তোমাদের জন্য ভালবাসা.........
বড় হয়ে যাওয়ার জন্য মাঝে- মধ্যে নিজেকে অভিশাপ দেই। মনে হয়, কেন বড় হলাম? অথচ ছোটবেলায় এই আমার মধ্যেই বড় হওয়ার জন্য কি চরম আকুতি কাজ করতো! ছোটবেলায় আম্মু যখন মারতো তখন মনে মনে বলতাম, “মেরে নাও। যত খুশী মেরে নাও। আমি যখন বড় হব তখনতো তুমি আর আমাকে মারতে পারবানা। তখন আমি তোমার কোন কথাই শুনবোনা”। খালামণি যখন আঙ্কেলের হাত ধরে ঈদের দিন বেড়াতে বের হতো তখন দেখতাম আর ভাবতাম, “বড় হই। তখন ঘোড়ায় চেপে একটা রাজপুত্র এসে আমাকেও এভাবে নিয়ে যাবে। আমি তার প্রিন্সেস হব আর সে আমাকে অনেক অনেক ভালবাসবে। আমি সারা পৃথিবী দেখবো তার হাত ধরে”। আর এখন যত বড় হচ্ছি জটিলতাগুলো ততোই আষ্টেপৃষ্টে বাধঁছে।
জীবনে প্রথমবারের মত নানুকে ছাড়া ঈদ করলাম। রোজা থেকেই নানুকে অনুভব করছিলাম। যেদিন সবার জন্য শপিং করলাম সেদিন নিজের অজান্তেই বার বার সেই শাড়িগুলোর দিকে তাকাচ্ছিলাম যেগুলো নানু পড়তো বা আমরা কিনে দিতাম। গত রোজার ঈদের আগে অনেকদিন সে আমাকে দ্যাখে নাই। তার আমাকে দেখতে হয়তো খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। তাই আমাকে দেখার জন্য একেকদিন একেক অজুহাত তৈরি করা আরম্ভ করল। একদিন ফোন করে বলে, “মাথায় খুব উকুন হইসে। উকুনের যন্ত্রণায় ঘুমাতে পারিনা। সময় নিয়ে একদিন আসো। এসে আমার উকুনগুলা এনে দাও। শ্যাম্পু করে দিয়ে যাও”। কিন্তু আমি যাইনি। যাইনি বলে আরেকদিন বললো, “নখগুলাতো বড় হয়ে গেল। কে কেটে দিবে? নিজের নখে নিজের গায়েই আঁচড় লাগতেসে। ব্যথা পাইতো। কবে কেটে দিবা”? তারপরও আমি যাইনাই। শত ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে গেছি। এরপর একদিন ঈদের শাড়ি নিয়ে তাকে দিতে গেলাম। কি যে খুশী আমাকে দেখে! নানু আমার আইডল। আমি সবসময় তাকে অনুসরণ করি এবং খুব ইন্টেনশনালি তার মত হতে চেষ্টা করি। আমি অন্য অনেকের মত মাদার টেরিজা বা ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের মত হবার চেষ্টা করিনি। আমি যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই নানুর মত হবার চেষ্টা করেছি।
এবার নানু নাই। রয়ে গেছে তার স্মৃতি শুধু। আম্মু, খালামণি, মামা সবার মধ্যেই এই অনুভুতি কাজ করছিল। তাই ভাবলাম ওদেরকে মন খারাপ করতে দেয়া যাবেনা। এটা আরো অনেক কঠিন একটা কাজ। যখন নিজের মনের মধ্যে একই আলোড়ন হওয়া সত্ত্বেও অন্যের সামনে খুশীর ভান করতে হয়। যেটা আমি প্রতিদিন করে চলেছি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারনে।
তবে এবারের ঈদে প্রথম চমকটা আমাকে আম্মুই দিল। এবং আমি কনফিডেন্ট যে একমাত্র আমার মা বলেই এটা পসিবল। এবারের ঈদে আমি কোন ড্রেস কিনিনি। দুই একটা যা গিফট পেয়েছি সেগুলোও বানাতে দেইনি। সো, এই ঈদে আই ডিডন্ট হ্যাভ এনি ঈদ ড্রেস। ঈদের দিন সকালে আম্মু করলো কি, ঈদ মোবারক বলে চিৎকার দিয়ে আমার ঘুম ভাঙ্গালো। হাতে দেখি, দুইটা প্যাকেট। একটা খুলে দেখলাম, সুন্দর একটা প্রিন্টেড জামা বানানো হয়েছে আমার জন্য। দেখে খুব খুশী হলাম। কিন্তু আমার জন্য সবচেয়ে বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল যখন আমি দ্বিতীয় প্যাকেটটা খুলি। দেখি, আমার জামা যেই প্রিন্টের ঠিক সেই একই কাপড় দিয়ে বানানো উচ্ছ্বাসের একটা জামা। আম্মু আমাকে সেটা দেখাচ্ছে আর বলছে, “নাও, তোমাদের মা- ছেলের ম্যাচিং ড্রেস”। দেখে খুশীতে এবং কৃতজ্ঞতায় মাকে জড়িয়ে ধরলাম।
আমার পরিবারের উপর আমার খুব ইনফ্লুয়েন্স আছে। তারা আমাকে খুব ভালবাসে এবং আমার উপর তাদের অগাধ আস্থা। আমি যদি বলি, আজকে সূর্যটা পুবদিকে না উঠে পশ্চিমে উঠেছে। তারা এটাই বিশ্বাস করে বলবে, মনে হয় সত্যিই আজকে সূর্যটা ভুল করে পশ্চিমে উঠেছে। তাদের এই অন্ধ বিশ্বাস এবং ভালবাসা ক্রমেই আমার মনে একটা ভুল ধারণার সৃষ্টি করেছিল। আমি ভাবতাম, যারা আমার সাথে মিশেছে বা আমার সাথে কোন না কোনভাবে কখনো সম্পৃক্ত তারা বোধ হয় আমাকে ছাড়া অচল। তারা কখনোই আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেনা। অথচ কঠিন বাস্তবতা আমাকে প্রমাণ করেছে, আমি অনেকের জন্যই কোনদিন কিছু ছিলাম না। আমি থাকা কিংবা না থাকাতে কিস্যু যায় আসেনা। আমি নাই তো কি হয়েছে আমার অল্টারনেট কত মানুষ আছে! যারা আমার থেকে অ-নে-ক অনেক ভাল।
ঈদের দিন সকালে আব্বু ঘোষণা দিল, যে যতবার তাকে সালাম করবে সে ততোবার সালামী পাবে। পার সালাম ১০০ টাকা। একজন যদি ১০ বারও সালাম করে সে ১০ বারই ১০০ টাকা করে পাবে। শুনে আমাদের বাচ্চা পার্টির মধ্যে খুশীর আনন্দ বয়ে গেল। আমি সারাদিনে আব্বুকে পাঁচবার সালাম করলাম এবং পাচঁশো টাকা পেলাম। এরমধ্যে উচ্ছ্বাসও একবার আব্বুর পা চেটে দিয়ে ১০০ টাকা সালামী আদায় করলো। উচ্ছ্বাস সেই টাকা নিয়ে কিছুক্ষণ খেললো। পরে অবুঝ সন্তানের টাকা মা’র পকেটেই যায়, সেই পরম্পরা অনুযায়ী ওর টাকাটাও আমি নিয়ে নিলাম।
এবারের ঈদে আমি বেসিক্যালি টাকা ইনকাম করেছি বিরিয়ানী আর ফিরনী রান্না করে। বিরিয়ানী খেতে নাকি এতই ভাল হয়েছিল যে খাবার পর আব্বু আর আঙ্কেল দুজনই আমাকে বকশিস হিসেবে ৫০০ করে টাকা দিল। আর আঙ্কেল ঘোষণা দিল, আমি যদি কাউকে পটাতে চাই তাহলে নাকি আমার উচিত হবে তাকে ফিরনী রান্না করে খাওয়ানো।
ঈদের দিন পরিবারের সবার সাথে প্রথমবারের মত “যমুনা ফিউচার পার্ক” গেলাম। আঙ্কেল নিয়ে গেল। বিচিত্র হলেও সত্যি যে, আমার জীবনের প্রথম সব ঘুরতে যাওয়া কিংবা খেতে যাওয়ার অভিজ্ঞতাই আঙ্কেলের সাথে হয়েছে। প্রথম প্লেনে চড়া, কক্সবাজার বেড়াতে যাওয়া, ওয়ান্ডারল্যান্ড, ফ্যান্টাসী কিংডম কিংবা নন্দন পার্ক, সোনারগাঁ অথবা নতুন কোন দেশ ভ্রমণ সবকিছু। ঢাকা শহরের প্রায় সব হোটেল কিংবা রেস্টুরেন্টে প্রথমবার আমি তার সাথেই খেয়েছি। খুব আদর করেন উনি আমাকে। আর আমিও তাকে বাবার মতোই দেখি। আমি অনেকদিন থেকে চাচ্ছিলাম যমুনা ফিউচার পার্কে বেড়াতে যেতে। কিন্তু হয়ে উঠছিলনা। এবার আরো বেশি অবাক হলাম তখনই যখন দেখলাম এখানেও আমি প্রথমবারের মত আঙ্কেলের সাথেই এসেছি। দায় বাড়ছে। এইসব ভালবাসার দায় চুকিয়ে তবেইনা ছুটি। সারাজীবন মনে রাখতে হবে, এই আমার “আমি” হয়ে উঠার পেছনে কার কি ভুমিকা রয়েছে। সবাইকে তাদের উপযুক্ত সম্মান এবং ভালবাসা ফিরিয়ে না দিলে মরেও যে শান্তি নাই। আমি যদি নাও থাকি তবু কাউকে না কাউকে দায়িত্ব দিয়ে যেতে হবে, এই অসাধারণ মানুষগুলোকে একটু দেখে রাখার।
ঈদের পরেরদিন অনেকগুলো মুভি দেখলাম। মুভি দেখার টাইম আমি খুব একটা পাইনা তবে দেখতে এনজয় করি। কত ভাল ভাল সিনেমা হচ্ছে অথচ কেউ প্রিয় সিনেমার কথা জিজ্ঞেস করলে আমি এখনো বলি, “চালতে চালতে আর সাথিয়া”। দুটোই ভাল সিনেমা এটা সত্যি তবে এরপরও ভাল সিনেমা আরো অনেক হয়েছে। কিন্তু আমার কেন জানি প্রিয় সিনেমা জিজ্ঞেস করলে খালি এই দুটোর কথাই মনে পড়ে। দিনটি শুরু হয়েছিল, “ব্রেক কি বাদ” মুভিটা দেখার মধ্য দিয়ে। এই মুভিটা এ্যাজ ইউজুয়াল একটা মুভি। কিন্তু আমার ভাল লাগে দুইটা কারনে। এক, নায়িকার চরিত্রের সাথে আমি নিজের অনেক মিল খুঁজে পাই আর দুই, মুভিটা দেখার পর আফসোস লাগে। মনে হয়, ইশ! আমার যদি এরকম একটা গুলাটি থাকতো! দুই নাম্বার যে সিনেমাটা দেখলাম তার নাম, “লাইফ ইজ বিউটিফুল”। দেখে চোখে পানি এলো। তৃতীয় সিনেমাটার নাম, “চিরদিনই তুমি যে আমার- পার্ট ২”। কোলকাতার বাংলা সিনেমার এম্নিতেই আমি দারুন ভক্ত তবু এই সিনেমাটা দেখতে খুব বেশি ইচ্ছে হচ্ছিলনা তার কারন নায়ক- নায়িকা কাউকেই চিনিনা, এরা দেখতে খুব বেশি একটা সুন্দরও না, এই সিনেমাটাতে পরমব্রত নাই ইত্যাদি বিভিন্ন কারনে। তাই খুব একটা আগ্রহ প্রথম দিকে কাজ না করলেও কাহিনী বাড়ার সাথে সাথে মনোযোগ আকর্ষণে বাধ্য এই সিনেমাটি। ফিনিশিংটা দেখে আবারো চোখে পানি চলে এল। আমার ল্যাক্রিমাল গ্ল্যান্ডের মনে হয় কোন সমস্যা হয়েছে। কথায় কথায় চোখে পানি চলে আসে। ডাক্তার দেখাতে হবে। এই যে, নায়িকার জন্য নায়কের এত এত স্যাক্রিফাইস, নায়িকা হারানোর কষ্টে নায়কের মরে যাওয়া এগুলো কেন সিনেমাতেই ঘটে? বাস্তবে কেন হয়না? বাস্তবে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে বহু বছর প্রেম করে বিয়ে করার পর হয়তো দেখা যায় যে, ছেলেটা মেয়েটাকে এত মারধোর করে যে পিঠের ব্যথা সারাজীবন মেয়েটার সংগী হয়ে যায়। প্রতিবার মেয়েটা উঠতে, বসতে, হাঁটতে, চলতে গেলে চিনচিনে ব্যথা তাকে মনে করিয়ে দেয় অতীতের ভালবাসা নামক এক শঠতার কথা। আর ছেলেটা কোনদিন তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হয়ে উলটো মেয়েটাকে অনুরোধ করে, “তোমার কাছে আমার হার্টলি রিকোয়েস্ট, প্লীজ আমার বা আমার পরিবারের নামে থানায় কমপ্লেইন করোনা। আমাদেরকে ঝামেলায় ফেলোনা”। মেয়েটা ভাবে, তার স্বামী তার সাথে অন্যায় করেছে এটা সত্যি। কিন্তু সে ভাবলো কিভাবে যে, তাকে মারার কারনে থানায় কমপ্লেইন করে পুলিশ দিয়ে সে তার স্বামীকে মার খাওয়াবে?”
আত্নহত্যাকে আমরা সবসময় খুব ডিসকারেজ করি। প্রমাণ করার চেষ্টা করি, ইস্কেপিস্টরা আত্নহত্যা করে। যত যাই ঘটুক না কেন, বেঁচে থাকতেই হবে এবং জীবনটাকে নতুন করে শুরু করতে হবে। কিন্তু কেউ যদি সত্যিকার অর্থে তার জীবন থেকে ছুটি নিতে চায় কিংবা বেঁচে থাকার আর কোন অর্থ খুঁজে না পায় তবে তাকেও কি আমরা ইস্কেপিস্ট বলবো? আমি ধীরে ধীরে বর্তমান সময়ে বাস করার জন্য অচল হয়ে পড়ছি। আমি অন্য সবার মত নতুন করে আর শুরু করতে চাইনা। আমার সেই শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট নেই। তোমরা যারা সেকেন্ডের কাটার সাথে নিজেকে বদলে নিতে পারো দুনিয়াটা আসলে তোমাদেরই। এখানে আমার মতো পুরোনো কোন শ্যাওলার কোন অস্তিত্ব নেই, থাকতে পারেনা। তাই আমার মত পরাজিত, জরাজীর্ণ মানুষের ছুটি নেয়াই উত্তম।
বি দ্রঃ নামটা হুমায়ুন আহমেদের একটা বই থেকে নেয়া। আজকের লেখাটার জন্য এর চেয়ে যুতসই কোন নাম খুঁজে পাচ্ছিলামনা বলেই এই নামকরন। আশা করি, প্রিয় লেখক সেটা বুঝবেন।
আপনার সাথে আমার অনেক কিছুতেই মিল । এই যেমন নূতন করে আর শুরু করতে পারিনা । মাঝে মাঝে মনে হয় একদম অচল হয়ে গেছি, সময়ের সাথে তাল মেলানো সম্ভব হয়না কিছুতে ! আর থেকে কাজ কি ! ছুটি নেওয়াই উত্তম !
ভাল থাকুন এবং লিখুন এ বি'র জন্য ! ভাল লাগলো পোষ্ট !
প্রিয় যেমন ঠিক তেমনি লেখা।।
বরাবরের মতোই ভালো এবং কিউট একটা লেখা। প্রতি উইকে এরকম লেখা দুটো করে চাই আর চাই ঈদের সেলামি!
মন্তব্য করুন