ইউজার লগইন

বন্ধু তোমায় না পাঠানো এই চিঠি

তোমার সাথে পরিচয় ক্লাস শুরুর আগে। যেদিন হলে সিট দিলো। দুইজন এক ডিপার্টমেন্ট। এমনকি এক সেকশন। হলেও রুমমেট। প্রথম দুএকদিন খুব বেশী কথা হয়নি। সারকিট ল্যাবে খুব বিস্ময়ের সাথে দেখলাম তুমি সবই বুঝে ফেলছো। অথচ তুমি তো আগে এসব পড়নি, বুঝলে কি করে। সেশনালে তোমার মাথাটা বেশ পরিস্কার ছিলো অল্প কদিনেই বুঝে গেলাম। আলাপ-পরিচয়ে জানলাম ঢাকা কলেজে পড়ার আগে তুমি মুন্সীগন্জে ছিলে। ইন্টারমিডিয়েটের হিসাবে তুমি আমার এক বছর সিনিয়র। কোন কারণে প্রকৌশলী হবার জন্য ১ বছর লস দিলে।

যতই দিন গেল তোমার সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকলো। একসাথে চলাফেরা-খাওয়াদাওয়া-পড়াশোনা। হলে-ক্লাসে-ক্যাফে-ক্যান্টিনে-নীরবে। হলে কেউ কেউ ডাকা শুরু করলো মাণিকজোড় হিসেবে। জানলাম তোমার পছন্দের নারীর কথা। নিজেও অনেক কিছু শেয়ার করলাম। স্কুল কলেজে থাকতেই গলা ছেড়ে গান গাওয়ার অভ্যাস তৈরী হয়েছিল, যদিও জানতাম গলায় খুব বেশী সুর নেই। তোমার মুখে তাও আমার গানের গলার প্রশংসা শুনলাম। ভালোই লাগলো। প্রশংসা শুনতে কার খারাপ লাগে বলো?

তুমি ছাত্রফ্রন্টের সক্রিয় কর্মী। আমি রাজনীতি সচেতন, কিন্তু কোন দলে নিজেকে মানাতে পারছি না। নির্দিষ্ট দলের চেয়ে রাজনীতিতে কিছু সুস্থ উপাদানের গুরুত্ব নিয়ে বেশী সচেতন। বন্ধু মহলে বলতাম আমি নির্দলীয় রাজনীতি করি। নির্মূল কমিটির প্রোগ্রামে টিয়ার গ্যাসের ধোয়ায় আক্রান্ত হয়েছি। মিছিলে থেকেছি পাশাপাশি। আমাদের কি সহযোদ্ধা বলা যায়?

তখন আমরা ফোর্থ ইয়ারে। পরদিন তোমার আর আমার প্রজেক্ট পার্টনারের বাসায় আসার কথা। রাত ১১টায় হল থেকে ফোনে জানালে তুমি আসছো না পরদিন। আমি একবার ভাবলাম বলি কেন আসবে না। কি মনে করে যেন আর বল্লাম না। তার মাস কয়েক আগে তোমার ভালোবাসার নারী সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছে। বুঝতাম তোমার মন খারাপ থাকে। অনেক সময় মনে হয় একটু যেন আনমনা। পরদিন আমার প্রজেক্ট পারটনার আর আসেনা। তখন বোধহয় ২ টার মত বাজে। হঠাৎ ফোন এলো এক ক্লাসমেটের। সে জানালো যে তুমি খুন হয়েছে। আমাকে বললো তাড়াতাড়ি বু্য়েটে আসতে। বাস শেষ, আর কিছু না। হলের কয়েনব্ক্স থেকে ফোন। কোন রকমে চলে আসলাম হলে। শুনলাম কারা যেন তোমাকে গুলি করে হত্যা করেছে। তুমি আর তোমার খুনীরা আহসানউল্লা হল আর বকশীবাজার গেটের পথে। পয়েন্ট ব্ল্যান্ক রেইন্জ।

তোমার দাফনে যাবো, শেষবারের মত তোমাকে দেখবো, এজন্য ছুটলাম শ্যাওড়া পাড়া। আমি যখন গেলাম তখন দাফনের শেষ পর্যায়। ওখানে কিছু বন্ধুকে পেয়েছিলাম। বাসায় ফিরতে ফিরতে বোধহয় রাত দশটা। একবারও কাঁদিনি। সেদিন ডিনারও করেছি। রাতে একসময় ঘুমও এলো।

পরদিন গেলাম ইউনিভারসিটিতে। ব্যাচের ছেলেমেয়েরা শোকদিবস করলো। এর মধ্যে ছাত্র খুনের বিচারকে কেউ কেউ (জুনিয়ররা) সাফল্যের সাথে পরীক্ষা পিছানোর আন্দোলন বানিয়ে ফেললো। ভাংচুর। পরীক্ষা পেছালো ওদের। ভার্সিটি অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হোলো। স্যাররা জানালেন যে "আহসানুল্লাহ হল থেকে বকশহিবাজার গেইট" বুয়েট ক্যাম্পাসের মধ্যে পড়েনা, তাই আহমেদ হত্যায় ওনাদের কিছু করার নেই। তারপর আমি ও আমার মত কিছু ২ পয়সার মানুষ চেষ্টা করলাম তোমার হত্যার বিচার নিয়ে চারদিক নাড়া দিতে। কেউ দেখলাম গা করেনা। চরম অসহযোগিতা দেখালো ছাত্রনেতারা। দলবাজি, গোষঠীবাজির চরম উৎকর্ষ দেখলাম। ও থাকলে আমি কোন প্রোগ্রামে থাকব না, এমন শর্ত দেয়ার লোকও কম না। একসময় সবই সয়ে যায়। পড়াশোনা নিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে গেলাম। নতুন কিছু ছেলেমেয়ে বন্ধু হলো। আস্তে আসতে দেখা গেলো আন্দোলন বলে কিছু নেই। অনেক ক্লু থাকা স্বত্বেও পুলিশ চুপচাপ।

র‌্যাগের সময় দেখলাম ১০০ টাকা চাঁদা তোলা হলো তোমার পরিবারের জন্য। আমরা যারা বুয়েটের ২ পয়সার ছাত্র ছিলাম তাদের কাছে ব্যাপারটা পরিস্কার হলো না। আমরা তো জানি তোমার পরিবারের দরকার হত্যার বিচার। হ্য়তো আমাদের সহানুভূতি। হোক তোমার পরিবার নিম্নবিত্ত কয়েক হাজার টাকা দিয়ে তারা কি করবে। এখন আমরা ছাত্র সংগঠনের পান্ডাও না, ক্যাফের সামনে আডডা দেয়া হাই প্রোফাইল ছাত্রও না। সুতরাং আমাদের কথা গুরুত্ব পেলো না। র‌্যাগের পর শুনলাম র‌্যাগের হর্তাকর্তারা জানালো তাদের কত টাকা তাদের নিজের পকেট থেকে খরচ গেছে। মজার ব্যাপার হলো র‌্যাগের চার বছর পর ব্যাচের কিছু হাই প্রোফাইল মানুষ আবার পিকনিকও করে র‌্যাগের উদ্বৃত্ত টাকা দিয়ে। আর হ্যাঁ, তোমার ফ্যামিলিকে কখনই কোন টাকা দেয়া হয়নি। সে টাকা দিয়েই কি পিকনিক .....

ঠিক ১৪ বছর হয়ে গেলো তোমার মৃত্যুর। অস্বীকার করবো না যেটুকু আমার করা উচিত ছিলো তোমার হত্যার বিচার বাস্তবায়নে সেটুকু করিনি। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, সীমাবদ্ধতা আর অসামর্থ্যের তো শেষ নেই। কখনো তোমার মার কাছে যাইনি। তোমার কবরের পাশে কখনো বসে থাকিনি। যে যায়গাটাতে তুমি লাশ হয়ে পড়েছিলে সেখানে মাঝে মাঝে ফুল দিতাম শুধু। ভাবতাম তাতে যদি আমাদের আশেপাশের মানুষরা মনে করে তোমার কথা।

মানুষের নিষ্ঠুরতা যেমন দেখেছি, আবার কত চমৎকার মানুষই না দেখেছি। তোমাকে কখনো দেখেনি, এমন মানুষও তো তোমার জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। কত বন্ধুই না পেয়েছি। তবু তোমার অভাব বোধ করি। দেশে গেলে। কিংবা প্রবাসে। ভাবি তোমার বাবা-মার কথা। ওনারা কি এখনো কাঁদেন? তোমার ভাইবোনেরা? তোমাকে নিয়ে তো ওদের তো অনেক স্বপ্ন ছিলো। আমাকে বা তোমার অন্য বন্ধুদের কথা ভাবলেই ওদের কি গা গুলিয়ে উঠে? ঠিক একটা পোকাকে কিলবিল করতে দেখলে যেমন মনে হয়।

নিজেকে নিজের কাছে বড় অপরাধী মনে হয়। ক্ষমা কোরনা আমাকে। কক্ষনো না।

পোস্টটি ১৪ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

রোবোট's picture


এই পোস্ট বছর খানেক আগে সামুতে পোস্ট করেছিলাম। এটি অমৌলিক পোস্ট। আমরা বনধু ব্লগের মডারেটররা ব্লগের নীতিমালার প্রতি শ্রদ্ধা জানায় এই পোস্ট মুছে দিতে পারেন।

মডারেটর's picture


আপনার এই পোস্টটি নীতিমালা ভঙ্গ করায় সরিয়ে দেয়া হলো। আমরা বুঝতে পারছি আপনি ডুয়্যাল পোস্টিং বিষয়ে আমরা বন্ধুর অবস্থান মেনে নিতে পারছেন না, বিষয়টিকে কেবল আমরা বন্ধুর দূর্বলতা হিসেবে দেখতে চাইছেন। কিন্তু আমরা বিষয়টিকে একজন লেখকের জন্য নতুন লেখা তৈরীর অনুপ্রেরণা হিসেবেই দেখতে পাই।

আমরা আশা করবো আপনিও অন্য সকল সদস্যের মতো নতুন লেখা লিখতে আগ্রহী হবেন।

ভাঙ্গা পেন্সিল's picture


এই লেখাটা আগে পড়ি নাই! বুয়েটে আমরা উত্তাল দিন বেশি একটা দেখি নাই...আপনার লেখাটা কি সত্যি ঘটনা?

রোবোট's picture


হুম্ম। ১৯৯৫ এর

মেহরাব শাহরিয়ার's picture


যদিও এই ক্যাম্পাসে পদার্পন সেই ঘটনার অনেক বছর পরে , বুয়েটের ছাত্র হিসেবে কেন যেন নিজেও অপরাধী হয়ে গেলাম ....

রোবোট's picture


হুম্ম

নুশেরা's picture


আরেকবার পড়লাম। যতদূর মনে পড়ে, প্রথমবার পড়ার পর মন্তব্য করতে পারিনি... আসলে কিছু্ই বলার থাকে না...
বন্ধুর আত্মার শান্তি কামনা করি...

রোবোট's picture


আমি এমনকি আমার সত্রীর সাথেও কখনো আহমেদকে নিয়ে আলাপ করিনি। আমার বুয়েট পরবর্তী অনেক বনধুই জানেনা এটা। সমস্যাটা আমার।

সামুতেও কমেন্টে লিখেছিলাম, "আমার পোস্টে খুব বেশী কমেন্ট আসেনা। এই পোস্টে কমেন্টের উত্তর দিতে না পারার কারণ কথা খুজে না পাওয়া। অন্য কিছু না। আশা করি কেউ কিছু মনে করবেন না।"

 

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

রোবোট's picture

নিজের সম্পর্কে

Self moderated blog - moderated under personal rules and preferences.

Thanks for coming to this page.