কথপোকথন
সকাল থেকেই তাথৈ এর মন ভাল নেই। মাঝে মাঝে দিনটা এত বিষণ্ণভাবে শুরু হয় যে ঘুম থেকে উঠেই রাজ্যের ভাল না লাগা এসে মনকে আচ্ছন্ন করে রাখার জন্য যথেষ্ট। একটানা শুনে চলছে লিওনেল রিচির সেই বিখ্যাত গান-
হ্যালো, ইজ ইট মি ইউ লুকিং ফর
কজ আই ওন্ডার হোয়্যার ইউ আর
এ্যান্ড আই ওন্ডার হোয়াট ইউ ডু
আর ইউ সামহোয়্যার ফিলিং লোনলি
অর ইজ সামওয়ান লভিং ইউ
টেল মি হাউ টু উইন ইওর হার্ট
ফর আই হ্যাভন্ট গট আ ক্লু
বাট লে মি স্টার্ট বাই সেয়িং
আই লভ ইউ।
শুক্র, শনিবার দুটো এজন্যই ভাল লাগেনা। কিচ্ছু করার থাকেনা। সপ্তাহের পাঁচদিন নাগরিক ব্যস্ততা শেষে শুক্রবারটা তবু আরাম আয়েশেই পার করা যায়। কিন্তু বিপত্তি বাঁধায় শনিবারটা। আরাম আয়েশও তখন কিরকম ক্লান্তিকর মনে হয়। ইচ্ছে হয় দূরে কোথাও চলে যেতে। কিন্তু কই আর যাবে সে! তার যে যাওয়ার কোন জায়গা নেই! তাই ঘুম থেকে উঠে এক কাপ চা হাতে নিয়ে বারান্দায় পায়চারি করতে করতে শুনতে পায় মোবাইল ফোনের অবিরত বেজে চলার শব্দ।
- হ্যালো, বান্দর।
- কি চাস?
- তোর কাছে আর কি চাবো? তোর কি কিছু দেয়ার ক্ষমতা আছে নাকি?
- মানে কি? ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুললি বলে মনে হইলো?
- মানে কিছুই না। তোর কাছ থেকে একটু সময় চাই। আড্ডা মারবো। দেখা করতে পারবি আজকে?
- পারবো। সকাল থেকে একটু বেড়াতে যাওয়ার জন্য অস্থির লাগতেসিল দোস্ত। থ্যাঙ্ক ইউ।
- থাক আর ফর্মালিটিজ করতে হবেনা। কোথায় আসবি? ক্যাম্পাসে?
- না। ক্যাম্পাসে যাবনা। আমি এখন আর ওখানে যাইনা।
- ঢং করিস নাতো। আমি ক্যম্পাস ছাড়া আর কিছু চিনিনা। চল আজকে আইবি এর লনে যেয়ে বসে থাকি।
একটু কিছুক্ষণ চিন্তা করে তাথৈ ক্যম্পাসে যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেল। বহুদিন সে ক্যাম্পাসে যায়না। আগে আইবিএর লনে বসতে না পারলে ওদের দম বন্ধ হয়ে যেত। আর এখন যতখানি সম্ভব সে ক্যাম্পাস এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। আজকে এতদিন বাদে অমি ক্যম্পাসে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছে। ক্ষতি কি গেলে! বেলা ১২ টার সময় ওরা ছবির হাটে থাকবে বলে দুজনেই ফোন রেখে দিল।
অনেকদিন বাদে তাথৈ ক্যাম্পাসে আসায় সব কিছু কেমন নতুনের মত ঠেকে। পুরনো, দরিদ্র, জরাজীর্ণ ক্যম্পাসটাকে অনেকদিন না দেখার কারণে তার কাছে বুর্জোয়া শ্রেণীর বলে মনে হয়। ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় অমি চলে আসলে সে বলে, "ক্যাম্পাসতো আর প্রলেতারিয়েত নাই, শাসক শ্রেণীর গন্ধ পাই"। শুনে অমি হেসে বলে, "আমাদের সেই কমিউনিস্ট পার্টি! কার্ল মার্ক্স, শ্রেণী সংগ্রাম, কাস্তে-হাতুড়ি"!
অমি আর তাথৈ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সাথে পড়েছে। একই ডিপার্টমেন্ট না হলেও পড়াকালীন সময়ে ওদের মধ্যে খুব ভাল বন্ধুত্ব ছিল। মাঝখানে জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে অনেকদিন দুজনের মধ্যে কোন যোগাযোগ না থাকলেও বন্ধুত্বটা এখনও সেই আগের মতোই আছে। অমি মাঝে মাঝে ফোন করে তাথৈ এর খোঁজ- খবর নেয়। ঠিক সেরকমভাবেই সকালে ফোন দিয়ে দুই বন্ধুতে এই ঘুরতে বের হওয়া।
- কিরে, মুখ এরকম কাইঞ্জা বানায় রাখসিস ক্যান?
- আমার মুখ এমনই।
- আগে না তুই খুব সাজুগুজু দিতি? তোর ক্লাসের মেয়েরা আবার পরের দিন তোরে নকল করে সেই সাজ দিয়ে আসতো?
- হুম। এখন আর সাজু দেইনা।
- চল, তোরে নিয়ে দুপুরে কোথাও খেতে যাই দোস্ত। তুই ছোটবেলায় ম্যালা খাওয়াইসস। ম্যালা টাকা নিসি আমরা তোর কাছ থেকে।
- নাহ। থাক। খেতে যাবোনা।
- কেন যাবি না? চল কেএফসি যাই।
- কেএফসি যাবোনা। আমি এখন আর কোলস্লো খাইনা।
- তাইলে পিজা হাট চল।
- না। স্ট্রবেরি রোমান্সও এখন আর খাই না।
- তাইলে চিকেন কিং?
- আমার সিরকা দেওয়া সালাদ খেতে কোন দিনও ভাল লাগেনা।
- তাইলে কই যাবি? হেলভেশিয়া?
- হেলভেশিয়ায় খেয়ে একদিন থুথু দিয়ে আসছি।
- তাইলে চল তুই আর আমি আজকে আইবিএতে শামসু মামার হলুদ খিচুড়ি খাই।
- হলুদ খিচুড়ি খাবোনা।
ঠিক সেই সময় অমির খুব কাছের বন্ধু তারেকের ফোন আসে। সেটা দেখে তাথৈ বলে,
- তুই এখনো তারেকের ন্যাদা ছাড়তে পারস নাই?
- ন্যাদা মানে কি?
- যেটা ধরে আছিস সেটাই।
- কি ধরে আছি?
- ন্যাদা।
- তুই এসমস্ত অদ্ভুত ওয়ার্ড কই পাস?
- এটা আমার নিজস্ব ডিকশেনারি ওয়ার্ড।
- একটা ডিকশেনারি বের করতে হবে। ফ্রম তাথৈ টু বাংলা ল্যাঙ্গুয়েজ। সেখানে বিশিষ্ট ভাষাবিদ তাথৈ এর নিজস্ব বানানো ওয়ার্ডসহ এর বাংলা অর্থ দেয়া থাকবে।
এরপর দুই বন্ধু মিলে রাজ্যের গল্প শুরু হলো। রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, নারীবাদ, চাকরি, ব্যবসা, পড়ালেখা, পরিবার, সমাজ, রাস্ট্র, আন্তর্জাতিক, খেলাধুলা, গান, সিনেমা, বিসিএস, রাফা কেন এখন ভাল খেলতে পারছেনা, “হ্যাপী নিউ ইয়ার” কেন এত্ত বেশি বাজে, সাকার কি ফাঁসি হবে কিনা, কেন তাথৈ এর বিয়ে হবেনা, বিদেশে পড়তে যাওয়া ঠিক কিনা, অমির কেন এখন ফ্যামিলি থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া উচিত, এখনো কেন আমাদের মধ্যে এত সঙ্কট ইত্যাদি এমন কোন বিষয় নাই যা নিয়ে তাদের বলার কিছু নাই। ধুমায়া আড্ডা আর চা-বিড়ি খেতে খেতে দুই বন্ধুতে আবার মাঝে মাঝে মতের মিল না হলে ঝগড়াও বেঁধে যাচ্ছিল। এরকম আড্ডা চললো দুপুর সাড়ে তিনটা পর্যন্ত। এরপর যখন দুজনেরই পেট ক্ষিদায় মোচড় দিল তখন ওরা গাউসুলের মামা-ভাগ্নের দোকানে গিয়ে একটা ঢ্যালঢ্যালা তরকারি দিয়ে ভাত খেয়ে ফেললো। ভাত খেয়ে তাথৈ আজ বহুদিন পর একটা পানও খেল। এরপর অমি বললো,
- তোর মন ভাল হইসে?
- আমার আবার মন খারাপ ছিল কখন?
- সকাল বেলায়ই তো দেখলাম যে মন খারাপ।
- জানিস কি হইসে?
- কি হইসে?
- আমার একটা কলিগ। নাম মারুফ ভাই। উনি কি বলসে?
- কি বলসে?
- উনি বলসে, পৃথিবীতে জেন্ডার চার রকম। এক, মাসক্যুলিন; দুই, ফেমিনিন; তিন, ট্রাঞ্জেন্ডার; আর চার, তাথৈ।
- হাহাহাহাহাহাহাহা। উনি তো ঠিকই বলসে। তোর মধ্যে কি মেয়েসুলভ কোন আচরণ আছে?
- কেন? সবাইকে কি আমার ফেমিনিনিটি দেখাতে হবে?
- না। সবাইকে দেখাতে হবেনা।
- উনি নাকি চার বছর আমার সাথে কাজ করে বুঝে নাই যে আমি একটা মেয়ে!
- ঢাকা শহরে মেয়েরা যেতে পারে এমন কয়টা বারের নাম জানিস?
- একটাও না।
- তাইলে তুই ফেইল।
- মানে কি?
- তুই কোন একটার নাম জানলে তোরে সেখানে নিয়ে গিয়ে মদ খাওয়াতাম। যেহেতু জানিস না, ফেইল মারছিস, সুতরাং খাওয়াবোনা।
- এটা কোন কথা? না জানি তো কি হইসে? গুগল মামা আছে। তারে জিজ্ঞেস করলেই সে বলে দিবে।
- আচ্ছা ঠিক আছে, বের কর। কিন্তু শর্ত একটাই, অন্য কারো সাথে নাচানাচি করতে যাবিনা।
- আচ্ছা, ঠিক আছে।
তারপর ওরা দুইজন একটা বারে গিয়ে শিভাজ রিগাল খেল। তাথৈ এর দিকে সবাই ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছিল দেখে সে খুব মজা পেল এ্যান্ড অ্যাজ ইউজ্যুয়াল ওর সাথে দোকানের লোকজনের খুব অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই খাতির হয়ে গেল। ততক্ষণে অনেক রাত হয়ে গেছে। বাসায় ফিরতে হবে। তাথৈ অমিকে বললো, “অমি আজকে আমাকে একটু বাড়ি পৌঁছে দিবি? আমাকে অনেক দিন কেউ বাড়ি পৌঁছে দেয়না। আমার খুব ইচ্ছে করে”। শোনামাত্রই অমি একটা রিকশা নিল তাথৈ এর বাসার উদ্দেশ্যে। টুনটুন করে খালি রাস্তায় রিকশা করে যাওয়ার সময় তাথৈ বকবক করতে করতে অমির মাথা খেয়ে ফেলছিল।
- তুই কি জানিস, আমার ডান কানটা ব্যথা হয়ে গেছে?
- ক্যান?
- এই যে, ডান দিকে বসে কন্টিনিউয়াসলি বকবক করে যাচ্ছিস, তাই।
- ওহ, আমি তো কথাই বলিনা।
- তুই কোন কথাই বলিস না। রাইট?
- হুম।
- তাথৈ একটা রিকোয়েস্ট করি, রাখবি?
- কি?
- জীবনটাকে নতুন করে শুরু কর। বাইরে চলে যা। তুইতো স্কলারশীপ পাবি। বাইরে যেয়ে ঘুরে আয়।
- তার আর দরকার নাই।
- কেন?
- এখন আর যেয়ে কি করবো? যে কারণে যেতে চাইতাম সেই কারণটাই যে এখন আর নাই। নতুন করে চাইলেই কি আর শুরু করা যায় সবকিছু?
- দেখিস, তোরই কিছু হবেনা। কিন্তু পৃথিবীর কেউ তোর জন্য অপেক্ষা করবেনা। তোকে ফেলে সবাই সামনে এগিয়ে যাবে। শুধু তুই পড়ে থাকবি এসব ফালতু ইমোশন নিয়ে।
- থাক না। আমি না হয় ব্যর্থদের দলেই নাম লিখাবো।
- তোর জায়গায় আরেকজন আসবে। সে তাকে ভালবাসবে, বিয়ে করবে, সন্তান হবে, সংসার করবে। তোর কথা কি কেউ মনে রাখবে রে পাগল? তোকে কেউ তখন আর মনে রাখবেনা। তুই তোর লাইফটাকে নষ্ট করিস না প্লীজ।
- আচ্ছা হঠাত করে কোন একদিন যদি শুনিস, আমি সুইসাইড করেছি। কি করবি?
- কিছুই করবোনা। প্রথমে অবাক হব, তারপর দুই-তিনদিন খারাপ লাগবে। এরপর সব ভুলে যাব। তাথৈ নামে যে আমার একটা বন্ধু ছিল সেটাই হয়তো কোন একদিন আর মনে থাকবেনা। মাঝখান থেকে তুই মরার সময় কষ্ট পাবি।
- সেটাই তো ভাল। রোজ রোজ একবার করে মরার চেয়ে একটু কষ্ট হলেও একেবারে মরে যাওয়াটাই কি ভাল না? আমি না হয় নতুন করে না’ই শুরু করলাম।
প্রথমেই কনগ্রাচুলেশন।
এত রাতে পোষ্ট দেয়ার জন্য। আগে পড়ে নিই, তারপর লেখা নিয়ে কথা হবে। কিল/দিল দেখছি পিসিতে, ব্লগে চোখ বুলাতেই দেখি তোমার লেখা। গুড জব এন্ড গুড নাইট!
তোমার কি এখনো পড়া শেষ হয় নাই?

কেবল পড়া শেষ হইলো। ঘুম থেকে উঠলামই একটু আগে।
গল্পটা খুব চমৎকার, তবে কেমন কেমন জানি জীবন থেকে নেয়া গন্ধ পাই। বাঙ্গালী বেকারের মন তো, সবকিছুতেই নিজের মতো করে এডপ্ট করি। লিখছো এত কষ্ট করে তাতেই আমি অনেক খুশী। তোমার লেখা কিংবা নিজের লেখার কি হাল তা দেখার জন্যই এখন এবিতে আসতে হয়।
তোমার তেলের উপরেই তো টিকে আছি দোস্ত।
ইরাম ইন্ডিং দিছো ক্যান?? কইষা মাইনাস!!
এরকম আড্ডা দেওয়ার মত মানুষ কইমা গেছে অনেক,
সবাই বড় হইয়া যাইতাছে মনে হয়। ভাল্লাগে না।
ভাল হইসে। ইরাম এন্ডিং হইসে।
আড্ডা চাইলে দেয়া যায়। আমার কুন অসুবিধা নাইক্কা।
তুমার ছুটি থাকে কবে?
শুক্র, শনি।
ঠিকাছে,
শান্ত ভাই মারফত
যোগাযোগ
করবো নে একদিন।
শেষ পরিনতি মরা জেনেও এতো আননদে মানুষই থাকতে পারে
(
আমারও খুব আড্ডা দিতে ইচ্ছে করছে, ইচ্ছে করছে আবার ইউনিভার্সিটিতে ফিরে যাই
লেখা ভাল্লাগছে
তাথৈ একসময় ভুল বুঝতে পারবে আশা করি
আমাদের সবার জীবনই মাঝে মাঝে এমন থেমে যায়
তবে একসময় সব ঠিক হয়ে যায়
শেলী তো বলেছেনই 'ইফ উইন্টার কামস, ক্যান স্প্রিং বি ফার বিহাইন্ড?'
মন্তব্য করুন