গানের কথা
১৯৯৯ সালের দিকে কিংবা তার পর পরই হঠাৎ বৃষ্টি দেখানো হলো টেলিভিশনে, অবশ্য সে সময়ে হঠাৎ বৃষ্টি দেখার মতো ধৈর্য্য ছিলো না, দুপুরে কিংবা বিকেলের নির্ধারিত আড্ডা কিংবা খেলার কোনো একটাতে ব্যস্ত ছিলাম- এর পরের কোনো একদিন দুপুরে সোহেল বাসায় আসলো,
সোহেল কোনো এক অনির্ধারিত কারণে জিদ ধরেছিলো আমাকে গীটার শিখতে হবে, আমাকে দিয়ে না কি গীটার বাজানো হবে- ওর পরম উৎসাহেই আমি গুলশানের মেলোডি থেকে ২ হাজার টাকায় একটা গিভসন কিনে আনলাম, কিছু টুংটাংও করলাম, তবে উৎসাহে ভাটা পরতেও সময় লাগলো না। সোহেল উৎসাহ নিয়েই আমাকে গীটার লেসন দেয়, এসে রীতিমতো ঘাড়ে ধরে প্রাকটিস করায়- ঐদিনও ও আসছিলো গীটার লেসন বুঝে নিতে- বললো চল একটা ছবি দেখে আসি-
বাংলা ছবি, তাও মিরপুরের এশিয়াতে, তখন বাংলা ছবি মানেই ভয়ংকর কিছু, দল বেঁধে মান্নার রাজা দেখতে গিয়ে হাফ টাইমে পালিয়ে এসেছি, কিন্তু মামুন যখন বললো এই ছবিটা দেখা উচিত- আর না করতে পারলাম না। শুক্রবার সন্ধ্যায় মামুন, আমি সোহেল বেবি ট্যাক্সি করে এশিয়া সিনেমা হলে গিয়ে নাইট শো তে হঠাৎ বৃষ্টি দেখলাম।
রাতের বেবিট্যাক্সিতে ফেরার সময় সোহেল আর মামুন দুজনেই নায়িকার( প্রিয়াংকা সম্ভবত) সৈন্দর্য্যে মুগ্ধ। ট্যাক্সিতে মামুন বললো ও এই ছবি দেখে একটা গান লিখে ঐটার মুখও সুর করছে কিছুটা। বাকি অংশ এখনও সম্পূর্ণ হয় নি। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ১২টা বাজলো, সেই সময়েই সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা আজকে রাতেই গানটা লিখে সুর করে ফেলবো-
সাড়ে ১২টায় কয়েক প্যাকেট চানাচুর আর এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে অন্য এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে উঠলাম গীটার হাতে। সোহেলদের জন্য হয়তো আলাদা কিছু না, ওরা এর আগেও গান লিখে সুর করেছে, কিন্তু আমার জন্য বিষয়টা ভীষণ উত্তেজনার- আজকেই প্রথম কোনো গানের কথার উপরে সুর বসানো হবে- সে গানের অর্ধেক অংশও আমাকে লিখতেও হবে-
নিষিদ্ধ উত্তেজনার মতো বুক ঢিপঢিপ করছে, খানিকাটা তৃষ্ণার্তও লাগছে, সিগারেট ধরিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে মামুন একটা কাগজ খুলে গানের মুখ বের বের করলো
যখন আর নেই কোনো আশা
খুঁজে ফিরি পথে পথে
পাগল আমি ভাঙাচোরা
লুকাই জনস্রোতে
নিস্তার নেই তবুও
আছো তুমি ঠিকই
হাজারো ভীড়ের মাঝে
তুমি সেই ছবি
চন্দ্রবিন্দুর একটা গান আছে- ডি মাইনর- ডি মাইনর- এ মাইনর, সি- এফ মেজর- বি ফ্ল্যাট একটা স্কেল আছে, বেশ কিছু হালকা রোমান্টিক গান এই সার্কেলে গাওয়া হয়েছে, সবচেয়ে পরিচিত দুইটা সম্ভবত লাকী আখন্দের এই নীল মনিহার আর স্করপিয়ন্সের হলি ডে।
কয়েকটা স্কেলের পর এই স্কেলের উপরেই গানটা শুরু হলো, গানটা লিখে সুর করতে আমাদের সময় লেগেছিলো সম্ভবত ৪০ মিনিট- জীবনানন্দের একটা কবিতার লাইন, আমার লেখা একটা কাঁচা কবিতা এই মিলিয়ে গানটা সুর হয়ে গেলো যখন তখন ভীষণ রকম উত্তেজিত- রাতে কয়েকবার গানটা গেয়ে- অন্য সব পুরোনো গানের সুর ভজে ঘুমাতে ঘুমাতে ভোর- আমার সকাল ৮টায় ক্লাশ, সেই ৭টায় উঠে ঢুলতে ঢুলতে ক্লাশে যাওয়ার স্মৃতি এখনও মনে আছে।
গানটা শেষ পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো
এই শহর জানে আমার নি:সঙ্গতা
পথ চলি একা একা আমি মাঝরাতে
আকাশের ওপারে আকাশ নীল হয়ে আছে
থেমে যায় বাতাস দিনের শুরুতে
যখন একাকী হাঁটি পথে-বেপথে তুমি সঙ্গে থাকো
আলো থেকে অন্ধকারে যাই, ফিরে আসি
আমি তোমাকে, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি তাই
আমি করতলে সাজিয়ে রাখি আমার হৃদয়
( মাঝে হয়তো একটা দুইটা লাইন মিসিং আছে, পুরোনো কোনো একটা ডায়েরীতে গানটা সম্পূর্ণ তোলা আছে)
আমরা তখন একটা ব্যান্ড করতে চেয়েছিলাম- সেই কাজটা আর আগায় নি, সোহেল হঠাৎ করে একদিন রাতে অস্ট্রেলিয়া চলে যাওয়ার পর ব্যান্ডের সব কিছু শেষ- মামুন গান বাজনা ছেড়ে এখন ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন কিংবা ওর আর্কিটেক্ট ফার্মের কোনো কিছু নিয়ে ব্যস্ত- ওর সাথে শেষ বার দেখা হওয়ার সময় বলছিলাম তোর কি আগের সময়টা মনে আছে- ও বললো দোস্তো লাস্ট ফাইভ ইয়ারস আমি গীটার ধরি নি। আই এম কোয়াইট ওকে উইথ ইট, তোর কাছে সোহেলের নাম্বার আছে?
অবশ্য এই দেখা হওয়ার ভেতরেও কেটে গেছে আরও ৫ বছর, সে সময়টাতে আমি এক শহর ডিঙিয়ে অন্য একটা শহরে যেতাম, নিলামে কেনা গিটার সাথে থাকতো না- কোনো দিন বিকেল বেলা একটা গানের কথা মাথায় নিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা, তারপর সম্পুর্ণ রাস্তায় সেই কথার উপরে সুর বসানোর চেষ্টা করতে করতে সময়টা ভালোই কেটে যেতো। বন্ধুর আকস্মিক বিচ্ছেদের সংবাদ পাওয়ার পর বন্ধু ইমেইলে বলেছিলো দেখ আমাকে কোনো সান্তনার কথা লিখবি না। আমি সব সান্তনার কথাই শুনে ফেলেছি, তোকে শুধু বলবার জন্য বলা। কাউকে শেয়ার করতে ইচ্ছা হচ্ছিলো আর তুই ছাড়া এই রকম অন্য কোনো বন্ধুকে মনে পরলো না। প্লীজ কোনো সহানুভুতির প্রত্যুত্তর দিবি না।
আমি একটা সান্তনামুলক বানী লিখতে গিয়েও নিজেকে সংবরণ করে নিলাম। ওদের সমস্যা কি ছিলো জানা হয় নি। দিব্যি চমৎকার একটা জুটি ছিলো, মাত্র কয়েক দিন আগেই আড্ডা দিয়ে, হাসি ঠাট্টার ভিতরে কাটিয়ে এমন কি ঘটলো- সেই নিষিদ্ধ কৌতুহলটুকু নিজের ভেতরেই কবর দিলাম। আর মাথার ভিতরে উঠে আসা কথাগুলোকে সুর দিতে বসলাম
মাঝে এক রাত্রি তোমার আমার, মাঝে অন্ধকারের দেয়াল
ঘড়ির কাঁটা লাফিয়ে যায় ঘর, খুঁজছি নিজের আড়াল
দেয়ালের চেনা ছবি, মুছে ফেলে সব স্মৃতি
পুরোনো চিঠির জঞ্জাল
পরিপাটি বিছানা ছেড়ে সাজানো অতিথি ঘরে
অপেক্ষায় আসবে সকাল
কথকতা গল্প শোনা, বিনিসুতোর মালা বোনা
মিথ্যে সব মিথ্যে কথার ফাঁদ
যায় না ঢাকা হাসি মুখে যতই ঢেকে রাখো বুকে
অমানিশা ভালোবাসার খাদ
গানটা কখনও সমাপ্ত হয় নি, এখনও মনে হয় দ্বিতীয় অন্তরার প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু সেই অন্তরাটুকু লিখে উঠতে পারে নি অন্তর।
এর ভেতরেই একদিন দেশের ৬১টা জেলায় বোমা হামলা হলো, বোমা হামলার ধারাবাহিকতায় তেমন নতুন কোনো ঘটনা ছিলো না এটা। সেইসব বোমাক্রান্ত মানুষের রক্তের ছাপ মুছে যেতে না যেতেই ২১শে আগস্ট বোমা হামলা হলো আওয়ামী লীগের জনসভায়- একের পর এক বোমাহামলার সংবাদ শুনে মনে হলো দেশটা খুব দ্রুত আফগানিস্তান হয়ে যাচ্ছে- সে ক্ষোভ নিয়ে একটা গান লিখে ফোন দিলাম অস্ট্রেলিয়ায়- সোহেল গানটা লিখ প্রথমে, তারপর সুর দিবো
শরমে ঢাকলো মুখ এক আকাশ তারা
পথ খুঁজে অবশেষে আমি দিশেহারা
আলো খুঁজে পাই না যে এ কোন আঁধার
কেনো এ জন্ম দিলে জননী আমার
বিপন্ন দিন যায় স্বপ্নাহত
বেঁচে থাকা ম্রিয়মান লজ্জানত
তোমাকে ধারণ করে সমগ্রতায়
ভালোবাসি এখনও আজও তোমায়
আমার বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ
আমার বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ
.................
কয়েকদিন পর সোহেল ফোন দিয়ে বললো তোর ফোনে লাউড স্পীকার আছে?
ফোনটা লাউড স্পীকারে দিয়ে গীটারটা ধর- সি স্ট্রোক কর
আমি লাউড স্পীকারে দিয়ে সি স্ট্রোক করলাম
না হচ্ছে না, তুই ডি টাকে একটু উপরে তুল, উঁহু এত না, একটু নামা, ঠিক আছে- এইবার এ-শার্প মাইনর
আমাদের কতো ইচ্ছা, কতো আবেগ নানা কারণে পূর্ণতা পায় না। আমার ইচ্ছে ছিল গিটার বাজানো (ভিন্ন মানসিকতার মানুষদের বলছি এখানে আক্ষরিক অর্থে বলা হচ্ছে ) শিখবো। কিন্তু অভিভাবকদের চাপে ভর্তি হতে হলো তবলায়। বছরখানেক শিখে ক্ষ্যান্ত দিলাম। পরের বছর আবারো বায়না ধরলাম কিন্তু ভর্তি করানো হলো হারমোনিয়ামে।
এখনো অবশ্য ইচ্ছে আছে- সন্তান যখন শিখবে তখন বাপ-ব্যাটা/বাপ-বেটি একসাথে শিখবো।
গানগুলো শুনতে পারলে ভালো লাগতো। আপনার এই লেখাগুলি ভালো লাগছে খুব।
ভাই, বেশ ভালা লাগলো।
পুরান কথা মনে আইনা দিলেন......
আমার কয়েক বন্ধু বেশ ভালো গিটার বাজাইত। আমিও ট্রাই নিসিলাম... আগাইতে পারি নাই। হেরপর দুই একখান গান লিখসিলাম ওগো লেইগা। সুরও দিসিলো। চাইর লাইন মনে আছে...
“ছোট ছোট কত কথা,
দুখখ, হাসি, গান।
হৃদয় গভীরে রয়ে যাওয়া,
ছোট ছোট নাম।“
......আর মনে নাই।
গানগুলো শুনতে পারলে ভালো লাগতো। আপনার এই লেখাগুলি ভালো লাগছে খুব।
ভাল লাগতেছে কিন্তু....
নেক্সট আড্ডায় কি এক/দুইটা গান হবে?
টুটুল আমি গান গাইলে বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার সমুহ সম্ভবনা আছে- লিপি আমার কিঞ্চিৎ গান গাওয়ার অপচেষ্টার সময় বলছিলো আমি যদি কখনো গান সুর করি তাহলে সে শুনবে- আর গাওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো- সেটা আমাকে দিয়ে হবে না। এ কথাটা প্রথম বলেছিলেন জনৈক ওস্তাদজী, আমি শৈশবে যখন গানের ক্লাশে ভর্তি হয়েছিলাম তখন। বলেছিলেন আমার গলায়, তাল,লয়-সুর কিছু নেই, আমি গান গাইলে শুধুমাত্র প্রলয় হতে পারে- আমি তো তেমনটা চাই না।
দুরের কোন এক গাঁয়ের মাঠে বইসা সন্ধ্যার ঠিক আগের মুহুর্তে... যখন আকাশে সূর্য যায় যায় ... হালকা একটা বাতাস ...
এমন একটা এলাকায় চলেন ... ব্যাকাপ হিসেবে বিমা থাকপে...
টুটুলের সাথে তীব্র সহমত।
আমি আছি
গানগুলো শুনতে পারলে ভালো লাগতো। আপনার এই লেখাগুলি ভালো লাগছে খুব।
রাসেল ভাই এইটা কি লিখলেন !!! কৈশরের কত ছোট ছোট ঘটনা মনে পৈড়া গেল......
গিটার হাতে কথা বসইয়া সুর করা।
বন্ধুরা মিলে গলা ছেড়ে গান গাওয়া।
সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপারটা হচ্ছে , টিভিতে সেই '৯৯ সালে 'হঠাৎ বৃষ্টি'র প্রিমিয়ার শো টা দেখা হয় নাই, সেই সময় তো বাংলা সিনেমা দেখার কোন রকম আগ্রহই ছিলো না, সিনেমা দেখা ছাড়া আরো কত কত কাজ করার আছে !!!
কিন্তু যারা যারা দেখছিলো তারা তো এইটারে একটা লিজেন্ডারী সিনেমা বইলা ঘোষনা দিলো সেইটা বন্ধু মহলেও এবং বাসাতেও। সুতরাং, চিন্তা করলাম সিনেমাটা দেখা দরকার। আমরা যে কয়েক জন সিনেমাটা মিস করছিলাম তারা সিনেমা হলে গিয়ে হঠাৎ বৃষ্টি দেখলাম।
সিনেমা হলটার নাম 'এশিয়া' এবং আমরা তিন বন্ধু মিলে সিনেমাটা দেখছিলাম
বাই দ্যা ওয়ে ... আপনে আমার দোস্তো নাতো !!!
তুই ম্যাট্রিক্স মার্কা কনফিউশন ঢুকায়া দিলি।
১ আর ৩ ভাল কিন্তু
২ নম্বর গান টা যাষ্ট গরজিয়াস।
গানগুলি গেয়ে ফেলেন।
এই সিরিজটা দারুন লাগতেছে।
মন্তব্য করুন