বিলাসী (২০১৩) - ২
মৃত্যুঞ্জয় আমাকে চিনিতে পারিয়া বলিল, কে, ন্যাড়া?
বলিলাম, হুঁ।
মৃত্যুঞ্জয় কহিল, ব’সো।
মেয়েটা ঘাড় হেঁট করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। মৃত্যুঞ্জয় দুই-চারিটা কথায় যাহা কহিল, তাহার মর্ম এই যে, প্রায় দেড়মাস হইতে চলিল সে শয্যাগত। মধ্যে দশ-পনরো দিন সে অজ্ঞান অচৈতন্য অবস্থায় পড়িয়া ছিল, এই কয়েকদিন হইল সে লোক চিনিতে পারিতেছে এবং যদিচ এখনো সে বিছানা ছাড়িয়া উঠিতে পারে না, কিন্তু আর ভয় নাই।
মৃত্যুঞ্জয় কহিলো - ব্লগে যাহারা সকাল সন্ধ্যা মানবতার কথা বলে, ধর্মের কথা বলে, সুশীল ব্লগার - তাহার কেহই তাহাকে দেখিতে আসে নাই। সেই রোগীকে এই বনের মধ্যে একাকী যে নাস্তিকের মেয়েটি বাঁচাইয়া তুলিবার ভার লইয়াছিল, সে কতবড় গুরুভার! দিনের পর দিন, রাত্রির পর রাত্রি তাহার কত সেবা, কত শুশ্রূষা, কত ধৈর্য, কত রাত-জাগা! সে কত বড় সাহসের কাজ! কিন্তু যে বস্তুটি এই অসাধ্য-সাধন করিয়া তুলিয়াছিল তাহার পরিচয় যদিচ সেদিন পাই-নাই, কিন্তু আর একদিন পাইয়াছিলাম।
ফিরিবার সময় মেয়েটি আর একটি প্রদীপ লইয়া আমার আগে আগে ভাঙ্গা প্রাচীরের শেষ পর্যন্ত আসিল। এতক্ষণ পর্যন্ত সে একটি কথাও কহে নাই, এইবার আস্তে আস্তে বলিল, রাস্তা পর্যন্ত তোমায় রেখে আসব কি?
বড় বড় আমগাছে সমস্ত বাগানটা যেন একটা জমাট অন্ধকারের মত বোধ হইতেছিল, পথ দেখা ত দূরের কথা, নিজের হাতটা পর্যন্ত দেখা যায় না। বলিলাম, পৌঁছে দিতে হবে না, শুধু আলোটা দাও।
সে প্রদীপটা আমার হাতে দিতেই তাহার উৎকণ্ঠিত মুখের চেহারাটা আমার চোখে পড়িল। আস্তে আস্তে সে বলিল, একলা যেতে ভয় করবে না ত? একটু এগিয়ে দিয়ে আসব?
মেয়েমানুষ জিজ্ঞাসা করে, ভয় করবে না ত? সুতরাং মনে যাই থাক, প্রত্যুত্তরে শুধু একটা ‘না’ বলিয়াই অগ্রসর হইয়া গেলাম।
সে পুনরায় কহিল, বন-জঙ্গলের পথ, চারিদিকে নানান দলের ক্যাডার থাকতে পারে , ছাগু থাকিতে পারে, পুলিশ থাকিতে পারে - একটু দেখে দেখে যেয়ো।
সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়া উঠিল, কিন্তু এতক্ষণে বুঝিলাম উদ্বেগটা তাহার কিসের জন্য এবং কেন সে আলো দেখাইয়া এই বনের পথটা পার করিয়া দিতে চাহিতেছিল। হয়ত সে নিষেধ শুনিত না, সঙ্গেই যাইত, কিন্তু পীড়িত মৃত্যুঞ্জয়কে একাকী ফেলিয়া যাইতেই বোধ করি তাহার শেষ পর্যন্ত মন সরিল না।
এই প্রসঙ্গে অনেকদিন পরের একটা কথা আমার মনে পড়ে। এক ব্লগার কে দেখিতাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গ আসিলেই কহিতো - " দেশের এত খারাপ অবস্থা, শেয়ার বাজার ধ্বংস হইয়া যাইতাছে, সকল টাকা লুটপাট হইয়াছে, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হইয়াছে, হলমার্ক টাকা মারিয়া দিয়াছে, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা উন্নতি হয় নাই, আর তুমি আসিয়াছো বিচার নিয়া। এসব হুজুর দের বিচারের যাহারা দাবী করিতেছে সকলেই নাস্তিক, তাহাদের লিস্ট করিতেছি, সময় হইলে ব্যবস্থা লইবো " ।
কিন্তু দুঃখটা তাঁহার তুচ্ছ করিয়া দেখানও আমার উদ্দেশ্য নহে। কিংবা তাহা খাঁটি নয় এ কথা বলাও আমার অভিপ্রায় নহে। কিংবা একজনের ব্যবহারেই তাহার চূড়ান্ত মীমাংসা হইয়া গেল তাহাও নহে। কিন্তু এমন আরও অনেক ঘটনা জানি, যাহার উল্লেখ না করিয়াও আমি এই কথা বলিতে চাই যে, দেশে কাঠালপাতার সংকট অচিরেই বাড়িবে।
প্রায় মাস-দুই মৃত্যুঞ্জয়ের খবর লই নাই। যাঁহারা আইটি পল্লী দেখেন নাই, কিংবা ওই ফেসবুকের জানালায় মুখ বাড়াইয়া দেখিয়াছেন, তাঁহারা হয়ত সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিবেন, এ কেমন কথা? এ কি কখনো সম্ভব হইতে পারে যে অত-বড় অসুখটা চোখে দেখিয়া আসিয়াও মাস-দুই আর তার খবরই নাই? তাঁহাদের অবগতির জন্য বলা আবশ্যক যে, এ শুধু সম্ভব নয়, এই হইয়া থাকে। একজনের বিপদে পাড়াসুদ্ধ ঝাঁক বাঁধিয়া উপুড় হইয়া পড়ে, এই যে একটা জনশ্রুতি আছে, জানি না তাহা সত্যযুগের পল্লীগ্রামের ছিল কি না, কিন্তু একালে ত কোথাও দেখিয়াছি বলিয়া মনে করিতে পারি না। তবে তাহার মরার খবর যখন পাওয়া যায় নাই, তখন সে যে বাঁচিয়া আছে, এ ঠিক।
এমনি সময়ে হঠাৎ একদিন কানে গেল, মৃত্যুঞ্জয়ের সেই বাগানের অংশীদার খুড়া ফেসবুকে তোলপাড় করিয়া বেড়াইতেছে যে, গেল—গেল, দেশটা এবার রসাতলে গেল! সুশীল ব্লগার বলিয়া সমাজে আর তাঁর মুখ বাহির করিবার জো রহিল না—অকালকুষ্মাণ্ডটা একটা নাস্তিকের মেয়ে নিকা করিয়া ঘরে আনিয়াছে। আর শুধু নিকা নয়, তাও না হয় চুলায় যাক, তাহার হাতে ভাত পর্যন্ত খাইতেছে! দেশে যদি ইহার শাসন না থাকে ত বনে গিয়া বাস করিলেই ত হয়!
তখন ছেলে-বুড়ো সকলের মুখের ঐ এক কথা,—অ্যাঁ—এ হইল কি? কলি কি সত্যই উলটাইতে বসিল!
(চলিবে)
কলি যুগে যুগে আসে ভাই, তবে ফুটে উঠা হয়না কখনো । পদতলে পিষ্ট হয়ে ধুলোয় আশ্রিত হয় ।
সময় বড় বেয়াদব ! আমরা কি পিঠ বাচানোর চেষ্টা করবো নাকি ভাইদের পাশে দাড়াবো ?
সুন্দর লেখা । ধন্যবাদ ।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ ভাই।
জোস হইতেছে তো!
সাথে আছি। অসাধারণ হচছে
সাথে থাকার জন্য
দারুন চলতেছে।
এই সিরিজের টাইমিংটা পারফেক্ট হইছে।
ইয়ে উলটা কইরা দেখো। টাইম দেইখ্যা সিরিজ শুরু হইছে।
সুশীল যেনো কারা!!!
কবি এখানে নীরব
দারুণ
ধন্যবাদ ভাই।
চমৎকার হচ্ছে, চলুক।
ধন্যবাদ
দারুন!
মন্তব্য করুন