| সৃষ্টিতে যাপনে কথাশিল্পী মাহবুব-উল আলম |
আজ থেকে ১১২ বছর আগের কথা। সে আমলে আমাদের দেশের সামাজিক বাস্তবতা যেরকম ছিলো, তাতে একজন কৃষকের পুত্র কৃষকই হতো, মৌলভীর পুত্র হতো মৌলভীই। এটাই ছিলো খুব স্বাভাবিক পরিণতি। এর ব্যতিক্রম হওয়াটাই ছিলো বিরল ব্যাপার। কিন্তু ১৮৯৮ সালের ১লা মে চট্টগ্রামের ফতেহাবাদ গ্রামে পিতা মৌলভী নসিহউদ্দিন সাহেবের দ্বিতীয় পুত্র হিসেবে জন্ম নেয়া মাহবুব-উল আলম নামের ছেলেটি পরবর্তীতে মৌলভী তো হলোই না, বরং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ফতেয়াবাদ মিডল ইংলিশ স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে তৎকালীন দেশসেরা কলেজ চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয়ে রীতিমতো লেখাপড়া চালিয়ে যেতে লাগলো। তৎকালীন সামাজিক বাস্তবতায় এটা একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় বৈ কি। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, তাঁর কোন ভাই-ই মৌলভী হন নি। তাঁর অন্য ভাইরা হচ্ছেন শামসুল আলম, দিদার-উল আলম ও ওহীদুল আলম।
যাক্, চট্টগ্রাম কলেজে মাহবুব-উল আলমের পড়ালেখা চলছিলো ভালোই। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে মনোযোগ চলে গেলো যুদ্ধের ময়দানে। যাকে বলা হতো পল্টন। ১৯১৭ সালে ঊনিশের সে তারুণ্য তাঁকে নিয়ে গেলো সেখানেই। যুদ্ধ করতে করতে চলে গেলেন মেসোপটোমিয়া। ১৯১৯-এ সেখান থেকে ফিরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-দৌঁড়ে সহপাঠিদের থেকে পিছিয়ে পড়া অত্যন্ত মেধাবী মাহবুব-উল আলমের শিক্ষাজীবনে আর ফেরা হলো না। কী আর করা ! সোজা কর্মজীবনেই ঢুকে গেলেন। প্রজাতন্ত্রের সাব-রেজিস্টার থেকে কর্মপরিক্রমায় হলেন ডিস্ট্রিক্ট সাব-রেজিস্টার। তারপর ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্টার এবং সবশেষে ইন্সপেক্টর অব রেজিস্ট্রেশন। কিন্তু রক্তে যাঁর মিশে আছে সাহিত্যের বিরল মেধা আর সৃজন-পোকার অহর্নিশ কামড়াকামড়ি, তিনি কি আর শুধু শুধু চাকরি-বাকরিতে সুস্থির থাকতে পারেন ! ফলে হাতের কলমটি কখন যে তার তাণ্ডব শুরু করে দিলো তা হয়তো সৃজনের ঘোরের মধ্যে থেকে তিনি নিজেও ভালো করে টের পান নি। যখন টের পেলেন ততক্ষণে সময়ের জল অনেকদূর গড়িয়ে গেছে।
মাত্র উনিশ বছর বয়সে প্রথম মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় রচিত ‘পল্টনজীবনের স্মৃতি’ (১৯৪০), ‘বর্মার হাঙ্গামা’ (১৯৪০), সাড়া জাগানো আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘মোমেনের জবানবন্দী’ এবং ‘পঞ্চ অন্ন’ (১৯৪৬), সমকালীনতা উত্তীর্ণ আধুনিক শিল্পকর্মরূপে স্বীকৃত ও সমাদৃত উপন্যাসিকা ‘মফিজন’, হাস্য-রসাত্মক গল্প সংকলন ‘গোঁফ সন্দেশ’ (১৯৫৩) সহ ৩৪টিরও অধিক গ্রন্থ সেই সাক্ষ্যই বহন করে। তাঁর ‘মোমেনের জবানবন্দী’ গ্রন্থটি ইংরেজী ও উর্দুতে অনুদিত হয় তখনই। ইংরেজীতে অনুবাদ করেন অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্ত্রী শ্রীমতি লীলা রায় ‘Confessions of a Believer’ নামে (১৯৪৬)। অসাধারণ জীবনদৃষ্টিসম্পন্ন এই বইটি তৎকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যতালিকায়ও অন্তর্ভূক্ত হয়।
সাহিত্য আর সৃজনশীলতা যাঁকে ভালোভাবে পেয়ে বসে, জগতের আর সবকিছুই বুঝি তাঁর থেকে একটু একটু করে আলগা হতে থাকে। মাহবুব-উল আলমের ক্ষেত্রে তা আরো বেশি সত্য হয়ে দেখা দিলো। তাই বুঝি একদিন হুট করে ৩৪ বছরের চাকরিটাই ছেড়ে দিলেন তিনি। প্রজাতন্ত্রের চাকুরি থেকে অবসর নিয়েই ১৯৫৩ সালে মাহবুব-উল আলম ‘জমানা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেন। এটিই চট্টগ্রামের প্রাচীনতম সাপ্তাহিক পত্রিকা। পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে তা ‘দৈনিক জমানা’য় রূপান্তর ও প্রতিষ্ঠিত করেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি যে শুধু নিজেকে সাংবাদিকতায় নিয়োজিত করেন তাই নয়, সম্পাদকীয় বিষয় নির্বাচন ও রচনারীতিতে স্বাতন্ত্র্যের জন্য সাংবাদিকতায়ও রীতিমতো পথিকৃতের মর্যাদা লাভ করেন। এরই মধ্যে রচনা করেন তিনটি ভ্রমণ কাহিনী ইন্দোনেশিয়া (১৯৫৯), তুর্কী (১৯৬০) ও সৌদী আরব (১৯৬০)। এ ছাড়াও তাঁর (মৃত্যু ৭ই আগষ্ট ১৯৮১) মরণোত্তর প্রকাশিত হাস্য-রসাত্মক গল্পসংকলন ‘প্রধান অতিথি ও তাজা শিংগী মাছের ঝোল’, ‘রঙবেরঙ’, ‘পল্টনে’ এবং ‘সাত সতেরো’ সে সময়ে পাঠক মহলে যথেষ্ট সাড়া জাগায়। অন্নদাশঙ্কর রায়ের সাথে দীর্ঘদিনের পত্রালাপের প্রেক্ষিতে বাংলা সাহিত্য ঋদ্ধ হয় আরো দুটো পত্র-সাহিত্য গ্রন্থ পেয়ে- ‘আলাপ’ ও ‘আলাপ: নবপর্যায়’।
কথাসাহিত্য চর্চার পাশাপাশি অত্যন্ত মননশীল ও শ্রমসাধ্য ইতিহাস রচনায় নিজেকে ব্রতী রেখেছেন এমন নজির বাংলা সাহিত্যে খুব একটা চোখে পড়ে না আমাদের। অথচ কী বিস্ময়করভাবে দেখি অভূতপূর্ব প্রকরণ, প্রক্রিয়া ও উপকরণ মিশিয়ে তিন খণ্ডে চট্টগ্রামের ইতিহাসের এক সমৃদ্ধ জগতের উপহার তুলে ধরেন পাঠকের হাতে- পুরানা আমল, নবাবী আমল ও কোম্পানী আমল নামে। আরো বিস্ময় অপেক্ষা করে জীবদ্দশায় সর্বশেষ যে দুঃসাধ্য কাজটি করে গেলেন তিনি, তা দেখে ! সাত বছরের একাগ্র সাধনা ও একক প্রচেষ্টায় সর্বাধিক তথ্যসমৃদ্ধ চার খণ্ডে রচিত ১২০০ পৃষ্ঠার বাঙ্গালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত, যার অসামান্য শিরোনাম- ‘রক্ত আগুন অশ্রুজল: স্বাধীনতা’। অশ্রু যখন কাব্যিক ব্যাপ্তি নিয়ে অশ্রুজল হয়ে ওঠে, এর নৈর্ব্যক্তিক গভীরতা স্বাধীনতা শব্দটির সাথেই শুধু মাখামাখি হয় না, স্বাধীনতার বোধটিও কেমন যেন বেদনাসিক্ত হয়ে ওঠে আমাদের বুকের কোণে। ভাবতেই অবাক লাগে, যে বয়সে একজন ব্যক্তি-মানুষ ব্যবহারিক জীবন থেকে নিজকে বিশ্লিষ্ট করে অসহায় সীমাবদ্ধতায় আটকে নিজেকে গুণ্ঠিত করে নেয় আত্মজৈবনিক স্মৃতিমত্ততায়, সেই বয়সে এসে কী করে একজন মাহবুব-উল আলম গোটা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়টাতে হেঁটে হেঁটে পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য কুড়িয়ে এতো বিশাল ইতিহাস গ্রন্থের কাঁচামাল সংগ্রহ করেন ! ভাবতেই গা শিহড়ে ওঠে ! নামের পাশে একটা ‘ইতিহাসবিদ’ বিশেষণ ধারণ করতেও এতো বিশাল কর্মকুশল আয়োজনের প্রয়োজন পড়ে না ! কিন্তু তাঁর তো ইতিহাসবিদ জাতীয় কোনো বিশেষণের চাওয়া ছিলো না। দরকার ছিলো আগুনের পরশমণির ছোঁয়ায় ভেতরে ধারণ করা ব্যক্তিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতার উন্মুক্ত জানালা দিয়ে যত কঠিনই হোক সত্য আর সুন্দরের সুবাতাস বইয়ে দিয়ে এই জনগোষ্ঠিকে ইতিহাসমনস্ক করে তোলা। কতোটা যোগ্যতা, সামর্থ আর কঠিন আত্মবিশ্বাস থাকলে এরকম একক ও বিশাল একটা কাজের পরতে পরতে নিবিড় কুশলতা ছুঁয়ে থাকে, তা বিস্ময়কর বৈ কি !
‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে…’, রবীন্দ্রনাথের এই সঙ্গীতটিকে ঋদ্ধি ও মননে ধারণ করেছিলেন বললে হয়তো ভুলভাবে বলা হবে ; বলতে হবে, ওই সঙ্গীতের মন্থিত জীবন-রসের সবটুকু মাধুর্যকেই বুকে আগলে নিয়েছিলেন তিনি। শুধু কি আগলেই নিয়েছিলেন ? আগুনের ওই পরশমণির অনিন্দ্য ছোঁয়ায় অগ্নিশুদ্ধ হয়ে নিজেকে এমন এক জীবনশিল্পীর মর্যাদায় আলোকিত করে নেন, সমকালীন বাস্তবতায় কী সাহিত্যে কী সাংবাদিকতায় কী চিন্তা-চেতনা-জীবনাচারে সময়ের চেয়েও এক অগ্রবর্তী পুরুষে উত্তীর্ণ হন তিনি। আর সময়ের চেয়ে এগিয়ে গেলে যা হয়, চলনে বলনে যাপনে সহজ সারল্যের প্রকাশ সত্ত্বেও সাধারণের চোখে হয়ে যান দুর্নিবার বিস্ময়, জিজ্ঞাসায় মোড়ানো এক রহস্য পুরুষ ! ক্ষণজন্মা পুরুষ মাহবুব-উল আলম ছিলেনও তা-ই।
তাই ধন্দে পড়তে হয় তাঁর নামের আগে প্রয়োগযোগ্য একক কোনো বিশেষণের খোঁজে। সাহিত্যে মৌলিক চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির জন্য যিনি সর্বোচ্চ পুরস্কার হিসেবে ১৯৬৫ সালে ‘বাংলা একাডেমী পুরস্কার’, ১৯৬৭ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দেয়া পুরস্কার ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স’ এবং ১৯৭৮ সালে ‘একুশে পদকে’ ভূষিত হন, ‘কথাশিল্পী’ বা ‘কথাসাহিত্যিক’ বিশেষণ যে তাঁর একান্ত নিজস্ব শব্দমালার অংশ হয়ে যায়, তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে ! প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ার কর্তৃক আমন্ত্রিত লেখক হিসেবে আমেরিকা সফরে (১৯৫৯ সালে) পাওয়া ‘He is a man of unusual talent’ অভিধা যাঁর স্বীকৃতিপত্রে ঝলমল করতে থাকে, বিশেষণ নিজেও হয়তো বিশেষায়িত হয়ে যায় মাহবুব-উল আলম নামটির সাথে একাত্ম হতে পেরে।
জীবনকে ভেতর থেকে কৌতুকময় দৃষ্টিতে দেখা এবং চতুর্মাত্রিক দৃষ্টিকোণে গভীর উপলব্ধির মধ্য দিয়ে তাকে যাচাই বাছাই করার বিশ্লেষণধর্মী সারস্বত ক্ষমতা সবাই পায় না। কাউকে কাউকে তা অর্জন করতে হয় প্রচুর অধ্যয়ন অধ্যবসায় আর অগ্নিশুদ্ধ জীবনবোধ দিয়ে। মাহবুব-উল আলম তাঁদেরই একজন। পরম হংসের মতো জীবনের সারটুকু ছেঁকে নিয়ে নিজের জন্য জমিয়ে রাখেন নি তা, আমাদের সাহিত্যপাতে ঢেলে দিয়েছেন শিল্পমমত্ব দিয়ে। নিজেকে এই সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির বাইরের কেউ ভাবেন নি বা মানুষ ও সমাজের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত দায়বদ্ধতাকেও গোপন করেন নি কখনো। তাই হয়তো তাঁর সহজাত কৌতুকময়তা দিয়ে নিজেকে সাহিত্যের একজন দিনমজুর হিসেবে আখ্যায়িত করতে একটুও কুণ্ঠাবোধ না করেই নির্দ্বিধায় বলে ফেলেন- ‘… আমি সাহিত্যের দিনমজুর !’ এখানেই তাঁর দায়বোধ কড়ায়গণ্ডায় উশুল করে দিয়ে যান তিনি। কিন্তু উত্তর প্রজন্ম হিসেবে আমরা কি তাঁর কোনো চর্চা করছি ? চাইলেও তাঁর সেই আলোচিত বইগুলো এখন কোথাও পাওয়া যায় না। এবং যতটুকু জানি তাঁর কোন রচনা-সমগ্রও প্রকাশিত হয় নি আজতক। আমাদের এই লজ্জাজনক সীমাবদ্ধতাকে আর কতোকাল অক্ষম পরিতাপ দিয়ে ঢেকে রাখবো আমরা, জানি না।
আমাদের সাহিত্যপাড়ায় বহু অঘা-মঘাকে নিয়েও আলোচনা হতে দেখা যায় বিস্তর। কিন্তু কী আশ্চর্য, একজন ‘unusual talent’ মাহবুব-উল আলম’কে নিয়ে কোন আলোচনা আদৌ কোথাও হয় বলে মনে হয় না। তাহলে বর্তমান প্রজন্ম তাঁর সম্পর্কে জানবে কোত্থেকে ? যাঁর মেধা ও কাজের তুলনায় বহুগুণে তুচ্ছ ও নগন্য কাজ দিয়েও একালের সাহিত্যপাড়ায় রীতিমতো আলোচিত হয়ে ওঠা কোনো বিষয়ই নয়, সেখানে নতুন প্রজন্ম এ সম্পর্কে কিছুই জানে না যে, আমাদের এমন একজন মাহবুব-উল আলম ছিলেন যিনি তাঁর মননশীলতার অনেক বড় ও ঈর্ষণীয় স্বীকৃতি পেয়েও নিজেকে সাহিত্যের একজন দিনমজুর পরিচয় দিতেই ভালোবাসতেন। ব্যক্তি ও কর্মযজ্ঞে কী ছিলেন তিনি- তা জানার দায়বোধ উত্তর প্রজন্ম হিসেবে আমাদের মধ্যে যদি সঞ্চারিত না হয়, এবং তা অর্জনেও যদি অক্ষম হয়ে পড়ি, এই দায়-দায়িত্ব কি এড়াতে পারবো আমরা ? কেননা, আমাদের পরেও আরো প্রজন্ম আসবে এবং আসতেই থাকবে।
৩৪ বছরের চাকুরিকালেই ফাঁকেফোকে লেখালেখির চর্চা আর অবসর গ্রহণ করে লেখা ও প্রকাশনায় পুরোপুরি জড়িয়ে যাওয়া এ মানুষটির স্বচ্ছলতায় কোন ঘাটতি ছিলো না। কিন্তু চট্টগ্রামের কাজির দেউড়ী থেকে বেরিয়ে রোজ হেঁটে হেঁটে শহরময় ঘুরে বেড়ানো এ মানুষটিকে কখনো রিক্সায় চড়তে দেখেছেন এরকম কোন প্রত্যক্ষদর্শী কেউ আছেন কিনা জানা নেই। এক বগলে কতকগুলো বই আর অন্য হাতে ছাতা ধরে চিরকালীন সাদা টুপি পরিহিত এই মানুষটি গোটা চট্রগ্রামবাসীর চোখে এমনই এক আর্কিটাইপ ব্যক্তিত্বের প্রতীকে পরিণত হয়ে গেলেন যে, এর বাইরে তাঁর অন্য কোন প্রতিকৃতি থাকতে পারে তা যেন একেবারে অকল্পনীয় ছিলো। কখনো টাউন বাসের ভীড়ের মধ্যে গুটিশুটি মেরে বসে থাকা সেই বই-বগলে মানুষটি এভাবেই বুঝি অত্যন্ত সঙ্গত ও স্বাভাবিক। কল্পনায় এভাবেই যেন স্পষ্ট দেখা যায় তাঁকে। বড় অদ্ভুত খেয়াল ছিলো বলে জানা যায় তাঁর। বাসের টিকেট, হ্যান্ডবিল কিংবা হাতে নেয়া কোন ঠোঙ্গা ইত্যাদি বিভিন্ন আকার আকৃতি আর ঢঙের উদ্ভট সব কাগজের ফাঁকা পিঠে গুটগুট অক্ষরে লিখে ফেলা কথাগুলোই যখন অবিকৃতভাবে একত্র গ্রন্থিত হয়ে কোন মহার্ঘ রচনার অদ্ভুত পাণ্ডুলিপির চেহারা পেতো, তা হাতে পেয়ে প্রকাশকদের যে কী রকম আক্কেলগুড়ুম অবস্থা হতো, তা ভাবলেই চমকে ওঠতে হয় ! স্রষ্টারা নাকি এরকম খেয়ালিই থাকেন। একেকজনের খেয়াল হয়তো একেকরকম। কিন্তু মাহবুব-উল আলমের মতো এমন বিচিত্র খেয়াল আর কোন লেখকের কোথাও কোনকালে ছিলো কিনা তা বলা দুষ্কর।
এক অস্বাভাবিক জীবনশিল্পী ছিলেন মাহবুব-উল আলম। নিকটজনদেরকে তিনি প্রায়ই বলতেন- ‘তিনটা বিষয় মেনে চলার চেষ্টা করো। এক, বছরে একবার হলেও সমুদ্রের কাছে যাবে ; সমুদ্রের বিশালতার পাশে নিজের ক্ষুদ্রত্ব ও নগন্যতাকে উপলব্ধি করে নিজেকে চিনতে পারবে। দুই, সম্ভব হলে বছরে একবারের জন্য সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টার চূড়ায় উঠবে ; উপর থেকে নিচের ছোট-বড় ভেদাভেদগুলো মুছে কিভাবে সবকিছু সমান হয়ে যায় তা শিখবে। তিন, বছরে অন্তত একটা রাত পূর্ণ জ্যোৎস্নায় কাটাবে ; সূর্যালোকের প্রখর তীব্রতার বিপরীতে চাঁদনির মোহনীয় স্নিগ্ধতায় মানবিক সৌন্দর্যবোধের পরিচর্যা হবে।’
ব্যাখ্যার চেয়ে কথাগুলোর উপলব্ধিজাত অনুভবই বুকের মধ্যে এক অস্বাভাবিক স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দেয়। ব্যক্তি মাহবুব-উল আলম হয়তো আজ সশরীরে আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু জীবনবোধে আচ্ছন্ন এক মননশিল্পী মাহবুব-উল আলমকে আমরা চাইলে বুকে ধারণ করে অনায়াসে মানবিক সৌন্দর্য্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠতে পারি, যদি তাঁর বিস্ময়কর সৃষ্টি ও জীবনবোধসম্পন্ন কথাগুলোকে আমরা নিবিড় চর্চা ও উপলব্ধিতে মেখে নিতে পারি। এটাই হতে পারে জন্মবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রেষ্ঠতম উপায়।
১লা মে জীবন ও কথাশিল্পী মাহবুব-উল আলমের পবিত্র জন্মবার্ষিকী। তাঁর প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের অন্তত ন্যুনতম যোগ্যতাটুকু যেন অর্জন করতে পারি, নগন্য একজন সাহিত্য-মজুর হিসেবে এই আকাঙ্ক্ষাটুকুই ব্যক্ত করছি আজ।
…
ব্লগ পোস্ট করার তাল হারিয়ে ফেলছি সম্ভবত !
' পোস্টে ছবি যোগ করুন' ট্যাবে ক্লিক করে ছবি আপলোডও করলাম, কিন্তু তারপরও কেন জানি এলো না। ফলে লিঙ্ক ব্যবহার করে ছবি জুড়ে দিলাম ঠিকই। তবে সব ছবির তো ইউআরএল লিঙ্ক থাকবে না ! কম্পু ফাইল থেকে তখন ছবি ব্যবহার করবো কিভাবে !
সিস্টেমটা সচলায়তনের মতো, তবু কোথায় একটু ফারাক যেন !
যাক্, এই ব্লগে এটা আমার প্রথম পোস্ট। সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই।
কাজরে পোষ্ট...
কেমন আছেন??
ধন্যবাদ আপনাকে।
ভালো থাকার কোনো বিকল্প নেই !
আমরা বন্ধুতে স্বাগতম রণদা। আপনার লেখা দেখেই লগ ইন করলাম। অসংখ্য ধন্যবাদ এমন একজন বিস্মৃতপ্রায় ( অন্তত আমার দ্বারা) মহান লেখককে আমাদের সামনে তুলে ধরার জন্য। মাহবুব-উল আলমের বই পুস্তক এখনও কি বাজারে পাওয়া যায়? সহজলভ্য হলে কাউকে দিয়ে কেনাতাম, যেভাবে আপনার ইয়োগার বই বইমেলা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে আমার পড়ার ঘরে
মামুন ভাই, আপনাদেরকে দেখেই তো বন্ধু হতে এলাম !
মাহবুব-উল আলমের বই এখন পাওয়া যায় না। অন্তত আমি পাইনি।
প্রকাশকরা আগ্রহী হলে হয়তো তাঁর পরিবারের লোকজন 'মাহবুব-উল আলম রচনাসমগ্র' প্রকাশ করতে পারেন। যতটুকু জানি, এযাবৎ তাঁর কোনো রচনাসমগ্র প্রকাশিত হয়নি।
ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন।
কিছুই জানতাম না উনার সম্বন্ধে
কত অজানা রে
প্রিয় পোষ্টে নিলাম
ধন্যবাদ আপনাকে।
রণদা, পয়লায় ব্যাপক স্বাগতম।
ফাঠায়া ফেলছেন দেখি।
দারুণ হইছে লেখাটা
এই বইটা দরকার, কই পাওয়া যায়?
বড় কঠিন প্রশ্ন নজু ভাই !
এখন পর্যন্ত যার উত্তর আমার জানা নাই।
ধন্যবাদ। উত্তর পেলে আপনাকে জানাবো।
স্বাগতম আপনাকে। অসাধারণ পোস্ট। তথ্যবহুল। সবার কাজে লাগবে।
মাহবুব-উল আলম এর প্রতি শ্রদ্ধা
ধন্যবাদ।
নজু ভাই'র মাধ্যমে অভ্র নিয়ে আপনার লেখার ফেসবুক-লিঙ্ক দিয়ে এই ব্লগে ঢুকে আপনার পোস্টে কমেন্টের প্রয়োজনেই প্রথম রেজিস্ট্রেশন করে ফেলি। আর রেজিঃ যখন করলামই, না-লেখাটা কেমন হয়ে যায় না ! এভাবেই বন্ধু হয়ে যাওয়া আর কি ! হা হা হা !
ভালো থাকবেন।
শ্রদ্ধেয় মাহবুব-উল আলমের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ! এমন সমৃদ্ধশীল একজন মানুষকে ব্লগের পাতায় এভাবে তুলে না ধরলে আমার পক্ষে হয়ত অজানাই থেকে যেতেন তিনি । রণদা কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি সে জন্য । বন্ধুতে আপনাকে সুস্বাগতম !
ধন্যবাদ আপনাকে।
'রক্ত আগুন অশ্রুজল: স্বাধীনতা' বইটা স্বাধীনতা যুদ্ধের উপর লেখা তাবৎ বইয়ের চেয়ে সেরা মনে হয়েছিল আমার। বহুবছর আগে পড়েছিলাম লাইব্রেরীতে। কোথাও পাওয়া যায় না এখন। মুদ্রিত হয়নি আর বোধহয়। অবাক লাগে কত আজে বাজে বইয়ের সংস্করনের পর সংস্করন বেরহয় একই বইমেলায়। অথচ এরকম গুরুত্বপূর্ন বইগুলো মুদ্রনে কেউ এগিয়ে আসে না। মাহবুবুল আলমের পরিবারের আরো গুনী মানুষদের বই বাজারে দুর্লভ সেকারনে।
কিছুদিন আগে ওনার আরেক ভাই ওহিদুল আলমের বই খুজতে খুজতে পুরো চট্টগ্রাম তন্ন তন্ন করে মাত্র একটা দোকানে ছিন্ন একটা কপি পেয়েছি। মলিন জীর্ন পাতাগুলো দেখে এত কষ্ট লাগলো। সবাই ভুলে গেছে এসব গুনী মানুষদের। আমার বাসার এক দেড়শো গজের ভেতর সেই স্মৃতিময় বাড়ীটা। বেঁচে থাকলে হয়তো গিয়ে চেষ্টা করতাম বইগুলো পুনঃমুদ্রন করা যায় কি না!
নীড়দা
রণদা উস্কে দিয়েছিলো। এখন আপনি তাতে ঘি ঢেলে দিলেন। এই বই তো আমার এখন লাগবেই। যে কোন মূল্যে। কারো ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকলে, বা কোনো লাইব্রেরিতে থাকলে হদিস দেন।
রণদাকে মাত্রই ফোন করে হাতে পায়ে ধরে একই অনুরোধ করেছি। আপনার কাছেও করতেছি।
বাজারে নাই আমি জানি। কার কাছে আছে বলেন, আমি সেখানে গিয়ে প্রয়োজনে ফটোকপি করে নিয়ে আসবো। তিনি দিতে না চাইলেও জোগাড়ের দায়িত্ব আমার। খালি খোঁজটুকু দেন।
এইটা অনুরোধ। [এখানে হাতে পায়ে ধরার ইমো হবে]
আমি বইটা পড়েছিলাম সম্ভবত চট্টগ্রামের শতবর্ষী প্রাচীন মিউনিসিপ্যালিটি লাইব্রেরীতে। পুরোনো দুর্লভ বইয়ের সমাহার ছিল জায়গাটা। এখন তো লাইব্রেরীটাও বন্ধ হয়ে গেছে। বইটা আমি নিজেও খুঁজেছি অনেক তখন। তারপর ভুলে গেছি। আজ থেকে আবারো খোঁজ শুরু করবো।
আসলেই আমরা অনেক কিছু হারিয়ে ফেলছি ! এগুলো খুঁজে পাওয়া দরকার।
ধন্যবাদ।
স্বাগতম রণদা
ছবির জন্য এইখানে দেখতে পারেন
লিঙ্ক-পোস্ট পড়ে তো ভয় পেয়ে গেছিরে ভাই !
আচ্ছা, আমার নিজস্ব ওয়ার্ডপ্রেস-ব্লগে আপলোড করা ছবির ইউআরএল লিঙ্ক ব্যবহার করে এখানে ছবি পোস্ট করা যাবে না ? তাহলে ভয় কাটতো কিছুটা।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকবেন।
বইটা দরকার। এরকম একটা বই সংগ্রহে থাকবে না, আর পড়বো না। মানাই যাচ্ছে না।
আসলেই মেনে যাওয়ার মতো কথা নয় !
ধন্যবাদ।
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী দৈনিক আজাদী পত্রিকায় এই মহান ব্যক্তি মাহবুব-উল-আলম সম্পর্কে প্রথম জেনেছিলাম। জেনেছিলাম এই মানুষটি হাতের কাছে যখন যা পেতেন যেমন ছোট খাট কাগজ, বাজারের ফর্দ, কাগজের ঠোঙ্গার মতো কাগজে তার সাহিত্য চর্চা করতেন। খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন। কিন্তু ফাঁকিবাজ আমার সেই বয়সে তার কোন লেখা পড়া হয়নি। হয়তো দৈনিক আজাদীতে তার কোন লেখা পড়েও থাকতে পারি যা আজ আর মনে করতে পারছি না। সদ্য স্কুল পাস করা আমি তখন (১৯৯২) চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি লাইব্রেরিতে (লালদীঘীরপাড়) যাতায়াত করলেও দূভাগ্যক্রমে সেই বইটি পড়া হয়নি। যার জন্য নীড়ু'দার প্রতি খুব ঈর্ষা হচ্ছে।
পরিশেষে অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি রণদা'কে তার এই সুন্দর পোষ্টটির জন্য। খুব ভাল হত আমরা যদি তার রচনাগুলোকে আবার সবার কাছে তুলে ধরতে পারতাম। এমন একজন মানুষকে তার কাজকে কোনভাবেই হারিয়ে যেতে দেয়া যায় না, এ ভারী অন্যায়।
সহমত পোষণ করছি আপনার সাথে। ধন্যবাদ।
একজন শুভানুধ্যায়ী বন্ধুর টেলিফোন পেয়ে অনলাইন সমকাল পত্রিকার আজ ৩০ এপ্রিল কালের খেয়া খুলে দেখি ওখানে এই লেখাটা আংশিক প্রকাশিত হয়েছে। ধন্যবাদ জানাচ্ছি সেই বন্ধুকে যিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেছেন।
বেশ ভালো লাগলো লেখাটা রণ'দা।
স্বাগতম
ধন্যবাদ।
এই পোস্টের মন্তব্যে কেউ কেউ, বিশেষ করে নজু ভাই, কথাশিল্পী মাহবুব-উল আলমের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসভিত্তিক 'রক্ত আগুন অশ্রুজল: স্বাধীনতা' বইটির সন্ধান করেছিলেন। বইটি আসলে কোথাও কিনতে পাওয়া যায় না।
তবে গতকাল ১লা মে নিমতলী এশিয়াটিক সোসাইটিতে মাহবুব-উল আলমের ১১২তম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিলো আমার। সেখানে বিষয়টি উত্থাপন করা হয়। এছাড়া এই পোস্টটিও ফেসবুক লিঙ্ক'র মাধ্যমে মাহবুব-উল আলমের উত্তরাধিকারদের নজরে এসেছে।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক মাহবুব-উল আলমের পৌত্র হাসনাইন সবিহ নায়ক ঘোষণা দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, যাদের সংগ্রহে বইটি আছে তাঁরা হাত তুলে জানান দিতে। এতে চারজনের হাত উত্তোলিত হতে দেখা গেছে, যাঁদের তিজনকে তাৎক্ষণিকভাবে চেনা সম্ভব হয়েছে। ড. মনসুর মুসা, চবি'র প্রাক্তন ভিসি ড. আব্দুল মান্নান ও মাহবুব-উল আলমের পুত্র সবিহ-উল আলম।
এর পরপরই লেখকের আরেক পুত্র অধ্যাপক ড. মোহিত-উল আলমের মাধ্যমে জানা গেল, সাত-মসজিদ রোডের ইউল্যাব লাইব্রেরিতে বইটির কপি রয়েছে। তবে আনন্দের সংবাদটি জানালেন সুব্রত বড়ুয়া। অনুপম প্রকাশনী থেকে তাঁরই সম্পাদনায় আগামী বইমেলার আগেই বইটি পুনঃপ্রকাশ হচ্ছে।
এটা অবশ্যই আনন্দের সংবাদ। তবে তাঁর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর ব্যাপারে এখনো অনিশ্চয়তা কাটেনি। আশা করি প্রকাশকদের কেউ না কেউ অবশ্যই এগিয়ে আসবেন।
ধন্যবাদ সবাইকে।
অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ দিলেন রণদা। বই ছাপানোর ব্যাপারে আমার বিশেষ কোন জ্ঞান নেই। তারপরও বলি, বাংলা একাডেমি কি তার বইগুলো পুনঃ প্রকাশ ও সংরক্ষণ করতে পারে না?! এ চাওয়াটা কি খুব বেশি চাওয়া হয়ে যায়?
আর একটা ব্যাপার, সেটা আমি জানিনা কতটা যুক্তিযুক্ত, কিন্তু আমার মনেহয় আমাদের একটা সরকারী বা বেসরকারী যে পর্যায়ে হোক না কেন একটা ডিজিটাল আর্কাইভ/লাইব্রেরী থাকা দরকার। ফ্রীতে না হোক পরসার বিনিময়ে হলেও থাকা দরকার।
রনদাকে স্বাগতম জানাই...
এমন আরো লেখা চাই বস...
নতুন জেনারেশনের কাছে আমাদের অগ্রজদের ইতিহাস কাউকে না কাউকে বলতেই হবে... আপনি হন সেই মানুষ ... যে আমাদের আমাদের পূর্বপুরুষদের আমাদের সুখের জন্য করে যাওয়া সংগ্রামের ইতিহাস শোনাবে।
স্বাগতম আপনাকে। অসাধারণ পোস্ট। তথ্যবহুল। সবার কাজে লাগবে।
মাহবুব-উল আলম এর প্রতি শ্রদ্ধা
মন্তব্য করুন