শিক্ষা-২
How do learners in different cultures relate to science and technology? Results and perspectives from the project ROSE (the Relevance of Science Education) নরওয়ের ওসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের গবেষণায় প্রাপ্ত উপাত্তে দেখা যাচ্ছে উগান্ডা, বাংলাদেশের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ভেতরে ভবিষ্যতে বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার আগ্রহ বেশী। তারা পরবর্তীতে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিষয়ক কোনো বিষয়ে নিজেদের কর্মজীবন শুরু করতে আগ্রহী। অন্য দিকে নরওয়ে, সুইডেন, ইংল্যান্ড, জাপান কিংবা অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল দেশগুলোর শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান বিষয়ে নিজেদের কর্মজীবন শুরু করতে অনাগ্রহী তবে প্রযুক্তিবিদ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করার ক্ষেত্রে তাদের আগ্রহ বিজ্ঞান বিষয়ে নিজেদের কর্মজীবন শুরুর তুলনায় বেশী।
অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশে, যেখানে এখনও চাকুরিবাজারে বিজ্ঞান শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বাড়তি কদর, সেখানে মানুষ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি বাড়তি আগ্রহ নয় বরং অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার প্রতি লোভ থেকে তারা বিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহন শেষে নিজেদের কর্মজীবন সেভাবেই শুরু করতে চায়।
বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষিত মানুষেরা অপেক্ষাকৃত কম কুসংস্কার আচ্ছন্ন, তারা অপবিজ্ঞান কিংবা অলৌকিক ঘটনাকে অবিশ্বাস করে এমন না। বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের বিজ্ঞান অনুধাবন, অপবিজ্ঞানে বিশ্বাস কিংবা আস্থা নিয়ে বড় মাপের কোনো গবেষণা হয় নি, তবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইডেন, কানাডা কিংবা জাপানে প্রায় নিয়মিত এই ধরণের গবেষণা করেন শিক্ষা গবেষকগণ।
নিছক কিছু বৈজ্ঞানিক বিধি মুখস্ত করা এবং সেসব বিধিকে গাণিতিক সংকেতে প্রকাশ করার ক্ষমতা বিজ্ঞান অনুধাবন না। বৈজ্ঞানিক বিধিগুলো জ্ঞানের সারসংক্ষেপ হিসেবে কেনো সর্বজনগ্রহনযোগ্য, কি প্রক্রিয়ায় প্রতিটি অনুসিদ্ধান্ত কিংবা অনুমানকে যাচাই করা হবে, কিভাবে পরস্পর বিরোধী ব্যাখ্যা থেকে নিবির যাচাই-বাছাই শেষে যৌক্তিকভাবে সুনিশ্চিত পরীক্ষার মাধ্যমে একটি ব্যাখ্যাকে বাতিল করা সম্ভব এবং কিভাবে একটি সাধারণ প্রশ্নকে কেন্দ্রে রেখে বিভিন্ন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে সমাধান খুঁজছে এবং পরস্পরকে সহযোগিতা করছে- সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি এবং বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতাগুলোকে যথাযথ উপলব্ধি করতে পারাটা সামগ্রীকভাবে বৈজ্ঞানিক অনুধাবন। নিজস্ব জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করার জন্যে যে প্রক্রিয়ায় নিজের জ্ঞানকে যাচাই করতে হয়- তা অধিকাংশ মানুষের পক্ষেই সম্ভব হয় না। শিক্ষা গবেষকেরা মাল্টিপল চয়েজ প্রশ্ন, হ্যাঁ-না প্রশ্ন, তুলনামুলক আলোচনার প্রশ্ন এবং বিস্তারিত সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে যাচাই করার চেষ্টা করেন।
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে নিবিড় গবেষনার ফলাফল শেষে জানা গেছে বাংলাদেশে পিএসসি সমাপ্ত করা অধিকাংশ শিক্ষার্থী তার বয়েস এবং পাঠ্যক্রম অনুযায়ী মাণসম্মত শিক্ষা পায় নি। তারা বাংলা কিংবা ইংরেজীতে নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারছে না, তারা গণিতের বিষয়গুলোও বুঝছে না। উঁচু পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে এমন নিবিড় গবেষণা করলে জানা যেতো আমাদের যেসব শিক্ষার্থী বিশ্বাস করে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি মঙ্গলজনক, তাদের বিজ্ঞান অনুধাবন ক্ষমতা কতটুকু?
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অপবিজ্ঞানে বিশ্বাস বেশী। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিজ্ঞান এবং অধিবিদ্যা বিষয়ে নিয়মিত পাঠদানকারী একজন অধ্যাপক তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে জানাচ্ছেন কোর্সটা শুরুর সময় শিক্ষার্থীদের ভেতরে বিজ্ঞান , অপবিজ্ঞান- অধিবিদ্যা সম্পর্কে যে ধরণের ভাসাভাসা ধারণা ছিলো এবং যারা এদের আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারতো না, কোর্সটা শেষ করার পর তারা বিজ্ঞান থেকে অপবিজ্ঞান কিংবা অধিবিদ্যাকে আলাদা করার দক্ষতা অর্জন করেছে। তবে শিক্ষা নিয়মিত অনুশীলনের বিষয়। কোর্সটা শেষ করার পরের বছর তাদের অধিবিদ্যা কিংবা অপবিজ্ঞান সম্পর্কিত ধারণা পুনরায় অস্পষ্ট হতে থাকে।
প্রাথমিক পর্যায়ের প্রশিক্ষনার্থী শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়ে তাদের বিজ্ঞান অনুধাবন এবং অপবিজ্ঞান সম্পর্কিত ধারণা যাচাইয়ের জন্যে করা গবেষণার ফলাফল বলছে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সাধারণ বিজ্ঞান পড়ানোর জন্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অধিকাংশেরই বিজ্ঞানভাবনা দুর্বল। এরা বিজ্ঞান এবং অপবিজ্ঞানের ভেতরে পার্থক্য করতে পারছে না। তারা বিজ্ঞানসম্মত নয় এমন এক কিংবা একাধিক বিষয়ে বিশ্বাস করে । গবেষণার উদ্দেশ্য ছিলো এইসব প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক যখন তাদের স্ব-স্ব শিক্ষালয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াবে, তখন সেসব শিক্ষার্থীর বিজ্ঞান অনুধাবন দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে কি না। চুড়ান্ত উপসংহারে গবেষকরা খুব বেশী আস্থাবান ছিলেন না।
সুইডেনে এইচএসসি সমমান পরীক্ষার্থীদের বিজ্ঞান-অপবিজ্ঞান সম্পর্কিত ধারণা বিষয়ে করা গবেষণা ফলাফল বলছে যদিও বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীরা বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কিন্তু তাদের অপবিজ্ঞান সংক্রান্ত বিশ্বাস মোটা দাগে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা না করা শিক্ষার্থীদের সমতুল্য।
বিজ্ঞান-অপবিজ্ঞান-অধিবিদ্যা এবং অলৌকিক অদ্ভুতুড়ে বিষয়ে বিশ্বাসের আলোচনায় শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস, সামাজিক সংস্কারও আলোচনায় এসেছে। গবেষণার ফলাফল বলছে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস তাদের বিজ্ঞান বিষয়ক ধ্যানধারণাকে প্রভাবিত করে এবং তাদের অপবিজ্ঞান কিংবা অধিবিদ্যায় আস্থাবান করে।
সকল বিষয় বিবেচনা করে একদল শিক্ষা গবেষক বলছেন শুধুমাত্র বিজ্ঞান বিষয়ক অনুধাবনকে গুরুত্ব দিয়ে পাঠ্যক্রম তৈরী না করে একই সাথে পাঠ্যক্রমে অপবিজ্ঞান-অধিবিদ্যা কিংবা অলৌকিক বিষয়াদি সম্পর্কিত আলোচনাও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
কেনো জ্যোতিষবিদ্যা, হেমিওপ্যাথি, গোমুত্রে রোগব্যাধি সারে, কিংবা বর্তমানের ইন্টারনেটের যুগে নানাবিধ স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শগুলো অগ্রহনযোগ্য,
আকুপাঙচারের নামে শরীরে সূচ ফোটালে নানাবিধ ব্যাধির উপশম হয়,
কাপিং করলে রোগ ব্যাধিমুক্ত থাকা যায় কিংবা এমনতর নানাবিধ বিষয় যে বাহিরাঙ্গে অনেকটাই বিজ্ঞানের মতো এবং যারা এই ব্যবসার সাথে জড়িত তারা বিভিন্ন বড় বড় জটিল শব্দে এসবের পেছনের বিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করছে- এই সকল বিষয়ই আদতে অপবিজ্ঞান।
কোনো ঘটনাকে অলৌকিক বলার আগে সকল ধরণের লৌকিক ব্যাখ্যা অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়ায় কিভাবে বিজ্ঞানভাবনা অন্তর্ভুক্ত হয়।
কেনো নিউওমারোলজি, ভাগ্যগণনা নিছক কথার কারসাজি, শুভ সংখ্যা, পোশাক, হাঁচি-কাশি সংক্রান্ত সকল কুসংস্কার কেনো বিজ্ঞানসম্মত নয়
সকল বিষয় যদি শিক্ষার্থীরা পাঠ্যক্রমের অংশ হিসেবে পাঠ করে, তারা বিজ্ঞান থেকে অপবিজ্ঞান কিংবা বৈজ্ঞানিক ভ্রান্তিকে আলাদা করতে পারবে সহজে।
অবশ্য শুভ সংখ্যা কিংবা শুভ সংস্কারগুলো , সৌভাগ্য- দুর্ভাগ্যে আস্থা স্থাপন , ঐশ্বরিক কৃপা প্রত্যাশায় যেকোনো আচার অনুষ্ঠানের সংস্কৃতি মোটা দাগে ব্যক্তির নিজস্ব বিশ্বাসের সম্প্রসারণ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষাপাঠক্রমে এমন সব বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি যে পরিমাণ বাড়তি বিতর্ক তৈরী করবে কিংবা এই ধরণের প্রশ্নসম্বলিত জরিপ কিংবা নিবির অনুসন্ধান যেভাবে গবেষককে বিতর্কিত করবে- বর্তমানের বাংলাদেশে অপবিজ্ঞান সম্পর্কিত গবেষণাকর্ম পরিচালনা বেশ কঠিন একটা কাজ।
মন্তব্য করুন