শিশু না কাল গেলো মাটি আর ধুলাতে, যৌবন কাল গেলো রঙ্গে
আমার একপাটি ঘুঙ্গুর ছিলো। সেই একপাটি ঘুঙ্গুর একপায়ে পড়েই শুরু হল হুমায়ুন স্যারের ক্লাসে আমার নাচ শেখা। এরপর রাজু স্যার, রূপা আপু, রামকান্ত স্যার অনেকের কাছেই নাচ শিখেছি। হুমায়ুন স্যার এবং রাজু স্যারকে আমি খুব পছন্দ করতাম। কারন উনারা দুজন আমাকে অনেক চকলেট খাওয়াতেন। আর খুব কষ্টকর ব্যাপার হচ্ছে এই দুজনেরই অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। শৈশব বলতে অনেকের মাঠ দাপিয়ে খেলাধূলা করার অনেক রকম স্মৃতি থাকে। কিন্তু আমার শৈশব ছিল শুধুই পড়ালেখা আর নাচ এই দুই গন্ডিতে সীমাবদ্ধ। আমার মাঠ দাপিয়ে খেলাধূলার সৌভাগ্য ছিলনা। ছিলো নাচ শেখার সুযোগ।
মনে আছে, এক শুক্রবার বিকেলে আব্বু আর ছোট খালা আমাকে নিয়ে গেলেন নাচের স্কুলে। তারপরে অনেক বছর আমি একটানা নাচ শিখেছি। তবে আমার নাচের মুল ক্রেডিট দিতে হয় ছোটখালাকে। কারন আমাকে নাচ শেখানোর ব্যাপারে ওই ছিল সবচেয়ে বেশী ইন্টারেস্টেড।
আমাদের স্কুলে ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের উপর অনেক বেশী জোড় দেয়া হত। ফোর্থ ইয়ারে উঠার পর থেকেই আমাদেরকে এই নাচ শিখতে হত। শাস্ত্রীয় নাচের অনেকগুলো ধারা আছে। যার মধ্যে একটা হচ্ছে ভরতনাট্যম। ঝন্টু (বেলায়েত হোসেন খান) স্যারের কাছে আমার ভরতনাট্যম শেখার শুরু।
ভারতবর্ষের অতিপ্রাচীন নৃত্যকলার একটি ভরতনাট্যম। যোগাসন থেকে এ নাচের উৎপত্তি। যোগাসনের মধ্য দিয়ে ধর্মশাস্ত্রে উল্লিখিত পুরাণ কাহিনীগুলোর নৃত্যায়নই প্রাচীন ভারতে পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকে ভরতনাট্যম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ভরতমুনির নামানুসারে যোগাসন নৃত্যনাট্যকলার এ ভরতনাট্যম নামকরণটি করেন পুরানন্দ দাস। ভারতের দক্ষিনাঞ্চলের এই নাচের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ভাব, রস ও তালের সমন্বয়। এ নাচে চোখ, ভ্রু, হাত ও পায়ের সাহায্যে বিভিন্ন মুদ্রার মাধ্যমে নানারকম অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে হয়। যেমন- দৃষ্টি নিক্ষেপের মাধ্যমে লজ্জা ও উপেক্ষা দেখানো, ভ্রূ নিক্ষেপের মাধ্যমে ভয় ও সন্দেহ প্রকাশ করা, নানারকম শরীরী অভিব্যক্তিতে মনের সূক্ষ্ণ অনুভূতি ফুটিয়ে তোলা ইত্যাদি। আসলে এ নাচটি অনেকটা মালা গাঁথার মতো। একটার পর একটা কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করে যাওয়া। নাচটি অনেকগুলো পর্যায়ে বিভক্তও। পর্যায়গুলো ক্রমানুসারে- গনেশবন্দনা, আলারিপ্পু, যতিস্বরম, তিল্লানা ও অভিনয়াম।
নাচ যেহেতু হিন্দু সংস্কৃতির সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত, তাই এই উচ্চাঙ্গ নৃত্যগুলোর জন্মও হয়েছিলো মূলত দেব-দেবীর পূজার্ঘ্য অর্পণের জন্য। সেই প্রেক্ষিতে ভরতনাট্যম শুরু হয় দেবতা গনেশের সন্তুষ্টি অর্জনের মধ্য দিয়ে। দেবতা গনেশকে উদ্দেশ্য করে যে স্তুতিমূলক নৃত্য করা হয় তার নামই গনেশবন্দনা। এখানে পায়ের কাজ খুব ধীর লয়ে শুরু হয় এবং আস্তে আস্তে সেটা দ্রুত থেকে দ্রুততর পর্যায়ে পৌঁছায়।
গনেশকে প্রণাম করার পর্ব শেষে শুরু হয় মূল নাচ। সেখানে প্রথমেই আসে আলারিপ্পু বা পুষ্পাঞ্জলি-আলারিপ্পু। আলারিপ্পু হচ্ছে ভরতনাট্যমের একটা বিশেষ নাচ যেখানে ফুলের পাপড়ির মতো শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে বিকশিত করতে হয় ধীরে ধীরে। তারপর পা দুটিকে সমান রেখে সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে হাত দু'টিকেও সামনের দিকে প্রসারিত করতে হয়। এরপর হাত দু'টিকে মাথার ওপর রেখে নাচের ভঙ্গিতে গুরু ও দেবতাদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করা হয়। গনেশবন্দনা আলারিপ্পুর শুরুতে করতে হয়। আবার অনেক সময় গনেশবন্দনা না করে তার বিকল্পে পুষ্পাঞ্জলি-আলারিপ্পুও করা হয়। এটা আলারিপ্পুরই একটা আলাদা ফর্ম, যেখানে ফুল দিয়ে দেবতাদের শ্রদ্ধা জানিয়ে মূল নাচ শুরু করা হয়।
পুষ্পাঞ্জলি-আলারিপ্পু করলে শুরুতে আর গনেশবন্দনা করা লাগে না। স্টেজ পার্ফরম্যান্সের সময় এই প্রত্যেকটি নাচই আবার পৃথকভাবে পরিবেশন করা যায়। যেমন, শুধুই আলারিপ্পু করা যায় সেখানে পুষ্পাঞ্জলি বা গনেশবন্দনা না করলেও চলে। এটা নির্ভর করে মূলত নাচের কোরিওগ্রাফি কেমন হবে তার উপরে।
প্রথম পর্যায়ের এই নাচের পর শুরু হয় দ্বিতীয় পর্যায়ের নাচ যতিস্বরম। 'যতি' অর্থ নানা রকম বাদ্যবর্গ অর্থাৎ বোল, আর 'স্বরম' অর্থ সরগরম। একটা নির্দিষ্ট রাগের সাথে যতি বা বোল ব্যবহার করে এই নাচটি করা হয়। অনেকগুলো টুকরা নাচ যেমন করা যায় এতে, তেমনি আবার সবগুলো টুকরা নাচ একত্র করে একটা বড় নাচও করা যেতে পারে। এ নাচ থেকেই ভরতনাট্যমের চোখের নানা রকম কাজ, পায়ের এবং হাতের কাজ ও অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলা হয়। যতিস্বরমের পর শুরু হয় তিল্লানা, এ নাচে যে বোল ব্যবহার করা হয় তা দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকী ঢঙে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের রাগ তারানা’র মতো। তিল্লানায় চোখ ও হাতের সাথে সাথে দ্রুতলয়ে পায়ের কাজ করতে হয় যা দেখতে অসম্ভব সুন্দর।
অভিনয়াম পর্বটা হলো অভিনয় প্রধান একটা নাচ। ভরতনাট্যমের এই পর্যায়টি বেশ কঠিন। এই অংশে নৃত্যাভিনয়ের মাধ্যমে মুখাভিনয়, মুদ্রাবিন্যাস ও দ্রুতবর্ধনশীল পায়ের কাজের সাথে সাথে বোল মিলিয়ে নাচ করতে হয়। এ নাচের পোশাকেও বেশ বৈচিত্র্য আছে। প্রাচীন মন্দিরের মূর্তির গায়ে যেরকম পোশাক ও গয়না থাকে এই নাচে সেই আদলেই পোশাক, গয়না ও সাজগোজ করা হয়।
নেচে জীবনে পাওয়া প্রথম পুরষ্কার ছিলো একটা পানির ফ্লাস্ক। সেটা এখনো আমার কাছে অনেক যত্নে রাখা আছে। বন্ধুদের সাথে করা স্টেজ পার্ফরম্যান্স, সিরিয়াসলি রিহার্সেল না করে দুষ্টুমি করার জন্য স্যারের বকুনি এখনো মাঝে মাঝে খুব নস্টালজিক করে ফেলে আমাকে। ইচ্ছে হয় সারাজীবন নাচ করি কিন্তু শত ব্যস্ততা আর আলসেমীর কারনে সেসব ইচ্ছেতেই আটকে যায়, বাস্তবে রূপ দেয়া হয়না। নাচ একটা সময় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছিল, নাচ নিয়ে তখন অনেক স্বপ্ন দেখতাম। এখন চাকরি ও অন্যান্য সব কাজ এতো বেশী গুরুত্ব পায় যে নাচটাই আর করা হয়না। তবে খুব বেশীদিন নাচ বন্ধ রাখার চেষ্টা করলে নিজেরো দম বন্ধ হয়ে আসে। দেখি, সবকিছু ছেড়েছুড়ে (এটা কি আসলেই আর সম্ভব? সবকিছু ছেড়েছুড়ে দেয়া?) আবার হয়তো নাচ করাই শুরু করবো।
শুরু করে দেন। শুভকামনা।
আপনার লেখা পড়ে অনেক কিছু জানা যায়। কিন্তু শুধুই আপনাকে নিয়ে কিছু লেখা যায়না?
অপেক্ষায় থাকবো এমন কোন লেখা জন্য। ভাল থাকুন, প্রিয় প্রিয় আপু।
আর শুরু! আলসের চরম আমি। আমারে দিয়া কিস্যু হবেনা।
ভাল থাকুন, প্রিয় বিষণ্ন বাউন্ডুলে।
পারলাম না...
পারলাম না...
হ'লোনা...
হ'লোনা...
আমি প্রথম কমেন্ট করতে চেয়েছিলাম 
আচ্ছা, একটা শোনা কথা; যারা নাচের চর্চা করেন, তারা নাকি নাচ ছেড়ে দিলে হাতির মতো মোটা হয়ে যান???

ভরত নাট্যম সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম। কিছু ছবি যোগ করে দিলে আমার মত নৃত্যমূর্খের বুঝতে আরো সুবিধা হ'তো...
প্রথম কমেন্ট করতে চাইলে কি এতো দেরীতে আসলে হপে নাকি?

আর আমি কি দেখতে হাতির মত মোটা নাকি?
আগের কমেন্ট বৃত্তবন্দীদা'র উদ্দেশ্যে ছিল। বুঝলামনা ক্যান ওইটা বিষণ্ণর কমেন্টের পর গেল? আমার ল্যাপ্পি প্রায়ই আমার সাথে এই ফাইজলামিটা করে।আর বিষণ্ণর সাথে সাথে আমিও
অনলাইনে এখন ৬ জন। তার মধ্যে চারটাই আমি। নেট এতো স্লো কাজ করছে যে বার বার লগইন করেও কমেন্ট করতে পারছিনা। যাক, এই মাত্র পাঠালাম। পেলে বলেন। আর চাকুরী টাকুরী ছেড়ে নাচের মাস্টার হয়ে যান।
আমি একটু গানটা খুজে দেখি,
নাচ ময়ূরী নাচরে... রুম ঝুমাঝুম নাচ রে...
আপনার কমেন্ট পাইসি।
আছেন ক্যামন? নতুন ল্যাপ্পি চলে ঠিকমতন? কমেন্টের জন্য একরাশ 
বাহ্ খুব ভাল লাগলো । আমি নাচের কিছুই বুঝি না। নাচতে পারিনা বলেই হাতির মত।
কেউ কোন দিন বললো না ছিপছিপে কবিতার মত।
তুমি নেচে যাও সব সময় ভাল থাকবে।
ধন্যবাদ।

ভরতনাট্যম সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানলাম, এমন একটি লেখার জন্য ধন্যবাদ।।
আপনাকেও লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
দারুণ লেখা
ধন্যবাদ ধন্যবাদ।

বৃদ্ধ ন' কাল গেলো ভাবিতে-চিন্তিতে
গুরু ভজিবি তুই কবে গো সাঁইজী
কার আশায় বান্ধিয়াছো ঘর?
দারুণ লেখা
নতুন গল্প দ্যান জলদি।
লেট করলেই খালি দেরী। শুরু করে দ্যান জলদি।
নাচ অনেক সময় এন্টি স্ট্রেস। প্রচুর পরিশ্রমের পর নাচ করলে দেখবে শরীর মন দুটোই হালকা লাগছে। কোন কিছুই ছাড়ার দরকার নেই। ভালবাসা সব একসাথে বেঁধে রাখবে।
কতদিন তোমার নাচ দেখিনা ববি।
আহহারে! রায়হান ভাইরে আপনের নাচের একটা ভিডিও পাঠান দ্রুত।
এমনি এমনি নাচ করলে আপু সত্যি এটা একটা এন্টি স্ট্রেস। কিন্তু বাংলাদেশের শিল্পী হিসেবে অন্য কোন দেশে পারফর্ম করার সময় নাচ নিজেই একটা বিরাট স্ট্রেস।

আপনার নাচের একটা ভিডিও দেন। দেখতে মঞ্চাইতেছে।
আরে কয়েকটা ছবি আপ্লোডাইতে চাইসিলাম, তাইই পারলামনা। আরতো ভিডিও! ছবি আপ্লোডাইতে চাইলেই কি কি জানি কয় আর হাইকোর্ট দেখায়। কিসুই বুঝতে পারিনা।
শুরু করে দেন আবার।
দেখি চেষ্টা করবো।
জানলাম, আপনি একজন নৃত্যশিল্পী। নৃত্যকলা সম্পর্কে আপনার পোস্টে অনেক কিছু জানলাম। ধন্যবাদ। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়, সুযোগ করে নিলেই সব সম্ভব।
- বাহ্ এটাই তো চাই।
নাচ সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানলাম। যা আগে কিছুই জানতাম না। অনেক ধন্যবাদ।
অনেক কিছু জানলাম , অনেক কিছু শিখলাম
মন্তব্য করুন