বিলাসী (২০১৩) - ৩
খুড়া বলিয়া বেড়াইতে লাগিলেন, এ যে ঘটিবে, তিনি অনেক আগেই জানিতেন। তিনি শুধু তামাশা দেখিতেছিলেন; কোথাকার জল কোথায় গিয়া মরে! নইলে পর নয়, প্রতিবেশী নয়, আপনার ভাইপো! তিনি কি ফেসবুকে রিপোর্ট করিতে পারিতেন না? তাঁহার কি ব্লগে পোস্ট দেবার ক্ষমতা ছিল না? তবে কেন যে করেন নাই, এখন দেখুক সবাই। কিন্তু আর ত চুপ করিয়া থাকা যায় না! এ যি সুশীল সমাজের নাম ডুবিয়া যায়! আস্তিকদের মুখ পোড়ে !
তখন আমরা সুশীল সকল লোক মিলিয়া যে কাজটা করিলাম, তাহা মনে করিলে আমি আজও লজ্জায় মরিয়া যাই। খুড়া চলিলেন সুশীল-বংশের অভিভাবক হইয়া, আর আমরা দশ-বারোজন সঙ্গে চলিলাম আস্তিকের বদন দগ্ধ না হয় এইজন্য।
মৃত্যুঞ্জয়ের পোড়ো-বাড়িতে গিয়া যখন উপস্থিত হইলাম তখন সবেমাত্র সন্ধ্যা হইয়াছে। মেয়েটি ভাঙ্গা বারান্দায় একধারে ব্লগ লিখিতেছিল, অকস্মাৎ লাঠিসোঁটা হাতে এতগুলি লোককে উঠানের উপর দেখিয়া ভয়ে নীলবর্ণ হইয়া গেল।
খুড়ো ঘরের মধ্যে উঁকি মারিয়া দেখিলেন, মৃত্যুঞ্জয় শুইয়া আছে। চট করিয়া শিকলটা টানিয়া দিয়া, সেই ভয়ে মৃতপ্রায় মেয়েটিকে সম্ভাষণ শুরু করিলেন। বলা বাহুল্য, জগতের কোন খুড়া কোনকালে বোধ করি ভাইপোর স্ত্রীকে ওরূপ সম্ভাষণ করে নাই। সে এমনি যে, মেয়েটি নাস্তিকের মেয়ে হইয়াও তাহা সহিতে পারিল না, চোখ তুলিয়া বলিল, বাবা আমারে বাবুর সাথে নিকে দিয়েচে জানো!
খুড়া বলিলেন, তবে রে! নাস্তিকের আবার নিকে ! ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং সঙ্গে সঙ্গেই দশ-বারোজন বীরদর্পে হুঙ্কার দিয়া তাহার ঘাড়ে পড়িল। কেহ ধরিল চুলের মুঠি, কেহ ধরিল কান, কেহ ধরিল হাত-দুটো—এবং যাহাদের সে সুযোগ ঘটিল না, তাহারাও নিচেষ্ট হইয়া রহিল না।
কারণ, সংগ্রাম-স্থলে আমরা কাপুরুষের ন্যায় চুপ করিয়া থাকিতে পারি, আমরা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে পারি , টিভিতে টক শো তে রাজা উজির মারিতে পারি এইখানে একটা অবান্তর কথা বলিয়া রাখি। শুনিয়াছি নাকি এ সকল মুক্তমনা পুরুষদের মধ্যে একটা কুসংস্কার আছে, স্ত্রীলোক দুর্বল এবং নিরুপায় বলিয়া তাহার গায়ে হাত তুলিতে নাই। এ আবার একটা কি কথা! দেশের সুশীল নামধারী ছাগু এ কুসংস্কার মানে না। আমরা বলি, যাহারই গায়ে জোর নাই, তাহারই গায়ে হাত তুলিতে পারা যায়। তা সে নর-নারী যাই হোক না কেন।
মেয়েটি প্রথমেই সেই যা একবার আর্তনাদ করিয়া উঠিয়াছিল, তারপরে একেবারে চুপ করিয়া গেল। কিন্তু আমরা যখন তাহাকে গ্রামের বাহিরে রাখিয়া আসিবার জন্য হিঁচড়াইয়া লইয়া চলিলাম, তখন সে মিনতি করিয়া বলিতে লাগিল, বাবুরা, আমাকে একটিবার ছেড়ে দাও, আমি ব্লগের পোস্ট টা দিয়ে আসি।
মৃত্যুঞ্জয় রুদ্ধ-ঘরের মধ্যে পাগলের মত মাথা কুটিতে লাগিল, দ্বারে পদাঘাত করিতে লাগিল এবং শ্রাব্য-অশ্রাব্য বহুবিধ ভাষা প্রয়োগ করিতে লাগিল। কিন্তু আমরা তাহাতে তিলার্ধ বিচলিত হইলাম না। স্বদেশের মঙ্গলের জন্য সমস্ত অকাতরে সহ্য করিয়া তাহাকে হিড়হিড় করিয়া টানিয়া লইয়া চলিলাম।
চলিলাম বলিতেছি, কেননা আমিও বরাবর সঙ্গে ছিলাম, কিন্তু কোথায় আমার মধ্যে একটুখানি দুর্বলতা ছিল, আমি তাহার গায়ে হাত দিতে পারি নাই। বরঞ্চ কেমন যেন কান্না পাইতে লাগিল। সে যে অত্যন্ত অন্যায় করিয়াছে এবং তাহাকে গ্রামের বাহির করাই উচিত বটে, কিন্তু এটাই যে আমরা ভাল কাজ করিতেছি, সেও কিছুতে মনে করিলাম না। কিন্তু আমার কথা যাক।
আপনারা মনে করিবেন না, আইটি পল্লী তে উদারতার একান্ত অভাব। মোটেই না। বরঞ্চ বড়লোক হইলে আমরা এমন সব ঔদার্য প্রকাশ করি যে, শুনিলে আপনারা অবাক হইয়া যাইবেন।
এই মৃত্যুঞ্জয়টাই যদি না তাহার হাতে ভাত খাইয়া অমার্জনীয় অপরাধ করিত, তা হইলে ত আমাদের এত রাগ হইত না। আর আস্তিক ছেলের সঙ্গে নাস্তিক মেয়ের নিকা—এ ত একটা হাসিয়া উড়াইবার কথা! কিন্তু কাল করিল যে ঐ ভাত খাইয়া! হোক না সে আড়াই মাসের রুগী, হোক না সে শয্যাশায়ী! কিন্তু তাই বলিয়া ভাত! লুচি নয়, সন্দেশ নয়, পাঁঠার মাংস নয়! ভাত খাওয়া যে অন্ন-পাপ! সে ত আর সত্য সত্যই মাপ করা যায় না! ভাত খাইয়া তাহারা অবাধ মেলামেশা করিবে - হউক স্বামী স্ত্রী কিন্তু এতে তো ইসলাম ধ্বংস হইবে। তাহারা ঘরে বসিয়া হিন্দি টিভি চ্যানেল দেখুক - উহাতে আপত্তি নাই কিন্তু তাই বলিয়া মাথায় কাপড় না দিয়া চলিবে ?
এই ত ইহারই কিছুদিন পরে, মাঝার মুখার্জি উরফে লুঙ্গি মাঝার মনের বৈরাগ্যে যখন নতুন করিয়া ফিরিয়া আসিলেন, তখন নিন্দুকেরা কানাকানি করিতে লাগিল যে, নাস্তিক টা আবার কী না কী বলিয়া ফেলে । সবাইকে অবাক করিয়া লুঙ্গি মাঝার তাহার পুর্বরুপ ঝাড়িয়া ফেলিয়া যেদিন ল্যাঞ্জা বাহির করিয়া ম্যা ম্যা করিতে লাগিলো সেদিনই বুঝিলাম ইহারা মরিয়া গেলে পঁচিয়া যায়, বাঁচিয়া থাকিলে ছাগু হয়।
কিন্তু যাক। ছাগুত্ত্বের কাহিনী আমাদের অনেক আছে। যুগে যুগে সঞ্চিত হইয়া প্রায় প্রত্যেকে বুদ্ধিজিবির দ্বারেই স্তূপাকার হইয়া উঠিয়াছে। এই বঙ্গের অনেক পল্লীতে অনেকদিন ঘুরিয়া গৌরব করিবার মত অনেক বড় বড় ব্যাপার প্রত্যক্ষ করিয়াছি। চরিত্রেই বল, ধর্মেই বল, সমাজেই বল, আর বিদ্যাতেই বল, শিক্ষা একেবারেই পুরা হইয়া আছে; এখন শুধু নাস্তিক বলিয়া কষিয়া গালিগালাজ করিতে পারিলেই দেশটা উদ্ধার হইয়া যায়।
(চলিবে )
দারুণ হইতাছে ভ্রাত ।
এখন শুধু নাস্তিক বলিয়া কষিয়া গালিগালাজ করিতে পারিলেই দেশটা উদ্ধার হইয়া যায়।
খুড়ো, দারুন লিখেচেন। ফাটিয়ে দিয়েছেন একেবারে।
সত্যি কচ্চেন খুড়ো?
অসাধারণ। অন্যগুলোর থেকেও এটা আরো জটিল হয়েছে বস
ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন
জোস হইতেছে ভাইজান!
থ্যাঙ্ক্যু
লিকিতে লিকেতেতো দেকি লেকক হইয়া যাইতাছেন... আগামী বইমেলায় কি আপোনার পুস্তক প্রকাশিত হইবে? এবং তাহার পর ....য়ের বাদ্য বাজিবে? আম্রা আম জনতা কত দিন ভালো মন্দ দুইটা খাওন হইতে বনচিতো রহিয়াছি
কী যে বলেন । এ সব ছাইপাশ লিকে আবার লেকক। তার আবার বই। কলিকাল কলিকাল !!!
সিরাম হয়েছে এই পর্বখানা।
নেক্সটে আরেকটু তাড়াতাড়ি দিলে আরও ভাল লাগব। ভাল থাকেন।
ধন্যবাদ।
তুমিও ভালো থেকো আপন মনে
মন্তব্য করুন