম না। প্রত্যেকবারের চেষ্টার পর একজন করে অতিথিসংখ্যা বেশী দেখাচ্ছিল
ধন্যবাদ নুসেরা......অনেক দিনের একটা আশা পুরন হলো
আপনার আগের লেখাটাতে কমেন্ট করার চেষ্টা করেছিলাম, পারি নাই। লেখাটা ভাল লেগেছে।
আমার পছন্দের দুই লাইনঃ
"এমন মানব জনম আর কি হবে,
মন যা কর ত্বরায় কর এই ভবে ... "
"জাত গেলো, জাত গেলো..." গানটা শুনে এক বন্ধুর ফেইসবুক স্ট্যাটাস ছিল এরকম-
"ভাবতে খুব অবাক লাগে, ১৫০-২০০ বছর আগে বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো ক্ষ্যাপা লোকটার মাঝে চিন্তার এধরনের আধুনিকত্ব কিভাবে এসেছিল?"
আসলেই।
"এমন মানব জনম আর কি হবে,
মন যা কর ত্বরায় কর এই ভবে ... "
...............আসলেই তাই
ধন্যবাদ নড়বড়ে
আমিও তাই বলি , এই লোকটার ভিতর কি ছিল ? কেমন করে এই উপলব্ধি আসে মানুষের ?যা আমরা এখনও পারিনা।
উপলব্ধিবোধ টা একরকম সৃষ্টিও করতে হয় নিজেদের মধ্যে...আমরা তার কতটুকুই বা করি
"ভাবতে খুব অবাক লাগে, ১৫০-২০০ বছর আগে বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো ক্ষ্যাপা লোকটার মাঝে চিন্তার এধরনের আধুনিকত্ব কিভাবে এসেছিল?"
বস মানুষ... তার সম্পর্কে কিছু বলার ক্ষমতা নাই
জানেন কি মৃত্যুর আগে লালন সাঁইজী তার মৃত্যু সম্পর্কে ভবিষ্যতবানীও করেছিলেন এইভাবে, "আশ্বিন মাসের শেষ দিন তোমরা কেউ দূরে কোথাও যেও না কারন ঐ দিন আল্লাহর গযব নাজিল হবে" ......... ভক্তদের জন্য দিনটি একরকম গযবই ছিল
তুই পাগল তোর মন পাগল
পাগল পাগল করিস না
পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না।
অনেক দিন পর পড়লাম, আসলে দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল বলে কিঞ্চিৎ লজ্জা বোধ করতেছি।
অসাধারণ একটা পোষ্টের জন্য ভক্তি লইবেন।
কাজী সাব, পোষ্ট দেন না কেন? অনেকদিন পোষ্ট দেন না বলে কিঞ্চিত লজ্জিত হইয়া এক্টা পোষ্ট দেন তাত্তাড়ি। অনেকদিন আপনের লেখা পড়ি না।
চ্রম উতাসি অবস্থা জয়িবু।
নিয়মিত হব শিঘ্রই
ব্যাপার না ... অসাধারণ ভক্তি সাধারণ ভাবেই গৃহীত হইলো।
আপ্নের চরম পোষ্টের অপেক্ষায়।
ভালো লাগলো.. তোমার সারা জীবনের রিসার্চ..
মন্তব্য করুন