স্মৃতিকাতরতা - ০১
বয়েস বাড়িবার সাথে সাথে পুরনো স্মৃতি গুলো নড়াচড়া করিতে আরম্ভ করিয়াছে অধিক মাত্রায় । একাকী সময়ে শুধু স্মৃতি হাতড়ে ফিরি । হাতড়াতে হাতড়াতে ভাবিলাম, নাহ , এগুলো ব্লগে লিখিয়া যাই। পরে কেহ পড়িয়া জানিতে পারিবে, নতুন প্রজন্মের ছেলেপুলে বুঝিবে আমরা কিরূপ দিনাতিপাত করিয়াছি।
আজিকে লিখিবো টেলিফোন লইয়া। এ যুগের ছেলে মেয়ে , এমনকি ৩/৪ বছরের শিশু মোবাইল ফোন চিনিয়া যায়। আমার ৪ বছর বয়সী ভগ্নি পুত্র মোবাইল নিয়া গেইম বাহির করিয়া গেইম খেলে, বোনের রিং টোন বদলাইয়া নিজের মন মত করিয়া দেয়। আর গোঁফের রেখা আসিবার আগেই মোবাইল হাতে আসিয়া যায় ছোকড়াদের।
তাহারা কী জানিবে আমাদের সময়ের কথা !!! আমাদের সেই ছেলেবেলায় মোবাইল ছিল না, ছিল শুধু "ফোন" বা দূরালাপনি । পরে উহা টিএন্ডটি ফোন , এখন হইয়াছে ল্যান্ড ফোন। যাহা হউক, কয়েক মহল্লায়, পুরো এলাকা জুড়ে মাত্র ২/১ টি ঘরে সেই ফোন দেখা যাইতো। উহা ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া ডায়াল করিতে হইতো। উহার নাম এনালগ ফোন। কে ফোন করিয়াছে, জানিবার উপায় ছিলো না। কোথায় করা হইতেছে সেইটাও দেখিবার উপায় ছিলো না তখন। কল আসিলে ক্র্যাং ক্র্যাং করিয়া রিং হইতো। তাহা থাকিলে সেই বাড়ীর আভিজাত্য কয়েক গুন বাড়িয়া যাইতো। শুধু আভিজাত্য নহে, সমাজে তাহাদের কদর হইতো সেইরূপ। কেননা, বিপদে আপদে তাহার বাড়ী গিয়া ফোন করিতে হইতো, প্রতিবেশীর বাড়িতে কেহ ফোন করিলে তাহার ডাকিয়া দিত। বৈদেশ হইতে ফোন আসিলে , ফোন আসিবার আগেই গিয়া অপেক্ষা করিতে হইতো । অতঃপর বৈদেশ হইতে ফোন আসিলে ওপাশ হইতে শুধাইতো - মুরগি কয়টা ডিম পাড়িয়াছে ?
তবে সকলের বাড়িতে গেলেই যে ফোন করিতে পারা যাইতো, তাহা নহে। কেহ কেউ ডায়াল রিং এর উপর ছোট তালা ঝুলাইয়া রাখিয়া কহিতো - চাবি কর্তা লইয়া গিয়াছে কিংবা গিন্নি লইয়া গিয়াছে কিংবা বাবা মা লইয়া গিয়াছে - এরূপ । যদিও বা কেহ ফোন করিতে সুযোগ প্রদান করিত , তদাপি এমন কিছু কথা শুনাইতো যে পরে আর ফোন করিতে যেন না যাই । প্রতিবেশীর ফোন আসিলে অনেকে রিসিভার তুলিয়া রাখিয়া দিয়া কয়েক মিনিট পরে কহিতো - উহারা বাড়ী নাই। একজনকে দেখিয়াছিলাম, ফোনের পাশে একটা কৌটা রাখিয়া দিতে। পরে শুনিয়াছিলাম ফোন করিয়া উহাতে ফোন বিল জমা দিতেই এই ব্যবস্থা করিয়াছেন। ব্যবস্থা টি খারাপ নহে, ফোন করার সুবিধা দিবে, বিল দিবো না ? শুনিয়াছি, তখন একবার কল করিয়া কেয়ামত পর্যন্ত কথা কহিলে একটি কলের বিল উঠিত । মিনিট বা সেকেন্ড হিসাবে পালস ব্যবস্থা ছিলো না।
তখন ক্রস কানেকশান এর খুব সুদিন ছিলো। কখনো কখনো রিসিভার তুলিলেই ওপাশ থেকে দুই ব্যাক্তির আলাপ শোনা যাইতো, মাঝখান দিয়া আপনিও কথা যোগ করিতে পারিতেন। কিংবা ভুল নম্বরে ফোন চলিয়া যাইতো প্রচুর। যদিও বা ফোন করিতে পারিয়াছেন, ফোনের ভিতর কণ্ঠস্বর এর সহিত ঢেউয়ের শব্দ, বাতাসের শব্দ পাওয়া যাইতো পুরা ফ্রী। মাঝে মাঝে এইসব শব্দের কারণে কণ্ঠস্বর হারাইয়া যাইতো যেন কোথায় !!
আরেকটি বিষয় খুবই ভোগাইতো - তাহা হইলো ফোন ডেড। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ফোন ডেড হইয়া থাকিতো। কেহ কিছুই কহিতে পারিতো না, ফোন অফিস কোন সুরাহা করিতে পারিতো না। কিছু উপরি দিলে ঠিক হইতো অবশ্য। একদা এক পত্রিকায় পড়িয়াছিলাম, মতিঝিলে কাহার বাসায় ফোন ডেড হইয়া ছিলো, টিএন্ডটি অফিসে যোগাযোগ করিয়াও ঠিক করিতে না পারিয়া পরে উক্ত ডেড ফোন এর চল্লিশা করা হইয়াছিল, টিএন্ডটি অফিসের কর্মকর্তা দের না কি সেই চল্লিশাতে দাওয়াত দেয়া হইয়াছিলো।
এনালগ ফোনের পর আসিলো ডিজিটাল ফোন। নম্বরের বাটন চাপিয়া কল করিতে হইতো। ফোন নম্বর গুলি বদলাইলো। পুর্বে ৩৮ দিয়া মিরপুরের নম্বর আরম্ভ হইতো, পরে উহা ৮০ দিয়া শুরু হইলো। ফোন ওয়ালা পরিবারের সংখ্যাও কিছু বাড়িলো । তথাপি ফোন করিবার যন্ত্রণা আগের মতই রহিয়া গেল। তখন ফোন সেট একটি কাঠের বাক্সে বন্ধ করিয়া রাখিয়া কহিতো - চাবি নাই, কেহ না কেহ লইয়া গিয়াছে। তখন মনে হয় বাটন চাপিয়া ফোন লক করার ব্যবস্থা ছিলো না । কাহারো বাসায় শোভা পাইতো কর্ডলেস ফোন। প্রতিবেশীর বাড়িতে গেলে সাথে লইয়া যাইতো, যতনা ফোনের প্রয়োজন তাহার অধিক দেখাইবার প্রয়োজনে।
এ সমস্যা সমাধানে তখন বেশ কিছু ফোন এর দোকান ব্যবসা আরম্ভ করিলো। ৫৫ সেকেন্ডে মিনিট ধরিয়া তাহারা বিল করিতো। কয়েক ক্রোশ দূর হইতে সেখানে গিয়া কল করিতো, আমাকেও যাইতে হইয়াছে বৈকি সেখানে কয়েকবার। কাহারো বাসায় গিয়া ফোন করিবার অনুরোধ করা হইতে দোকানে গিয়া ফোন করা তে বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিতাম। মাঝে মাঝে লাইন ধরিতে হইতো কেননা কেহ কেহ সেই দোকানে বসিয়া , ফোন ধরিয়া প্রেম করিতো ঘন্টার পর ঘন্টা।
দিন বদলাইলো, ফোন আরো সহজলভ্য হইয়া উঠিলো। সেই সাথে বাড়িতে লাগিলো তার চোরদের দৌরাত্ম। তাহারা প্রায়শঃ টেলিফোনের তার চুরি করিয়া লইতো। সেই সময় আমরাও টিএন্ডটি ফোন এর আবেদন করিয়া একখানা ফোন ঘরে তুলিয়াছিলাম। কয়দিন যাইতে না যাইতেই রাতের অন্ধকারে তাহার তার চুরি হইয়া গেল। তার কিনিয়া জোড়া লাগাইলাম। আবার চুরি হইলো। নৈশ প্রহরী কে ধরিলাম - তুমি থাকিতে তার চুরি হয় কী করিয়া? জবাবে সে কহিলো - "স্যার , আমি রাতে ভালো করে চোখে দেখিনা, আর কানেও ভালো করে শুনিনা। " বুঝিলাম, নৈশ প্রহরী হইবার জন্য উপযুক্ত সে।
দিন যায়, ফোন পালটায়। ফোনের রেট পালটাইয়া উহা মিনিট প্রতি পালস হয়। কাহাকে ফোন করা হইতেছে তাহা দেখার সুবিধা ওয়ালা সেট আসিতে থাকে বাজারে, এরপর কলার আইডি ওয়ালা লাইন, সেট আসিলো । এক সময় মোবাইল ফোন আসে। তার ছাড়াই আলাপ করিবার যন্ত্র। এক সময় লক্ষাধিক টাকা খরচ করিয়া ইষ্টকের ন্যায় বৃহৎ মোবাইল সেট লইয়া লোকজন ঘুরাঘুরি করিতে শুরু করে। আভিজাত্য প্রকাশের নতুন পন্থা আসিলো। মিরপুর হইতে মতিঝিলে কল করিলে উহাতে এন ডাব্লিউ ডি বিল আসিতো, ঢাকার বাহিরে গেলে টাকা দিয়া রোমিং অন করাইতে হইতো, কে ফোন করিলো জানিবার জন্য টাকা খরচ করিয়া লিস্ট একটীভ করাইতে হইতো - এরূপ নানাবিধ অত্যাচার লইয়া শুরু করিয়াছিল মোবাইল ফোন।
তারপর ? তারপর তো চখের সামনেই , তাই আর কথা বাড়াইলাম না।
এমন মজা করে টেলিফোনের ইতিহাস খুব ভাল লাগল। আসলেই একেবারে বাস্তব ইতিহাস। মীরপুর আর মোহম্মদপুরের নাম্বার পেতে মেজাজ গরম হয়ে যেত। বাসার ফোন ছিল বাবা মার বেডরুমে। আমাদের ফোন আসা একটি অপরাধের মত ছিল। তবে বাবা/মা বাসায় না থাকলে ফোন নিয়ে ফাজলামী তো কম করিনি। ঢাকার বাইরে কল করতে অনেক টাকা লাগতো তার চেয়ে বড় কথা লাইন পাওয়া যেত না। আর যেখানে একচেঞ্জে ফোন করে লাইন পেতে হত সেতো ভয়াবহ। একচেঞ্জের লোকজন ফোন ধরতোই না।
ট্রাঙ্ক কল এর কথা তো ভুইলাই গেছিলাম। কল বুক কইরা কল করতে হইতো তখন , কত যে প্যাঁড়া । মনে করায়ে দেবার জন্য ধ্যইন্যা
আহা! এনালগ ফোনের দিনগুলি চমত্কার ছিল।
আরেকখানা দারুন সিরিজ শুরু করায় ধন্যবাদ। ভালো থাকেন ভাই।
তুমি তো পিচ্চি, তুমি ক্যামনে পাইলা এনালগ ফোন ?
আহ কি দারুন!
লাইক লাইক লাইক
আহা কি লেখনী
ফিরিয়ে দাও অরন্য ---- লহ এ নগর
টেলিফোন নিয়া লিখিলে একখানি বহি লেখা যাইবে, কি সব দিন ছিলগো ...... বিগগান দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগ (
বিগগান দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগ - ঠিক কইছেন গো খালাম্মা
অসাধারণ একটা লেখা । কি মনে করায় দিলেন সাঈদ ভাই!!! আহারে সেই দিনগুলি !!! পাচ তারা দিলাম ।
পাচ তারার জন্য ১ টা ধ্যইন্যা পাতা
সুপার্ব।
ক্রস কানেকশন জিনিষটা কি এই যুগের পোলাপাইন বুঝলোই না। আহা! ক্রস কানেকশন মিস করি
ক্রস কানেকশান আমিও মিস করি। ফ্রেন্ডরা মিলে শুনতাম ক্রস কানেকশান এর কথা গুলো
ক্রস কানেকশন জিনিষটা কি এই যুগের পোলাপাইন বুঝলোই না। আহা! ক্রস কানেকশন মিস করি...
দারুন লিখছেন ওস্তাদ
ধন্যবাদ ওস্তাদ
দারুন পোষ্ট!
কত্তো অল্পে কত্তো কি বললেন, মনে করাইলেন!
কী কী কমন পড়লো ?
ব্যাপক আনন্দ পাইলাম এই লেখা পড়ে। কারন আমি নিজেও সেই যুগের মানুষ যখন ফোনের অবস্থা এমন ছিল। ক্রস কানেশন এ প্রেম করে বিয়ে হইসে এমন ঘটনাও দেখেছি।
তবে একটা কথা লিখতে ভুলে গেসেন তা হল এক সময় ঢাকা শহরে নীল রঙের পে ফোন ছিল যেটা ব্যবহার করতে তিন মিনিটের জন্য একটা বাঘ মার্কা সিকি ঢুকাতে হোতো। আমি তখন সুর্যসেন হলের আবাসিক ছাত্র। আমাদের হল গেটে এই পে ফোন লাগলো। দেখে মনে হোল যেন আলাদিনের প্রদীপ। সবাই সিকি পকেটে নিয়ে ঘুরি। ফোন বুথ খালি দেখলেই খামোকা কোথাও ফোন করে কথা বলতাম। শান্ত ভাই নামের একজন দুই পকেট ভর্তি সিকি নিয়ে ওনার প্রেমিকার সাথে কথা বলতে শুরু করত । তখন সবাই বুঝতো আজ আর কারো কোন চান্স নাই কথা বলার।
একদিন দখি দেয়াল খালি ফোন টা নাই। কি হোল খোঁজ নিয়ে জানা গেলো হলের কোনো মাস্তান ফোন সেট খুলে নিজের রুমে নিয়ে লাগিয়েছে।
কী করে যেন এই ফোনের কথা ভুইলা গেছিলাম। আমাদের কলেজেই ছিলো কয়েন দিয়া ফোন সিস্টেম। কত কথা কইছি ফোন দিয়া , ভাবতেই (
ক্রস কানেকশন
ভালই স্মৃতিকাতর করে দিলেন!
ক্রস কানেকশনা আর কয়েন বক্সে অয়েন হারানোর দিনগুলোতে আবার ফিরে গেলাম
হ ভাই, লেখার সময় আমিও হারায়ে গেছিলাম
ভাল্লাগসে, বহুত ভাল্লাগসে
আমি দ্বাপর যুগের লোক না, তাও ভাল্লাগসে।
ভাল্লাগসে শুনে প্রীত হইলাম।
মন্তব্য করুন