আমি রাতের আকাশ শীতের বাতাস তোমার চুলের গন্ধ
আমাদের পুরানো বাড়িটা একতলা ছিল। চারদিকে দেয়াল এবং উপরে টিনের চালা দেয়া বাড়িটার প্যাটার্ন ছিল বাংলোর মতো। চারদিকে বাগানে ঘেরা বাড়িটার নামও ছিল “বাগান বাড়ি”। এমন কোন গাছ নেই যা সেই বাগানে ছিলনা। ফুল-ফল থেকে শুরু করে নানারকম পাতাবাহার, শাক-সবজি এমনকি ঔষধি গাছ পর্যন্ত বাতাসে দুলে দুলে তার অস্তিত্ব জানান দিত। গেটের উপর ছিল একটা মাধবীলতার গাছ। সেটা তার ফুলের ভারে নুয়ে পড়ে পুরো গেটটাকে ঢেকে রাখতো। প্রতিটা ঋতুই বাড়িটাতে আলাদাভাবে ধরা দিত। যখন খুব গরম পড়তো, একটা গাছেরও পাতা নড়তোনা। সজনে গাছ আর নিম গাছটা ছিল পাশাপাশি। আমরা এই গাছ দুটোর নিচে মাদুর বিছিয়ে, হ্যারিকেন জ্বালিয়ে, হাত পাখায় বাতাস করতাম আর শুয়ে শুয়ে আকাশের তারা দেখতাম। যখন বর্ষা নামতো, ঝমঝম বৃষ্টিতে ভেঙ্গে যেতো আমাদের টিনের চালা। সে কি শো শো বাতাসের শব্দ! আর আমরা ছোট্ট ছোট্ট খেলনার হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে উঠানে দৌঁড়াদৌড়ি করতাম শীল কুড়ানোর জন্য। শীল ধরতে গেলেই পানি হয়ে যেত তাই ধরার সাথে সাথেই সেটা মুখে পুড়ে দিতাম। বৃষ্টি নিয়ে ফ্যান্টাসী আমার সেই বয়স থেকেই। বৃষ্টি নামলেই উঠানে দৌঁড়। কি রাত, কি দিন! একটা কদম গাছ আর একটা বেলী গাছ ছিল, প্রচুর ফুল ফুটতো। আর ছিল একটা গন্ধরাজের গাছ। তারার মত গাছ ভর্তি করে কত্ত ফুল! তবে আমার সবচেয়ে প্রিয় গাছ ছিল, জামরুল গাছ। সাদা-সবুজে মেশানো বড় বড় জামরুল ধরতো গাছটাতে। জামরুলের কারণে গাছটা আমার প্রিয় ছিলনা। প্রিয় ছিল কারণ, এই একটা গাছ ছাড়া আর কোনটাতেই আমি চড়তে পারতামনা। যেদিন জামরুল গাছটা কেটে ফেলা হল আমি সত্যি ওর কান্না শুনতে পাচ্ছিলাম আর আমিও ওকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলাম। তখন থেকেই আমি গাছের কথা বুঝতে পারি আর আমার ধারণা ওরাও আমার সাথে কথা বলে। এরপর বর্ষা শেষে হু হু বাতাসে শীত আসতো, যা আমার কোনদিনও ভাল লাগেনা। টিনের চালা ভোরের কুয়াশায় এত্ত ঠাণ্ডা থাকতো যে মাঝে মাঝে দুপুর পর্যন্ত সূর্যের দেখা মিলতোনা। আমি লেপের নীচ থেকে একদমই বের হতে চাইতামনা, অথচ খুব সকালে স্কুল থাকার কারণে একটা মোটা সোয়েটার গায়ে চাপিয়ে, মাফলারে কান পেঁচিয়ে, মুখ-ঠোঁট ভর্তি করে ভ্যাসলিন লাগিয়ে আম্মু স্কুলে নিয়ে যেত। আর আমি রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে ল্যাম্পপোস্ট, গাছ কিংবা তারখাম্বা ধরে আটকায় থাকতাম, স্কুলে যাবনা। স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে একটা প্রাণ বা টিনটিনের কমিক্স কিনতাম, রাস্তায়ই সেটা পরা শেষ হয়ে যেত আর কিনতাম একটা বাটি কেক, সেটা খেতে খেতে বাসায় আসতাম। স্কুলের চারপাশের সব দোকানদারেরা আমাকে চিনতো বলে বাকি নিতে আমার খুব বেশি বেগ পোহাতে হতনা। তবে শীতকালে নানু খুব মজার মজার পিঠা বানাতো যেগুলো খেতে খুব্বই মজা লাগতো। এখন নানু নাই, তাই পিঠা খাওয়া হয়না। আম্মু বানাতে পারেনা আর আমিও না।
প্রকৃতিকে ভালবাসলে নাকি প্রকৃতিও ভালবাসে। আমি প্রকৃতি খুব ভালবাসি। পাহাড়, নদী, ঝর্ণা, সমুদ্র, গাছ-পালা, মেঘ, তারা, বৃষ্টি আমার খুব বেশি পছন্দ। জানিনা, ওরা আমাকে ভালবাসে কিনা। একবার সেইন্টমার্টিন বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেইন্টমার্টিনের সমুদ্রটা খুব সুন্দর। গলা সমান পানিতে দাঁড়ালেও নীচে পায়ের তালু পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়। আমরা ওখানে খুব সুন্দর একটা রেস্ট হাউজে ছিলাম। একদিন সেই রেস্ট হাউজ থেকে ভোর পাচঁটায় বের হয়ে একা একা হেঁটে কিছুদূর এগুতেই যে দৃশ্য দেখলাম তা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। সামনে নীল শুধুই নীল রঙের অথৈ সমুদ্রকে ঘিরে ছোট-বড় বিভিন্ন আকৃতির রং-বেরঙ্গের প্রবাল পাথর। আর তার নীচের বালিগুলো সুর্যের আভায় চিকচিক করছে। পানি এত স্বচ্ছ যে এক্কেবারে নীচের সামুদ্রিক প্রাণীগুলোকে পর্যন্ত সাঁতার কাটতে আর খেলতে দেখা যাচ্ছে। আর পুরো জায়গাটা ঘেরা সারি সারি নারিকেল গাছ। এত ভয়ংকর সুন্দর বেশিক্ষণ সহ্য করা খুব কঠিন। আমি সেখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারলামনা। এত বিশালতার মাঝে নিজেকে খুব ক্ষুদ্র আর একা মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এই জায়গাটায় একা না, নিজের সেই মানুষটাকে সাথে নিয়ে আসতে হবে। তার হাতে হাত রেখে এই বিশালতার সামনে এসে দাঁড়াবো আমি। মনে হয়না এই জীবনে কোনদিনও আর সেখানে যাওয়া হবে আমার!
আরেকবার অফিসের কাজে সুনামগঞ্জ গেলাম। কাজ শেষে বিকেলে আমরা নৌকায় করে ঘুরতে বেড়িয়েছিলাম। দেখি চারপাশে থই থই পানি। আমরা একটা ইঞ্জিন দেয়া নৌকা ভাড়া করেছিলাম, যেটা খুব দ্রুত যাচ্ছিল। যেতে যেতে একটা জংলার মত জায়গায় গিয়ে পৌঁছালাম। দেখি পানির চারপাশে সেই জংলাটা বনের মত ঘিরে রেখেছে। পানিতে ভাসছে শাপলা আর কচুরীপানার ফুল। কয়েকটা সাদা বক ডিগবাজি দিয়ে গোসল করছে। অসম্ভব সুন্দর! মনে হল, ইশ! এখন যদি ঝমঝম করে বৃষ্টি নামতো! তাহলে আমি নৌকায় বসে এই অসম্ভব সুন্দর জায়গাটাতে বৃষ্টিতে ভিজতাম! তখনও আ্মি সেই মানুষটার অনুপস্থিতি বোধ করছিলাম। আমার সব ফ্যান্টাসী পানিকেন্দ্রিক অথচ আমি সাঁতার জানিনা। পাহাড় দেখলেই আমার উঠতে ইচ্ছে করে। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে প্রকৃতির বিশালতাকে উপভোগ করতে চাই আমি। উচুঁ পাহাড়ের উপরে দাঁড়ালে মনে হয়, ইশ! যদি পাখির মত ডানায় ভর করে শূণ্যে ভেসে যেতে পারতাম!
ছোট বেলায় আমি আর তমা খুব হাঁড়ি-পাতিল খেলতাম। বালি দিয়ে ভাত, ইটের গুড়ার ডাল আর শুকনা মরিচ গুড়ো, পাতা-ফুল দিয়ে বানানো তরকারি আর পলাশ ফুলের ভেতরের যে লম্বা লম্বা সাদা শলতেগুলো হয় সেগুলো দিয়ে সেমাই। আমাদের দুজনের দুটো মাদুর ছিল, যা দিয়ে আমরা আলাদা বাসা বানাতাম আর একজন আরেকজনের বাসায় লাল-হলুদ রঙের ছোট্ট শাড়ি পরে বেড়াতে আসতাম। গয়না হিসেবে থাকতো হেলেঞ্চা শাকের ডাঁট দিয়ে বানানো গলার মালা। মাধবীলতা আর শিউলি ফুলের মালাও পড়তাম অনেক সময়। কিন্তু হেলেঞ্চা শাকের ডাঁট দিয়ে বানানো মালা সহজে মরতোনা। ডাঁট কেটে পানির মধ্যে রেখে দিলে ওইটা ফুলে যেত তখন মালা বানালে দেখতেও সুন্দর লাগতো। আরেকটা মালা বানাতাম, সেটা হচ্ছে মোমের মালা। মোম জ্বালিয়ে পানির মধ্যে রস ফেললে ওইটা শক্ত হয়ে যায় তখন সেগুলো সুঁই-সুতায় গেঁথে মালা বানানো যায়। এই মালাটা অবশ্য মামা খুব ভাল বানাতে পারতো। আমার আর তমার দুটো পান্ডা ছিল। আমারটা ছেলে আর তমারটা মেয়ে। আমার ছেলে পান্ডাটার নাম ছিল “আযান” আর তমার মেয়েটার নাম “আঁধি”। আযান আর আঁধিকে আমরা প্রতিদিন একবার করে বিয়ে দিতাম।
আমাদের একটা কাঠের ঘোড়া ছিল। ওই ঘোড়াটায় আমরা তিনজন একসাথে বসতাম। বসে গাইতাম, “লাকড়ি কি কাঠি কাঠি কি ঘোড়া”। ছিল একটা খেলনার স্টীমার। যেটার পাটাতনের নীচে কেরোসিন তেল দেয়া থাকতো আর কুপির মত একটা শলতে ছিল, আগুন দিলে ভোঁ ভোঁ শব্দ করে স্টীমারটা চলতে শুরু করতো আর আমরা গামলা ভর্তি পানির মধ্যে সেটাকে ছেড়ে দিতাম। এই খেলনাটাও আমি আর তমা চালাতে পারতামনা, মামা চালিয়ে দিত। আমার আর মামার কোন খেলনা ছিলনা, তমার ছিল অনেক। আমরা দুজন তমারটা দিয়েই খেলতাম। আমাদের একটা টিয়া পাখি ছিল। আমি আর তমা সেটার পায়ে কাগজ পেঁচিয়ে গাইতাম, “কবুতর যাহ যাহ যাহ, কবুতর যা যা যা”।
বাবা-মায়েরা অনেক সময় অতিরিক্ত আদরের কারনে, না বুঝে বা জেদের বশবর্তী হয়ে সন্তানের প্রতি অবিচার করে ফেলেন। তারা হয়তো অন্ধ ভালবাসার কারণে এটাও বুঝতে পারেননা যে, তারা কাজটা খারাপ করছেন। আমি বিশ্বাস করি, একদিন পৃথিবীর সকল বাবা-মা তার সন্তানদেরকে বুঝতে পারবেন।
মানুষের ভাল সময়ের পর খারাপ আর খারাপের পর নাকি ভাল সময় আসে। ২৮টা বছর পার হয়ে যাচ্ছে। কবে আসবে আমার ভাল সময়? আমি যে ক্লান্ত হয়ে গেলাম ভাল সময়ের অপেক্ষায়! মাঝে মাঝে যখন খুব একা লাগে, অসহায় হয়ে পড়ি তখন মনে হয়, কেউ যদি মাথায় হাত রেখে বলতো, “এই যে আমি আছি তো”! আমি সেই অদেখা মানুষটার অদৃশ্য হাত ধরে সকল বাধা অতিক্রম করতে পারতাম, সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মত স্পর্ধা দেখাতাম। যার আস্কারাতে আমি হয়ে উঠতাম আরো বেশী স্পয়েল্ড। তার সুন্দর হাসিতে ভেসে যেত আমার সব কষ্ট, সব না পাওয়া আর সারল্যে ভরা চোখ দুটোর দিকে তাকালে শুনতে পেতাম, আশা জাগানিয়া এক নতুন গান। তার কাছে অন্য সবার মত, আমি মানেই শুধু খারাপ না, আমি মানে বেঁচে থাকা।
সুইট, কিউট ও নষ্টালজিক একটা লেখা।
আপনি বলেন সবসময় আপনার নাকি লেখা ভালো হয় না। আমি তো দেখি আপনার লেখা কত দারুন। আই এম ইমপ্রেসড!
আপনি ইম্প্রেসড জেনে আমি আনন্দিত।
আনন্দিত হবার কিছু নাই, আপনাকে সামনে আরো লিখতে হবে।
লিখতে হলেও আনন্দিত আর লিখতে না হলেও আনন্দিত। কারণ আপনি আমার লেখা অখাদ্যগুলো খুব মনোযোগ সহকারে পড়েন আর ভূয়সী প্রশংসা করেন।

আরো অনেকেই প্রশংসা করে, কিন্তু তারা কমেন্ট করে না কিংবা ব্লগেই আসে না!
তাইলে আর কিবায় হবো?
উফ!এত্ত চমত্কার চিত্রকল্প, পড়লেই মন ভালো হয়ে যায়। ^_^
পিচ্চিবেলার অনেক কিছু আর সেন্টমার্টিনসের বেশ খানিকটা অনুভুতি কমন পড়েছে।
অনেক দিনের পর, প্রিয় লিস্টে জমানোর মতন প্রিয় কারও লেখা!
আমার লেখা পড়ার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ স্যার।
চমৎকার একটি লেখা পড়লাম
অসাধারণ লাখলো (y)
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
আপনার আরো লেখা চাই....
আশা করি পাব
মনে তো হয় পাবেন।
শুধু আপনি না আমরা সবাই।
আপুর প্রত্যেকটা লেখার মধ্যে ভিন্ন মাত্রার স্বাদ পাই...
really→→
ধন্যবাদ।
আপু খুব মন খারাপ করা লেখা। ইস তোমার মত মজার শৈশব যদি আমার থাকত
আমার শৈশব খুব বেশি মজার না। কিন্তু আমি মজার স্মৃতিগুলো মনে রেখেছি আর খারাপগুলো শিফট ডিলেট।
এই লাইনগুলো সম্পর্কে একটা কথাই বলা যায়- 'একলা হলে এই লাইনগুলোই আমরা হাতড়ে বেড়াই, কিন্তু খুজে পাই না।' লেখাটায় লাইনগুলো আছে বলেই পুরোটা পড়া সার্থক হয়েছে।
মন্তব্য করুন